শুক্রবার, ২৪ অক্টোবর, ২০২৫
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ২৪ অক্টোবর ২০২৫, ১১:৫৭

কমরেড শাহজাহান তালুকদারের মৃত্যুতে শোকগাথা

হাসান আলী
কমরেড শাহজাহান তালুকদারের মৃত্যুতে শোকগাথা

মানুষের জীবনে কিছু সম্পর্ক থাকে যা কেবল মতাদর্শে নয়, হৃদয়ের গভীরে গঁাথা থাকে। আমার একসময়ের রাজনৈতিক সহকর্মী, বন্ধু, সহযোদ্ধা শাহজাহান তালুকদার ছিলেন তেমনই এক মানুষÑযার মৃত্যু আমাকে গভীর শোক ও শূন্যতায় ভরিয়ে দিয়েছে। তিনি ছিলেন হৃদয়ের মতো নির্মল, চিন্তায় যেমন দৃঢ় তেমনি কর্মে অনড়। আজ তিনি আর নেইÑহার্টের অসুখে মৃত্যুর পর যেন এক অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটলো, যা আমাদের যৌথ সংগ্রামী স্মৃতিকে চিরদিন মনে করিয়ে যাবে।

১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সালের সেই উত্তাল সময়টায় আমরা একই বামপন্থী রাজনৈতিক সংগঠনের পতাকাতলে কাজ করেছি। দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তখন নানা উথালপাথাল, দমন-পীড়ন, আন্দোলন ও স্বপ্নের দিনগুলো। শাহজাহান তালুকদার ছিলেন মাঠের মানুষÑদলের সিদ্ধান্তে, কৃষকের মিছিলে, শ্রমিকের দাবিতে, অন্যায়ের প্রতিবাদে সবসময় সামনের সারিতে। তঁার কণ্ঠে ছিলো প্রতিবাদের আগুন, কিন্তু হৃদয়ে ছিলো অসীম কোমলতা।

রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিলো অপূর্ব। বহুদিন তঁার বাসায় খেয়েছি, থেকেছি, আলোচনা করেছি, তর্ক করেছিÑতবুও সম্পর্কের উষ্ণতা কখনো নিভে যায়নি। তিনি বিতর্কে তীক্ষ্ণ ছিলেন, কিন্তু মননে উদার। বিরোধী মতকেও শ্রদ্ধা করতেন, কারণ তঁার বিশ্বাস ছিলো, “বাম রাজনীতি মানে মানুষের প্রতি ভালোবাসা, মতের প্রতি সম্মান।” এই মানবিক মূল্যবোধই তঁাকে আলাদা করে তুলেছিলো।

শাহজাহান তালুকদার ছিলেন একনিষ্ঠ সংগঠক। ভূমিহীন কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণির অধিকার আদায়ে তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন। চঁাদপুর জেলার মাঠেঘাটে, পাড়া-মহল্লায় তঁার পদচিহ্ন ছড়িয়ে আছে। কৃষকের ফসলের ন্যায্যমূল্য, শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি, নদীভাঙ্গন প্রতিরোধ আন্দোলন, ভূমিহীন কৃষকের অধিকার আদায়ে, নারীর সমান অধিকারের দাবিতে তিনি কখনো পিছপা হননি। আন্দোলনের দিনগুলোতে অনেক কষ্ট, অভাব, এমনকি নিপীড়নের মুখেও তিনি হাসিমুখে বলতেনÑ“জনগণের পাশে থাকলেই রাজনীতি সার্থক।”

শাজাহান তালুকদার নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন কয়েকবার। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ভোট পাননি বলে কোনো সময়ে তঁার মধ্যে কোনো হতাশা লক্ষ্য করিনি। তিনি বলতেন, নির্বাচনে শাসকের পরিবর্তন হয় জনগণের কোনো পরিবর্তন হয় না, জনগণের পরিবর্তন হবে বিপ্লবের মাধ্যমে এবং সেটা হতে হবে সঠিক বিপ্লবী দলের নেতৃত্বে।

এই চঁাদপুরে তিনি কারাবন্দী থাকলেও মুক্তির জন্যে কোনো আকুলতা তঁার মধ্যে দেখিনি।

ছোট দলের বড়ো নেতা বলে কেউ কেউ আমাদের টিপ্পনী কাটলে আমরা খুবই মন খারাপ করতাম, কিন্তু তিনি আমাদের সাহস যুগিয়ে বলতেন, সংখ্যায় বেশি হলেই রাজনীতি সঠিক হবে এমন কোনো কথা নয়। আমরা জনগণের সমর্থন পেয়ে একদিন সমাজ পরিবর্তনের নিয়ামক শক্তি হিসেবে দঁাড়িয়ে যাবো।

মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের চঁাদপুর জেলার সমন্বয়ক ছিলেন। বয়স ও অসুস্থতা সত্ত্বেও সংগঠনের কাজ তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে করে গেছেন। দলের তরুণ প্রজন্মের কাছে তিনি ছিলেন প্রেরণার প্রতীক। তঁার বাড়ি ছিলো সাধারণ কর্মীদের জন্যে উন্মুক্তÑযেখানে আলোচনা হতো দেশের ভবিষ্যৎ, সমাজতান্ত্রিক আদর্শ, শ্রমিক শ্রেণির মুক্তির পথ নিয়ে।

আজ যখন তিনি আমাদের মাঝে নেই, মনে পড়ে তঁার হাসিমুখ, তঁার ত্যাগ, তঁার অবিচল বিশ্বাসের কথা। আমাদের অনেকেই হয়তো ভিন্ন রাজনৈতিক পথে হেঁটেছি, কিন্তু তঁার মতো নির্লোভ, সৎ ও সংগ্রামী মানুষের অভাব আজ প্রবলভাবে অনুভব করছি। এমন সহযোদ্ধারা সমাজের মেরুদণ্ড হয়ে থাকেনÑতঁারা হারিয়ে যান না, তঁারা ছড়িয়ে যান স্মৃতি, কাজ ও আদর্শে।

শাহজাহান তালুকদার ছিলেন এক রাজনৈতিক সৈনিক, যিনি রাজনীতিকে কখনো পেশা নয়, বরং নৈতিক দায়িত্ব বলে মনে করতেন। তঁার মৃত্যু শুধু চঁাদপুর নয়, পুরো বাম আন্দোলনের জন্যে এক অপূরণীয় ক্ষতি।

সহযোদ্ধা শাহজাহান তালুকদার, আপনার সংগ্রামী জীবন আমাদের প্রেরণা হয়ে থাকবে। আপনার মতো সৎ ও নির্ভীক মানুষ যতদিন থাকবে স্মৃতিতে, ততদিন সমাজে আলোর পথ হারাবে না।

আপনার প্রতি স্যালুট, শ্রদ্ধা, সম্মান ও অশেষ ভালোবাসা।

আপনি বেঁচে থাকবেন আমাদের মনে, আমাদের লড়াইয়ে।

লেখক : কমরেড শাহজাহান তালুকদারের প্রাক্তন রাজনৈতিক সহকর্মী।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়