বৃহস্পতিবার, ২৮ আগস্ট, ২০২৫  |   ২৯ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জের শীর্ষ মাদক কারবারি কামরুল আটক
  •   ফরিদগঞ্জের শীর্ষ মাদক কারবারি কামরুল আটক
  •   ফরিদগঞ্জের শীর্ষ মাদক কারবারি কামরুল আটক

প্রকাশ : ২৮ আগস্ট ২০২৫, ০৮:৪৮

আলঝাইমার্স মোকাবিলায় পরিবারের ভূমিকা

হাসান আলী
আলঝাইমার্স মোকাবিলায় পরিবারের ভূমিকা

পরিবার হলো মানুষের সবচেয়ে মৌলিক সামাজিক প্রতিষ্ঠান, যেখানে রক্তের সম্পর্ক, বিবাহ বা দত্তক গ্রহণের মাধ্যমে গঠিত মানুষরা একত্রে বসবাস করে। পরিবারে সাধারণত বাবা-মা, স্বামী-স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, ভাই-বোন, দাদা-দাদি সহ নিকটাত্মীয়রা অন্তর্ভুক্ত থাকে। পরিবার শুধু একসঙ্গে বসবাসের জায়গা নয়, এটি ভালোবাসা, স্নেহ, মমতা, সেবা, যত্ন, দায়িত্ব-কর্তব্য, পারস্পরিক সহায়তা ও সামাজিক শিক্ষার কেন্দ্র।

মানব সভ্যতার আদিকাল থেকেই মানুষ একা একা টিকে থাকতে পারতো না।প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যপশু, খাদ্য সংকট ইত্যাদি মোকাবিলা করতে মানুষকে দলবদ্ধ ভাবে থাকতে হতো। সেই দলবদ্ধতা থেকে ধীরে ধীরে পরিবারের ধারণা জন্ম নেয়। মূলত পরিবার গড়ে উঠেছিল টিকে থাকা, ভালোবাসা, উত্তরাধিকার ও সামাজিক জীবনের ভিত্তি হিসেবে।

আলঝাইমার্স রোগীর পারিবারিক ভূমিকা নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা পাঠকের জন্যে নিচে তুলে ধরা হলো--

১. আবেগিক সহায়তা প্রদান : রোগীর মেজাজ, আচার- আচরণের পরিবর্তন আসতে পারে, যা পরিবারের জন্যে চ্যালেঞ্জিং হলেও ধৈর্য ও সহানুভূতির সাথে মোকাবিলা করা জরুরি।

রোগী যেন ভালোবাসা, নিরাপত্তা এবং আত্মমর্যাদা অনুভব করেন তা নিশ্চিত করা উচিত।

২.স্মৃতি উদ্দীপক কার্যকলাপে সহায়তা করা : পুরানো অ্যালবাম, পরিচিত গান, অতীতের দেখা সিনেমা, ছেলে-মেয়ে বা নিকটতমদের বিয়ে কিংবা জন্মদিনের ছবি দেখানো, প্রিয় স্মৃতি নিয়ে গল্প করা,

স্মৃতিচারণ রোগীর মানসিক স্বাস্থ্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

৩. নিয়মিত তত্ত্বাবধান ও নিরাপত্তা : রোগীকে সঠিক দিক নির্দেশনা দেওয়া, ভুলে যাওয়া প্রতিদিনের কাজগুলোতে সাহায্য করা। গ্যাসের চুলা, আগুন, ধারালো ছুরি-দা-কাঁচি, খোলা দরজা, টয়লেটের মতো নিরাপত্তা ঝুঁকি এড়াতে নজরদারি জোরদার করতে হবে।

৪. নিয়মিত চিকিৎসা ও ওষুধ ব্যবস্থাপনায় সহায়তা : নির্দিষ্ট সময়ে ওষুধ খাওয়ানো, ওষুধ খেতে না চাইলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ খাওয়াতে হবে। ওষুধ খাওয়ানোর ক্ষেত্রে জোরজবরদস্তি হিতে বিপরীত হতে পারে।

সবসময়ই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ফলোআপ করানো।

৫. দৈনন্দিন কাজে সহায়তা করা : যেমন পোশাক পরানো, দাঁত মাজতে সহযোগিতা, গোসল করানো, টয়লেট করানো, পরিমাণ মতো পানি পান করানো, সাবান দিয়ে হাত-পা পরিষ্কার করা, গায়ে তেল বা লোশান লাগানো, চুল আঁচড়ে দেয়া, জুতো পায়ে পরিয়ে দেয়া, খাবার মুখে তুলে দেওয়া, ছিপিওয়ালা প্লাস্টিকের বোতল সামনে রাখা, যাতে ছিপি খোলার কথা মনে করে। ছোটখাট সহজ কাজ সামনে রাখা, যাতে রোগী স্বেচ্ছায় কাজ করতে আগ্রহী হয়।

৬. যোগাযোগ বজায় রাখা ও সামাজিক সম্পৃক্ততা বাড়ানো : রোগীকে সামাজিক পরিবেশে রাখার চেষ্টা করা, যেন তারা বিচ্ছিন্ন না হয়ে পড়ে। পরিচিতদের সঙ্গে দেখা করানো বা সহজবোধ্য কথোপকথনে অংশগ্রহণ করানো।

৭. নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেয়া : দীর্ঘ সময় ধরে রোগীর সেবা-যত্ন করার মধ্য দিয়ে পরিবারের সদস্যদের মানসিক চাপ, হতাশা ও ক্লান্তি আসতে পারে। তাই প্রয়োজন মনে করলে কাউন্সেলিং বা সাপোর্ট গ্রুপে অংশ নিতে পারে।

৮. সচেতনতা বৃদ্ধি ও তথ্য সংগ্রহ : আলঝাইমার্স সম্পর্কে জানাশোনা বাড়ানো। রোগের ধাপ ও লক্ষণগুলো বোঝা এবং রোগীর প্রয়োজন অনুযায়ী প্রস্তুত থাকা। রোগীর পরিবর্তনগুলো ধারাবাহিকভাবে লিখে রাখা, যাতে পরিস্থিতি বোঝা সহজ হয়।

আলঝাইমার্স রোগীর যত্ন নেওয়া সহজ নয়, তবে পরিবারের ভালোবাসা, সহানুভূতি এবং ধৈর্যই হতে পারে রোগীকে স্বস্তিতে রাখার মূল চাবিকাঠি। পরিবারের সক্রিয় ভূমিকা রোগীর জীবন মানোন্নয়নে ব্যাপক সাহায্য করতে পারে।

রোগীর যত্নে দৈনন্দিন একটা গাইড লাইন থাকলে ভালো হয়। পাঠকের বিবেচনার জন্যে একটি নমুনা গাইড লাইন নিচে দেওয়া হলো--

ক. সকালে কোমলভাবে ডাকুন। হাসি মুখে হাল্কা স্পর্শে জাগিয়ে তুলুন। নাস্তা করানোর আগে দাঁত ব্রাশ করে মুখ ধুয়ে দিন। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা, প্রয়োজন হলে গোসল করিয়ে দেয়া, কাপড় চোপড় পাল্টানোতে সহযোগিতা করা। চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী ওষুধ খাওয়ানো। সহজ ও পুষ্টিকর নাস্তা যেমন খিচুড়ি, নরম ভাত, ডিম, স্যুপ, ফল দেওয়া যেতে পারে। হাল্কা ব্যায়াম, হাঁটাহাঁটি ও পরিচিত জায়গায় বেড়ানো।

খ. দুপুরের আগে স্মৃতি উদ্দীপক কাজ করানো যায়। পুরানো ছবি দেখা, পরিচিত গান শোনানো, ছোট ছোট গল্প বলা। ছোট ছোট কাজ করতে দেওয়া যেন সহজ কাজ করা ভুলে না যায়।

দুপুরে নরম এবং সহজে চিবানো যায় এমন খাবার দিন। নিয়ম করে পানি খেতে দিন, যেন পানিশূন্যতা না হয়। দুপুরের খাবারের পর বিশ্রাম কিংবা একটু খানিক ঘুম।

গ. বিকেলে হাল্কা নাস্তা হিসেবে বিস্কুট, কলা, চা বা দুধ দেওয়া যেতে পারে। সহজ খেলা বা সহজ কাজকর্ম করা, যেমন বল ঘোরানো, রং করা, ছবি আঁকা, হাত ধরে হাঁটাহাঁটি করা, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো। পরিচিত মুখ, হাসিমাখা মুখ, স্নেহ-মমতা, শ্রদ্ধা এগুলো রোগীর মানসিক স্বাস্থ্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

ঘ. রাতে সহজ কথাবার্তা বলুন। সারাদিন কী কী হলো বলুন এবং শুনুন। প্রতিদিন একই সময়ে খাবার দিন যাতে ভালো ঘুম হয়। চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী ওষুধ খাওয়ান। ঘুমানোর আগে পাজামা পরিয়ে দাঁত ব্রাশ করে দিন। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আরামদায়ক বিছানায় শুতে দিন।

রোগীর গায়ে হাল্কা স্পর্শ কিংবা জড়িয়ে আদর করতে পারেন।

নিচের কয়েকটি বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে--

- প্রতিদিন একই রুটিনে রাখুন।

- খুব সহজ ও বোধগম্য ভাষায় কথা বলুন। প্রশ্ন করে বিব্রত করবেন না। সবসময়ে নিজের পরিচয় বলুন।

- নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ধারালো ছুরি কাঁচি, আগুন, সিঁড়ি, টয়লেট থেকে নিরাপদ রাখুন।

- রাতে রুমে হাল্কা আলো জ্বালিয়ে রাখুন।

- মেজাজ হারিয়ে ফেললে ধৈর্য ধরুন কিংবা নিজেকে সরিয়ে অন্য কাউকে দিন।

-পরিবারের সদস্যদের সাথে আলাপ আলোচনা করে কাজ ভাগ করে দিন।

- পারস্পরিক সম্পর্ক বজায় রাখতে দোষ খুঁজে বের না করা।

- আঘাত বা ব্যথা পেলে বলতে নাও পারে।

- ঝাড়ফুঁক, কবিরাজি, হোমিওপ্যাথি, ইউনানি, তাবিজ তুমার, আধ্যাত্মিক উপায়ে চিকিৎসার চেষ্টা রোগীর জীবনকে আরো বেশি কষ্টের মধ্যে ফেলবে। মনে রাখতে হবে, এই রোগে আরোগ্য লাভ হবে না।

- সেবা যত্ন ও ওষুধপত্র সেবনের মধ্য দিয়ে অর্থবহ জীবন যাপনের সম্ভাবনা আছে।

- আপনজনরা হাত ধরে একটু সময় পাশে বসেন।

লেখক : প্রবীণ বিষয়ে লেখক, গবেষক ও সংগঠক।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়