প্রকাশ : ১৭ আগস্ট ২০২৫, ০৯:০৮
অপরাধের মাত্রা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে, আতঙ্কে সাধারণ মানুষ

দেশে হঠাৎ করে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে গেছে। অন্তর্বর্তী সরকার কেন জানি অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। অথচ এই সরকার দলীয় নয়। একটি সুন্দর বাসযোগ্য বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে শত শত মানুষ নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছে। অথচ সেই স্বপ্ন আজ দুঃস্বপ্নে রূপ নিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, নাগরিকদের বর্তমান আর্থ-সামাজিক অনিরাপত্তা পূর্ববর্তী সরকারের আমলের একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার অংশ।
সারাদেশের মতো চাঁদপুর জেলায়ও আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি হচ্ছে। পত্রিকায় চোখ রাখতেই অপমৃত্যুর সংবাদ ভেসে উঠে। এ যেন এখন নিত্যদিনের ঘটনা। মানুষ দিন দিন অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। সামান্য ঘটনায় একে অপরকে মেরে ফেলছে। সন্দেহজনক হলেই গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলছে। ২০২৪-এর ৫ আগস্টের পর পুলিশ প্রশাসন যেন অকার্যকর হয়ে পড়ছে। পুলিশের এমন ভূমিকায় অপরাধীরা সাহস পাচ্ছে দ্বিগুণ। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দেরও সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। সব মিলিয়ে দিনকে দিন আইনশৃঙ্খলা অবনতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। এতে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে নষ্ট হচ্ছে।
ফরিদগঞ্জের কথাই ধরি, জুলাই-আগস্ট মাসে অনেক অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, যে ঘটনাগুলো আমাদের ব্যতিব্যস্ত করে, লজ্জিত করে। মানুষ কেন জানি অস্থির হয়ে উঠছে। বিশ্বাস নেই, আস্থা নেই, ধৈর্য নেই, মানবিক অনুভূতি দিন দিন কমে যাচ্ছে, সামাজিক বন্ধন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ রকম অরাজকতা আগেও ছিলো। আবার মাঝে মাঝে কিছুটা সময় শান্তিও ছিলো। হঠাৎ হঠাৎ কেন জানি অস্থির হয়ে উঠে সমাজ, যেমন এখন আবার হচ্ছে। সামাজিক এই অবক্ষয় রোধে প্রশাসনের কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেই।
১১ আগস্ট উপজেলার ৪নং গুপ্টি ইউনিয়নের বড়গাঁও গ্রামে চাচার হাতে ভাতিজা খুন হয়েছে। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রকাশ্যে জবাই করে চাচা হাছান ভাতিজা বাহার হোসেন বাবু (২৪)কে হত্যা করে। এ ঘটনায় ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত হয় আরও ২ জন। আগস্ট মাসেই বাবার ক্রয় করা অটো কেন বিক্রি করা হলোÑছেলেদেরকে শাসানোর কারণে তিন সন্তান ও স্ত্রীসহ বাবা মনাকে (৬৫) হাত-পা বেঁধে শ্বাসরোধ করে হত্যার চেষ্টা করে।
আগস্ট মাসে ফরিদগঞ্জের আরেকটি ন্যাক্কারজনক ঘটনা হলোÑবিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ঢাকা থেকে এক নার্সকে ডেকে এনে তিনদিন বাসায় আটকিয়ে গণধর্ষণ করা। মাসখানেক আগে চাঁদপুরে মসজিদে ঢুকে খতিবকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে রক্তাক্ত জখম করা হয়। ফরিদগঞ্জে বাগান থেকে এক যুবকের মরদেহ উদ্ধার হয়। পরিবারের অভিযোগ, চুরির অপবাদ দিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
ঢাকায় ব্যবসায়ীকে প্রকাশ্যে রাস্তায় পাথর মেরে হত্যা। খুলনায় যুবদল নেতা হত্যা। চট্টগ্রামে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার। কুমিল্লায় ধর্ষণ, কুষ্টিয়ায় চালককে হত্যা করে অটোরিকশা ছিনতাই। চাঁদপুরে এক মেয়েকে মেরে বাথরুমে ফেলে রাখা। মতলবে গৃহবধূর লাশ সেপটিক ট্যাংক থেকে উদ্ধার। হাইমচরে মেঘনা নদী থেকে পুরুষের মরদেহ উদ্ধার। মতলব উত্তরে পুকুর থেকে অটোরিকশা চালকের মরদেহ উদ্ধার। শাহরাস্তির ঠাকুর বাজারে নৈশপ্রহরীকে বেঁধে ডাকাতি। বাবুরহাট ট্যাক্সি ক্যাব স্ট্যান্ডে চলছে চাঁদাবাজি। নোয়াখালিতে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে যাওয়া বিধবাকে গণধর্ষণ।
এছাড়া আত্মহত্যার ঘটনাতো রয়েছেই। চুরি-ডাকাতিও রয়েছেই। সব ঘটনা গণমাধ্যমে আসে না। কিছু ঘটনা আরেক ঘটনায় চাপা পড়ে যায়। এসব কিসের আলামত? সমাজ কোথায় যাচ্ছে? রাষ্ট্র কী করছে? যত্রতত্র চাঁদাবাজি, দখলবাজি, খুন, হত্যা, ধর্ষণ, মারামারি, চুরি, ডাকাতি চলছেই।
অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে বিশেষ কিছু অপরাধের মাত্রা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। মব সন্ত্রাসের মতো অপরাধ সরাসরি ভুক্তভোগী ছাড়াও আতঙ্কে ফেলেছে সাধারণ জনগণকে। মব সন্ত্রাস পরিস্থিতি পর্যালোচনায় হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত নয় মাসে মব সন্ত্রাস ঘটেছে ২০২টি। এসব ঘটনায় ১৩১ জন নিহত ও ১৬৫ জন আহত হয়েছে।
মানবাধিকার সাংস্কৃতিক ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে, গত জুনে দেশে অন্তত ৪১টি গণপিটুনির ঘটনায় ১০ জন নিহত হন এবং আহত হন ৪৭ জন। ডাকাতি, চুরি, খুন, ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, কটুক্তি, প্রতারণা ও অপহরণের অভিযোগ এনে গণপিটুনি দেওয়া হয়েছে তাদের।
বিভিন্ন অপরাধের এই মাত্রাতিরিক্ত বিস্তৃতি নিয়ে সরকারসহ নানা রাজনৈতিক দলের মধ্যে তেমন বিশেষ উদ্বেগ দেখা যায়নি, যতোটা দেখা গেছে সংবিধান সংস্কার ও নির্বাচনবিষয়ক ঐক্য নিয়ে। আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের বর্তমান সংঘাতময় অবস্থান নিয়ে নানা আলোচনা হচ্ছে।
জুন মাসে ‘ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড পিস’ প্রকাশিত বৈশ্বিক শান্তি সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৩তম, যেখানে গত বছর অবস্থান ছিল ৯৩তম (প্রথম আলো, ১৩ জুলাই ২০২৫)। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে কয়েক মাসের মধ্যে আমূল পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। যা সম্ভব, তা হলো এসব অপরাধ দমনে সদিচ্ছা, দৃশ্যমান প্রচেষ্টা ও উপযুক্ত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ।
লেখক পরিচিতি : সাধারণ সম্পাদক, ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাব।