বুধবার, ২৫ জুন, ২০২৫  |   ৩০ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ২৫ জুন ২০২৫, ০৯:১৯

বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে একাল-সেকালের গানগুলোর জনপ্রিয়তা ও স্থায়িত্ব

কবির হোসেন মিজি
বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে একাল-সেকালের গানগুলোর জনপ্রিয়তা ও স্থায়িত্ব

একটা সময় ছিলো যখন সন্ধ্যা নামতেই পাশের বাসা বা বাড়ি থেকে রেডিও অথবা ক্যাসেট প্লেয়ারে ভেসে আসতো--এই মন তোমাকে দিলাম...অথবা চিরদিনই তুমি যে আমার...। যে গানে মিশে থাকতো আবেগ, ভালোবাসা, বিচ্ছেদ কিংবা সাহসের গল্প। সেই পুরানো গানগুলোই এক সময়ে মানুষের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলো। তবে সময়ের আবর্তে সেই গান আজ অতীত স্মৃতি হয়ে গেছে। এখন যখন গান শুনি, তখন শব্দ থাকে, কিন্তু মনের সেই আবেগ কোথায় যেন হারিয়ে থাকে।

এই লেখায় আমরা ফিরে দেখবো বাংলা গানের সেই সোনালি সময়, ৮০ এবং ৯০-এর দশক। সেই সঙ্গে তুলনামূলক আলোচনা করবো ২০০৬-২০০৭ সালের পরবর্তী সময়ের গানের সঙ্গে। যেখানে জনপ্রিয়তা, স্থায়িত্ব আর শ্রোতার হৃদয় ছোঁয়ার জায়গা অনেকটাই বদলে গেছে। বাংলা গানের সবচেয়ে সমৃদ্ধ সময়গুলোর একটি ছিল ১৯৮০–৯০ দশক। এই সময়টা বাংলা চলচ্চিত্র ও আধুনিক বাংলা গানে এমন কিছু শিল্পী, গীতিকার ও সুরকার উঠে আসেন, যারা আজও কিংবদন্তি হয়ে আছেন। সেই সময়ের গান মানেই এক ধরনের আবেগ, কথা, সুর এবং কণ্ঠের মেলবন্ধন। গানগুলো শুধু গানই ছিলো না, ছিলো মানুষের জীবনের গল্পের মতো। যেমন বাংলা গানের কিংবদন্তি প্রয়াত এন্ড্রু কিশোর ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্র গানের রাজা। তাঁর কণ্ঠে ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’, ‘আমার সারাদেহ খেয়ো গো মাটি’, ‘সবাই তো ভালোবাসা চায়’, ‘কারে দেখাবো মনের দুঃখ গো’ গানগুলো আজও মানুষের মনকে নাড়া দিয়ে কাঁদায়। রুনা লায়লার ‘তুমি আমার জীবন, আমি তোমার জীবন’, ‘রাঙ্গামাটির পাহাড়ে’ সহ তাঁর গলায় যেন মধু ঝরে। সাবিনা ইয়াসমিনের ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’ সহ অন্য গানগুলো আজও গ্রামবাংলার হাওয়ায় বাজে। সৈয়দ আব্দুল হাদীর ‘একবার যদি কেউ ভালোবাসতো’, ‘চোখ বুঁজিলেই দুনিয়া আন্দার’, ‘মনের প্রেমে বাত্তি জ্বলে’ গানগুলো তাঁর আবেগঘন কণ্ঠে আজো চিরকালীন হয়ে আছে। এছাড়া কণ্ঠশিল্পী আবিদা সুলতানা, তপন চৌধুরী, মনির খান, খুরশিদ আলম, আব্দুল জব্বার-- এঁরা প্রত্যেকে গানের ভুবনে ইতিহাস গড়েছেন। তাঁদের কণ্ঠের জনপ্রিয় গানগুলো আজীবনই মানুষ শুনবে এবং শুনে যাচ্ছেন। সেই সময়ের গান মানুষ শুনতো ক্যাসেট কিনে টেপরের্কডারে, রেডিওতে অথবা টেলিভিশনে অপেক্ষা করে। গানগুলো মাসের পর মাস, এমনকি বছরের পর বছর মানুষের মনে গেঁথে থাকতো, আজো গেঁথে আছে। পরিবারের সবাই একসঙ্গে বসে গান শুনতো। গান হয়ে উঠেছিল পারিবারিক বিনোদনের মাধ্যম।

তখনকার সময়ে গান লিখতেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার, শেখ সাদী খান, আলাউদ্দীন আলী, প্রণব ঘোষ, সৈয়ম শামসুল হক, আনোয়ার পারভেজসহ আরো অনেকে। যাদের কলমে ও সুরে জন্ম নিতো অসাধারণ সব সৃষ্টি। কিন্তু ২০০৬-২০০৭ সালের পর থেকে বাংলাদেশের গানে একটা স্পষ্ট পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। নতুন ধরনের প্রজন্ম, ডিজিটাল প্রযুক্তির আগমন এবং ইউটিউবভিত্তিক রিলিজ প্রক্রিয়া গানের গতিপথ পাল্টে দেয়।

তখনকার গানে যেমন সুরের মুর্ছনা, আবেগ ছিলো, ছিলো মিউজিকেরও একটা দারুণ শ্রুতিমধুরতা। এখনকার গানে মিউজিক বেশি, ভয়েস কম, গান বোঝার চেয়ে মিউজিক আর বাদ্যযন্ত্রের বিটই বেশি শোনা যায়। তাই মানুষের মনে এসব গান দাগ কাটেনি, মনে আবেগ জন্মায়নি। ২০০৮-২০১০ সালের পরের গানগুলো যতো দ্রুত ভাইরাল হয়, আবার ততোটাই দ্রুত ভুলে যাওয়া যায়। দু-তিন মাসের জন্যে ‘হিট’ হয়ে উঠে কোনো গান, এরপর হারিয়ে যায় নতুন বিটের অন্য কোনো গানের ভিড়ে।

বর্তমান প্রজন্ম ইউটিউব, ফেসবুক, টিকটক, স্পটিফাই, অ্যাপসের মাধ্যমে গান শোনে। কিন্তু তারা গান শুনে ২০ সেকেন্ড অথবা ১ মিনিট। আবেগ বা গল্প ধরার আগেই প্লে করা গান স্কিপ করে দেয়। ফলে একটি গান শোনার ধৈর্য ও অভ্যাস হারিয়ে গেছে।

গানের আবেদন কেন বদলে গেলো?

এটা শুধু সময়ের পরিবর্তন নয়, এটা জীবনধারার পরিবর্তন। এখন জীবন অনেক গতিময়, অস্থির। গানেও সেই ছাপ। আগের মতো একজন শিল্পী ক্যারিয়ার ধরে রেখে ২০-৩০ বছর গাইতে পারছেন না। তরুণ শিল্পীরা বেশিরভাগই গান করছেন অল্প সময়ে বিখ্যাত হবার জন্যে, স্থায়িত্বের ভাবনা কম। ইউটিউব কিংবা টিকটকে জনপ্রিয়তা হয়ে উঠেছে মূল সূচক। কম বাজেট, বেশি কৌশল। সস্তা বাজেটে গান তৈরি হয়। লিরিক ও সুরের গভীরতা অনেক সময়ই অনুপস্থিত। একাধিক গানের মধ্যে মিল পাওয়া যায়, মৌলিকতা কমে যাচ্ছে।

তবে কি এখন ভালো গান হয় না?

অবশ্যই হয়। এখনো কিছু ভালো মানের শিল্পী আছেন। যেমন ইমরান, কাজী শুভ, এফ আই সুমন, পরশী, ঈশিতা, নোবেল, মেজবাহ, এলিটা করিম, শান, নেমেসিস, আর্টসেল বা হাবিব ওয়াহিদসহ উল্লেখযোগ্য কিছু শিল্পী অনেক ভালো গান করছেন, কাজ করছেন। কিন্তু গানগুলোর স্থায়িত্ব প্রশ্নবিদ্ধ। সেগুলো নিয়ে খুব কম সময় আলোচনা হয়।

পুরানো গানের প্রতি ভালোবাসা আজও অমলিন। আজও চাঁদপুরের কোনো গ্রামে, বা ঢাকার কোনো মধ্যবয়সী রিকশাওয়ালার স্মার্ট ফোনে রেডিও’র মতো শোনা যায়--আমার বুকের মধ্যিখানে মন যেখানে হৃদয় যেখানে... এই ভালোবাসা এত সহজে মুছে যায় না। পুরানো গান মানে স্মৃতির জানালা খুলে যাওয়া। পুরানো গান মানে প্রেমের চিঠির ভাঁজে লুকানো কষ্টের অক্ষর। মোট কথা সময় বদলালেও গান থাকবেই। এখন যুগ পাল্টেছে, নতুন প্রযুক্তি এসেছে, ধারা বদলেছে। তবু গান তার মূল আবেদন হারায়নি।

একালের গান যেখানে প্রযুক্তির আলোয় ঝলমলে, সেকালের গান সেখানে হৃদয়ের আলোয় উজ্জ্বল। নতুন প্রজন্মের দরকার পুরানো গান শোনা, বোঝা, শিখা। আর সুরকার, গীতিকারদের দরকার নতুন সময়ের মধ্যে থেকেও সেই আবেগ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা। কারণ গান শুধু বিনোদন নয়, গান আমাদের মনের খোরাক, আমাদের সংস্কৃতি, স্মৃতি আর আত্মার ভাষা। এই লেখার সূত্রে অনেকেই ফিরে যেতে পারেন পুরানো অ্যালবামগুলোর দিকে, হয়তো আবার শুনবেন এন্ড্রু কিশোরের কণ্ঠের ‘আমার সারাদেহ খেয়ো গো মাটি, ভালোবেসে গেলাম শুধু’, রুনা লায়লার ‘শিল্পী আমি তোমাদেরি গান শুনাবো’, কিংবা সুবীর নন্দীর ‘কতো যে তোমাকে বেসেছি ভালো’, সৈয়দ আব্দুল হাদীর ‘কি করে বলিবো আমি...’। তাতেই বাংলা গানের প্রতি আমাদের ভালোবাসা আবার নতুন করে জেগে উঠবে।

চাঁদপুর জেলা বিএনপির আয়োজনে বাংলা নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মনোমুগ্ধকর নৃত্য পরিবেশন করছেন রংধনু সাংস্কৃতিক সংগঠনের নৃত্য শিল্পীরা।

চাঁদপুর জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে জেলা প্রশাসনের আয়োজনে কাজী নজরুল ইসলামের ১২৬তম জন্মজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মনোজ্ঞ নৃত্য পরিবেশন করছেন শিল্পকলা একাডেমির শিল্পীরা।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়