শুক্রবার, ৩০ মে, ২০২৫  |   ২৭ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   ঢাকা থেকে উড্ডয়নের পরপরই তার্কিশ এয়ারলাইন্সের ইঞ্জিনে আগুন

প্রকাশ : ২৯ মে ২০২৫, ০৮:৫৯

কা’বার পথে পথে উপস্থিতির মোহনীয় সুর লাব্বাঈক

মুহাম্মদ আরিফ বিল্লাহ
কা’বার পথে পথে উপস্থিতির মোহনীয় সুর লাব্বাঈক

লাব্বাঈক আল্লাহুম্মা লাব্বাঈক, লাব্বাঈকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান্ নি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক্, লা শারিকা লাক্। মহান রবের দরবারে উপস্থিতি জানান দিতে এভাবেই বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন ভাষার, বিভিন্ন রঙ্গের, বিভিন্ন আকারের লক্ষ লক্ষ মানুষ সমবেত হচ্ছে পবিত্র মক্কায়। হে আল্লাহ ‘আমি উপস্থিত, আমি উপস্থিত’ এই ধ্বনি এখন মক্কার আকাশে-বাতাসে, অলিতে-গলিতে উচ্চারিত। ধনী গরিব সাদা কালো মোটা চিকন সকল পুরুষ একই সাদা পোশাকে মাথা খোলা রেখে খালি পায়ে নারীরা তাদের পরিহিত স্বাভাবিক পোশাক আর খালি পায়ে মহাপরাক্রমশালী প্রভুর দরবারে উপস্থিত। জীবনের যত অপরাধ ক্ষমা পাওয়ার এ এক মহা সুযোগ। এ সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য হাজীগণ পবিত্র কা’বার গিলাফ ধরে অশ্রুবন্যায় ভাসিয়ে দেয় বুক।

দোয়া কবুলের জায়গা খোঁজে বেড়ায় প্রতিটি মুমিনের হৃদয়। হাজরে আসওয়াদ এবং পবিত্র কা’বার দরজার মাঝখানে যার নাম মুলতাজিম; দোয়া কবুলের একটি জায়গা। রবের সন্তুষ্টি পাওয়ার আশায় প্রতিটি হাজীর আকুতি থাকে মুলতাজিমে গিয়ে দোয়া করার জন্য। রুকনে ইয়ামিন আরেকটি জায়গা, যে স্থান অতিক্রম করার সময় প্রিয় নবী (স.) দোয়া করতেন রাব্বানা আতিনা ফিদ-দুনইয়া হাসানাতাও ওয়া ফিল আখিরাতি হাসানাতাও ওয়া ক্বিনা আজাবান-নার।’ অর্থাৎ ‘হে আমাদের প্রভু! আমাদেরকে দুনিয়াতে কল্যাণ দান করুন। আর পরকালেও কল্যাণ দান করুন। আর আমাদেরকে (জাহান্নামের) আগুনের আজাব থেকে রক্ষা করুন।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ২০১)

হাতিমে কা’বায় নামাজ আদায় করা এবং দোয়া করা। হাতিমে কা’বা পবিত্র কা’বার একটি অংশ। যেখানে নামাজ আদায় করা এবং দোয়া করার সুযোগ লাভ করা মহান রবের বিশেষ নিয়ামত প্রাপ্তির অংশ। মাক্বামে ইবরাহিমে নামাজ আদায় করা। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পবিত্র কা’বার তাওয়াফ শেষ করে মাকামে ইবরাহীমে দুই রাকা’ত নামাজ আদায় করতেন। আরাফাতের ময়দানে দোয়া করা। মদীনায় মসজিদে নববীতে রিয়াজুল জান্নাতে দোয়া করা। একজন হজ্ব পালনকারীর জন্য মনের মাধুরি মিশিয়ে এই স্থানগুলোতে মহান রবের সন্তুষ্টির আশায় নিজেকে উজাড় করতে পারলে আশা করা যায় তিনি মহান রবের রহমতে আবৃত হবেন।

হজ্বের আমলের অন্যতম একটি সাফা মারওয়া পাহাড় সায়ী করা বা দৌঁড়ানো। সাফা পাহাড় থেকে সায়ী শুরু করে মারওয়া পাহাড়ে গিয়ে সপ্তম বার সায়ী শেষ হয়। আমি আমার অনুভূতি দিয়ে যেটুকু বুঝতে পেরেছি তাহলো, পানির সন্ধানে শিশু পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ.) কে তপ্ত বালুর উপর রেখে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে মা হাজেরা সাফা পাহাড় এবং মারওয়া পাহাড়ে দৌঁড়াচ্ছিলেন। এভাবে সপ্তমবার যখন মারওয়া পাহাড়ে উঠলেন, তখন মহান রব মা হাজেরার মনের আকুতিতে সন্তুষ্ট হয়ে রহমতের ঝর্ণা প্রবাহিত করে দিলেন জমজমের পানি। সপ্তমবার মারওয়া পাহাড়ে মা হাজেরাকে যেভাবে তাঁর প্রজন্মের জন্য মহান রবের অনুগ্রহের ফল্গুধারা প্রবাহিত হয়েছে তেমনি আমরাও যদি হজ্ব এবং উমরা পালনের সময় সেই অনুভূতি নিয়ে সাফা মারওয়া পাহাড় সায়ী করতে পারি, তবে আমাদের প্রজন্মের জন্যও আমাদের রব অনুগ্রহ দান করবেন ইনশাআল্লাহ।

পবিত্র হজ্বের আমলগুলো হযরত আদম (আ.), হযরত হাওয়া (আ.), হযরত ইবরাহীম (আ.), হযরত হাজেরা (আ.), হযরত ইসমাঈল (আ.) এর দোয়া, ত্যাগ, মহান রবের হুকুমের প্রতি আনুগত্যের চরম পরাকাষ্ঠার নমুনা। যে নমুনা উম্মতে মোহাম্মাদীর জন্য তাওহীদ, রিসালাত এবং আখিরাতে বিশ্বাসের এক উন্নততর শিক্ষা। যে শিক্ষার মাধ্যমে প্রতিটি মুমিন তথা বিশ্ব মানবতা ঐক্য, সংহতি, ধৈর্য, আতিথিয়েতা, ভ্রাতৃত্ববোধ, বিশ্বাসযোগ্যতা, বিশ্বযোগাযোগ, মানুষের অধিকার, সম্পদের সুষম ব্যবহার, প্রতিবেশির হক, পরিবারের হক, সমাজের হক, রাষ্ট্রের হক ইত্যাদির প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী হতে পারে। কারণ হযরত আদম (আ.), হযরত হাওয়া (আ.), হযরত ইবরাহীম (আ.), হযরত হাজেরা (আ.), হযরত ইসমাঈল (আ.)সহ সকল নবী-রাসুলদের মিশনের সফল পরিসমাপ্তি হয়েছে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স.) এর বিদায় হজ্বের ভাষণের মাধ্যমে। একজন মুমিন হিসেবে হজ্ব করতে গিয়ে আরাফাতের ময়দান থেকে বিদায় হজ্বের ভাষণের অনুভূতি অর্জন করতে পারাই পবিত্র হজ্ব পালনের অন্যতম সফলতা। যা একজন হাজী সাহেবের মাধ্যমে পৃথিবীর সকল সমাজ বাস্তবতায় প্রতিফলিত হতে পারে।

হজ্বের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রকৃত পক্ষে হজ্ব আর্থিক এবং শারিরীক উভয়ের সমন্বিত একটি ইবাদত। সুতরাং উভয় দিক থেকে সামর্থ্যবান মুসলিমের উপর হজ্ব আদায় করা ফরয। অর্থাৎ হজ্ব পালন করতে সক্ষম এমন ব্যক্তির সুস্থতার পাশাপাশি হজ্বে যাওয়া-আসার ব্যয় এবং হজ্ব আদায়কালীন সাংসারিক খরচ বহন করতে সক্ষম এমন সামর্থ্যবান ব্যক্তির উপর হজ্ব আদায় করা ফরয। হজ্ব প্রত্যেক সামর্থবান মুসলমানের উপর সারা জীবনে একবারই ফরয হয়। একবার ফরয হজ্ব আদায়ের পর পরবর্তী হজ্বগুলো নফল হিসেবে গণ্য করা হয়। এ সম্পর্কে হাদীস শরীফে আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, একদিন বিশ্বনবী (স.) আমাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন। তিনি বললেন- হে মানবসকল! আল্লাহ তাআলা তোমাদের উপর হজ্ব ফরয করেছেন। সুতরাং তোমরা হজ্ব করো। এক ব্যক্তি বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! প্রতি বছর কি হজ্ব করতে হবে? তিনি চুপ রইলেন এবং লোকটি এভাবে তিনবার জিজ্ঞেস করল। অতপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি যদি হ্যাঁ বলতাম, তাহলে তা (প্রতি বছর হজ্ব করা) ফরয হয়ে যেতো, কিন্তু তোমাদের পক্ষে তা করা সম্ভব হতো না।-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১৩৩৭ (৪১২); মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১০৬০৭; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ৩৭০৪; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস : ২৫০৮; সুনানে নাসায়ী ৫/১১০; শরহে মুশকিলুল আছার, হাদীস : ১৪৭২; সুনানে দারাকুতনী ২/২৮১

ইবনে আববাস (রা.) হতে বর্ণিত অনুরূপ হাদীসে আরো বলা হয়েছে, হজ্ব (ফরয) হল একবার, এরপরে যে অতিরিক্ত আদায় করবে তা নফল হিসেবে গণ্য।-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ২৩০৪; সুনানে দারিমী, হাদীস : ১৭৮৮; সুনানে নাসায়ী ৫/১১; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ১৭২১; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ২৮৮৬; মুসতাদরাকে হাকিম, হাদীস : ৩২০৯

হজ্ব যেহেতু একবারই ফরয তাই যার উপর হজ্ব ফরয হয়েছে সে যদি মৃত্যুর আগে যে কোনো বছর হজ্ব আদায় করে, তবে তার ফরয আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু হজ্ব বিধানের মৌলিক তাৎপর্য, তার যথার্থ দাবি ও আসল হুকুম হচ্ছে হজ্ব ফরয হওয়ার সাথে সাথে তা পালন করা। বিনা ওজরে দেরি না করা। কারণ ওজর ছাড়া দেরি করাও গুনাহ। আল্লাহ তাআলা ও তার রাসূল (স.) ফরয হজ্ব আদায়ের প্রতি এমনভাবে গুরুত্বারোপ করেছেন যে, কেউ যদি এই হজ্বকে অস্বীকার করে বা এ বিষয়ে কোনো ধরনের অবহেলা প্রদর্শন করে তবে সে আল্লাহর জিম্মা থেকে মুক্ত ও হতভাগ্যরূপে বিবেচিত হবে।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন- মানুষের মধ্যে যারা সেখানে (বায়তুল্লাহ) পৌঁছার সামর্থ্য রাখে তাদের উপর আল্লাহর উদ্দেশ্যে এ গৃহের হজ্ব করা ফরয। আর কেউ যদি অস্বীকার করে তাহলে তোমাদের জেনে রাখা উচিত যে, আল্লাহ তাআলা সৃষ্টিজগতের প্রতি মুখাপেক্ষী নন।-সূরা আলে ইমরান-আয়াত : ৯৭।

এছাড়া যে কোনো ধরনের বিপদ মুসিবত, অসুস্থতার সম্মুখীন হওয়া বা মৃত্যুর ডাক এসে যাওয়া তো অস্বাভাবিক নয়। তাই হজ্ব ফরয হওয়ার পর বিলম্ব করলে পরে সামর্থ্যহীন হয়ে পড়লে বা মৃত্যুবরণ করলে আল্লাহ তাআলার নিকট অপরাধী হিসেবেই তাকে উপস্থিত হতে হবে। এজন্যই হাদীস শরীফে হজ্ব ফরয হওয়ার পর কালবিলম্ব না করে দ্রুত আদায় করার প্রতি জোড় দেয়া হয়েছে। হজ্বের গুরুত্ব ও ফজিলত অনেক। হজ্ব পালনকারীর পূর্ববর্তী গুনাহ সমূহ ক্ষমা করে দেয়া হয়। আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-যে ব্যক্তি হজ্ব করে আর তাতে কোনোরূপ অশ্লীল ও অন্যায় আচরণ করে না তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।-সুনানে তিরমিযী, হাদীস : ৮১১

অন্য বর্ণনায় আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আমি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ্ব করল এবং অশ্লীল কথাবার্তা ও গুনাহ থেকে বিরত থাকল সে ঐ দিনের মতো নিষ্পাপ হয়ে হজ্ব থেকে ফিরে আসবে যেদিন মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ট হয়েছিল।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ১৫২১; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১৩৫০; মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ৭৩৮১; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ২৮৮১; সুনানে নাসায়ী ৫/১১৪

আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-এক উমরা আরেক উমরা পর্যন্ত মধ্যবর্তী সময়ের গুনাহের ক্ষতিপূরণ হয়ে যায়। আর হজ্বে মাবরূরের প্রতিদান তো জান্নাত ছাড়া আর কিছুই নয়।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ১৭৭৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১৩৪৯; মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ৭৩৫৪; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস : ২৫১৩; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ৩৬৯৫; সুনানে তিরমিযী, হাদীস : ৯৩৩; মহান আল্লাহ আমাদের হজ্বে মাবরূর আদায় করার তৌফিক দান করুন। আমিন।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়