প্রকাশ : ১৪ মে ২০২৫, ০৮:৩২
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ : ইতিহাসের রূপকথা

ভারত ও পাকিস্তান দুই পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী রাষ্ট্র, যাদের পারস্পরিক সম্পর্ক দীর্ঘকাল ধরে সংঘাতময়। ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগের পর থেকে এই দ্বন্দ্বের সূচনা ঘটে। প্রধান বিরোধপূর্ণ ইস্যু হলো কাশ্মীর, যার ওপর দুই রাষ্ট্রই দাবি করে। এই প্রবন্ধে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের ইতিহাস, কারণ, কৌশল এবং আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করা হবে।
১৯৪৭-৪৮ সালের যুদ্ধ
বিভাজনের প্রেক্ষাপটে প্রথম সংঘাত
কারণ : জম্মু ও কাশ্মীর ছিল একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য যার শাসক ছিলেন হিন্দু। পাকিস্তান চেয়েছিল কাশ্মীর তাদের সঙ্গে যুক্ত হোক, কিন্তু রাজা হরি সিং ভারতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।যুদ্ধের বিবরণ : পাকিস্তান সমর্থিত উপজাতীয়রা কাশ্মীরে আক্রমণ করে। ভারত সামরিক হস্তক্ষেপ করে। এ যুদ্ধ ১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় শেষ হয়।
ফলাফল : কাশ্মীর দুই ভাগে বিভক্ত হয়: পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীর (চড়ক) এবং ভারত-নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীর। প্রথমবার জাতিসংঘ কাশ্মীর ইস্যুতে হস্তক্ষেপ করে। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধ‘অপারেশন জিব্রালটার’ ও পূর্ণমাত্রার লড়াই কারণ : পাকিস্তান মনে করেছিল কাশ্মীরি জনগণের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে এবং তারা ভারতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে সহায়তা করবে। এই উদ্দেশ্যে ‘অপারেশন জিব্রালটার’ চালু করা হয়।
যুদ্ধের ধরণ : গোপন অনুপ্রবেশ এবং পরে পূর্ণ সামরিক যুদ্ধ। ভারত ও পাকিস্তান উভয়ই ব্যাপক ট্যাংক যুদ্ধ, বিমান হামলা এবং স্থল যুদ্ধ পরিচালনা করে।
ফলাফল : যুদ্ধ অমীমাংসিত অবস্থায় শেষ হয়। তাসখন্দ চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি হয়, যা তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যস্থতায় হয়।
১৯৭১ সালের যুদ্ধ
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও দক্ষিণ এশিয়ার মানচিত্র বদলপ্রেক্ষাপট : পূর্ব পাকিস্তানে ভাষা ও সাংস্কৃতিক দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলন। ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা শুরু হয়। ভারত ১ কোটি শরণার্থী আশ্রয় দেয়।
যুদ্ধের ধারা : ভারত মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা করে। ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতের বিভিন্ন বিমানঘাঁটিতে হামলা চালায়, ফলে যুদ্ধ শুরু হয়। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তান আত্মসমর্পণ করে।
ফলাফল : বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। ৯০,০০০ পাকিস্তানি সেনা বন্দী হয়। ভারতের কূটনৈতিক অবস্থান বিশ্বে শক্তিশালী হয়
১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধ
উচ্চপর্বতের লড়াই
প্রেক্ষাপট : পাকিস্তানি সেনা ও অনুপ্রবেশকারীরা কারগিল অঞ্চলে ভারতীয় পোস্ট দখল করে। ভারতে সরকারিকভাবে একে অনুপ্রবেশ বলে চিহ্নিত করে এবং পাল্টা অভিযান শুরু করে।বিশেষত্ব : যুদ্ধ উচ্চপর্বতের হওয়ায় পরিবহন ও সরবরাহ ছিল অত্যন্ত কঠিন। ভারত বিমান ও স্থল অভিযানের মাধ্যমে এলাকা পুনর্দখল করে।
ফলাফল : আন্তর্জাতিক সমর্থন ভারতের দিকে যায়। পাকিস্তান অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিকভাবে চাপে পড়ে। আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও পারমাণবিক ছায়া
১৯৯৮ সালে উভয় দেশ পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা করে, ফলে যুদ্ধের আশঙ্কা আরও বিপজ্জনক হয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় শান্তিপূর্ণ সমাধান চেয়েছে, তবে প্রকৃত সমাধান এখনো অধরা।
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুধু সীমান্ত সংক্রান্ত নয়; এটি ইতিহাস, পরিচয়, ধর্ম, রাজনীতি এবং ভূ-রাজনীতির একটি জটিল মিশ্রণ। প্রত্যেকটি যুদ্ধ দুই রাষ্ট্রের সমাজ, অর্থনীতি ও কূটনীতি পরিবর্তন করেছে। একবিংশ শতাব্দীতে দুই দেশের উচিত হবে যুদ্ধের পরিবর্তে কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার স্থায়ী সমাধান খোঁজা।
তথ্যসূত্র (নির্বাচিত)
UN Archives, Indian Ministry of Defence Reports
Kargil Review Committee Report
Stanley Wolpert, India and Pakistan: Continued Conflict