প্রকাশ : ১৪ মে ২০২৫, ০৮:৩০
বজ্রপাতে ঝরে যাওয়া জীবন

দেশে এক দিনে বজ্রপাতে ১৮ জনের মৃত্যুর খবর বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতোই। এক দিনে একক কারণে এত মৃত্যু নিশ্চয়ই উদ্বেগজনক। বজ্রপাতের এই বিপদ অবশ্য অনেক আগে থেকেই আমরা দেখে আসছি। প্রতি বছর বজ্রপাতে প্রায় ৩০০ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। বজ্রপাতে এত প্রাণহানির পরও মানুষ এখনও কেন সচেতন হচ্ছে না, সে এক বিস্ময়। বজ্রপাতে হঠাৎ মৃত্যু হয়ে যেতে পারে বটে, তবে এ সময় কিছু পদক্ষেপ ব্যক্তির সুরক্ষায় কাজ করতে পারে। পাশাপাশি মৃত্যুর হার কমাতে সরকারি পদক্ষেপও জরুরি। বজ্রপাতে যখন মৃত্যুর সংখ্যা কমছে না, তখন স্বাভাবিকভাবেই এই দুই বিষয় নিয়েই প্রশ্ন তোলার অবকাশ থেকে যায়।
মঙ্গলবার সমকালের প্রিন্ট সংস্করণে প্রকাশিত একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন ছিলÑবজ্রপাতে ঝরে গেল ১৮ প্রাণ। সেখানে দেখানো হয়েছেÑবজ্রপাতে মৃত্যু কমাতে সরকারি নানা উদ্যোগ আছে। একে দুর্যোগও ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু সরকার এ লক্ষ্যে কিছু ভুল প্রকল্প নিয়েছে। অন্যদিকে বড় গাছ কাটা বন্ধ না হওয়া এবং প্রয়োজনীয় সচেতনতা তৈরির চেষ্টা না থাকায় মৃত্যু রোধ হচ্ছে না। বজ্রসহ ঝড়বৃষ্টির পেছনে নদী শুকিয়ে যাওয়া, বায়ুদূষণ, জলাভূমি ভরাট হওয়া আর গাছ ধ্বংস হওয়ার প্রভাবও অনস্বীকার্য।
বিভিন্ন তথ্যে এটা স্পষ্ট, সারাবিশ্বে বজ্রপাতে যে সংখ্যায় মানুষ মারা যায়, তার এক-চতুর্থাংশই বাংলাদেশে। বজ্রপাতে প্রাণহানির শিকার অধিকাংশই মাঠে থাকা কৃষক। অনেকে বাড়ি ফেরার পথে এবং বাইরে গোসল করা কিংবা মাছ শিকারের সময়ও বজ্রপাতে মারা যান। তবে শহরের ভবনগুলোতে বজ্রপাত প্রতিরোধক দণ্ড থাকায় হতাহতের সংখ্যা কম।
বেসরকারি সংগঠন ডিজাস্টার ফোরামের হিসাবে, ২০১০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বজ্রপাতে প্রাণ গেছে ৩ হাজার ৮৭০ জনের। এত প্রাণহানি দেখেই হয়তো সরকার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। কিন্তু তার অধিকাংশই সে অর্থে কাজে আসেনি। ২০২৩ সালে এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে সমকালের একটি প্রতিবেদন ছিলÑমৃত্যু ঠেকানোর উদ্যোগ প্রকল্পেই ঘুরপাক। সরকার ২০১৬ সালে বজ্রপাতকে জাতীয় দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা দেয় এবং ওই বছরই বজ্রপাতে মৃত্যু প্রতিরোধে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সারাদেশে ১০ লাখ তালগাছের চারা এবং ৩৫ লাখ তালের আঁটি রোপণের উদ্যোগ গ্রহণ করে।
কিন্তু সম্পূর্ণ অপরিকল্পিত প্রকল্পটির অধীনে প্রায় শতকোটি টাকা গচ্চা যায়। দায়িত্বশীলরা একটা সময় পর এসে বলেছিলেন, তালগাছ বড় হতে ৩০-৪০ বছর সময় লাগে। সেজন্য প্রকল্পটি তাদের নিকট গ্রহণযোগ্য সমাধান নয়। এরপরও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে হাওরাঞ্চলের বজ্রপাতপ্রবণ ২৩ জেলায় বজ্রনিরোধক দণ্ডসহ বজ্রপাত-নিরোধক কংক্রিটের ছাউনি নির্মাণ করে কোনো প্রকার সমীক্ষা বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই। এমনকি ২০১৭ সালে বজ্রপাতের পূর্বাভাসের জন্য ৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের আট স্থানে স্থাপন করা হয় লাইটনিং ডিটেকটিভ সেন্সর- এলডিএস; যার মাধ্যমে ১৫ মিনিট আগেই সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষকে বজ্রপাতের তথ্য জানার কথা থাকলেও বাস্তবে তা কাজ করেনি। এরপর ২০২৩ সালে সরকার ‘হাই ইমপ্যাক্ট ওয়েদার অ্যাসেসমেন্ট’ একটি প্রযুক্তি চালু করার সময়ই এর কার্যকারিতা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলেছিলেন। সোমবারের ১৮ জনের মৃত্যু প্রমাণ করছে সরকারের প্রকল্পগুলো ‘সকলি গরল ভেল’।
বাকি রইল মানুষের সচেতনতা। বস্তুত বজ্রপাত থেকে সুরক্ষায় এটাই সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র। আকাশে যখন কালো মেঘ জমে মাঠে বা বাড়ির বাইরে থাকা মানুষের তখনই বাড়িতে বা নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়া উচিত। এপ্রিল থেকে মে মাসের মধ্যে বজ্রপাত বেশি হয়। এ সময়ে কেউ কৃষি কাজের জন্যও বাড়ির বাইরে গেলে জুতা পরে যাওয়া উচিত। জুতা না থাকলে ভূপৃষ্ঠ দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হওয়ার সময় তা শরীরে সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে। সেজন্য এ সময় জুতা ছাড়া যাওয়া যাবে না। বজ্রপাতের সময় উঁচু স্থান ও উঁচু গাছের নিচে আশ্রয় নেওয়া যাবে না। খোলা জায়গায় বা মাঠে থাকলে মাটির সঙ্গে যেন স্পর্শ কম হয়, এমনভাবে দুই হাত দিয়ে কান চেপে ধরে রাখতে হবে। এ সময় পানিতে থাকলে দ্রুত উঠে যেতে হবে।
বজ্রপাতে মৃত্যুর মিছিল থামাতে এই সচেতনতার কাজটাই আগে করা জরুরি। তাছাড়া প্রকৃতিবিনাশী সব কর্মকাণ্ড থামাতে হবে। আমাদের পরিবেশবিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রতিশোধ শেষ বিচারে যে কতভাবে হতে পারে, বজ্রপাতে মৃত্যু তার অন্যতম উদাহরণ।