প্রকাশ : ১৫ মার্চ ২০২৫, ১৫:০৭
বার্ধক্যে হত্যা, আত্মহত্যা ও সহজ মৃত্যু

হত্যা মানে জীবন নাশ করা। হত্যা সাধারণত চার ধরনের হয়ে থাকে, যথা পরিকল্পিত হত্যা, অপরিকল্পিত হত্যা, অবহেলাজনিত হত্যা, আত্মরক্ষার্থে হত্যা। এক বা একাধিক ব্যক্তি পূর্বপরিকল্পনা করে যে হত্যাকাণ্ড চালায় তা পরিকল্পিত হত্যা। অপরিকল্পিত হত্যা হলো, হত্যার পরিকল্পনা ছিলো না, কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। কার্যকর সতর্কতা অবলম্বন করলে মৃত্যু এড়ানো যেতো এমন ঘটনাকে অবহেলাজনিত হত্যা বলা যায়। নিজের জান-জীবন, সহায়-সম্পদ রক্ষার্থে কাউকে হত্যা করলে তা আত্মরক্ষার্থে হত্যা বলে বিবেচিত হবে।
প্রবীণরা কম-বেশি হত্যার ঝুঁকিতে থাকেন। বিশেষ করে পরিবারের নিকটতম সদস্য, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, গৃহকর্মী, কেয়ারটেকার, কেয়ারগিভার, গাড়ি চালক, দারোয়ান, ডাকাত, ছিনতাইকারীর হাতে নিহত হবার খবর আমরা প্রায়ই শুনতে পাই। সন্তানের হাতে বৃদ্ধ বাবা-মায়ের নিহত হবার সংবাদ আমাদের দারুণভাবে পীড়িত করে। সহায়-সম্পদসম্পন্ন প্রবীণরা যেমনি নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকেন, তেমনি সহায়-সম্বলহীন প্রবীণরাও নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকেন। প্রতি বছর কত প্রবীণ হত্যাকাণ্ডের শিকার হন তা আলাদা করে জানতে পারলাম না। প্রবীণকে হত্যার হাত থেকে রক্ষা করতে আমাদের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। প্রত্যেক এলাকায়, পাড়া- মহল্লায়, গ্রামে-গঞ্জে, ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন পর্যায়ে হত্যার ঝুঁকিতে থাকা প্রবীণদের তালিকা তৈরি করতে হবে। ওয়ার্ড কমিশনার, ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার, এনজিওরা নিজ এলাকার ঝুঁকিপূর্ণ প্রবীণদের তালিকা তৈরি করে নিকটস্থ থানায় রাখলে স্থানীয় প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তদারকির মাধ্যমে হত্যার ঝুঁকি কমিয়ে আনতে পারবে।
মানুষ হত্যা সবচাইতে ঘৃণিত কাজ জেনেও স্বার্থ হাসিল, আধিপত্য বজায় রাখতে মানুষ হত্যা করতে খুনিদের বুকে কঁাপন ধরে না। আইনের কঠোর প্রয়োগ ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে সামাজিক নিরাপত্তা বাড়িয়ে তুলতে হবে।
আত্মহত্যা হলো নিজেকে প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে হত্যা করা। সাধারণত বিষপান, গলায় ফঁাস, আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি, পানিতে ঝঁাপ দিয়ে পড়া, ট্রেন কিংবা গাড়ির নিচে লাফ দেয়া, উঁচু জায়গায় থেকে ঝঁাপিয়ে পড়ে, ঘুমের ওষুধ খেয়ে ইত্যাদির মাধ্যমে মৃত্যু ঘটায়। আত্মহত্যা দু ধরনের। একটি হলো পরিকল্পনা করে, আরেকটি হলো হঠাৎ করে ঝেঁাকের মাথায়। প্রবীণদের মধ্যে নারীর চাইতে পুরুষ বেশি আত্মহত্যা করে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সারা পৃথিবীতে যেসব কারণে মানুষের মৃত্যু ঘটে তার মধ্যে আত্মহত্যা ত্রয়োদশতম কারণ। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব সুইসাইড প্রিভেনশনের তথ্য মতে, বিশ্বজুড়ে বছরে সাত লাখের বেশি মানুষ আত্মহত্যা করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সামরিক প্রবীণদের আত্মহত্যার হার বেসামরিক প্রবীণদের চাইতে বেশি। ১৯৫৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আত্মহত্যা প্রতিরোধ কেন্দ্র খোলার মাধ্যমে প্রবীণদের আত্মহত্যা প্রতিরোধের ওপর জোর দেয়া শুরু হয়।
বাংলাদেশের ঝিনাইদহ, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, মেহেরপুরে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। একজন প্রবীণ যখন মনমরা, নিরানন্দ, অমনোযোগী, খিটখিটে মেজাজ, খাবার আর ঘুমের পরিবর্তন, কথায় কথায় নিজেকে অপরাধী দোষী কিংবা পুরানো কথা বলে কঁাদতে থাকে, তখন বুঝতে হবে ব্যক্তিটি বিষণ্নতায় ভুগছেন।
ব্যক্তিত্বের সমস্যা, মানসিক চাপ, হতাশা, অবসাদ, অপমান, ঋণগ্রস্ততা, হেনস্তার শিকার হয়ে কেউ কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। আমাদের পরিবারে কিংবা আশপাশে প্রবীণদের মধ্যে এমন আচরণ দেখতে পেলে তাকে কিছুটা সময় দিন। বুঝতে চেষ্টা করুন সমস্যা কতোটা গভীর। চেষ্টা করতে হবে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞকে দেখানো কিংবা কাউন্সেলিং করানো। সবচেয়ে ভালো হয় একজন প্রবীণকে বছরে অন্তত একবার মানসিক রোগের চিকিৎসক দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে নেয়া। সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় করতে পারলে প্রিয় প্রবীণদেরকে আত্মহত্যার হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে।
সহজ মৃত্যু বা ইউথেনেশিয়া হলো কোনো ব্যক্তির ইচ্ছাকৃত ভাবে যন্ত্রণাহীন মৃত্যু। জীবনের প্রতি মানুষের মায়া অপরিসীম। জীবনকে ভালো বাসে বলেই এতো দুঃখ-কষ্ট, সংগ্রামের মধ্যেও মানুষ বেঁচে থাকে। বেঁচে থাকার অধিকারকে পৃথিবীর সব রাষ্ট্রই আইনী সুরক্ষা দেয়। সম্মানজনক মৃত্যু জীবনের অধিকার হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করাকে ধর্মীয়ভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। তিনটি বিশেষ পরিস্থিতিতে সহজ মৃত্যুর বিষয়টি বিবেচনা করতে হয়, যথা-স্বেচ্ছাকৃত, অনিচ্ছাকৃত এবং বাধ্য হয়ে মৃত্যু। যখন ব্যক্তি অনিরাময়যোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে যন্ত্রণাদায়ক জীবনের অবসান চান, তখন সেটা হবে স্বেচ্ছাকৃত মৃত্যু। অনিচ্ছাকৃত মৃত্যু হলো দীর্ঘ ব্যয়বহুল চিকিৎসা খরচ চালাতে অক্ষম এবং রোগমুক্তি পাবার সম্ভাবনা কম থাকলে সহজ মৃত্যুর ইচ্ছা পোষণ করা। বাধ্য হয়ে মৃত্যু হলো নিরাময়হীন, যন্ত্রণাদায়ক জীবনের অবসানের জন্যে পরিবারের সদস্যদের আবেদনে মৃত্যুর ব্যবস্থা করা। রোগীর সীমাহীন ভোগান্তি দেখার ধৈর্য হারিয়ে পরিচর্যাকারী, স্বাস্থ্য কর্মী, চিকিৎসক এবং আত্মীয় স্বজনরা সহজ মৃত্যুর জন্যে আইনী কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করতে দেখা যায়। সহজ মৃত্যু সাধারণত দুই রকমের হয়ে থাকে। পরোক্ষ মৃত্যু এবং প্রত্যক্ষ মৃত্যু। প্রত্যক্ষ মৃত্যু হলো বিষাক্ত ইনজেকশন বা কড়া ঘুমের ওষুধ দিয়ে। পরোক্ষ মৃত্যু হলো অক্সিজেন, ওষুধ এবং খাবার বন্ধ করে দিয়ে।
অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ‘মৃত্যুর ‘ যন্ত্রণা লাঘবে মরফিনের ব্যবহার শুরু হয়। ১৯৩৬ সালে রাজা পঞ্চম জর্জকে তার মৃত্যু ত্বরান্বিত করার জন্যে মরফিন এবং কোকেনের একটি মারাত্মক ডোজ দিয়ে হত্যা করা হয়, যা পঞ্চাশ বছর পর জানাজানি হয়। কানাডায় প্রতি বিশটি মৃত্যুর মধ্যে একটি হলো স্বেচ্ছা মৃত্যু। সুইজারল্যান্ডে ইতোমধ্যে সহজ মৃত্যুর পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।
নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম, স্পেন, অস্ট্রিয়া, আমেরিকার ৬টি প্রদেশ, কানাডা, কলম্বিয়া, সুইজারল্যান্ড শর্ত সাপেক্ষে স্বেচ্ছায় সহজ মৃত্যুর অধিকার দিয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সাবেক প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের নেতৃত্বে ৯ মার্চ ২০১৮ সালে সুপ্রিম কোর্ট পরোক্ষ মৃত্যু সহজ মৃত্যুকে বৈধতা দিয়েছে। বাংলাদেশে ২০১৭ সালে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে একজন ফল বিক্রেতা ‘ ডুচেন মাসকুলার ডিস্ট্রোফি (ডিএসডি) নামক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত দুই সন্তান এবং এক নাতির সহজ মৃত্যুর আবেদন করেছিলেন। কিন্তু আদালত শেষ পর্যন্ত রাজি হয়নি।
হাসান আলী : প্রবীণ বিষয়ে গবেষক, লেখক ও কথক; প্রবীণ বিষয়ে বহু গ্রন্থ প্রণেতা।