সোমবার, ১০ মার্চ, ২০২৫  |   ৩২ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ১০ মার্চ ২০২৫, ০৯:৪১

কে হবে আগামী বাংলাদেশের ‘মাস্টার মাইন্ড’

মইনুদ্দিন লিটন
কে হবে আগামী বাংলাদেশের ‘মাস্টার মাইন্ড’

আমরা যখন যা করি তার পূর্বে কোনো না কোনোভাবে একটা পরিকল্পনা থাকে। এটাকে বলে কর্ম পরিকল্পনা। আর পরিকল্পনার পেছনে যিনি মুখ্য ভূমিকা রাখেন তাকেই ‘ব্রেইন চাইল্ড’ বা ‘মাস্টার মাইন্ড’ বলা হয়। প্রতিটা খুনের জন্যে যেমন পরিকল্পনা করা হয়, তেমনি খুনের পেছনেও থাকে ‘মাস্টার মাইন্ড’। হয়তো ভাবছেন রাগের মাথায় খুন করে ফেললো, কোনো পূর্বপরিকল্পনা ছিলো না। ব্যাপারটা হঠাৎই ঘটেছে। এক্ষেত্রে বিচারিক ধারা বদলে যায়। শাস্তিটাও অন্য রকম হয়। কিন্তু আমার মনে হয়, সব কিছুরই একটা পূর্ব পরিকল্পনা থাকে, এমনকি প্রতিটি খুনেরও। আর এই পরিকল্পনার কাজটা যিনি করেন সবসময়, তিনিই করেন এমনটা না ও হতে পারে। কিন্তু পরিকল্পনা সম্পাদনকারীর কাজটা করার জন্যে যথেষ্ট যৌক্তিক সর্মথন থাকতেই হয়। না হয় ঐ কাজটাই সম্পাদন হয় না।

১৯৪৬ সালে কলকাতায় ‘দ্যা গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ বা কলকাতার ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়। সেই দাঙ্গার ‘মাস্টার মাইন্ড’ কে ছিল? কেন তা জানা গেল না? কী কারণে তা ইতিহাস থেকে গোপন করে ফেলা হলো? জানা যায়, ঐ দাঙ্গায় মাত্র ৭২ ঘণ্টায় চার থেকে পাঁচ হাজার মানুষ খুন হয়। তার পরপরই ঐ বছরের অক্টোবর মাসের দশ তারিখে নোয়াখালীতে সেই দাঙ্গার গরম আঁচ এসে লেগেছিল। তখন নোয়াখালীতেও প্রায় চার সপ্তাহ ধরে এই দাঙ্গা চলেছিল। সেই বছরে ৬ নভেম্বর গান্ধী নোয়াখালীতে আসেন। তিনি এখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থামাতে শান্তি মিশন নিয়ে আসেন। তিনি ঢাকা থেকে ট্রেনে করে তৃতীয় শ্রেণির টিকিট কেটে নোয়াখালী চৌমুহনী রেল স্টেশনে নেমেছিলেন। এই ফাঁকে বলে রাখি, আমি কিন্তু ইতিহাস গবেষক নই। আমাদের চাঁদপুরে তো আবার অনেক ইতিহাস গবেষক আছেন। আমি তাদের লেখা পড়েছি। সরাসরি বললে ওগুলো টুথপেস্ট নাকি কপি-পেস্ট সেটা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। একবার এক ইতিহাস গবেষক তো ইয়া মোটা একটা বই লিখে ফেললেন। কী যেন নামটা, মনে নেই। সেখানে তিনি চাঁদপুরে চা-শ্রমিক বিদ্রোহ নিয়ে লিখতে গিয়ে তাবৎ দুনিয়া ঘুরে এলেন। এ নিয়ে ঢাকা শিল্পকলা মঞ্চে নাটক হয়েছে ‘মুল্লুকে চলো’, তা নিয়েও লিখলেন। চা-শ্রমিক বিদ্রোহ নিয়ে চাঁদপুরেও নাটক হয়েছিল। তিনি নিজেও দেখেছিলেন। কিন্তু তার ইতিহাস গবেষণায় চাঁদপুরের নাটকটির কথা একদমই বললেন না। কারণ ঐ নাটকটি আমি লিখেছিলাম, পরিচালনাও আমি করেছিলাম। তিনি কেন আমার নাটকের কথা তার গবেষণায় লিখলেন না? এর পিছনেও কি কোনো ‘মাস্টার মাইন্ড’ আছে? নাকি তিনি কোনো কারণে আমার উপরে মাইন্ড করেছিলেন তা আমি জানি না। কী করে জানবো? আমি তো আর অন্তর্যামী নই। সে যাই হোক, ফিরে আসি গান্ধীর কাছে।

কলকাতা থেকে গান্ধীর সাথে আরো যারা এসেছিলেন তাদের মধ্যে গান্ধীর ছাগলও ছিল। কারণ গান্ধী সব সময় ছাগলের দুধ খেতেন। তাই তিনি যেখানে যেতেন, সাথে ছাগলেরাও তার সাথে যেতো। তবে গান্ধীর ইউরোপে ভ্রমণকালে ছালগও সফর সঙ্গী হতো কিনা আমার জানা নেই। সে যাই হোক, এখানে এসে তিনি একশ’ ষাট মাইল পায়ে হেঁটে একশ’ সাতচল্লিশটি গ্রাম পরিদর্শন করেন। ঐ সকল গ্রাম ঘুরে ঘুরে তিনি স্থানীয় হিন্দু ও মুসলমানদের সাথে বৈঠক করেছিলেন। তবে ইতিহাসে জানা যায়, গান্ধী নোয়াখালীতে এসে কেবল হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের সাথেই বৈঠক বা সভা করছিলেন। এতে করে সেখানকার মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ ক্ষুব্ধ হয়। তাদের বিশ্বাসের জায়গায় আঘাত লাগে। তারা ভাবলেন, গান্ধী এলেন এবং তিনি এখানে দাঙ্গা থামাতে শান্তি মিশন নিয়ে এলেন। কিন্তু তিনি কেবল একটি সম্প্রদায় বা হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের সাথেই আলোচনায় বসছেন, মুসলমানদের সাথে বসছেন না! এবং এরই পরিপ্রেক্ষিতে তারা ক্ষুব্ধ হয়ে গান্ধীর ছাগল চুরি করে খেয়ে ফেলেছিল। অবশেষে নোয়াখালীর চাটখিলে গান্ধী স্থানীয় মুসলমান সম্প্রদায়ের সাথে বৈঠকে বসেছিলেন। তবে গান্ধীর ছাগল চুরির ব্যাপারে কাশেম ফৌজের নাম শোনা গেলেও আসল ‘মাস্টার মাইন্ড’ কে তা খুব সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে এটা জানা যায়, গান্ধী নোয়াখালীতে প্রায় চার মাস ছিলেন এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থামাতে অনেক চেষ্টা করেছিলেন। তবে গান্ধীর সেই শান্তি মিশন সফল হয়েছিল এমনটা বলা যায় না। জেনেছি এখানকার দাঙ্গা শেষ হতে না হতে ১৯৪৭ সালে ভারতের বিহারে দাঙ্গা শুরু হয়। ঐ দাঙ্গায় অনেক মুসলমান খুন হতে থাকে। তখন মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ গান্ধীকে বিহারে যেতে অনুরোধ করেন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, গান্ধী ১৯৪৭ সালের ২ মার্চ নোয়াখালী থেকে বিহারের উদ্দেশ্যে চলে গিয়েছিলেন। পেছনে পড়ে ছিল উত্তপ্ত নোয়াখালীতে গান্ধীর ব্যর্থ শান্তি মিশন!

১৯৯৫ সালে ল্যাটিন আমেরিকাতে ‘কিউপাক্যাব্রা’ নামে একটি ভেম্পায়ারের সোশ্যাল রিপোর্ট পাওয়া যায়। ‘কিউপাক্যাব্রা’ শব্দটি স্প্যানিশ ভাষা থেকে এসেছে। স্প্যানিশ ভাষায় ‘কিউপা’ অর্থ ‘শুষে নেয়া’। আর ‘ক্যাব্রা’ শব্দের অর্থ হলো ‘ছাগল’। এই দুটো শব্দ একত্র করলে হয় ‘কিউপাক্যাব্রা’। অর্থাৎ ‘রক্তচোষা ছাগল’ অথবা ‘ছাগলের রক্তচোষা’। রিপোর্টে জানা যায়, এই অদ্ভুত শ্রেণির প্রাণীটি সেখানকার গবাদি পশুদের আক্রমণ করে মেরে ফেলতো। এ নিয়ে সে বছরেই হলিউডে ‘স্পেসিস’ নামের একটি হরর ফিল্ম হয়েছিল। যেই ছবিতে আমেরিকা এবং উত্তর আমেরিকাতে এরকম একটি ভয়ঙ্কর দানব দেখানো হয়েছে। আয়ারল্যান্ডের লোকো কাহিনীতেও বিলুপ্তপ্রায় ‘বিলবেরি’ গোট বা ছাগলের উপাখ্যানের অনেক রহস্যময় কথা আছে। আধুনিককালে অর্থাৎ ১৯৬০ সালে রহস্যময় ‘গোট ম্যান’ বা ‘ছাগল-মানব’ সম্পর্কে কিছু ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু সে খবর প্রথম পত্রিকায় আসে দশ বছর পরে, ১৯৭০ সালে স্থানীয় ‘কান্ট্রি নিউজ’ নামের পত্রিকায়। এ নিয়ে জন হেইডেন ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ পত্রিকায় তার লেখা আর্টিকেল ছাপাবার পরে ‘গোট ম্যান’ বা ‘ছাগল-মানব’ নিয়ে মিডিয়াতে বেশ তোলপাড় শুরু হয়েছিল। প্রাচীন মিশরে ছাগলকে ‘শয়তান’ হিসেবে পূজা করা হতো। আমরা ইতিহাসে জেনেছি, একসময় মুসা নবীর জাতি তার উপরে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিল। তারা নিষেধাজ্ঞার পরেও স্বর্ণের তৈরি ছাগলের পূজা করেছিল। সেই জন্য ঐ জাতি অভিশপ্তও হয়েছিল।

ছাগল নিয়ে আমার এতো কথা কচলানোর একটা রহস্য আছে। আমি দেখেছি মানুষের ইতিহাসে ‘ছাগল’ নানা সময়ে নানান প্রেক্ষাপটে একদম লেপটে জড়িয়ে থাকে। আমিতো দেখেছি, কোনো যৌক্তিক বাহাসের সময় কোনো কূল না পেয়ে অনেকেই মন্তব্য করে ফেলেন, ‘’পাগলে কিনা বলে, ছাগলে কিনা খায়”। অনেকে তো ক্ষুব্ধ হয়ে চটে গিয়ে বলেই ফেলেন,“তুই একটা ছাগল”। এসব গালাগালি আর ফালাফালিতে আমরা ছাগলকে যত অবজ্ঞাই করি না কেন, বাংলাদেশের রাজনীতির মাস্টার মাইন্ডে ছাগলের ভূমিকা কোনোদিনও কমলো না। সেই ১৯৪৬ সালে গান্ধীর ছাগল কাণ্ড থেকে আজ অবধি ছাগল কাণ্ড চলছেই।

এইতো গতকাল রাতে চায়ের আড্ডায় স্নেহের ইখতিয়াউদ্দিন শিশুর মুখে কোরবানির ঈদে ওর আর মাকসুদুল ইসলাম রতন খানের ছাগল কেনার কাণ্ড শুনে আবার হাসলাম। কোরবানির হাটে ছাগল উঠেছে। অনেক দরাদরির পরে ছাগলের দাম সাব্যস্ত হলো ৯ হাজার টাকা। কিন্তু ছাগল নিয়ে আসতেই বিক্রেতার বউ ফোন করে জানতেই স্বামীর উপরে ভীষণ খেপে একদম মাই-ফায়ার। বউ এই বিক্রিতে রাজি না। স্বামী বলছে ‘আমি তো বিক্রি কইরা ফেলাইছি’। ফোনের অপর প্রান্তে বউয়ের চিৎকার,‘ছাগল পাললাম আমি, গোসল করাইলাম আমি, কাঁঠাল পাতা খাওয়াইলাম আমি। আর তুমি কেমনে সেই ছাগল ৯ হাজারে ছাইড়া দেও? আমি ছাগল বেচুম না।’ হায় হায়! ‘মাস্টার মাইন্ড’ কী কয়, রাত পোহালেই তো ঈদ!!!

হ্যাঁ.. রাত পোহালেই কতকিছু ঘটে যেতে দেখলাম। কখনো সেই ‘কিউপাক্যাব্রা’ ভেম্পায়ারের মতো। কখনো রহস্যময় ‘গোট ম্যান’ বা ‘ছাগল-মানব’- এর মতো। কখনো ব্যর্থ শান্তি মিশনে খুন হওয়া গান্ধীর ছাগল। কখনোবা তার চাইতেও ভয়ংকর এক দানবের মতো মতিউরের ছাগল কাণ্ড থেকে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পলায়ন। সে বছর কোরবানির ঈদে সাদেক অ্যাগ্রো ফার্ম থেকে ১৫ লাখ টাকার ছাগল কিনতে গিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মতিউর রহমান নামের এক কর্মকর্তার ২৫ বছরের মুশফিকুর রহমান ইফাদ নামের ছাগলটা যে কাণ্ডটা ঘটালো তার সূত্র ধরে একের পর এক দুর্নীতির খবর প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। এক পর্যায়ে তো হাসিনা গর্ব করে বলেই ফেললো, তার পিয়ন দুর্নীতি করে চারশ’ কোটি টাকার অবৈধ মালিক হয়ে হেলিকপ্টারে চড়ে বেড়ায়। এই তথ্য জনমনে ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি করে। মানুষ আন্দোলনে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ছাত্রদের আহ্বানে আপামর জনতা রাস্তায় নেমে আসে। তবে কি হাসিনার পতনের পেছনেও ‘মাস্টার মাইন্ড’ ছাগলের অনন্য এক ইতিহাস আছে? ’৭১-এর ইতিহাসে কত যোদ্ধাকে কেবল শরণার্থী শিবির ঘুরে এসে নিজের নামের আগে নিজেই বীর খেতাব ঝুলিয়ে দিতে দেখেছি। কিন্তু নিরস্ত্র আবু সাঈদের মতো বিধ্বংসী মারণাস্ত্রের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়াবার মতো বীর গোটা পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া যাবে কি? কিংবা গোলা-বারুদের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন আকাশের নিচে সহযোদ্ধার জীবন বাঁচাতে ‘’পানি লাগবে.পানি..” মুগ্ধের এমন চিৎকার আর শোনা গেছে কি কোনো যুদ্ধের ময়দানে?

’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের পরে কেটে গেছে প্রায় সাড়ে তিন দশক। তারপর হাসিনার ফ্যাসিজমের পতন ঘটলো। তবে স্বাধীনতার পূর্ব থেকে আজ অবধি ক্ষমতায় থাকা কোনো সরকারপ্রধানের আন্দোলনের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবার এটাই একমাত্র নজির। আন্দোলনের বছর ২০২৪ জুড়ে চূড়ান্ত ভাঁওতাবাজির নির্বাচন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক সংকট, দেশের রিজার্ভ ডাকাতি, কোটা সংস্কার এবং শেষ পর্যন্ত প্রায় দুই হাজার ছাত্র-জনতা খুন করা হলো। এভাবেই একের পর এক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আজ এক নতুন বাস্তবতা আর সমীকরণের পথে হাটঁছে বাংলাদেশ। আগামীর পথে এই নতুন বাংলাদেশ নতুনভাবে গড়ে তুলবার একজন ‘মাস্টার মাইন্ড’ চাই। কে হবে সেই ‘মাস্টার মাইন্ড’?

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়