প্রকাশ : ০৯ মার্চ ২০২৫, ১০:১০
শিক্ষা জাতীয়করণের আন্দোলন : আদতে দায় কার?

এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা দীর্ঘ দুই দশকের বেশি সময় ধরে শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের আন্দোলন করে যাচ্ছে। তবে এ আন্দোলনটি বেশি মাত্রায় হচ্ছে এক দশক ধরে। দেশের ৩১ হাজার এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারীদের সংখ্যা ৫ লক্ষাধিক। দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের ৯৭ ভাগ শিক্ষার নেতৃত্ব দিচ্ছে এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। একই বই, একই সিলেবাস একই যোগ্যতার শিক্ষক অথচ বৈষম্যের পরিক্রমা ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর। আর সব মিলে তথৈবচ শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য দূরীকরণে মরিয়া দেশের এমপিওভুক্ত শিক্ষক সমাজ। বিশেষ করে গ্রামীণ পর্যায়ের বেসরকারি স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষকরা এ আন্দোলনের বোটম লাইনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। অপরদিকে আন্দোলনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য না বুঝে সাধারণ মানুষের মধ্যে কেউ কেউ মনে করছেন শিক্ষকরা কেবল তাদের বেতন-ভাতা সুবিধাদির জন্যে আন্দোলন করছে। প্রকাশটা এমন, যেন শিক্ষকগণ তাদের সুবিধাদি বৃদ্ধি করতেই স্বার্থপর বনে গেছেন। আর এদিকে প্রখর চেতনাদীপ্ত ছাত্র সংগঠন সক্রিয় না থাকায় শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের আন্দোলনে নেই। থাকলেও মোটা দাগে তা স্পষ্ট নয়। ছাত্র সংগঠনগুলোকে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট আন্দোলনের চেয়ে জাতীয়-আন্তর্জাতিক রাজনীতিকেই বেশি প্রাধান্য দিতে দেখা যাচ্ছে। শিক্ষা উপকরণের দাম অতিমাত্রায় বৃদ্ধি, সময়মতো শিক্ষার্থীরা পাঠ্যপুস্তক না পাওয়া, ভুলে ভরা পাঠ্যপুস্তক হওয়ার পরও উল্লেখযোগ্য কোনো আন্দোলন ছাত্র সংগঠনগুলো গড়ে তুলতে পারেনি। মানুষের মনের কথাগুলো বলার মতো এখন সাহসী ছাত্র নেতৃত্বের অভাব বোধ হচ্ছে। শিক্ষা উন্নয়নের জন্যে এখন শিক্ষকরাই কথা বলছে বেশি। তবে শিক্ষার মানের চেয়ে অর্থনৈতিক মুক্তিকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন শিক্ষকরা। কারণ বর্তমান দুর্মূল্যের বাজারে সংসারের খরচ নির্বাহ করা দুঃসাধ্য বৈ কিছু নয়। ফলে আদর্শ, চেতনার চেয়ে জীবন-জীবিকা পরিচালনা চ্যালেঞ্জ। আর্থিক সংকট মোকাবেলায় শিক্ষকরা রাজপথে থেকে লড়াই করছেন। কিছু প্রশ্ন এসে যায়, আসলে কি শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ করলে কেবল শিক্ষক সমাজই লাভবান হবেন? তাদের জীবন-জীবিকার উত্তরণ করতেই তারা দিনের পর দিন প্রেসক্লাব কিংবা শাহবাগে অবস্থান নিচ্ছেন? পর্যবেক্ষক মহলের সেই একই প্রশ্ন। তাই উপরোক্ত কয়েকটি প্রশ্নের অবতারণা হচ্ছে সর্বদাই। এবং সে প্রশ্নগুলোর উত্তর আমার এ রচনায় পাঠকগণ ঈষৎ ইঙ্গিত হিসেবে হলেও পেয়ে যাবেন।
যে কারণে রাজপথে শিক্ষক সমাজ
এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এন্ট্রি লেভেলের একজন শিক্ষক ১২ হাজার ৫০০ টাকা বেতনে চাকরিতে যোগদান করছেন। আর কর্মচারী পান ৮ হাজার ২৫০ টাকা। ১ হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া, ৫শ’ টাকা চিকিৎসা ভাতা এটা সকলের জন্যে। উৎসব বোনাস দেয়া হয় ২৫%। কর্মচারীদেরকে দেয়া হয় ৫০%। আর বৈশাখী ভাতা দেয়া হয় ২০%। বৈশাখী ভাতায় সরকারি-বেসরকারি কোনো বৈষম্য নেই। উৎসব বোনাস ব্যতীত বেতন-ভাতাদি থেকে গ্রাচ্যুইটির জন্যে সরকার আবার ১০% কেটে নিচ্ছে। এমন নির্মম সিদ্ধান্ত সরকারি চাকুরিজীবীদের ক্ষেত্রেও নেই। অথচ পরিমিত ভাতার পরিমাণ বৃদ্ধি না করেই কেটে নিচ্ছে ১০%। এটা একটা চরম নির্মমতা ছাড়া আর কিছুই নয়। আর এদিকে ২০১৮ সাল থেকে ৫% ইনক্রিমেন্টে যুক্ত হয়েছে শিক্ষকরা। তবে একজন এন্ট্রি লেভেলের শিক্ষক প্রথম বছরে কর্তনের পর বেতন পাচ্ছেন ১২৪০০ টাকা। এখনকার অধিকাংশ তরুণ শিক্ষক অনার্স-মাস্টার্স পাস করা। এনটিআরসিএ-এর মাধ্যমে যোগ্যতায় অবতীর্ণ এসব শিক্ষক। এভাবেই গত ১৮ বছর ধরে এ তরুণ শিক্ষকরাই বেসরকারি পর্যায়ের শিক্ষার চালকের আসনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এসব শিক্ষক অনেক যোগ্য অথচ যোগ্যতার বিচার নেই। কয়েক হাজার পদ এখনও শূন্য রয়েছে। গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদন করেও যোগদান করেনি। ফলে শিক্ষক সংকটও চরমে। এ রকম নামমাত্র বেতনে একজন শিক্ষকেরই জীবনযাপন পরিচালনা করা যদি হুমকি হয় তাহলে মেধাবীরা কেন এ পেশায় আসবে? অল্প বেতনে একজন শিক্ষকেরইতো জীবন চলে না, পরিবারের অন্য সদস্যদের জীবিকা নির্বাহ করা কোনোভাবেই সম্ভব না। দেখা গেছে, অধিকাংশ শিক্ষকের কর্মস্থল নিজ বসত থেকে অনেক দূরে। কিংবা নিজ জেলা থেকে অন্য জেলা। পরিবার-পরিজন ছেড়ে থাকতে হয় বাসাভাড়া করে। আর যারা স্থানীয় তাদের তুলনাটাই দেয়া যাক। একজন শিক্ষক বাসা থেকে কর্মস্থলে যেতে প্রতিদিন যদি ১শ’ টাকা ভাড়া গুণতে হয়। তাহলে মাসে ২২ দিন আসা-যাওয়া করলে ২২শ’ টাকা যাতায়াতে খরচ হয়। কর্মস্থলে দুপুরের খাবারও রয়েছে। গড়ে প্রতিদিন ১শ’ টাকা খরচ হলে এখানেও গুণতে হয় ২২শ’ টাকা। যাতায়াত ভাড়া ও দুপুরের খাওয়া বাবদ ৪ হাজার ৪শ’ টাকা ব্যয় হয়ে থাকে। ওই শিক্ষক মাস শেষে পরিবারের জন্যে কীই-বা খরচ মেটাতে পারবে? ফলে সংসারের টানাপোড়নে পড়তে হয় শিক্ষককে। স্ত্রী-সন্তান এবং বাবা-মার ন্যূনতম চাহিদা পূরণ করা অসম্ভব। ২৫% উৎসব বোনাসে আসে ৩ হাজার ১শ’ টাকা। এ টাকা দিয়ে একজনেরই ঈদের পোশাক কেনা সম্ভব না। পরিবারের অন্য সদস্যদের পরিণতি তাহলে কী? ঈদের মুদি বাজার কেনাতো সুদূর পরাহত।
এবার আসা যাক জাতীয়করণ হলে শিক্ষার্থীদের কী উপকার হবে?
মফস্বলে একজন শিক্ষার্থী ন্যূনতাম ২শ’ টাকা করে প্রতি মাসে বেতন দিচ্ছে। কোনো কোনো মফস্বল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৫শ’ থেকে হাজার টাকাও বেতন নিচ্ছে। জাতীয়রকণ হলে শিক্ষার্থীরা মাসিক বেতন নামমাত্র হারে দেবে। অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ১ হাজার টাকা থেকে কয়েক হাজার পর্যন্ত সেশন ফি নেয়া হয়। পরীক্ষার ফি নেয়া হয় ন্যূনতম ৫শ’ টাকা। শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ হলে অতিরিক্ত বেতন ও ফি পরিশোধ থেকে শিক্ষার্থীরা রেহাই পাবে। দেখা গেছে, বছর ঘুরে একজন শিক্ষার্থীর বেতন, পরীক্ষার ফিসহ অন্তত ৪ হাজার টাকা থেকে ১২/১৩ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হিমশিম খেতে হয়। বিভাগীয় শহরগুলোতে আরও কয়েকগুণ। এ পরিমাণ বকেয়া পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে অনেক শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন বিপন্ন হয়ে পড়ে। জাতীয়করণ হলে এ থেকে নিস্তার পাবে শিক্ষার্থীরা।আন্দোলনকারী শিক্ষকদের প্রস্তাব
দেশের ৩১ হাজার এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সকল আয় রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা নিয়ে শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ করার প্রস্তাব দিয়েছে বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠন। তারা প্রমাণসহ দেখান যে, প্রচলিত অবস্থায় প্রতিষ্ঠানের সকল আয় নিয়ে গেলে রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে কোনো অর্থ ব্যয় করতে হবে না। আর যদি শিক্ষার্থীদের বেতন ৫০ টাকা হারে ধরা হয়, তাহলে রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে কিছু পরিমাণ টাকা লাগবে, যা রাষ্ট্রের জন্যে ন্যূনতম বোঝাও হবে না। এ বিষয়ে বিস্তারিত ফিরিস্তি তুলে ইতোমধ্যে কয়েকটি শিক্ষক সংগঠন প্রতিবেদনও মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে বিগত সরকার নীতিগতভাবে জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত নিয়ে অল্পসংখ্যক প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করেছে। যে পদক্ষেপটি ছিল খুবই মন্থর। এতে করে শিক্ষক সমাজ বিগত সরকারের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে জোরালোভাবে। ধাপে ধাপে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো জাতীয়করণের তকমা শিক্ষক সমাজ তখন মেনে নেয়নি।
শিক্ষক সমাজ আস্থা রাখছে, হয়তো বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্দ্বিধায় শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের ব্যাপারে পদক্ষেপ নিয়ে শিক্ষা উন্নয়নের গতিকে আরও বাড়িয়ে তুলবেন। প্রসঙ্গত যে, বৈষম্যহীন স্লোগানে উদ্দীপ্ত হয়ে ছাত্র-জনতা গণঅভ্যুত্থান করলো। সবাই আশা করেছে, আর কোনো বৈষম্য হয়তো থাকছে না। কারণ অতীতে শিক্ষকরা অনেক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছেন। এবার বৈষম্য থেকে অন্তর্জাল থেকে অবমুক্তি পাবেন।
বিগত আমলে আন্দোলনকারী শিক্ষকগণ জাতীয়করণের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে আমলা, বড়ো বড়ো শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সভাপতি, এমপি, মন্ত্রী এবং রাজনৈতিক নেতাদেরকে দায়ী করছেন। বড়ো বড়ো শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যাপকমাত্রায় শিক্ষাব্যবসা হয়ে থাকে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে হাজার হাজার টাকা বেতন ও সেশন ফি নিচ্ছে এবং সে টাকা স্থানীয় কমিটি ও প্রতিষ্ঠানপ্রধানসহ আত্মসাৎ করার ব্যাপক অভিযোগও আছে।
নিবিড় পর্যালোচনায় উঠে এসেছে, শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানরাই বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠনের কেন্দ্র হতে মহানগর, জেলা, উপজেলায় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে রয়েছেন। এসব নেতা কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলছেন না। কারণ প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বড়ো অঙ্কের বেতনসহ বিভিন্ন সুবিধা ভোগ করছেন। এমনকি নামে-বেনামে ব্যয়ের ভাউচার সন্নিবেশন করে প্রতিষ্ঠানের অর্থ লোপাট করছেন। এর সাথে জড়িত থাকেন ম্যানেজিং কমিটির সদস্যরা। কার্যত এসব প্রতিষ্ঠান প্রধানরা আন্দোলনে আগ্রহী নন এবং পদও কুক্ষিগত করে রাখেন কিংবা তার অধীনস্থ শিক্ষকদেরকে আন্দোলনে আসতে উৎসাহিত করছেন না।
প্রসঙ্গত, একটি দেশে শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের জন্যে আন্দোলন কেন অনিবার্য হয়ে উঠবে? কেন শিক্ষকদেরই আন্দোলন করতে হবে? এখানে কি ছাত্র-জনতার দায় নেই? এখানে কি রাষ্ট্রের দায় নেই? মানুষ প্রত্যাশা করতেই পারে দেশকে এগিয়ে নিতে রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরাইতো এটা উপলব্ধি করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগ্রহণ করবেন। যাতে করে সমাজ ও সভ্যতা এগিয়ে যায়। যেন এদেশের শিক্ষার্থীরা বিশ্ব নাগরিক হয়ে উঠতে পারে। একটি টেকসই মানবিক সমাজ গড়ে উঠতে পারে।
মোট কথা, শিক্ষকদেরকে অভুক্ত রেখে ভালো শিক্ষা আশা করা যায় না, ভালো কিছু অর্জন হয় না। সরকারি-বেসরকারি বৈষম্য রেখে কার্যত ভালো জাতিও গড়ে উঠবে না।
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ মাধ্যমিক সহকারী শিক্ষক সমিতি, কেন্দ্রীয় কমিটি।