বৃহস্পতিবার, ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫  |   ২৬ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৩:২০

আরও ঋণী করতেই যা নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে

জাহাঙ্গীর হোসেন
আরও ঋণী করতেই যা নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে

‘বাংলা’ বাঙালির প্রাণের সম্পদ। একমাত্র বাঙালিরাই ভাষার জন্যে সর্বপ্রথম জীবন দিলো, পৃথিবীর আর কোথাও এমন নজির নেই। বাঙালি জাতির স্বকীয়তা ‘বাংলা ভাষা’। যা বিশ্বের দরবারে স্বমহিমায় জাগ্রত এবং এক আদুরে উপকরণ হয়ে আছে। এ ভাষা বাঙালির জন্যে মর্যাদার। কারণ এ ভাষা রক্ষার্থে জীবন দিয়েছে বাঙালিরা। তাই ভাষা শহিদদের প্রতি আমাদের রয়েছে ঋণ। যে ঋণ শোধ হবে না। এ ঋণ আরও বাড়িয়ে তুলতে হবে। আরও ঋণী হতে হবে। এখানে দেশের খ্যাতিমান বুদ্ধিজীবী ও সাহিত্যিক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর প্রবন্ধের একটি অংশ আলোচনা প্রণিধানযোগ্য মনে হচ্ছে। প্রবন্ধের শিরোনামটি বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামকে নিয়ে। নজরুল বাংলা সাহিত্যকে এগিয়ে নিয়েছেন তথা বাঙালিকেই সমৃদ্ধ করেছেন--এমন তুলনায় তিনি প্রবন্ধটি লিখেন। প্রবন্ধের শিরোনামটি ছিল 'যে ঋণ পরিশোধ না করাই ভালো।' এ প্রবন্ধের প্রথমাংশে তিনি লিখেন, ‘ঋণতো আছেই, থাকবেই। ক্ষুদ্র ঋণ যাদের তারা সেটা শোধ করেন, বড়ো ঋণীরা করতে চান না, কিন্তু সমষ্টিগতভাবে আমাদের অনেক ঋণ আছে। যেগুলো শোধ করা কখনই সম্ভব নয় এবং যেগুলো আমাদের নত না করে ধনী করে। এমনই একটি ঋণ আমাদের কাজী নজরুল ইসলামের কাছে। এ ঋণ সাংস্কৃতিক।’

এমনই সাংস্কৃতিক ঋণের আবহে দেশবাসীকে ঋণের প্রবাহে দোলাচ্ছে বাংলাভাষাবাদীরা। এ ঋণও শোধ করা যাবে না। ঋণ ক্রমশ বাড়িয়ে তুলতে হবে। তবে খেলাপি থাকতে হবে আমাদের, যদি প্রথম বৈশাখের তাৎপর্য তথা বাঙালির বাঙালিত্ব ও মূল্যবোধকে জাগ্রত করতে কোনো অবদান না রাখি।

বাঙালির লোকায়ত সংস্কৃতিকে প্রাণজ করতে দেশের বিভিন্ন স্থানে মহান একুশ উদযাপনে নানামুখী কর্মযজ্ঞ। পহেলা বৈশাখ ও নবান্ন উৎসব উদযাপনে মানুষের যাপিত জীবনকে আরও সম্মুখে নিয়ে আসা। এভাবে বিভিন্ন অনুষঙ্গের মাধ্যমেই বাঙালির কৃষ্টি-সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখতে হবে। যাতে করে অপশক্তির আক্রমণ ও ষড়যন্ত্র সপাটে তুলোধুনো করা যায়। সে কারণে মুক্তমনাদের সর্বদাই মাথা ঘামাতে হবে।

এখানে আলোচনার দাবি রাখে যে, বাঙালি ছাড়াও ইকুয়েডরের উপজাতিরা নিজস্ব ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে সংগ্রাম করেছে। তারা সে সংগ্রামের আলোর মুখ দেখেনি। বাঙালিরা তা করে দেখিয়েছে, যা এখন বিশ্বে ‘বাংলাভাষী’ আলোকময় হয়ে আছে। বাংলাদেশের পাহাড়ি এলাকার জনগোষ্ঠীর কিছু ভাষা নিজস্ব অক্ষর এখনও তৈরি হয়নি। এসব করা একান্ত কর্তব্য রাষ্ট্রের। মানুষের নিজস্বতা, মৌলিকতা ধরে রাখতে রাষ্ট্রকেই দায়িত্ব নিতে হবে, পৃষ্ঠপোষকতা করতে হবে।

প্রসঙ্গত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাষাবিজ্ঞানী জন অস্টিন ও ব্রিটিশ ভাষাবিজ্ঞানী পিটার কে অস্টিন বিশ্বের ২০ টি ভাষা আগামী ১০ বছরের মধ্যে অবলুপ্ত হয়ে যাবার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ২০১০ সালে। এর মধ্যে ১০টি ভাষাকে খুবই আশঙ্কাজনক মনে করা হয়েছিলো। রাজনীতি, ধর্ম, অর্থনীতি, সাম্রাজ্যবাদ--এসবের প্রভাবই মূলত ভাষা অবলুপ্ত হওয়ার প্রধান কারণ বলে এ দুই বিজ্ঞানী মনে করেছেন। সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলোর ভাষা ইংরেজি, স্প্যানিশ ও হিন্দি। ম্যান্ডারিসও বাদ নেই এ জায়গায়। সাম্রাজ্যবাদের প্রভাবে উল্লিখিত ভাষাগুলো ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছে। যার ফলস্বরূপ জেরু, খোমিনি, ওরোডুইন, কুসূন্ডা, আইনু, গুউগু, যিমিধিইর, কেট, বো- এসব ভাষা এখন অবলুপ্ত হবারই কথা।

এ দুই ভাষা বিজ্ঞানীর তথ্যমতে, ভারতের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে জেরু ভাষাভাষীর লোকের সংখ্যা ২০। খোইসান তথা খোমানী ভাষাভাষীর সংখ্যা ২৫। ১০০ জনের ভাষা ছিলো 'আইনু', এরা জাপানের বিরাতোরী ও হোক্কাইদো দ্বীপের নিবুতানি শহরের বাসিন্দা। 'তহাও' ভাষায় কথা বলে তাইওয়ানের 'সানমুন লোক'। এদের সংখ্যা ০৬ জন। 'ইউচি' ভাষায় কথা বলে ১৯ জন, এরা আমেরিকার ওকলাহামা অঞ্চলের অধিবাসী। ব্রাজিলের বোদেনিয়া অঞ্চলে 'ওরোডুইন' ভাষায় কথা বলে ০৫ জন। ‘তেরসামি’ ভাষায় কথা বলে ১০ জন। গুউগু ভাষাভাষী লোক ছিল অস্ট্রেলিয়ায়। এদের সংখ্যা ১০০ জন। ‘কেট’ ভাষা নাইজেরিয়ায় প্রচলিত। এ ভাষাভাষী লোকের সংখ্যা ৫শ'। তিব্বতের বর্মী 'কোরো' ভাষাভাষীর সংখ্যা সর্বোচ্চ ১২শ’।

‘বাংলা ভাষা’ বিশ্বের ভাষাভাষীর মধ্যে চতুর্থ থেকে এখন পঞ্চম স্থানে অবস্থান করছে।

‘ম্যান্ডারিস’ হলো প্রথম, দ্বিতীয় অবস্থানে ইংরেজি, তৃতীয় অবস্থানে 'স্প্যানিশ', চতুর্থ অবস্থানে আছে 'হিন্দি'। ফলে সংখ্যা ও গুরুত্বের দিক দিয়ে বেশ তাৎপর্যময় 'বাংলা'। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ১৩৫৮ বঙ্গাব্দ যথাক্রমে ২১ ফেব্রুয়ারি ও ৮ ফাল্গুন আন্তর্জাতিকভাবে স্মরণীয়-বরণীয় দিন হিসেবে পালিত হচ্ছে।

বাহ্যত, রাজনীতিতে ফ্যাসিজিজম জায়গা পেলে তা কৃষ্টি-সংস্কৃতিতেও প্রভাব ফেলে। প্রাচীন বাংলায় বেগ পেতে হয়েছে সুনিপুণ নির্মাণকারীদের, যারা বাংলাভাষাকে এগিয়ে নিয়েছেন। তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। বৈষ্ণব সহজিয়ারা মুখোমুখি হয়েছেন গৌড়ীয় গোস্বামীদের। বৈষ্ণব সহজিয়ারা এদের রোষানলে পড়েছেন বাংলায় লেখার কারণে। কৃষ্ণদাস কবিরাজ 'শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত' বাংলায় লিখার অপরাধে ক্ষুব্ধ হয়ে তার বইটি যমুনা নদীতে ফেলে দেন শ্রীজীব গোস্বামী। তারপরও সহজিয়া বৈষ্ণবেরা বাংলায় সাহিত্য রচনা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন নি। বাংলা ভাষায় লেখাকে এগিয়ে নিয়েছেন এদেশের সুফিসাধক কবিরা। কিন্তু এখানেও বাধ সাধে গোঁড়া মুসলমানেরা। যেমন হিন্দুয়ানি ভাষা হিসেবে সংস্কৃতিকে প্রধান করে দেখেছেন, তারাও বাধ সেধেছেন বাংলা ভাষা ব্যবহার, প্রচলনের ক্ষেত্রে। গোড়া হিন্দু ও মুসলমানদের তোপের মুখে সবসময় বাংলাভাষা মুখোমুখি হয়েছে।

বলা বাহুল্য, মহান একুশ ও পহেলা বৈশাখ আগমনের বার্তায় এ দেশে দুটি পক্ষ সচল হয়ে উঠে। একটি পক্ষ, যারা বাঙালি সত্তায় জড়িয়ে আছেন এবং কৃষ্টি- সংস্কৃতির আবিলতায় একাকার হয়ে আছেন। অপরপক্ষে আছেন, জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতসারে যারা বাঙালি সত্তাকে মেনে নিতে পারেন না। সে সূত্রে কায়েদ এ আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর তকমায় যারা আবেষ্টিত, উর্দু প্রীতিতে যারা নিমজ্জমান এবং পাক সংস্কৃতির ঢেঁকুর তুলতে যারা খুশিতে গদগদ থাকেন, তাদের জন্যে 'পহেলা বৈশাখ' গাত্রদাহের মতোই। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত কবি কায়কোবাদের বক্তব্য তুলে ধরা যাক। কায়কোবাদ বলেন 'বঙ্গভাষা যে বঙ্গীয় মুসলমানদের মাতৃভাষা, এ-সম্বন্ধে বোধ হয় এখন আর দ্বিমত নাই। অন্তত অধিকাংশ বঙ্গীয় মুসলমানই এ কথা একবাক্যে স্বীকার করেন। অল্পসংখ্যক যাহারা করেন না, তাহারা এখনও উর্দুর স্বপ্নে বিভোর হইয়া আছেন। -- প্রকৃতির নিয়মকে উল্টাইয়া দিয়া উর্দু কোন রূপেই বাংলার মুসলিম জনসাধারণের ভাষা হইতে পারে না।'

বাংলাভাষার কোন জাতিভেদ নেই। সকল হিন্দু-মুসলমান মানুষের ভাষা বাংলা। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ' বাংলাভাষী' কেবল আমাদের মাতৃভাষা নয়, আমাদের জন্মভূমির ভাষা। ইহা হিন্দুরও ভাষা, মুসলমানেরও ভাষা। ইহার উপর হিন্দু-মুসলমানের তুল্য অধিকার।'

উপর্যুক্ত বক্তব্যসমূহ তিনি ১৯৩২ সালের ২৫-২৬ ডিসেম্বর 'বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সম্মিলন'-এ সভাপতির ভাষণে তুলে ধরেন। সম্মেলনের এ বক্তব্যটি আরও স্পষ্ট করে দেয় যে, ' ---- যাহারা মুসলমানের জন্য এক প্রকারের বাংলা ভাষা এবং বাঙালি হিন্দুর জন্য আর এক প্রকারের বাংলা ভাষার প্রচলন দেখিতে চাহেন, আমি তাহাদের কেহ নহি। আমি বাংলার হিন্দু এবং বাংলার মুসলমানের জন্য এক মিলিত ভাষা চাই'।

অথচ ১৯৪৭ সালে জাতিভেদে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র সৃষ্টির পর বাংলাকে রীতিমতো উপেক্ষা করা হয়েছে এবং অন্তত আরবির আদলেও যাতে বাংলা ব্যবহার করা হয়-- এমন সব ষড়যন্ত্র পর্যন্ত হয়েছে। রাষ্ট্র ও ধর্মীয় প্রভাবে উর্দুকে চরম প্রাধান্য দিয়ে তদুপরি বাংলাকে সে মাত্রায় উপেক্ষা করা হয়েছিল। কিন্তু বাংলার তরুণ-যুবারা এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে, বাংলাভাষাকে প্রাণের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

অথচ দেখা গেলো, প্রায় ৬ শ' বছর পূর্বে ত্রিপুরা রাজ্যের মহারাজ ধর্ম মানিক্য তাঁর শাসনামলে বাংলাকে রাজভাষা হিসেবে মর্যাদা দিয়েছে। এমনকি তিনি দুই লেখক বানেশ্বর ও শুক্রেশ্বর শর্মাকে দিয়ে বাংলাভাষায় প্রথম ইতিহাস গ্রন্থ প্রকাশ করান। ইতিহাস গ্রন্হটির নাম- রাজমালা। ধর্ম মানিক্যের শাসনকাল ছিল১৪৩১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৪৬২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। এ সময়কালে তিনি উল্লিখিত কাজগুলো সম্পাদন করেন। অথচ এক ধরনের বকধার্মিকরা পহেলা বৈশাখকে 'হিন্দুয়ানি সংস্কৃতি' আখ্যা দিয়ে পরোক্ষভাবে বাঙালি জাতিকে বিভ্রান্ত করতে ও বাঙালি সত্তাকে অদৃশ্যায়ন করতে একপ্রকার অতি উৎসাহী অজ্ঞেয় কতিপয় ধর্মান্ধ লোক উল্টা-পাল্টা ফতোয়া দিচ্ছে। এমনকি পহেলা বৈশাখ উদ্যাপনকে অপসংস্কৃতি বলে আখ্যা দেন। এতে করে চিরায়ত সংস্কৃতি লালন-পালনকারী ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ হিসেবের খাতা মেলাতে পারেন না। ব্যবসায়ীরা বছরের হালখাতা খোলার সময় ভুয়া তকমা তাদেরকে বেশ বিভ্রান্ত করে এবং বিপদে ফেলে দেয়। এসব ধর্ম বেপারীরা আরও পেয়ে বসে কয়েকবছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টিএসসিতে পুলিশের উপস্থিতিতে নারীদের শ্লীলতাহানির বিষয় নিয়ে।

কোন ধর্মীয় উৎসব সর্বজনীন নয়--সেটি হচ্ছে নিজ নিজ সম্প্রদায়গত উৎসব। কোন ধর্মীয় উৎসব সর্বজনীন হতে পারে না। কিন্তু বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, ভাষা দিবস এবং পহেলা বৈশাখের মতো বিভিন্ন লোকজ উৎসব সর্বজনীন। সকল পর্যায়ের মানুষ নির্বিঘ্নে ও অবলীলায় এ উৎসবে মজে যান এবং নিজস্বতা খুঁজে পান। যেখানে ব্যক্তিবাদ, দল-মত, ধর্ম, বর্ণের বালাই থাকতে পারে না।

পয়লা বৈশাখ, নবান্ন উৎসব বাঙালি জাতির লোকায়ত উৎসব। যেটাকে আমরা লোকজ বলে থাকি। প্রান্তিক মানুষের প্রাণ এখানে আছে বলেই--এ উৎসব 'লোকজ' বলে ধরে নেয়া হয়। ধানকাটার মৌসুমে কৃষকের মুখে হাসি ফোটে। তখন মাড়াইকৃত ধান পেষণ করে চলে। এগুলো রূপান্তর করে পিঠা-পুলি, মুড়ি-মুড়কি, শিরনি ও পায়েশ তৈরি করা হয়। এ নিয়ে আনন্দের সীমা-পরিসীমা থাকে না। এ জায়গায় বিভিন্ন ধর্ম অনুসারীরা যার যার মতো করে নবান্ন উৎসবে বিভিন্ন আয়োজন করে থাকেন। তাই বলে এটা কোনো ধর্মীয় সংস্কৃতি নয়।

মোঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। নামের মাহাত্ম্যই বলে দিচ্ছে তিনি ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের একজন। কৃষকের খাজনা আদায়ের জন্যে হিজরি সনের সাথে মিল রাখা যায়নি। তাই কৃষক বিপাকে পড়ে যায়। এ সমস্যা সমাধান করতে বাংলা সনের প্রচলন করেন সম্রাট আকবর। কারণ চান্দ্র বছরের সাথে বাংলা ঋতুর এলোমেলো হয় ও তালগোল পাকিয়ে যায়। তাই এর সুষ্ঠু সমাধানের জন্যে ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ৯১২ হিজরি সনে প্রখ্যাত ইরানি জ্যোতির্বিজ্ঞানী আমির ফতেহ উল্লাহ সিরাজকে সম্রাট আকবর দায়িত্ব দেন। তিনি হিজরি সনের সঙ্গে মিল রেখে সৌর মাসভিত্তিক ফসলি সন প্রবর্তন করেন। সে কারণে বাংলা মাসের প্রথম মাস চৈত্র না রেখে বৈশাখ রাখার প্রস্তাব দেন। তখন পহেলা বৈশাখ পহেলা মহররমের সাথে মিল থাকায় ১ বৈশাখ বাংলা নববর্ষ হিসেবে উদ্যাপিত হয়ে আসছে।

পহেলা বৈশাখ ঘিরে মানুষের মনন জগতে স্পন্দন তৈরি হয়। তাই পুরানো ক্লেশ, হিংসা-বিদ্বেষ, দুঃখ-বেদনাকে বিদায় ও সুখ-সমৃদ্ধুকে ধন্যবাদ জানানো হয় এবং আগামী পথচলা ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যময় করতে নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হয়। অর্থাৎ এটা এক ধরনের সুখানুভূতি।

সুলতানি আমলে সোনারগাঁওয়ে সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের নেতৃত্বে ভাটিয়ালি, মারফতি, মরমী গানসহ উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে কবিতার আসরও বসত। কারণ সুলতান নিজেই একজন কবি ছিলেন। ওই সময় বিভিন্ন খানকায়ে লোকজ উৎসব জমে উঠতো। ওই সময় পীর-ফকিরদের বিভিন্ন খানকায় ও দরবার শরীফে ওরস অনুষ্ঠানকালে পালাগান ও কাওয়ালি আসর জমানো হতো।

প্রসঙ্গত, লোকজ উপাদানের নিদর্শন হচ্ছে 'মসলিন'। চতুর্দশ শতকে সোনারগাঁওয়ে 'মসলিন' শিল্প বেশ সমৃদ্ধ ছিল। এ সংস্কৃতির ঐতিহ্য ধরে রাখতে শিল্পাচার্য জয়নাল আবেদীন ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের আর্থিক অনুদানে সোনারগাঁওয়ে গড়ে তোলেন 'বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন'।

এখানে যুক্তিগ্রাহ্য যে, কুটিরলিপি থেকে বাংলালিপির উদ্ভব হয়েছে বলে ভাষাবিদরা মনে করেছেন সেই দশম শতকে। বাংলাভাষার পথচলা কত শেকড় থেকে এসেছে তা খুবই অনুমেয়, যা কুটিরশিল্পের মজ্জা থেকেই বহিঃপ্রকাশ। কম্বোজরাজা ন্যায়পালদের 'ইর্দার' দানপত্রে এবং মহিপালদের 'বানগড়' দাপত্রের লিপিতে আদি বাংলা বর্ণমালা খচিত লেখা দেখা যায়। সে থেকেই বাংলা বর্ণমালার পথচলা শুরু। তাই বাংলার স্বকীয়তা খুবই বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। বাংলার মেঠোপথকে টেকাতে করতে হবে কিছু না কিছু কাজ। এ ঋণ কাজে সকলের আন্তরিকতা সোৎসাহ যুক্ত হয়েছে এবং আরও প্রয়োজন। তাই সবশেষে কবি শামসুর রাহমানের একটি গানের প্রথম স্তবক দিয়েই লেখার সমাপ্তি টেনে দিতে চাই, ' স্মৃতি ঝলমল সুনীল মাঠের কাছে, পানি টলটল মেঘনা নদীর কাছে, আমার অনেক ঋণ আছে, ঋণ আছে'।

লেখক পরিচিতি : কবি, প্রাবন্ধিক, মার্কসবাদ গবেষক।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়