প্রকাশ : ৩০ জুন ২০২১, ০০:০০
বিম্বিত বীক্ষণ
অধ্যক্ষ রতন কুমার মজুমদার
পর্ব-১৪
|আরো খবর
ছেঙ্গারচর হাইস্কুলে নকলবিরোধী অভিযানের পরদিন স্থানীয় সকল পত্রিকা হেডলাইন করেছে ‘নকলের মহোৎসব বন্ধে প্রশাসনের অভিযান’। এ অভিযান সারা শহরের আলোচিত বিষয় ছিলো সেদিন। এতো পরিমাণ শিক্ষার্থী বহিষ্কার হওয়াতে এ খবর কোনো কোনো জাতীয় পত্রিকায় স্থান পেয়েছে। এতে করে দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অধিকাংশ মানুষ বলেছে ব্যবস্থাটা ঠিক হয়েছে। আর সুবিধা-বঞ্চিতরা বলেছে, এ কাজটা ঠিক হয়নি। ১৯৯৯ সালে সারা বাংলাদেশেই নকল ছিলো শিক্ষার্থীদের কাছে অধিকার। চাঁদপুরে শহরের দু-একটি কেন্দ্র ছাড়া প্রতিটি কেন্দ্রে নকল হতো প্রকাশ্যে। এ প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত হয়ে পড়েছে শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক, রাজনৈতিক ব্যক্তি এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রশাসনের কর্মকর্তাসহ অনেকেই।
চাঁদপুরের সবচেয়ে স্পর্শকাতর কেন্দ্র ছিলো মতলব, কচুয়া, ফরিদগঞ্জ ও হাজীগঞ্জ। এই সমস্ত কেন্দ্রে প্রশাসনিক কর্মকর্তারাও কোনো কোনো সময়ে নকল রোধে উদাসীনতা দেখিয়েছে। চাঁদপুরে নকলের বিস্তারটা একটু বেশিই ছিলো। পাশের জেলা এবং দূরের জেলা থেকেও শিক্ষার্থীরা নকলের সুবিধা নেয়ার জন্যে চাঁদপুরের কেন্দ্রগুলোতে পরীক্ষা দিতে আসতো। সেক্ষেত্রে এগিয়ে ছিলো কচুয়া। কথিত ছিলো কচুয়াতে শিক্ষার্থীদের ফরম পূরণের রেট ছিলো বিভিন্ন রকম। এক. অবাধে নকলের সুযোগ দেয়া হবে বলে ফরমপূরণ করে দেয়া হতো ১০ হাজার টাকায়। দুই. শিক্ষক এবং অভিভাবকরা নকল সরবরাহ করবে তাদের ফরমপূরণের রেট ২৫ হাজার টাকা। তিন. শিক্ষার্থীর পরীক্ষা কেন্দ্রে আসার প্রয়োজন নেই। কেন্দ্রের বাইরে থেকে খাতা লিখে এনে জমা দিবে সেটার রেট ছিলো ৫০ হাজার টাকা। এ ধরনের খবরগুলো যখন আসতে থাকলো তা চাঁদপুর জেলা প্রশাসনে রীতিমত আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ালো। কিন্তু প্রশাসন হাল ছেড়ে দেয়নি। সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, যে কোনো উপায়ে এ অনিয়ম বন্ধ করতে হবে।
ইতিমধ্যে জেলা প্রশাসক জনাব রেজাউল করিম এবং অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক জনাব সিরাজুল ইসলামের নির্দেশে ৫টি ভিজিল্যান্স টিম গঠন করা হলো। প্রতি টিমের নেতৃত্বে থাকবেন একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা। কোন্ দিন কোন্ টিম কোন্ কেন্দ্রে যাবে সেটা কাউকে জানানো হতো না। সকাল ৮টায় টিম রওনা হলে জানা যেতো কোন্ কেন্দ্রে যেতে হবে। মাদ্রাসাগুলোর অবস্থা ছিলো আরও ভয়াবহ। শিক্ষক এবং ছাত্র মিলে কেন্দ্রগুলোতে নকলের হাট বসাতো। প্রতিদিন যখন নকলবিরোধী অভিযান চলতে থাকে তখন কেন্দ্রগুলোতে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। কখন ভিজিল্যান্স টিম আসবে। ভিজিল্যান্স টিমে কাজ করতে গিয়ে আরো ভয়ানক যে জিনিসটা জানা গেলো তা হলো কেন্দ্রগুলো পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে নকলের সুবিধা দেয়া হবে বলে প্রবেশপত্র দেয়ার সময় অর্থ আদায় করেছে। এখন নকলের সুবিধা না পাওয়াতে কোনো কোনো কেন্দ্রে শিক্ষার্থীরা কেন্দ্র সচিবের উপর চড়াও হয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেলো উত্তোলিত টাকার ভাগ বিভিন্ন জায়গায় দিতে হয়। এ টাকার ভাগ উপজেলা পর্যায়ের কোনো কোনো প্রশাসনিক কর্মকর্তাকেও দিতে হতো। কেন্দ্রগুলোতে যা হতো সেটাকে পরীক্ষা না বলে নকলের উৎসব বলাটা যুক্তিযুক্ত। সেই উৎসবে শামিল হতো শিক্ষক, অভিভাবক, কোনো কোনো প্রশাসনিক কর্মকর্তা, এমনকি কোনো কোনো সময় রাজনৈতিক ব্যক্তিও।
আমাদের ভিজিল্যান্স টিমের সাথে সবসময় পুলিশ স্কট থাকতো। ইতিমধ্যে নকল প্রতিরোধ করতে গিয়ে টিমের কোনো কোনো সদস্য আক্রান্তও হয়েছেন। এমন একটা অবস্থা হয়েছিল দুটি পক্ষ হয়ে গিয়েছিল। প্রথম পক্ষ ভিজিল্যান্স টিম দ্বিতীয় পক্ষ কেন্দ্রের সবাই। সকলে মিলে ভিজিল্যান্স টিমের সদস্যদের প্রতিপক্ষ করে ফেলেছে। প্রতিদিনই টিমের সদস্যদের হাতে এক দেড়শ’ শিক্ষার্থী বহিষ্কার হতো। ওই সময়ে তিনজন ভিজিল্যান্স টিমের সদস্যের নাম খুব আলোচিত ছিলো চাঁদপুর শহরে। এক. এসিল্যান্ড জনাব ইমাম উদ্দিন কবির , দুই. আমি নিজে এবং তিন. জনাব মোশারেফ হোসেন।
আমি ছিলাম অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক জনাব সিরাজুল ইসলাম স্যারের টিমে। স্যারের ব্যক্তিত্বের কারণে সবাই স্যারকে ভয় করতো। আমাদের টিমের আরেক সদস্যের নাম ছিলো সাংবাদিক গোলাম কিবরিয়া এবং একজন ম্যাজিস্ট্রেট। আমাদের টিমটি ছিলো সারা চাঁদপুরের আতঙ্ক। ওই সময়ে সত্যিকার অর্থে পরীক্ষা বলতে ছিলো নকলের মহোৎসব। আমি এমনও দেখেছি পিতা তার পুত্রকে, বড় ভাই, ছোট ভাইকে নকল সরবরাহ করতে আসতো। সবচেয়ে ভয়াবহ ছিলো অধিকাংশ শিক্ষক নকলের পক্ষে ছিলেন। কেউ কেউ নিজেরাই ছাত্রদের নকল সরবরাহ করতেন। এজন্যে অনেক শিক্ষককে কেন্দ্র থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থাগ্রহণ করা হয়েছে। কিছু কিছু শিক্ষক বাধ্য হয়ে নকলের পক্ষে থাকতে হয়েছে। আমরা শিক্ষকদের বোঝানোর চেষ্টা করেছি, যতোই চাপ থাকুক নিজের মেরুদ- সোজা করুন। একবার অন্তত না বলুন। ঘুরে দাঁড়ান। নিজের আত্মসম্মানের জন্যে অন্তত নকলকে না বলুন। কিন্তু কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছিলো না। অধিকাংশ শিক্ষক পরীক্ষার হলে ডিউটি দিতো পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থেকে। কোনো কোনো সময় নকল সরবরাহও করতো।
শিক্ষক যখন নকল সরবরাহে জড়িয়ে পড়ে তখন বুঝতে হবে শিক্ষাব্যবস্থা পুরোটাই ভেঙ্গে পড়েছে। এখান থেকে বের হওয়া খুবই কঠিন। কিন্তু চাঁদপুর জেলা প্রশাসন বিশেষ করে জেলা প্রশাসক জনাব রেজাউল করিম এবং অতিরক্ত জেলা প্রশাসক জনাব সিরাজুল ইসলাম স্যার হাল ছেড়ে দেয়ার পাত্র নন। এসএসসি পরীক্ষা শেষ হলো। সামনেই এইচএসসি পরীক্ষা। সিরাজ স্যার প্রতি উপজেলায় গিয়ে ছাত্র, শিক্ষক, রাজনৈতিক ব্যক্তি এবং অভিভাবকদের সাথে সভা করেছেন। তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, আপনাদের সন্তানদের অভিষ্যতের জন্যে নকলকে না বলুন। কিন্তু চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনি।
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু হবে ক’দিন পর। প্রস্তুতি শুরু। সহকারী কমিশনার (শিক্ষা) জনাব আনোয়ার হোসেন চৌধুরী (বর্তমানে অতিরিক্ত সচিব) জেলার ১৭টি কেন্দ্রের জন্যে ১৭টি ভিজিল্যান্স টিম করলেন। প্রতি টিমে একজন ম্যাজিস্ট্রেট, একজন অধ্যাপক, একজন সাংবাদিক এবং একজন সরকারি কর্মকর্তা। পরীক্ষার দিন গাড়ি রওনা হওয়ার পর জানা যাবে টিম কোথায় যাচ্ছে। কারণ কেন্দ্রগুলো তখন মরিয়া হয়ে গেছে যে কোনো উপায়ে হোক টিমকে বশে আনা। কিন্তু তাদের সে আশা দুরূহই রয়ে গেলো। প্রতিদিনই টিম নতুন গন্তব্যে রওনা হতো।
ভিজিল্যান্স টিমে কাজ করতে গিয়ে কিছু বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছে। কেন্দ্রগুলো যেহেতু ছাত্রদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিতো সেহেতু টাকা দিয়ে তারা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে চাইতো। কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতাও এতে প্রভাব বিস্তার করতে চাইতেন। ফরিদগঞ্জ একটি মাদ্রাসা কেন্দ্রে আমাদের টিমের অভিযানে ৫ জন ফেক পরীক্ষার্থীকে এরেস্ট করা হলো। বহিষ্কার হলো ১৪৬ জন। সে রাতেই বিভিন্ন তদবির শুরু হলো যেনো পরবর্তী পরীক্ষায় সেখানে কোনো টিম না যায়। নানাভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করা হলো। একজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা প্রশাসনকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন সারাদেশেই তো এমন হয়। পরে জানা গেলো তিনিও কেন্দ্রের কাছে কোনো অদৃশ্য কারণে বশীভূত হয়েছেন। কিন্তু চাঁদপুর জেলা প্রশাসন কোনো তদবিরের কাছে নতি স্বীকার করেনি।
সারাদেশে চাঁদপুর ছিলো তখন নকল প্রতিরোধে আলোচিত বিষয়। জাতীয় পত্রিকাগুলোতে প্রতিনিয়ত খবর ছাপা হতে শুরু করে। কিন্তু কেন্দ্রের সবাই নকলের পক্ষে। প্রতিপক্ষ ভিজিল্যান্স টিম। আমরাও দেখলাম প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণ পরীক্ষার্থী বহিষ্কার হচ্ছে। এতে করে সমাজে একটা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে। তাই শ্রদ্ধেয় সিরাজ স্যার একটু ভিন্ন কৌশল নিয়ে আমাদের ব্রিফ করলেন। আমাদের টিমগুলো পরীক্ষা শুরু হওয়ার ৩০ মিনিট পূর্বেই কেন্দ্রে পৌঁছে যেতাম। কেন্দ্রে গিয়ে স্থানীয় শিক্ষকদের সহায়তায় পরীক্ষার পূর্বেই ছাত্রদের বুঝিয়ে কিছু সময় দিয়ে নকল চেক করে নিয়ে নিতাম। কোনো কোনো সময় দেহ তল্লাশি করে নকল আদায় করে নিতাম। এতে অবশ্য কিছুটা কাজও হয়েছে। আমরা বহিষ্কারে কম গিয়ে প্রতিরোধে আগ্রহী হলাম।
ভিজিল্যান্স টিমের কাজ শেষ করে শহরে আসার পথে আমাদের মধ্যে অনেক সময় আতঙ্ক কাজ করতো। সাথে অবশ্য পুলিশ টিম থাকতো। ছেঙ্গারচর কেন্দ্রে ডিউটি শেষ করে ফিরে আসার পথে এনডিসি এটিএম নাছির মিয়া ছাত্রদের দ্বারা আক্রান্ত হন। চাঁদপুর ফিরে আসলে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। আমার কলেজের অধ্যক্ষের নিকট যতো অভিযোগ জমা হতে থাকে। আমাকে যেনো ভিজিল্যান্স টিমে পাঠানো না হয়। সারা জেলার অধ্যক্ষরা আমার কলেজের অধ্যক্ষকে চাপ দিতে থাকে। আমার অধ্যক্ষ আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, এতে করে আমার শত্রু বেড়ে যাচ্ছে। আমিও আমার সিদ্ধান্তে অটল। আমার অবস্থান থেকে আমি এক চুলও নড়লাম না। তবে জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আমাকে সতর্কতার সাথে শহরে চলাফেরার জন্যে পরামর্শ দিয়েছেন। আবার অভয়ও দিয়েছেন। (চলবে )