প্রকাশ : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৩:৫১
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের ‘চাঁদাবাজির শাসক’ মুছা: শতকোটি টাকার মালিক ও শ্রমিকদের আতঙ্ক
চাঁদাবাজির শাসক: কে এই মুছা?

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক এখন চাঁদাবাজির এক রাজত্বে পরিণত হয়েছে, যার প্রধান হর্তাকর্তা মোহাম্মদ মুছা—এক সময়ের শ্রমিক নেতা এবং বাবুর্চি, যিনি আজ কোটি কোটি টাকার মালিক। ১৫ বছরের চাঁদাবাজি কর্মকাণ্ডে মোহাম্মদ মুছা আজ দক্ষিণ চট্টগ্রামের শ্রমিক মহলের কাছে এক অপ্রতিরোধ্য দানব হয়ে উঠেছেন।
|আরো খবর
দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে শ্রমিকদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করে, মুছা একটি বিশাল চাঁদাবাজির সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। তাঁর প্রভাব এখন কেবল চট্টগ্রাম-বহর্দ্দার হাট টার্মিনাল কিংবা কক্সবাজার সীমান্তের পরিবহন গন্তব্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রতিটি স্টেশন, থানা, এবং পথ ঘাটে তার ক্ষমতা বিস্তৃত। চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে একাধিক প্রতিবাদ সত্ত্বেও তার এই অবৈধ শাসন দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে পরিবহন শ্রমিকদের জন্য।
মুছার চাঁদাবাজির হার: কোটি টাকা প্রতিদিন
মুছার বাহিনী প্রতিদিন হাজার হাজার বাস থেকে চাঁদা আদায় করে, শুধু দক্ষিণ চট্টগ্রামেই তার প্রতিদিনের আয় প্রায় কোটি টাকা। প্রতিটি বাস থেকে সে আদায় করে দৈনিক হাজার থেকে হাজার টাকা—এছাড়া নতুন গাড়ি চলাচলের জন্য এককালীন ৪০ হাজার টাকা চাঁদা, এবং পরিবহন মালিকদের থেকে মাসিক চাঁদা আদায় করা হয়। দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রতিটি স্টেশনে তার বাহিনী চাঁদাবাজির মহোৎসব শুরু করায় শ্রমিকরা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। তাদের ভাষ্য, “কাজের কঠোর পরিশ্রমের বদলে আমাদের হারানো আয় চাঁদাবাজির দখলে চলে যাচ্ছে।”
তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালের পর মুছা শুধুমাত্র শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নয়, এক আধিপত্যশালী ব্যক্তি হিসেবে দক্ষিণ চট্টগ্রামের অর্থনৈতিক চিত্রে ছড়িয়ে পড়েন। তার অবৈধ আয় আজ পুরো অঞ্চলে বিশাল একটি অন্ধকার ব্যবসা তৈরী করেছে, যার সঙ্গে জড়িত শুধুমাত্র শ্রমিকরা নয়, পরিবহন মালিকরা, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা এবং অপরাধী চক্রও।
পটিয়া থেকে কক্সবাজার: চাঁদাবাজির সোনালী রাজত্ব
প্রতিদিন চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক দিয়ে চলাচল করা ৬০০ থেকে ৭০০ বাসের মধ্যে অধিকাংশ বাস মালিকদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করছেন মুছা এবং তার বাহিনী। তার চাঁদাবাজির হিসাব অনুযায়ী, একটি বাস থেকে সে দৈনিক ৩০০-৪০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা নেয় এবং বিভিন্ন পর্যায়ের পরিবহন কর্তৃপক্ষ থেকে মাসিক হারে চাঁদা আদায় করে। এছাড়া তিনি নতুন চালু হওয়া পরিবহনগুলির কাছ থেকেও এককালীন সাড়ে ৪০ হাজার টাকা আদায় করেন। সব মিলিয়ে, বছরে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক থেকে প্রায় ৪০ কোটি টাকার চাঁদাবাজি চলছে।
রাজনৈতিক ছায়ায় চাঁদাবাজির সম্রাট
মুছার চাঁদাবাজির শেকড় রাজনৈতিক মহলে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত। জানা গেছে, তার এই অবৈধ উপার্জনের বেশিরভাগই রাজনৈতিক সম্পর্কের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতায় আসার পর, মুছার চাঁদাবাজির পরিসর একাধিক রাজনীতিবিদের সাথে গোপন আঁতাতের মাধ্যমে বিস্তৃত হয়। প্রতিটি চাঁদাবাজির টাকার একটি অংশ নিয়মিতভাবেই পৌঁছাতো বিভিন্ন রাজনৈতিক মহলে। তার এসব কর্মকাণ্ডে একাধিক রাজনৈতিক নেতার নাম প্রকাশ পেয়েছে, যাদের ছায়ায় মুছা ব্যবসায়িকভাবে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে।
ধোলাইয়ের পরও ফিরে আসা: চাঁদাবাজি চলছে পুরোদমে
২০২৩ সালের ৫ আগস্ট, শ্রমিকরা একত্রিত হয়ে মুছার চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নামলে এক মাসের জন্য চাঁদা আদায় বন্ধ ছিল। তবে সম্প্রতি, নতুন এক শক্তির সহায়তায় তার চাঁদাবাজি পুনরায় শুরু হয়েছে। এই চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানিয়ে স্থানীয় শ্রমিক ইউনিয়ন এবং পরিবহন ব্যবসায়ীরা রাস্তায় নেমে এসেছেন।
নতুন পরিবহন মালিকদের আতঙ্ক: চাঁদাবাজির শিকার হতে হচ্ছে নতুন বাস চালকদেরও
নতুন বাস মালিকদের জন্য একটি সন্ত্রাসী পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে, যারা নতুন গাড়ি চালু করতে গেলে মুছার বাহিনীকে চাঁদা প্রদান করতে বাধ্য। পরিবহন মালিকরা জানান, এককালীন ৪০ হাজার টাকা দিতে না পারলে তাদের নানানভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়। এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রশাসন যেন দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করে, এমনটাই দাবী করছেন ক্ষতিগ্রস্ত বাস মালিকরা।
মুছার চাঁদাবাজির কারণে এখন চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক নিয়ে আসন্ন সংকটের আশঙ্কা করা হচ্ছে। পরিবহন ব্যবসা ও শ্রমিকদের স্বার্থে দ্রুত পদক্ষেপ নিলে, হয়তো এ অবৈধ কর্মকাণ্ড একদিন বন্ধ হবে।
ডিসিকে/এমজেডএইচ