প্রকাশ : ১৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১০:৫৭
বাংলাদেশের কূটনৈতিক নীতি এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন : রাখাইন স্বাধীনতার প্রেক্ষিতে কৌশলগত সম্ভাবনা
মিয়ানমারের রাখাইন স্টেটের পরিস্থিতি বর্তমানে একটি জটিল ভূ-রাজনৈতিক সংকটে পরিণত হয়েছে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারের পতন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র এবং এ পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশ, ভারত ও চীনসহ বিশ্বের বড়ো শক্তিগুলোর কৌশলগত সম্পর্ক এবং উপস্থিতি গভীরভাবে যুক্ত। বাংলাদেশ যে বর্তমানে প্রায় ১৫ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে, তার কূটনৈতিক নীতি কীভাবে এই পরিস্থিতিতে কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারে এবং কীভাবে রাখাইন স্টেটের স্বাধীনতার বা কনফেডারেশনের প্রশ্নে বাংলাদেশ তার পররাষ্ট্র কৌশলকে সামঞ্জস্য করতে পারে, তা নিয়ে একটি সুষম বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
১. বাংলাদেশের কূটনৈতিক পলিসি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক
বাংলাদেশের কূটনৈতিক নীতি বিশেষভাবে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে, তবে ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর প্রভাবকে অগ্রাহ্য করা সম্ভব নয়। রাখাইন স্টেটের স্বাধীনতার ইস্যু বাংলাদেশের জন্যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ উত্থাপন করে :
রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন : রোহিঙ্গারা, যারা বাংলাদেশের সীমানায় আশ্রয় নিয়েছে, তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর একটি সুষ্ঠু এবং মানবিক উপায় বের করা।
ভারতের প্রভাব : ভারতের ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব বাংলাদেশে প্রায়শই একটি আলোচনার বিষয় হয়ে থাকে, বিশেষত রাখাইন পরিস্থিতি ঘিরে। ভারতের অবস্থান মিয়ানমারে রাখাইনের স্বাধীনতা বা কনফেডারেশনের প্রশ্নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতি এই দিক থেকে যে উদ্যোগ নিতে পারে তা হলো, মিয়ানমার এবং ভারতের সঙ্গে একটি ত্রিপাক্ষিক কূটনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু করা, যেখানে বাংলাদেশ রাখাইনের স্বাধীনতা কিংবা কনফেডারেশনের শর্তগুলো বিবেচনা করবে এবং সেই সাথে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়টি সমাধান করবে। এর জন্যে চীন এবং ভারতকে সহায়ক ভূমিকা নিতে উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে।
২. রাখাইন স্টেটের স্বাধীনতা ও বাংলাদেশের ভূমিকা
রাখাইনের স্বাধীনতার প্রশ্নটি বাংলাদেশকে খুবই সচেতন করে তুলছে, কারণ এই অঞ্চলের স্বাধীনতার সাথে সংশ্লিষ্ট রয়েছে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি জনগণের স্বায়ত্তশাসন বা স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা। তাই বাংলাদেশ যখন রাখাইন স্টেটের স্বাধীনতা বা কনফেডারেশনের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করবে, তখন তাকে পার্বত্য অঞ্চলের জনগণের অধিকার রক্ষায় সতর্ক থাকতে হবে।
বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী এই পরিস্থিতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। রাখাইনে স্থিতিশীলতা আনতে এবং রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের সামরিক সহায়তা দেওয়া যেতে পারে। এই সহায়তার বিনিময়ে রাখাইন অঞ্চলের স্বাধীনতা বা কনফেডারেশনের শর্তগুলোর প্রতি সমর্থন দেওয়ার জন্যে একটি চুক্তি সম্পন্ন করা যেতে পারে।
এই চুক্তির পক্ষগুলো হলো :
ক. রাখাইনের স্বাধীনতাকামী বা কনফেডারেশনপন্থী নেতৃত্ব, যারা রাখাইনের স্বাধীনতা বা কনফেডারেশনের জন্যে কাজ করছে।
খ. বাংলাদেশ সরকার, যেটি রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার লক্ষ্য পূরণে রাখাইনের নেতৃত্বের সঙ্গে চুক্তি করতে আগ্রহী।
গ. আন্তর্জাতিক বা আঞ্চলিক মধ্যস্থতাকারী শক্তি, যেমন চীন, ভারত বা আন্তর্জাতিক সংস্থা, যারা এ প্রক্রিয়ায় সহায়তা করতে পারে।
৩. চীন এবং বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক
চীন, যে মিয়ানমারের বড়তম আন্তর্জাতিক সহযোগী এবং বিনিয়োগকারী, তার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। চীনকেও বাংলাদেশের কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে ধরা হয়। বাংলাদেশের কূটনৈতিক নীতি চীনের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে রাখাইন স্টেটের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। চীন বাংলাদেশের সঙ্গে তার সম্পর্ক জোরদার করতে আগ্রহী, যা বাংলাদেশের কূটনৈতিক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে।
৪. রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন : চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনা
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। রাখাইনের স্বাধীনতা বা কনফেডারেশনের শর্তে যদি রোহিঙ্গারা তাদের অধিকার ফিরে পায়, তবে তারা স্বদেশে ফিরে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত হতে পারে।
রোহিঙ্গাদের অধিকার বলতে বোঝানো হচ্ছে :
নাগরিকত্ব প্রদান : মিয়ানমারে তাদের পূর্ণ নাগরিকত্বের স্বীকৃতি।
বাসস্থান ও সম্পত্তির অধিকার : তাদের পূর্বের ভূমি ও বাড়িঘর ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তা।
নিরাপত্তা : রাখাইনে তাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সুরক্ষা এবং নিরাপত্তার গ্যারান্টি।
রাজনৈতিক অংশগ্রহণ : রাখাইনের স্থানীয় প্রশাসনে রোহিঙ্গাদের যথাযথ প্রতিনিধিত্ব।
এই শর্তগুলো পূরণ হলে রোহিঙ্গারা তাদের স্বদেশে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে আগ্রহী হতে পারে। বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এই অধিকারগুলো বাস্তবায়নে রাখাইনের নেতৃত্বকে রাজি করানোর লক্ষ্য রাখতে পারে। বাংলাদেশ তার কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে এবং আন্তর্জাতিক মহলে রোহিঙ্গাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে জোরালো প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে পারে। বিশেষভাবে, মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারের পতনের পর, রাখাইনের স্বাধীনতা বা কনফেডারেশনের পরিস্থিতি যদি স্থিতিশীল হয়, তাহলে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর জন্যে একটি নিরাপদ পরিবেশ তৈরি হতে পারে।
৫. উপসংহার
রাখাইন স্টেটের পরিস্থিতি বাংলাদেশের কূটনৈতিক নীতি এবং নিরাপত্তা কৌশলকে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে পরিণত করেছে, যা আগামীতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির অন্যতম বড়ো পরীক্ষা হতে পারে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারের পতনের ইঙ্গিত এবং রাখাইনে আঞ্চলিক শক্তির পালাবদল বাংলাদেশের জন্যে এক অনন্য সুযোগ তৈরি করেছে। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ যদি তার পররাষ্ট্র নীতি এবং নিরাপত্তা কৌশলকে দক্ষতার সাথে প্রয়োগ করতে পারে, তবে শুধু রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনই সম্ভব হবে না, বরং রাখাইন রাজ্যের স্বাধীনতা বা কনফেডারেশনের প্রশ্নেও বাংলাদেশের অবস্থান পরিষ্কার হবে।
রহমান মৃধা : গবেষক ও লেখক (সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন)