রবিবার, ১২ জানুয়ারি, ২০২৫  |   ২৯ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জের লক্ষ্মীপুরে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় গুরুতর আহত ৩ : এলাকায় আতঙ্ক
  •   শিক্ষা খাতে নজিরবিহীন রদবদল: একযোগে চার বোর্ড চেয়ারম্যানকে ওএসডি
  •   মধ্যরাতের আতঙ্ক
  •   চীনা সেনাদের ভারতের অরুণাচলে অনুপ্রবেশ: বিতর্কিত অঞ্চল নিয়ে উত্তেজনা তুঙ্গে
  •   আপনার টাকা কোথায় গেল?

প্রকাশ : ১২ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯:১৬

বাংলাদেশে ঘন ঘন ভূমিকম্প : বড়ো বিপর্যয়ের জন্যে আমরা কতোটা প্রস্তুত?

মীর আব্দুল আলীম
বাংলাদেশে ঘন ঘন ভূমিকম্প : বড়ো বিপর্যয়ের জন্যে আমরা কতোটা প্রস্তুত?

বাংলাদেশ একটি ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ। সাম্প্রতিক সময়ে ঘন ঘন ভূমিকম্পের ঘটনা দেশের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, জনসংখ্যার ঘনত্ব এবং অবকাঠামোগত দুর্বলতা বড়ো কোনো ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের দুর্বল প্রস্তুতি এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণ ভূমিকম্পের ঝুঁকি বহু গুণ বাড়িয়ে তুলেছে। ১০০ বছরের ভূমিকম্পের ইতিহাসে ছোট-বড়ো অনেক ভূমিকম্প বাংলাদেশে আঘাত হেনেছে, যা ভবিষ্যতের জন্যে সতর্ক সংকেত হিসেবে কাজ করা উচিত।

কেনো বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ?

বাংলাদেশের ভূমিকম্পপ্রবণতার প্রধান কারণ এর ভৌগোলিক অবস্থান। দেশটি তিনটি বৃহৎ টেকটোনিক প্লেট—ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান এবং বার্মা প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত। এই প্লেটগুলোর সংঘর্ষ এবং গতিশীলতা ভূমিকম্পের প্রধান কারণ। প্লেটগুলোর নিয়মিত সঞ্চালন এবং ঘর্ষণের ফলে ভূগর্ভে যে শক্তি জমা হয়, তা বড়ো ভূমিকম্পের জন্ম দিতে পারে।

বিশেষ করে সিলেট, চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ভূমিকম্পের জন্যে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এসব অঞ্চলের মাটির গঠন এবং পাহাড়ি এলাকার ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য ভূমিকম্পের সময় ভূমিধসের ঝুঁকি তৈরি করে। ঢাকা শহরও এই ঝুঁকির বাইরে নয়, কারণ এটি একটি সিল্টি বেসিনের ওপর অবস্থিত। ভূমিকম্প হলে এই এলাকার মাটি সহজেই কম্পনের তীব্রতা বাড়িয়ে তুলতে পারে।

গত ১০০ বছরে বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকম্প হয়েছে। এগুলোর মধ্যে কয়েকটি ছোট পরিসরে হলেও বড়ো ভূমিকম্পের আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলেছে।

১৮৯৭ সালের শিলং ভূমিকম্প (ম্যাগনিটিউড ৮.৭) : এটি ভারতের শিলং অঞ্চলে উৎপন্ন হয়, কিন্তু বাংলাদেশে এর ব্যাপক প্রভাব পড়ে। বিশেষত সিলেট অঞ্চলে এই ভূমিকম্পের ফলে বড়ো ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়। এটি বাংলাদেশের ভূমিকম্প প্রবণতার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।

১৯১৮ সালের আসাম ভূমিকম্প (ম্যাগনিটিউড ৭.৬) : উত্তর-পূর্ব ভারতে উৎপন্ন এই ভূমিকম্প সিলেটসহ বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে ব্যাপকভাবে অনুভূত হয়।

১৯৫০ সালের আসাম-তিব্বত ভূমিকম্প (ম্যাগনিটিউড ৮.৬) : সিলেট এবং চট্টগ্রামে এই ভূমিকম্প ব্যাপক তীব্রতা নিয়ে আঘাত হানে। যদিও বড়ো ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি, কিন্তু এটি বড়ো ধরনের বিপর্যয়ের সতর্ক সংকেত দেয়।

১৯৮৮ সালের চট্টগ্রাম ভূমিকম্প (ম্যাগনিটিউড ৭.৫) : পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে এই ভূমিকম্প বড়ো ধরনের ক্ষতি করে। অনেক ভবন ধসে পড়ে এবং বহু মানুষ হতাহত হয়।

২০০৪ সালের সুমাত্রা-আন্দামান ভূমিকম্প (ম্যাগনিটিউড ৯.১) : এটি বাংলাদেশে সরাসরি আঘাত না করলেও উপকূলীয় এলাকাগুলোতে সুনামির ঝুঁকি তৈরি করে।

২০১৬ সালের মিয়ানমার ভূমিকম্প (ম্যাগনিটিউড ৬.৮) : এই ভূমিকম্প ঢাকাসহ সারা দেশে অনুভূত হয়। এটি মানুষের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টি করে এবং ভবনের ক্ষয়ক্ষতি হয়।

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে ঘন ঘন ভূমিকম্পের ঘটনা টেকটোনিক প্লেটগুলোর চলাচল এবং তাদের মধ্যে শক্তি সঞ্চয়ের প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত। প্লেটগুলোর মধ্যকার চাপ বাড়লে ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থাকে।বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে বড়ো ভূমিকম্প হয়নি। এটি 'সিসমিক গ্যাপ' তৈরি করেছে, যা বিপুল শক্তি জমা করছে। ভবিষ্যতে এটি বড়ো ধরনের ভূমিকম্পের আকারে প্রকাশ পেতে পারে।

বড়ো ভূমিকম্প হলে বাংলাদেশের প্রস্তুতি কতোটুকু?

বড়ো ভূমিকম্প মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি অত্যন্ত দুর্বল। এর পেছনে রয়েছে বেশ কয়েকটি কারণ :

অবকাঠামোগত দুর্বলতা : ঢাকাসহ দেশের প্রধান শহরগুলোতে ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোডের যথাযথ প্রয়োগ হয় না। পুরনো ও দুর্বল ভবনের সংখ্যা বিপুল, যা ভূমিকম্পে ধসের ঝুঁকি বাড়ায়।

উদ্ধার সরঞ্জামের অভাব : বাংলাদেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্যে ফায়ার সার্ভিস এবং সিভিল ডিফেন্সসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো প্রস্তুত থাকলেও তাদের সরঞ্জাম এবং প্রযুক্তি বড়ো ভূমিকম্প মোকাবিলার জন্যে পর্যাপ্ত নয়।

জনসংখ্যার ঘনত্ব : বাংলাদেশ পৃথিবীর ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। ভূমিকম্পের সময় মানুষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি রয়েছে।

জরুরি সেবার দুর্বলতা : বড়ো ভূমিকম্পের পর চিকিৎসা, আশ্রয় এবং খাবারের সেবা দিতে বাংলাদেশের প্রস্তুতি খুবই সীমিত।

সচেতনতার অভাব : দেশের অধিকাংশ মানুষ ভূমিকম্পের সময় করণীয় সম্পর্কে সচেতন নয়। এটি প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি বাড়ায়।

ভূমিকম্পের ঝুঁকি কমানোর জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। এর মধ্যে রয়েছে :

বিল্ডিং কোডের কঠোর প্রয়োগ : নতুন ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং পুরনো ভবনগুলোর ঝুঁকি মূল্যায়ন করে সংস্কার বা পুনর্র্নিমাণ করতে হবে।

সিসমিক ম্যাপিং : পুরো দেশের সিসমিক ঝুঁকির একটি বিস্তারিত মানচিত্র তৈরি করা প্রয়োজন।

উদ্ধার কর্মীদের প্রশিক্ষণ : দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্যে ফায়ার সার্ভিস, সিভিল ডিফেন্স এবং সেনাবাহিনীকে আধুনিক সরঞ্জাম সরবরাহ এবং প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

সচেতনতা কার্যক্রম : স্কুল, কলেজ এবং কমিউনিটি পর্যায়ে ভূমিকম্প মোকাবিলার প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

জরুরি পরিকল্পনা : বড়ো ভূমিকম্পের পর ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলার জন্যে একটি জাতীয় জরুরি পরিকল্পনা থাকা জরুরি।

বাংলাদেশ একটি ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ এবং বড়ো ভূমিকম্প হলে ক্ষতির মাত্রা ভয়াবহ হতে পারে। আমাদের অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এখনই প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। দুর্যোগ মোকাবিলায় সঠিক পরিকল্পনা, প্রযুক্তি এবং জনসচেতনতা বাড়িয়ে বড়ো ধরনের বিপর্যয় রোধ করা সম্ভব। ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ রোধ করা না গেলেও এর ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই।

মীর আব্দুল আলীম : সাংবাদিক, সমাজ গবেষক; মহাসচিব, কলামিস্ট ফোরাম অফ বাংলাদেশ।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়