প্রকাশ : ০২ জানুয়ারি ২০২৫, ২৩:২৯
পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্য
মানবজনমের প্রাকৃতিক আবির্ভাব ঘটে পিতা-মাতার মাধ্যমে। নবজাতক সন্তানকে সাদরে পৃথিবীর আলো-বাতাসের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব্ গ্রহণ করেন পিতা-মাতাই। জগতের নানা ঘাত-প্রতিঘাত থেকে সযত্নে আগলে রেখে সন্তানের নিরাপদভাবে বেড়ে ওঠার মূল কারিগর পিতা-মাতা। জগত সংসারের চিরায়ত মায়াবন্ধনে তাই পিতামাতা ও সন্তানের মধ্যকার সম্পর্কই সর্বাধিক গভীরতাময়, তাৎপর্যপূর্ণ ও অর্থবহ। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই অকৃত্রিম বন্ধনকে এতই মর্যাদা দান করেছেন যে, আল্লাহর ইবাদতের পরই পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণকে স্থান দিয়েছেন। এমনকি পিতা-মাতা যদি মুশরিকও হয়, তদপুরি তাদের প্রতি অবাধ্যতা কিংবা অসম্মানসূচক আচরণ করা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। ইসলামের এই অনন্য দিক-নির্দেশনা পিতা-মাতার মর্যাদা ও অবস্থানকে সর্বোচ্চ সীমায় উন্নীত করেছে। দুঃখজনক হ’লেও সত্য যে, ইসলাম পিতা-মাতার মর্যাদাকে এত উচ্চকিত করার পরও মুসলিম সমাজের বহু গৃহে পিতা-মাতারা নিগৃহীত জীবন-যাপন করছেন। বিশেষ করে যখন তারা বৃদ্ধাবস্থায় উপনীত হন কিংবা রোগ-শোকে জর্জরিত হয়ে পড়েন, তখন তারা একেবারেই অপাংক্তেয় হয়ে ওঠেন। এমনকি এমতাবস্থায় সন্তানরা কখনও অত্যন্ত নির্মমভাবে তাদেরকে ঘরছাড়া করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন কিংবা বিধর্মী দেশগুলোর অনুকরণে প্রবীণ নিবাসে রেখে আসেন। ফলে এককালে যে সন্তানদেরকে তারা সর্বোচ্চ মমত্ব ও ভালোবাসা দিয়ে লালন-পালন করেছিলেন, সেই সন্তানদের হাতেই তারা চূড়ান্ত লাঞ্ছনার শিকার হন। শেষ জীবনটা তাদের কেটে যায় অব্যক্ত বেদনা আর হাহাকারের দীর্ঘশ্বাসে।
সন্তান যেমন পিতা-মাতার জন্য আল্লাহপ্রদত্ত শ্রেষ্ঠ উপহার, তেমনি পিতামাতা সন্তানেরজন্য দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ নেয়ামত। দু’জন বিশ্বস্ত মানুষ বহুবিধ পরিশ্রমের মাধ্যমে অন্য একজন মানুষকে তিলে-তিলে বড় করে তোলে। যার জন্য এত ত্যাগ, কষ্ট ও এত ভালোবাসা, সে হল সন্তান। আর অপর দু’জন নিঃস্বার্থ মানুষের পরিচয় পিতা ও মাতা। গর্ভ থেকে শুরু করে মা যেমন আপন সন্তানকে বহু কষ্ট ও ত্যাগ-তিতীক্ষার মাধ্যমে ধীরে-ধীরে বড় করে তুলতে সাহায্য করেন, তেমনি পিতাও সর্বোচ্চ শ্রম ঢেলে স্ত্রী-সন্তানের যাবতীয় ভরণ-পোষণ নির্বাহের কঠিন দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন। সেজন্য পৃথিবীতে সন্তানের নিকট পিতা-মাতার সম্মান ও মর্যাদা সবার উপরে। মহান আল্লাহ সমগ্র বিশ্ববাসীর একমাত্র উপাস্য ও অভিভাবক, আর পিতা-মাতা হ’লেন সন্তানদের ইহকালীন জীবনের অভিভাবক। সুতরাং সন্তানদের কাজ হলো আল্লাহতা‘আলার যাবতীয় হুকুম-আহকাম পালনের সাথে সাথে পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করা। জন্মের পর থেকে শুরু করে কৈশোর পর্যন্ত সন্তান পিতা-মাতার তত্ত্বাবধানেই থাকে এবং সম্পূর্ণ অনুগত থাকে। অতঃপর যৌবনে বা সংসার জীবনের কোন কোন ক্ষেত্রে পিতা-মাতার সঙ্গে তার সন্তানদের মতপার্থক্য দেখা দিতে পারে, এটা স্বাভাবিক। সেজন্য মহাজ্ঞানী আল্লাহতা‘আলা পিতা-মাতার সঙ্গে তার সন্তানদের বাল্য জীবনের ভালবাসার ন্যায় সারা জীবন সুসম্পর্ক অটুট ও বহাল রাখার আদেশ দিয়েছেন।
পিতা-মাতার মর্যাদা:মানব সৃষ্টির ইতিহাসে আদম ও হাওয়া ব্যতীত সকল সৃষ্টিই পিতা-মাতার মাধ্যমে পৃথিবীতে এসেছে। কেবল ঈসা (আঃ) পিতা ব্যতীত জন্মগ্রহণ করেছেন। তাই ইসলামী শরী‘আতে পিতা-মাতাকে অপরিসীম মর্যাদা দান করা হয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন তাঁর উপর বিশ্বাস স্থাপনের পরপরই পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ করাকে আবশ্যক করে দিয়েছেন। তাদের আদেশ-নিষেধ শরী‘আত বিরোধী না হ’লে তা মেনে চলার নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমার প্রতিপালক আদেশ করেছেন যে, তোমরা তাঁকে ছাড়া অন্য কারো উপাসনা কর না এবং তোমরা পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ কর। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়ে যদি তোমার নিকট বার্ধক্যে উপনীত হন, তাহ’লে তুমি তাদের প্রতি উহ্ শব্দটিও উচ্চারণ কর না এবং তাদেরকে ধমক দিয়ো না। আর তাদের সাথে নরমভাবে কথা বল। আর তাদের প্রতি মমতাবশে নম্রতার বাহু অবনমিত কর এবং বল, হে আমার প্রতিপালক! তুমি তাদের প্রতি দয়া কর যেমন তারা আমাকে ছোটকালে দয়াবশে প্রতিপালন করেছিলেন’ (বনী ইসরাঈল ১৭/ ২৩-২৪)। তিনি আরো বলেন : ‘আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহারের আদেশ দিয়েছি। তার জননী তাকে কষ্ট সহকারে গর্ভে ধারণ করেছে এবং কষ্ট সহকারে প্রসব করেছে। তাকে গর্ভে ধারণ করতে ও তার দুধ ছাড়াতে লেগেছে ত্রিশ মাস। অবশেষে সে যখন শক্তি-সামর্থ্যরে বয়সে ও চল্লিশ বছরে পৌঁছেছে, তখন বলতে লাগলো, হে আমার পালনকর্তা! আমাকে সামর্থ্য দাও, যাতে আমি তোমার নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করতে পারি। যা তুমি দান করেছ আমাকে ও আমার পিতা-মাতাকে এবং যাতে আমি তোমার পছন্দনীয় সৎকাজ করি। আমার সন্তানদেরকে সৎকর্মপরায়ণ কর, আমি তোমারই অভিমুখী হ’লাম এবং আমি আজ্ঞাবহদের অন্যতম’ (আহক্বাফ ৪৬/১৫)।
পিতা-মাতার দো‘আ কবুলযোগ্য :
পিতা-মাতার মর্যাদা এতো বেশী যে, তারা সন্তানের জন্য দো‘আ করলে আল্লাহতাদের দো‘আ ফিরিয়ে দেন না। পিতা-মাতা যদি সন্তানের জন্য ভালো দো‘আ করেন তবে তা কবুল হয়। আবার সন্তানের বিরুদ্ধে খারাপ দো‘আ করলে সেটিও আল্লাহ কবুল করে নেন। যেমন হাদীছে এসেছে-আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘তিন ব্যক্তির দো‘আ নিঃসন্দেহে কবুল হয়। মযলুমের দো‘আ, মুসাফিরের দো‘আ ও সন্তানের জন্য পিতার দো‘আ। তবে সন্তানের বিরুদ্ধে পিতা-মাতার দো‘আ করা সমীচীন নয়। যেমন হাদীসে এসেছে, রাসূল (সাঃ) বলেন, ‘তোমরা কখনো নিজেদের বা তোমাদের সন্তানদের বা তোমাদের খাদেমের বা তোমাদের মাল স¤পদের অকল্যাণ ও অমঙ্গল বা ক্ষতি চেয়ে বদ দু‘আ করবে না। কারণ, হয়ত এমন হতে পারে যে, যে সময়ে তোমরা বদ দু‘আ করলে, সেই সময়টি এমন সময় যখন আল্লাহ বান্দার সকল প্রার্থনা কবুল করেন এবং যে যা চায় তাকে তা প্রদান করেন। এভাবে তোমাদের বদদু‘আও তিনি কবূল করে নেবেন’।
পিতা-মাতার দান ফেরতযোগ্য :
কাউকে কোন উপহার দিলে ফেরত নেওয়া শরী‘আত সম্মত নয়। কিন্তু সন্তানের নিকট পিতা-মাতার অধিক মর্যাদার কারণে তাদের কর্তৃক দান ফিরিয়ে নেওয়ার অধিকার দেওয়া হয়েছে। যেমন হাদীসে এসেছে, ইবন ওমর ও ইবন ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, উপহার প্রদানের পর তা আবার ফিরিয়ে নেয়া কারো জন্য বৈধ নয়। তবে পিতা তার সন্তানকে দেয়া উপহার ফিরিয়ে নিতে পারে। যে ব্যক্তি কাউকে কিছু দিয়ে তা আবার ফিরিয়ে নেয় সে হ’ল কুকুরের মত; সে খায়, যখন পেট ভরে যায় তখন বমি করে এবং পরে নিজের বমি নিজেই খায়’।
মায়ের বিশেষ মর্যাদা :
পিতা-মাতার ক্ষেত্রে কারো মর্যাদা খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। কেননা মর্যাদার দিক থেকে কোন ক্ষেত্রে পিতা অগ্রগামী আবার কোন ক্ষেত্রে মা। ঠিক পরীক্ষার মত পিতা অংকে ভাল তো মা ইংরেজীতে, আবার পিতা হাদীসে ভাল তো মা কুরআনে। তবে গর্ভধারণ, সন্তান জন্মদান ও দুগ্ধপান করা কেবল মায়েরাই করে থাকেন। এতে পিতার কোন অংশদারিত্ব নেই। এজন্য আল্লাহতা‘আলা মাকে তিনগুণ বেশী মর্যাদা দান করেছেন। এর পরের ক্ষেত্রগুলোতে পিতা-মাতার সমান অবদান থাকে। যেমন আল্লাহতা‘আলা বলেন,‘আর আমরা মানুষকে তার পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে কষ্টের পর কষ্ট বরণ করে গর্ভে ধারণ করেছে। আর তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে। অতএব তুমি আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। (মনে রেখ, তোমার) প্রত্যাবর্তন আমার কাছেই’ (লোক্বমান ৩১/১৪)।
মায়ের পদতলে সন্তানের জান্নাত :
মা এতো মর্যাদাবান যে, তার পদতলে সন্তানের জান্নাত রয়েছে। যেমন হাদীসে এসেছে, মু‘য়াবিয়া ইবন জাহেমাহ আস-সুলামী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, জাহেমাহ রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকটে এসে বলল, হে আল্লাহ্র রাসূল! আমি জিহাদে যাওয়ার উদ্দেশ্যে আপনার সাথে পরামর্শ করার জন্য এসেছি। তিনি আমাকে বললেন, তোমার কি মা আছে? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, ‘তুমি তার নিকটে থাক। কেননা জান্নাত তার পায়ের নীচে’। কোন বর্ণনায় রয়েছে, তিনি বললেন, তোমার কি পিতা-মাতা আছেন? আমি বললাম, হ্যাঁ। তখন তিনি বললেন ‘তুমি তাদের নিকটে থাক। কেননা জান্নাত রয়েছে তাদের পায়ের নীচে’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, জাহেমাহ আস-সুলামী রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ডান দিক থেকে ও বাম দিক থেকে দু’বার এসে বলেন, আমি আপনার সাথে জিহাদে যেতে চাই এবং এর মাধ্যমে আল্লাহ্র সন্তুষ্টি ও আখেরাত কামনা করি। জবাবে রাসূল (সাঃ) বলেন, তোমার মা কি বেঁচে আছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। রাসূল (সাঃ) বললেন, ‘ফিরে যাও। তার সাথে সদাচরণ কর’। অবশেষে তৃতীয় বার সম্মুখদিক থেকে এসে একই আবেদন করেন। তখন রাসূল (সাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করেন, তোমার মা কি জীবিত আছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তখন রাসূল (সাঃ) বললেন, ‘তোমার ধ্বংস হোক! তার পায়ের কাছে থাক। সেখানেই জান্নাত রয়েছে’।মায়ের মর্যাদা তিনগুণ বেশী :
মা সন্তানের প্রতি অত্যন্ত দয়াদ্র ও স্নেহশীল হওয়ার কারণে আল্লাহতার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দিয়েছেন। হাদীসে এসেছে, আনাস ইবন মালেক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, এক মহিলা আয়েশা (রাঃ)-এর কাছে এলে তিনি তাকে তিনটি খেজুর দেন। সে তার ছেলে দু’টিকে একটি করে খেজুর দেয় এবং নিজের জন্য একটি রেখে দেয়। তারা খেজুর দু’টি খেয়ে তাদের মায়ের দিকে তাকাল এবং অবশিষ্ট খেজুরটি পেতে চাইল। মা খেজুরটি দুই টুকরা করে প্রত্যেককে অর্ধেক অর্ধেক করে দিল। নবী (সাঃ) ঘরে আসলে আয়েশা (রাঃ) তাকে বিষয়টি অবহিত করেন। তখন তিনি বলেন, এতে তোমার বিস্মিত হওয়ার কি আছে? সে তার ছেলে দু’টির প্রতি দয়া পরবশ হওয়ার কারণে আল্লাহ তার প্রতি দয়া পরবশ হয়েছেন’। তিনটি কারণে পিতা অপেক্ষা মায়ের মর্যাদা তিনগুণ বেশী। (১) গর্ভধারণ (২) কষ্টের পর কষ্ট বরণ এবং (৩) দুই বছর যাবৎ বুকের দুধ খাওয়ানো। হাদীসে এসেছে, আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, এক ব্যক্তি রাসূল (সাঃ)-এর নিকট এসে জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহ্র রাসূল! আমার নিকট কে উত্তম ব্যবহার পাওয়ার অধিক হকদার? তিনি বললেন, তোমার মা। লোকটি বলল, অতঃপর কে? নবী করীম (সাঃ) বললেন, তোমার মা। সে বলল, অতঃপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সে বলল, অতঃপর কে? তিনি বললেন, অতঃপর তোমার পিতা’। অন্য হাদীছে এসেছে, আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, এক ব্যক্তি রাসূল (সাঃ)-এর নিকট এসে জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল! আমার নিকট কে উত্তম ব্যবহার পাওয়ার অধিক হকদার? তিনি বললেন, তোমার মা, তারপর তোমার মা, তারপর তোমার মা, তারপর তোমার পিতা, তারপর যে তোমার সবচেয়ে নিকটবর্তী’।
অন্যত্র এসেছে, মিকদাম ইবনে মা‘দীকারিব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘আল্লাহ তোমাদের মায়েদের স¤পর্কে তোমাদের তিনবার উপদেশ দিচ্ছেন, অতঃপর তোমাদের পিতাদের স¤পর্কে তোমাদের উপদেশ দিচ্ছেন, অতঃপর নৈকট্যের .মানুসারে নিকটাত্মীয় স¤পর্কে তোমাদের উপদেশ দিচ্ছেন’। সর্বপ্রথম সদ্ব্যবহার পাওয়ার হকদার মা, তারপর পিতা, তারপর ছেলে-মেয়ে, তারপর দাদাগণ-নানাগণ ও রক্ত স¤পর্কীয় মাহরাম আত্নীয়গণ। যেমন চাচা ও ফুফুগণ, মামা ও খালাগণ। এরপর পর্যায়ের নিকটাত্মীয়গণ। এরপর রক্তস¤পর্কীয় গায়ের মাহরাম (যাদের সাথে বিবাহ হালাল বা বৈধ)। যেমন-চাচতো ভাই, চাচাতো বোন, মামাতো ভাই, মামাতো বোন ইত্যাদি। এরপর শ্বশুর বাড়ির আত্নীয়দের সাথে সদাচরণ করতে হবে। এরপর খাদেম বা কর্মচারীদের সাথে, প্রতিবেশীদের সাথে। এর মধ্যে যার বাড়ির কাছে সে বেশী হকদার, এভাবে পর্যায়ে দূরের আত্মীয়-স্বজন।
পাপ মোচনে মায়ের সেবা:
মায়ের খেদমত পাপ মোচনে সহায়ক। এজন্য কোন ব্যক্তি পাপ করলে রাসূল (সাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম তাদের মায়ের খেদমত করার পরামর্শ দিতেন। যেমন হাদীসে এসেছে, ইবন ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, এক ব্যক্তি তার নিকট উপস্থিতি হয়ে বলল, আমি এক মহিলাকে বিবাহের প্রস্তাব দিলাম। সে আমাকে বিবাহ করতে অস্বীকার করল। অপর এক ব্যক্তি তাকে বিবাহের প্রস্তাব দিলে সে তাকে বিবাহ করতে পছন্দ করল। এতে আমার আত্মমর্যাদাবোধে আঘাত লাগলে আমি তাকে হত্যা করি। আমার কি তওবার কোন সুযোগ আছে? তিনি বলেন, তোমার মা কি জীবিত আছেন? সে বলল, না। তিনি বলেন, তুমি মহামহিম আল্লাহর নিকট তওবা কর এবং যথাসাধ্য তার নৈকট্য লাভের চেষ্টা করো। (আতা‘ রহঃ বলেন) আমি ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর নিকট গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তার মা জীবিত আছে কি-না তা আপনি কেন জিজ্ঞেস করলেন? তিনি বলেন, ‘আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য মায়ের সাথে সদাচরণের চেয়ে উত্তম কোন কাজ আমার জানা নেই’। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, তিনি বলেন, ‘তোমার পিতা-মাতা বা তাদের একজন কি জীবিত আছেন? সে বলল, না। তিনি বললেন, যথাসাধ্য আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করো। লোকটি বের হয়ে যাওয়ার পর আমরা তাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, তার পিতা-মাতা বা তাদের একজন যদি জীবিত থাকত তাহ’লে তার জন্য আশা করতাম। কারণ পিতা-মাতার সাথে সদাচরণ অপেক্ষা গুনাহ মোচনকারী আর কিছুই নেই’।
পিতা-মাতার আনুগত্য করা :
পিতা-মাতা সন্তানের জন্য আল্লাহতা‘আলার পক্ষ থেকে বড় নেয়ামত। তারা সর্বদা সন্তানের কল্যাণের কথা চিন্তা করেন। অনেক সময় পিতা-মাতার মতের সাথে সন্তানেরমতের অমিল হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে সন্তানের জন্য আবশ্যক হ’ল পিতা-মাতার আনুগত্য করা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘ইবাদত কর আল্লাহর, শরীক করো না তাঁর সাথে অপর কাউকে, পিতামাতার সাথে সৎ ও সদয় ব্যবহার কর এবং নিকটাত্মীয়, ইয়াতীম-মিসকীন, নিকট প্রতিবেশী, দূর প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথী, মুসাফির এবং দাস-দাসীর প্রতিও। নিশ্চয়ই আল্লাহ পছন্দ করেন না দাম্ভিক-অহংকারীকে’ (নিসা ৪/৩৬)। তিনি আরো বলেন, ‘আর যখন আমরা বনী ইসরাঈল কাছ থেকে অঙ্গীকার নিলাম যে, তোমরা আল্লাহ ব্যতীত কারো দাসত্ব করবে না এবং পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম ও অভাবগ্রস্থদের সাথে সদ্ব্যবহার করবে, মানুষের সাথে উত্তম কথা বলবে’ (বাক্বারাহ ২/৮৩)। অন্যত্র আল্লাহতা‘আলা বলেন, তুমি বল, এস আমি তোমাদেরকে ঐ বিষয়গুলো পাঠ করে শুনাই যা তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের উপর হারাম করেছেন। আর তা হ’ল এই যে, তোমরা তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক করবে না। পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করবে। দরিদ্রতার ভয়ে তোমরা তোমাদের সন্তানদের হত্যা করবে না। আমরাই তোমাদেরকে ও তাদেরকে জীবিকা প্রদান করে থাকি। (আন‘আম ৬/১৫১)। অন্যত্র আল্লাহ নিজের অবদানের পাশাপাশি মায়ের অবদান সন্তানদের স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের মায়ের গর্ভ থেকে বের করেছেন। তোমরা কিছুই জানতে না। তিনি তোমাদেরকে কর্ণ, চক্ষু ও অন্তর দিয়েছেন, যাতে তোমরা অনুগ্রহ স্বীকার কর’ (নাহল ১৬/৭৮)। পবিত্র কুরআনে পিতা-মাতার হক সমূহকে আল্লাহতা‘আলার ইবাদত ও আনুগত্যের সাথে যুক্ত করে বর্ণনা করা হয়েছে। যাতে বান্দা তার জীবদ্দশায় সতর্কতা বজায় রেখে একনিষ্ঠভাবে পিতা-মাতার ন্যায়সঙ্গত অধিকার পূর্ণ করতে সক্ষম হয়। পিতামাতাকেও তাদের গর্ভধারণকালীন কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে, যাতে পিতা-মাতা সন্তানকে কোন সময় আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ করতে না বলে। আল্লাহতা‘আলা বলেন, ‘তিনিই আল্লাহ যিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন একজন মাত্র ব্যক্তি (আদম) থেকে। অতঃপর তার থেকে সৃষ্টি করেছেন তার স্ত্রী (হাওয়া)-কে। যাতে সে তার নিকটে প্রশান্তি লাভ করে। অতঃপর যখন সে তাকে আবৃত্ত করে, তখন সে হালকা গর্ভধারণ করে। আর এটা নিয়েই সে চলাফেরা করে। অতঃপর যখন তা ভারি হয়, তখন স্বামী-স্ত্রী উভয়ে তাদের প্রতিপালককে ডাকে, যদি তুমি আমাদেরকে সুসন্তানদাও, তাহ’লে অবশ্যই আমরা কৃতজ্ঞ বান্দাদের অর্ন্তভুক্ত হব। অতঃপর যখন আল্লাহতাদেরকে সুঠামদেহী সন্তানদান করেন, তখন তারা আল্লাহর এই দানে তার সঙ্গে অন্যকে শরীক নির্ধারণ করে। অথচ তারা যেসব বিষয়কে শরীক সাব্যস্থ করে, আল্লাহতাদের থেকে অনেক ঊর্ধ্বে। তারা কি এমন বিষয়কে শরীক নির্ধারণ করে যারা কিছুই সৃষ্টি করে না বরং তারা নিজেরাই সৃষ্ট ’ (আ‘রাফ ৭/১৮৯-১৯১)। যুরারাহ বিন আওফা হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘জনৈক ব্যক্তি ইবন ‘আব্বাস (রাঃ)-এর নিকট এসে বলল, আমি রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেতে চাই। অথচ আমার পিতা-মাতা আমাকে বাধা দেন। তিনি বললেন, পিতা-মাতার অনুগত্য কর এবং অপেক্ষা কর। কেননা খুব শীঘ্রই রোমকরা তুমি ছাড়া এমন ব্যক্তির সাক্ষাৎ লাভ করবে, যে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে’।
পিতা-মাতার আনুগত্যের ব্যাপারে রাসূল (সাঃ)-এর উপদেশ :
রাসূল (সাঃ) ছাহাবীগণের অবস্থা বিবেচনা করে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিষয়ে উপদেশ দিতেন। কখনো শিরকের বিরুদ্ধে উপদেশ দিতেন। কখনো অন্যান্য অপরাধ হ’তে বিরত থাকার নছীহত করতেন। বিশেষ করে তিনি পিতা-মাতার আনুগত্য করার উপদেশ অধিকহারে দিয়েছেন। যেমন হাদীসে এসেছে, আবু দ্দারদা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ)-আমাকে নয়টি ব্যাপারে অছিয়ত করেছেন, (১) আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করো না, যদিও তোমাকে হত্যা করা হয় অথবা অগ্নিদগ্ধ করা হয়। (২) ইচ্ছাকতৃ ভাবে ফরজ ছালাত ত্যাগ করো না, যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় ফরজ ছালাত ত্যাগ করবে তার স¤পর্কে আমার কোন দায়িত্ব নাই। (৩) মদ্যপান করো না, কেননা তা সকল অনাচারের চাবি (মূল)। (৪) তোমার পিতা-মাতার আনুগত্য করবে, তারা যদি তোমাকে দুনিয়া ছাড়তেও আদেশ করেন তবে তাই করবে। (৫) শাসকদের সাথে বিবাদে জড়াবে না, যদিও দেখ যে, তুমিই (হক্বের উপর প্রতিষ্ঠিত তবুও)। (৬) যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করো না, যদি তুমি ধ্বংস হও এবং তোমার সাথীরা পলায়ন করে। (৭) তোমার সামর্থ্য অনুসারে পরিবারের জন্য ব্যয় করো। (৮) তোমার পরিবারের উপর থেকে লাঠি তুলে রাখবে না (অর্থাৎ শাসনের মধ্যে রাখবে)। (৯) তাদের মধ্যে মহামহিম আল্লাহর ভয় জাগ্রত রাখবে’। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, তিনি বলেন, ‘তোমার পিতা-মাতার আনুগত্য করবে, যদিও তারা তোমাকে তোমার সম্পদ থেকে ও কেবল তোমার জন্য নির্দিষ্ট সম্পদ থেকে বঞ্চিত করে’।
আল্লাহর অবাধ্যতায় পিতা-মাতার আনুগত্য নেই :
পিতা-মাতা তার সন্তানকে শরী‘আত বিরোধী কোন কাজের আদেশ করলে, সন্তান তা প্রত্যাখ্যান করলেও কোন দোষ হবে না। যেমন আল্লাহতা‘আলা স্বীয় কালামে বলেছেন, ‘আর যদি পিতা-মাতা তোমাকে চাপ দেয় আমার সাথে কাউকে শরীক করার জন্য, যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তাহ’লে তুমি তাদের কথা মানবে না। তবে পার্থিব জীবনে তাদের সাথে সদ্ভাব রেখে বসবাস করবে। আর যে ব্যক্তি আমার অভিমুখী হয়েছে, তুমি তার রাস্তা অবলম্বন কর। অতঃপর তোমাদের প্রত্যাবর্তন আমারই নিকটে। অতঃপর আমি তোমাদেরকে তোমাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে অবহিত করব’ (লোক্বমান ৩১/১৫) এখানে শিরক বলতে আল্লাহর সত্তা বা তাঁর গুণাবলী ও তাঁর ইবাদতে শরীক করা বুঝায়। একইভাবে আল্লাহর বিধানের সাথে অন্যের বিধানকে শরীক করা বুঝায়। ধর্মের নামে ও রাষ্ট্রের নামে মানুষের মনগড়া সকল বিধান এর মধ্যে শামিল। অতএব পিতা-মাতা যদি সন্তানকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীসের বাইরে অন্য কিছু করতে চাপ প্রয়োগ করেন, তবে সেটি মানতে সন্তান বাধ্য নয়। কিন্তু অন্য সকল বিষয়ে সদাচরণ করবে (কুরতুবী, লোক্বমান ৩১/১৫ আয়াতের তাফসীর দ্রষ্টব্য)। মুছ‘আব বিন সা‘দ তার পিতা সা‘দ বিন খাওলা হ’তে বর্ণনা করেন যে, আমার মা একদিন আমাকে কসম দিয়ে বলেন, আল্লাহ কী আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের নির্দেশ দেননি? কসম! আমি কিছুই খাব না ও পান করব না, যতক্ষণ না মৃত্যুবরণ করব অথবা তুমি মুহাম্মাদ (সাঃ) অস্বীকার করবে’। ফলে যখন তারা তাকে খাওয়াতেন, তখন গালের মধ্যে লাঠি ভরে দিয়ে ফাঁক করতেন ও তরল খাদ্য দিতেন। এভাবে তিন দিন যাওয়ার পর যখন মায়ের মৃত্যু ঘনিয়ে আসল, তখন সূরা আনকাবূত এর ৮নং আয়াত নাযিল হ’ল, ‘আর আমরা মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি যেন তারা পিতা-মাতার সাথে (কথায় ও কাজে) উত্তম ব্যবহার করে। তবে যদি তারা তোমাকে আমার সাথে এমন কিছুকে শরীক করার জন্য চাপ দেয়, যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই, সে বিষয়ে তুমি তাদের কথা মান্য করো না। আমার কাছেই তোমাদের প্রত্যাবর্তনস্থল। অতঃপর আমি তোমাদের জানিয়ে দেব যেসব কাজ তোমরা করতে’। মানব জাতিকে এক আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্য করার জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে। অতঃপর শ্রেষ্ঠত্বের এই মর্যাদা রক্ষায় তাকে প্রয়োজনীয় জ্ঞান-বুদ্ধি দান করা হয়েছে। কিন্তু মানবজাতির শত্রু ইবলীস ইবাদতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ফলে সন্তানকে সতর্ক করা হয়েছে, যাতে শয়তানের অনুগত কোন মুশরিক পিতা-মাতা পিতৃত্বের দাবি নিয়ে নিজ সন্তানদের শিরক করায় বাধ্য করতে না পারে। কারণ শিরক হলো অমার্জনীয় পাপ। এখানে মহান আল্লাহর পক্ষ হ’তে অধিকার প্রাপ্ত পিতা-মাতা ও সন্তান উভয়কেই শিরকমুক্ত থেকে ইসলামের প্রতি সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণের কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পবিত্র কুরআনে বিধৃত ইবরাহীম (আঃ)-এর কাহিনী অবলম্বনে পিতা কর্তৃক পুত্রকে শিরকের পথে আহ্বান এবং পুত্র কর্তৃক পিতাকে সত্যের পথে আহ্বানের দলীল পাওয়া যায়। ইবরাহীম (আঃ)-এর পিতা মূর্তিপূজাকে তথা মুশরিক ছিলেন। অথচ ইবরাহীম (আঃ) ছিলেন সুপথপ্রাপ্ত। মহান আল্লাহবলেন,স্মরণ করুন, যখন ইবরাহীম পিতা আযরকে বললেন, তুমি কি প্রতি মাসমূহকে উপাস্য মনে কর? আমি দেখতে পাচ্ছি যে, তুমি ও তোমার সম্প্রদায় প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতায় রয়েছ’ (আন‘আম ৬/৭৪)। অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন, ‘ইতিপূর্বে আমরা ইবরাহীমকে সৎপথের জ্ঞান দান করেছিলাম। আর আমরা তার সম্পর্কে সম্যক অবগত ছিলাম। যখন তিনি তার পিতা ও সম্প্রদায়কে বললেন, এই মূর্তিগুলি কী, যাদের পূজায় তোমরা রত আছ? তারা বলল, আমরা আমাদের বাপ-দাদাদেরকে এদের পূজারী হিসাবে পেয়েছি। তিনি বললেন, তোমরা ও তোমাদের বাপ-দাদারা স্পষ্ট ভ্রান্তির মধ্যে রয়েছ’ (আম্বিয়া ২১/৫১-৫৪)। ইবরাহীম (আঃ) তাঁর পিতার শিরকের আহ্বানে সাড়া দেননি। কারণ তাঁর পিতা আল্লাহর বিরুদ্ধে আহ্বান করেছিল।
পিতা-মাতার সামনে উচ্চস্বরে কথা না বলা :
পিতা-মাতার মাধ্যমে মানুষ পৃথিবীতে আগমন করে। এক সময় তারাও বার্ধক্যে উপনীত হন। তখন তাদের মন-মানসিকতা শিশুদের মত হয়ে যায়। শিশুরা যেমন উচ্চবাক্য শুনলে কষ্ট পেয়ে কান্নাকাটি করে, তেমনি পিতা-মাতারও এমন অবস্থায়। সেজন্য তাদের সামনে উচ্চস্বরে কথা বলতে আল্লাহ নিষেধ করেছেন। আল্লাহতা‘আলা বলেন, ‘তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়ে যদি তোমার নিকট বার্ধক্যে উপনীত হন, তাহ’লে তুমি তাদের প্রতি উহ্ শব্দটিও উচ্চারণ করো না এবং তাদেরকে ধমক দিয়ো না। তুমি তাদের সাথে নম্রভাবে কথা বল’ (ইসরা ১৭/২৩)। পিতা-মাতার সেবাযত্ন ও আনুগত্য করা কোন সময়ই বয়সের গণ্ডীতে সীমাবদ্ধ নয়। সর্বাবস্থায় এবং সব বয়সেই পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করা ওয়াজিব। কিন্তু বার্ধক্যে উপনীত হলে পিতা-মাতা সন্তানের সেবাযত্নের বেশী মুখাপেক্ষী হয়ে পড়ে এবং তাদের জীবন কোন কোন সময় সন্তানদের দয়া ও কৃপার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। তখন সন্তানেরপক্ষ থেকে সামান্য অবহেলা দেখলেও তাদের অন্তরে তা গভীর বেদনা ও ক্ষতের সৃষ্টি করে। অপরদিকে বার্ধক্যের উপসর্গসমূহ স্বভাবগতভাবে মানুষের মেজাজকে খিটখিটে করে দেয়। তদুপরি বার্ধক্যের শেষ প্রান্তে যখন বুদ্ধি-বিবেচনাও লোপ পায়, তখন পিতা-মাতার চাওয়া-পাওয়া পূরণ করা অনেক সময় সন্তানের পক্ষে কষ্টকর হয়। আল্লাহতা‘আলা এসব অবস্থাতেও পিতা-মাতার মনে তুষ্টি ও সুখ-শান্তি বিধানের আদেশ দেয়ার সাথে সাথে সন্তানকে তার শৈশবকাল স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, আজ পিতা-মাতা তোমার যতটুকু মুখাপেক্ষী, এক সময় তুমিও তদপেক্ষা বেশী তাদের মুখাপেক্ষী ছিলে। তখন তাঁরা যেমন নিজেদের আরাম-আয়েশ ও কামনা-বাসনা তোমার জন্যে কুরবান করেছিলেন এবং তোমার অবুঝ কথাবার্তাকে হেমমতার আবরণ দ্বারা ঢেকে নিয়েছিলেন, তেমনি মুখাপেক্ষিতার এই দুঃসময়ে বিবেক ও সৌজন্যবোধের দাবী হল, তাদের পূর্ব ঋণ শোধ করা। ‘উফ’ বাক্যে এদিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে, যা দ্বারা বিরক্তি প্রকাশ পায়। এমনকি তাদের কথা শুনে বিরক্তিবোধক দীর্ঘশ্বাস ছাড়াও এর অর্ন্তভুক্ত। মোট কথা, যে কথায় পিতা-মাতার সামান্য কষ্ট হয়, তাও নিষিদ্ধ। বিশেষ করে বার্ধক্যে তাঁদেরকে ধমক দিতে এমনকি তাদের প্রতি উহ্ শব্দটি ব্যবহার করতেও নিষেধ করেছেন। কেননা বার্ধক্যে তাঁরা দুর্বল ও অসহায় হয়ে যান। পক্ষান্তরে সন্তানরা হয় সবল, উপার্জনক্ষম ও সংসারের সব কিছুর ব্যবস্থাপক। এছাড়া যৌবনের উন্মাদনাময় উদ্যম এবং বার্ধক্যের ভুক্তপূর্ব উষ্ণ অভিজ্ঞতার মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এরূপ ক্ষেত্রে পিতা-মাতার প্রতি আদব ও শ্রদ্ধার দাবীসমূহের প্রতি খেয়াল রাখার অত্যন্তকঠিন য়ে দাঁড়ায়। তাই আল্লাহর কাছে সন্তোষভাজন সেই-ই হবে, যে তাঁদের শ্রদ্ধার দাবী পূরণ ও প্রাপ্য অধিকার আদায়ের ব্যাপারে যত্নবান হবে।
পিতা-মাতা যুলুম করলেও তাদের খিদমত করা :
পিতা-মাতা যেমন বয়োবৃদ্ধ, তেমনি তারা জ্ঞানেও বৃদ্ধ। সেজন্য তারা যেকোন সিদ্ধান্ত বুঝে ও জেনে গ্রহণ করে থাকেন। আর যুবকেরা কাজ করে জোশে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে পিতা-মাতার সিদ্ধান্ত সন্তানেরনিকট সঠিক মনে নাও হতে পারে। তার নিকট মনে হতে পারে এটি যুলুম। এই অবস্থাতেও পিতা-মাতার আনুগত্য করা ও তাদের সেবা করা আবশ্যক। রাসূল (সাঃ) বলেন, ‘তোমার পিতা-মাতার আনুগত্য করবে, তারা যদি তোমাকে দুনিয়া ছাড়তেও আদেশ করেন তবে তাই করবে’। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, তিনি বলেন, ‘তোমার পিতা-মাতার আনুগত্য করবে, যদিও তারা তোমাকে তোমার সম্পদ থেকে ও কেবল তোমার জন্য নির্দিষ্ট যাবতীয় বস্তু থেকে বঞ্চিত করে’।
পিতা-মাতার প্রতি খরচ করা :
ভালো পথে সম্পদ ব্যয় করার ক্ষেত্রে পিতা-মাতাকে সর্বাগ্রে স্থান দেওয়া হয়েছে। আল্লাহতা‘আলা বলেন, ‘লোকেরা তোমাকে জিজ্ঞেস করছে, কিভাবে খরচ করবে? তুমি বলে দাও যে, ধন-সম্পদ হ’তে তোমরা যা ব্যয় করবে, তা তোমাদের পিতা-মাতা, নিকটাত্মীয়, ইয়াতীম, মিসকীন ও মুসাফিরদের জন্য ব্যয় কর। আর মনে রেখ, তোমরা যা কিছু সৎকর্ম করে থাক, আল্লাহসে বিষয়ে সম্যকরূপে অবগত’ (বাক্বারাহ ২/২১৫)। রাসূল (সাঃ) বলেন, ‘প্রথমে নিজের জন্য ব্যয় কর। এরপর অবশিষ্ট থাকলে পরিজনের জন্য ব্যয় কর। নিজ পরিজনের জন্য ব্যয় করার পরও যদি কিছু অবশিষ্ট থাকে তবে নিকটাত্নীদের জন্য ব্যয় কর। আত্মীয়-স্বজনদেরকে দান করার পরও যদি কিছু অবশিষ্ট থাকে তাহ’লে এদিক অর্থাৎ সম্মুখে ডানে-বামে ব্যয় করবে’। আর পিতা-মাতা পরিজনের অন্যতম সদস্য। হাদীসে এসেছে, আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘একদা আমরা রাসূল (সাঃ)-এর সাথে বসা ছিলাম। হঠাৎ করে একজন যুবক ছানিয়া নিম্ন ভূমি থেকে আগমন করল। তাকে গভীর দৃষ্টিতে অবলোকন করে বললাম, হায়! যদি এই যুবকটি তার যৌবন, উদ্যম ও শক্তি আল্লাহর পথে ব্যয় করত! বর্ণনাকারী বলেন, রাসূল (সাঃ) আমাদের বক্তব্য শুনে বললেন, কেবল নিহত হ’লেই কি সে আল্লাহর পথে থাকবে? যে ব্যক্তি মাতা-পিতার খেদমতে সচেষ্টা থাকবে সে আল্লাহর পথে। যে পরিবার-পরিজনের কল্যাণের জন্য চেষ্টায় রত থাকবে সে আল্লাহর পথে। যে ব্যক্তি নিজেকে গোনাহ থেকে রক্ষার চেষ্টায় রত থাকবে সে আল্লাহর পথে। আর যে ব্যক্তি সম্পদের অধিকতর প্রাচুর্যের নেশায় মত্ত থাকবে সে শয়তানের পথে। আরেকটি হাদীছে এসেছে, আমর ইবন শু‘আইব (রহঃ) থেকে পর্যায়ক্রমে তার পিতা ও দাদার সূত্রে বর্ণিত। এক ব্যক্তি নবী (সাঃ)-এর নিকট এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমার স¤পদ ও সন্তান আছে। আমার পিতা আমার স¤পদের মুখাপেক্ষী। তিনি বলেন, তুমি ও তোমার সম্পদ উভয়ই তোমার পিতার। তোমাদের সন্তানতোমাদের জন্য সর্বোত্তম উপার্জন। সুতরাং তোমরা তোমাদের সন্তানদের উপার্জন থেকে খাবে’।
পিতা-মাতার প্রতি খরচের ক্ষেত্রে মাকে অগ্রাধিকার দেওয়া :
পিতা-মাতার উভয়ের প্রতি খরচ করা সন্তানের জন্য আবশ্যক। তবে মায়ের অধিক অবদান থাকার কারণে মাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। যেমন হাদীছে এসেছে, তারিক্ব মুহারিবী (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমরা মাদীনায় আগমন করলাম, আর তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) দাঁড়িয়ে ভাষণ দিচ্ছিলেন, তিনি তাতে বলছিলেন, দাতার হাত উঁচু (মর্যাদাস¤পন্ন)। তোমার পোষ্যদের মধ্যে দানের কাজ আরম্ভ কর। (যেমন) তোমার মা, তোমার বাবা, তোমার বোন, ভাই; এভাবে যে যত তোমার নিকটাত্নীয় (তাকে মর্যাদা দানের ব্যাপারে অগ্রাধিকার দাও)।
শেষ বয়সে পিতা-মাতাকে সঙ্গ দেওয়া :
যৌবনের উদ্যমতা ও কর্মচঞ্চল বয়সসীমার চৌহদ্দি মাড়িয়ে এক সময় পিতা-মাতাও বার্ধক্যে উপনীত হন। এসময় তারা শিশুমনা হয়ে যান। ফলে তারা শিশুদের মত সঙ্গ চায়। শিশুরা যেমন পিতা-মাতা বা আত্মীয়-স্বজনের সাথে খেলতে, ঘুরতে বা বেড়াতে চায়, তেমনি বৃদ্ধ বয়সে পিতা-মাতাও সঙ্গ চায়, ঘুরতে চায়, আত্মীয়-স্বজনের বা সন্তানের সাক্ষাৎ চায়। এ সময় সন্তানের জন্য আবশ্যক হ’ল তাদের সাথে অবস্থানকরা বা তাদেরকে নিজের কাছে রাখা। এ সময় তাদের সঙ্গ দিলে বরকত লাভ করা যায়। বৃদ্ধ মানুষ পৃথিবীতে আছে বিধায় এ ধরা কল্যাণ ও বরকতময়। ইসলামে বদ্ধৃ পিতা-মাতার খিদমত ও সেবা করার ফযীলত ও গুরুত্ব বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন হাদীছে এসেছে, আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ) বলেন, তার নাক ধূলায় ধূসরিত হৌক (৩ বার)। বলা হ’ল, তিনি কে হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন, যে ব্যক্তি তার পিতা-মাতা উভয়কে কিংবা একজনকে বৃদ্ধাবস্থায় পেল, অথচ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারল না’
অমুসলিম পিতা-মাতার সেবা করা :
পিতা-মাতা অমুসলিম হ’লেও তারা জন্মদাতা তাদের স্নেহ-ভালোবাসায় সন্তান বড় হয়ে উঠে। সেজন্য তাদের সাথে সর্বাবস্থায় সদাচরণ করতে হবে। তারা আল্লাহ্ ও রাসূল বিরোধী কোন আদেশ না করলে তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করতে হবে। আল্লাহতা‘আলা বলেন, ‘নবী (মুহাম্মাদ) মুমিনদের নিকট তাদের নিজেদের অপেক্ষা অধিক ঘনিষ্ঠ এবং তাঁর স্ত্রীগণ তাদের (মুমিনদের) মা। আর আল্লাহর কিতাবে রক্ত সম্পর্কীয়গণ পরস্পরের অধিক নিকটবর্তী অন্যান্য মুমিন ও মুহাজিরগণের চাইতে। তবে তোমরা যদি তোমাদের বন্ধুদের প্রতি সদাচরণ কর তাতে বাধা নেই। আর এটাই মূল কিতাবে (অর্থাৎ লওহে মাহফূযে) লিপিবদ্ধ আছে (যার কোন নড়চড় হয় না) (আহযাব ৩৩/৬)।
আল্লাহতা‘আলা অন্যত্র বলেন, ‘আর যদি পিতা-মাতা তোমাকে চাপ দেয় আমার সাথে কাউকে শরীক করার জন্য, যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তাহ’লে তুমি তাদের কথা মানবে না। তবে পার্থিব জীবনে তাদের সাথে সদ্ভাব রেখে বসবাস করবে। আর যে ব্যক্তি আমার অভিমুখী হয়েছে, তুমি তার রাস্তা অবলম্বন কর। অতঃপর তোমাদের প্রত্যাবর্তন আমারই নিকটে। অতঃপর আমি তোমাদেরকে তোমাদের কতৃকর্ম সম্পর্কে অবহিত করব’ (লোকমান ৩১/১৫)। হাদীছে এসেছে, সা‘দ ইবন আবু ওয়াক্কাছ (রাঃ) বলেন, ‘আমার স¤পর্কে আল্লাহর কিতাবের চারটি আয়াত নাযিল হয়। (১) আমার মা শপথ করেন যে, আমি যতক্ষণ মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে ত্যাগ না করব ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি পানাহার করবেন না। এই প্রসঙ্গে মহামহিম আল্লাহনাযিল করেন, ‘পিতা-মাতা যদি তোমাকে আমার সাথে এমন কিছু শরীক করতে চাপ দেয় যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তবে তুমি তাদের আনুগত্য করবে না এবং দুনিয়াতে তাদের সাথে সদ্ভাবে বসবাস করবে’ (লোকমান ৩১/১৫)। অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, আসমা বিনতে আবুবকর (রাঃ) বলেন, আমার মুশরিকা মা কুরাইশদের আয়ত্তে থাকাকালীন আমার নিকট এসেছিল। তখন আমি রাসূল (সাঃ)-কে ফৎওয়া জিজ্ঞেস করে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমার মুশরিকা মা আমার কাছে এসেছে। আর তিনি ইসলাম গ্রহণে অনাগ্রহী। আমি কি তার সাথে সদ্ব্যবহার করব? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তোমার মায়ের সাথে সদ্ব্যবহার কর’। হাফেয ইবন হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, ঘটনাটি ছিল হুদায়বিয়ার সন্ধি থেকে মক্কা বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত সময়কার। যখন তিনি তার মুশরিক স্বামী হারেছ ইবন মুদরিক আল-মাখযূমীর সাথে ছিলেন (ফাৎ হুল বারী)। আসমা (রাঃ)-এর মা আবু বকর (রাঃ)-এর স্ত্রী মুশরিকা অবস্থায় মক্কা থেকে মদীনায় গিয়ে স্বীয় কন্যা আসমার গৃহে আশ্রয় নেন। তার আগমনের এ সময়টি ছিল কুরাইশদের সাথে রাসূল (সাঃ)-এর যুদ্ধ-বিগ্রহ বন্ধ এবং একে অপরের নিরাপত্তার সন্ধি চুক্তির মেয়াদকালে। এ সময়ও সে ইসলামের প্রতি বিমুখ ও বীতশ্রদ্ধ ছিল। কিন্তু স্বামী ও সšা— নাদির বিরহ-বিদ্রোহের লাঞ্ছনাময় জীবনের দুর্বিষহ যন্ত্রণায় ছিল কাতর। আসমা (রাঃ) বলেন, এজন্য সে আমার কাছ থেকে কিছু পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী ছিল। সে কমপক্ষে এতটুক আশা করে এসেছিল যাতে আমি তার সাথে আত্নীয়তার স¤পর্ক রক্ষা করি। মুশরিকা মায়ের এ অবস্থা দেখে আসমা বিনতু আবুবকর (রাঃ) নবী করীম (সাঃ)-এর নিকট জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি কি আমার এই মায়ের সাথে আত্নীয়তার স¤পর্ক বজায় রাখব এবং তার সাথে সদাচরণ করব? তখন নবী (সাঃ) বললেন, হ্যাঁ! তুমি তার সাথে স¤পর্ক বজায় রাখ। অর্থাৎ সে যা পেলে খুশী হয়, তুমি তাকে তা দাও। হাফেয ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেন, এ হাদীছ দ্বারামুশরিক নিকটতম আত্নীয়ের সাথেও সদাচরণ করার বৈধতা প্রমাণিত হয়’। অন্য হাদীছে এসেছে, আবু বকর কন্যা আসমা হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী করীম (সাঃ)-এর যুগে আমার অমুসলিম মা আমার কাছে এলেন। আমি নবী করীম (সাঃ)-এর নিকট জিজ্ঞেস করলাম, তার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করব কি-না? তিনি বললেন, হ্যাঁ। ইবন উয়াইনাহ (রহঃ) বলেন, এ ঘটনা প্রসঙ্গেই আল্লাহতা‘আলা অবতীর্ণ করেন, ‘দ্বীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করেনি, আর তোমাদেরকে তোমাদের ঘর-বাড়ী থেকে বের করে দেয়নি তাদের সঙ্গে সদয় ব্যবহার করতে আর ন্যায়নিষ্ঠ আচরণ করতে আল্লাহনিষেধ করেননি (মুমতাহিনাহ ৬০/০৮)’ ।
পিতা-মাতার সেবা করার ফযীলত
দ্বীন রক্ষার জন্য অনেক সময় জিহাদে যেতে হয়। আর আল্লাহর পথে জিহাদের ফযীলত কত বেশি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অথচ এই ফযীলতপূর্ণ আমলের উপর পিতা-মাতার সেবাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। যেমন হাদীছে এসেছে-আব্দুল্লাহ ইবন আমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নবী করীম (সাঃ)-এর নিকট এসে জিহাদে যাবার অনুমতি প্রার্থনা করল। তখন তিনি বললেন, তোমার পিতা-মাতা কি জীবিত আছেন? সে বলল, হ্যাঁ। নবী করীম (সাঃ) বললেন, তাহলে তাঁদের খিদমতের চেষ্টা কর’। হাফেয ইবন
হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, এর অর্থ হ’ল, ‘তোমার পিতা-মাতা জীবিত থাকলে তাদের সেবা ও খিদমতে সর্বোচ্চ চেষ্টা কর। কারণ এটি জিহাদের স্থলাভিষিক্ত হবে’ (ফাৎ হুল বারী ১০/৪০৩)। অন্য হাদীসে এসেছে, আব্দুল্লাহ বিন আমর ইবনুল আছ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নবী করীম (সাঃ)-এর নিকট এসে বলল, আমি আপনার হাতে হিজরত ও জিহাদের জন্য বায়‘আত গ্রহণ করব। এতে আমি আল্লাহরকাছে পুরস্কার ও বিনিময় আশা করি। তিনি বললেন, তোমার পিতা-মাতার মধ্যে কেউ জীবিত আছেন কি? সে বলল, হ্যাঁ, বরং উভয়ে জীবিত আছেন। তিনি বললেন, তাহ’লে তুমি আল্লাহর কাছে বিনিময় প্রত্যাশা করছ? সে বলল, হ্যাঁ। তিনি বললেন, তাহ’লে তুমি তোমার পিতামাতার কাছে ফিরে যাও এবং তাদের দু’জনের সঙ্গে সদাচরণপূর্ণ জীবন যাপন কর’। অন্য হাদীছে এসেছে, আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, জনৈক ব্যক্তি ইয়েমেন থেকে হিজরত করে রাসূল (সাঃ)-এর নিকট চলে আসলে তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ইয়েমেনে কি তোমার কেউ আছে? সে বলল, আমার পিতা- মাতা আছেন। তিনি বললেন, তারা তোমাকে অনুমতি দিয়েছেন? সে বলল, না। তিনি বললেন, তুমি তাদের নিকট ফিরে গিয়ে তাদের কাছে অনুমতি প্রার্থনা কর। যদি তারা অনুমতি দেন তাহলে জিহাদে যাও। অন্যথা তাদের সাথে সদাচরণ করো’।
পিতা-মাতার সেবায় আল্লাহর সন্তুষ্টি :
সন্তানের নিকট মায়ের যেমন বিশেষ মর্যাদা রয়েছে, তেমনি পিতারও বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। পিতা যদি কোন বৈধ কারণে সন্তানের উপর অসন্তুষ্ট থাকেন, তাহ’লে আল্লাহতার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে যান। কারণ একজন সন্তানকে আদর্শবান হিসাবে গড়ে তুলতে পিতার আর্থিক ও মানসিক অবদান রয়েছে। যেমন হাদীছে এসেছে, আব্দুলাহ ইবনু আমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি নবী করীম (সাঃ) হ’তে বর্ণনা করেন, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘পিতার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং পিতার অসন্তুষ্টিতে আল্লাহতা‘আলার অসন্তুষ্টি রয়েছে’।
পিতা-মাতার সেবায় জান্নাত লাভ :
পিতা-মাতার আদেশ-নিষেধ পালন করলে এবং তাদের আদেশ-নিষেধকে যথাযথভাবে হেফাযত করলে জান্নাত লাভ করা যায়। কারণ তারা সন্তানের জন্য জান্নাতে যাওয়ার শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। যেমন হাদীসে এসেছে-আবুদ্দারদা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, জনৈক ব্যক্তি তার নিকটে এসে বলল, আমার স্ত্রী আছে। আর আমার মা আমার স্ত্রীকে তালাক দানের নির্দেশ দিচ্ছেন। এমতাবস্থায় আমি কি করব? জবাবে আবু দ্দারদা বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি। তিনি বলেছেন, ‘পিতা হ’লেন জান্নাতের সর্বোত্তম দরজা। এক্ষণে তুমি তা হেফাযত করতে পার অথবা বিনষ্ট করতে পার’। অত্র হাদীছে পিতা দ্বারা জিনস তথা পিতা-মাতা উভয়কে বুঝানো হয়েছে।
পিতা-মাতার সেবায় বয়স ও রিযিক বৃদ্ধি পায় :
পিতা-মাতার খিদমত করলে আল্লাহ বেশী বেশী সৎ আমল করার সুযোগ দেন এবং আয়-রোযগারে বরকত দান করেন। যেমন হাদীসে এসেছে,আনাস ইবনু মালেক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি পছন্দ করে যে, তার আয়ু বৃদ্ধি করা হোক এবং তার জীবিকায় প্রশস্ততা আসুক সে যেন তার পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করে ও আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখে’। আমিন-
লেখক : মুহাদ্দিস ফরিদগঞ্জ মজিদিয়া কামিল মাদ্রাসা, খতীব কালেক্টরেট জামে মসজিদ। পিএইচডি গবেষক, আরবী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী।