প্রকাশ : ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:২১
রাজনৈতিক পরিবারেই বেড়ে উঠেন কৃষ্ণা রহমান
কৃষ্ণা রহমান, জন্ম ১৫ আগস্ট ১৯৫৪, মা রীনা রহমান, বাবা তারা রহমান, স্বামী সৈয়দ মতিউর রহমান, মৃত্যু ২৬ ডিসেম্বর ২০২৩, মঙ্গলবার, মুক্তিযোদ্ধা পরিচিতি নম্বর : ০১৪৭০০০১৬৪০।
১৯৬৬-এর ছয়দফা, ’৬৯-এর গণআন্দোলনের সময় যারা ছাত্র আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলো তারা আনেকেই ’৭১-এর স্বাধীনতাযুদ্ধে অগ্নিমুখ হয়ে নেমে পড়েন।
মুক্তিযুদ্ধকালে খুলনা গালর্স কলেজের ১ম বর্ষের ছাত্রী ছিলেন কৃষ্ণা রহমান। ১৯৫৪ সালের ১৫ আগস্ট খুলনায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাবা তারাপদ দাস বসু, মা রীনা দাস বসু। তিনি পিতা মাতার একমাত্র সন্তান। মুসলিম ধর্ম গ্রহণের পর তাঁর বাবার নাম তারা রহমান, আর মায়ের নাম রীনা রহমান হয়। খুলনা পিটিআই স্কুলে কৃষ্ণা রহমানের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। বাবা ও কাকা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। রাজনৈতিক পরিবেশেই তাঁর বেড়ে ওঠা। শৈশবে পড়েছেন বড়ো বড়ো রাজনৈতিক নেতার জীবনী। সেসব জীবনী পড়ে আলোড়িত হয়েছেন। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে রাজনৈতিক অঙ্গনে পথচলা শুরু করেন। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করেন। সে সময় তাঁর নামে হুলিয়া জারি হয়। তবু তিনি দমে যাননি। আন্ডার গ্রাউন্ডে গিয়েও সক্রিয় থাকেন।
খুলনা জেলার পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন ও মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। মার্চের প্রথম থেকেই তারা বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। ৩ মার্চ খুলনায় মিছিল হয়। স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলতে তুলতেই শুরু হয় স্বাধীনতার দাবি। মিছিলে তাদের স্লোগান 'পাকিস্তানে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো'। মিছিলে গুলি চলে। সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান কৃষ্ণা রহমান। এরপর ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা রাস্তায় নেমে পড়েন।
১ এপ্রিল ছাত্রনেতা কামরুজ্জামান টুকুর নেতৃত্বে কৃষ্ণারা গল্লামারী রেডিও স্টেশন দখল করতে যান। ওই মুহূর্তে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে অস্ত্র হিসেবে শুধু হাতে থাকে 'থ্রি নট থ্রি' রাইফেল। সেদিন ওই সামান্য অস্ত্র নিয়ে সুবিধা করতে পারেননি। দলের অনেকে শহিদ হন। সেখান থেকে বেঁচে গিয়ে কৃষ্ণা রহমান পালিয়ে বাগেরহাটের কারাপাড়ায় চলে যান। চিতলমারীতে কমান্ডার হাবিবের নেতৃত্বে ইপিআর ও পুলিশের সমন্বয়ে একটি বাহিনী তৈরি করা হয়। কমান্ডার হাবিব কৃষ্ণা রহমানকে জিজ্ঞেস করেন, "আপনি কি যুদ্ধে যাবেন? গেলে আমাদের কাছে ট্রেনিং নিতে পারেন।"
প্রায় ২০ দিন ধরে ট্রেনিং নেন সেখানে। চিতলমারী ছিলো হিন্দু এলাকা। রাজাকাররা হিন্দু বাড়িতে গিয়ে লুটপাট ও ধর্ষণ করতো। এলাকাবাসীকে বাঁচাতে কৃষ্ণা রহমানসহ আনেকেই একত্রিত হয়ে হামলাকারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। ২০-২৫টি থ্রি নট থ্রি অস্ত্র দিয়ে লড়াই হয়। যুদ্ধশেষে কৃষ্ণা রহমানরা জয়লাভ করেন। শক্রপক্ষের সব অস্ত্র তারা ছিনিয়ে আনেন। তাদের সাথের কয়েকজন আহত হন। তাদেরকে সেবা করে সুস্থ করেন। সেখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে চলে যান ভারত। যাওয়ার সময় দেখেন বাংলার আনাচে-কানাচে শুধু লাশ আর লাশ। শিয়াল, কুকুরে মানুষের লাশ টেনে নিয়ে যাচ্ছে। মৃত লাশের ভাগ্যে এক টুকরো কাপড় বা একখণ্ড মাটিও নেই। প্রাণের ভয়ে অনেকে প্রিয়জনকে ছেড়ে পালাচ্ছে।
কৃষ্ণা রহমান ভারতের শিয়ালদাহ চলে যান। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)-এর একটা মিছিল দেখতে পেলে তিনিও মিছিলের সাথে ঢুকে পড়েন। কলকাতার পথপুকুরের লেলিন স্কুলে গিয়ে দেখা পান বাংলা ভাষাভাষীর অন্যতম নেতা ভবানী সেনের। ভবানী সেন কৃষ্ণা রহমানকে নিয়ে যান অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কাছে। কৃষ্ণার যুদ্ধ করার প্রাণপণ চেষ্টা দেখে তাঁকে পাঠানো হয় গোবরা ক্যাম্পের পরিচালক সৈয়দ চৌধুরীর কাছে। এখানে আবার ট্রেনিং নেন। ট্রেনিং শেষে তাঁর দায়িত্ব পড়ে যুদ্ধের গোপন তথ্য নিয়ে আসার। যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র নিয়ে পৌঁছে দিতেন জায়গামত।
এরপর ইলামিত্রের বাসায় দেখা হয় রণেশ দাশগুপ্তের সঙ্গে। ৮নং থিয়েটার রোডে বসতেন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ।
রণেশ দাশগুপ্ত কৃষ্ণা রহমানকে তাজউদ্দীন আহমদ চিঠি লিখে পাঠিয়ে দেন ত্রাণ ও পুনর্বাসনবিষয়ক মন্ত্রী কামারুজ্জামানের কাছে। সেই চিঠি নিয়েই বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে নাম লেখেন এবং সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
সাজেদা চৌধুরী তখন নারীদের আশ্রয় ও প্রশিক্ষণের জন্যে গোবরা ক্যাম্প প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত ছিলেন। জুন মাসে তিনি গোবরা ক্যাম্পে যান এবং তখন থেকেই তিনি কাজ করতে শুরু করেন। গোবরা ক্যাম্পে অবস্থানকালে তিনি তিন ধরনের কাজ করেছেন। প্রথমত, জনগণকে উদ্বুদ্ধকরণ, দ্বিতীয়ত গোবরা ক্যাম্পে তিনি নার্সিং প্রশিক্ষণ নেন এবং তৃতীয়ত সশস্ত্র প্রশিক্ষণ। এখানে তিন ধরনের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন সবাই। এছাড়া তার নিজস্ব দক্ষতা ও যোগ্যতার গুণে তাকে বাড়তি কিছু দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে, যেমন : যেসব মেয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিল, তাদের দেখাশোনা করার দায়িত্ব ছিলো তাঁর ওপরে।
এক সাক্ষাৎকারে কৃষ্ণা রহমান বলেন, ‘আমার জন্ম হয়েছিল এক প্রগতিশীল পরিবারে। বাবা ’৫২ সালে জেল খেটেছিলেন ভাষা আন্দোলন করতে গিয়ে। তিনি চালের ব্যবসা করতেন। বাবার মতো আমারও ছিলো অদম্য সাহস। যুদ্ধের শেষের দিকে ভীষণ ইচ্ছে ছিলো অস্ত্র হাতে আবারও সরাসরি যুদ্ধে যাওয়ার, কিন্তু পারিনি। এতো তাড়াতাড়ি যে যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে ভাবিনি।’
কৃষ্ণা রহমানকে নিয়ে সাংবাদিক ও গবেষক দীপংকর গৌতম লিখেন, ‘একসময় কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র একতায় মিছিলের ছবি ছাপা হলে অনেকের ভেতরে দেখা যেতো এক সংগ্রামী নারীর মুখ। ইস্পাতদৃঢ় মুষ্টিবদ্ধ হাতে স্লোগান দিচ্ছেন। তিনি আর কেউ নন, বীর মুক্তিযোদ্ধা কৃষ্ণা রহমান।... ভীষণ বিনয়ী অথচ লড়াকু। যে কোনো আন্দোলন-সংগ্রামে সামনে থাকতেন, প্রয়োজনে থাকতেন মানুষের পাশে। কার কী খেতে পছন্দ, কে কোন্ সংকটে আছে, কার ঘরে ডাক্তার দেখানোর কেউ নেই--সেই সব মানুষ তাঁর কাজের অংশ। এলাকার মানুষের পরম শ্রদ্ধেয় ছিলেন তিনি। কৃষ্ণা রহমানের গোটা জীবন সংগ্রামের স্রোতধারায় প্রোজ্জ্বল। ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গনের পর বিশ্বেও কমিউনিস্ট আন্দোলনে যে পরিবর্তন হয়, তার ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে বাংলাদেশেও। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি বিলোপবাদের হাতে পড়ে। সেখান থেকে পার্টিকে যারা ধরে রাখেন তিনি তাদের একজন। আমি গোপালগঞ্জ থেকে ঢাকা আসার পরে পার্টি অফিসে গেলে তাঁর সঙ্গে দেখা হতো। মায়ের স্নেহে ছোটদের ভালোবাসতেন। ভীষণ বিনয়ী ও লড়াকু। যে কোনো আন্দোলন-সংগ্রামে সামনে থাকতেন। আমি তখন উদীচী করি। আজকের কাগজের কাজ সেরে উদীচীতে আসি। তারপর এই মহীয়সী নারীকে মাঝেমধ্যেই গোপীবাগ রেলগেটে পৌঁছে দিয়ে আমি সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজের গলিতে চলে যেতাম। তাঁর বড়ো মেয়ে সৈয়দা অনন্যা রহমানসহ আমরা সংগীত বিভাগে কাজ করতাম। প্রতিদিনের বিপ্লবী এই মহীয়সী নারীকে আমরা সংগঠন করার কারণে 'আপা' বলে ডাকলেও তিনি আমাকে সন্তানের মতো স্নেহ করতেন। আমি গোপীবাগ এলাকায় থাকার কারণে দেখতাম সব মানুষ তাঁকে আভূমিনত শ্রদ্ধা করে। এলাকার মানুষের পরম শ্রদ্ধেয়া তিনি। তাঁর জীবনটাই সংগ্রামের ইতিহাসে ভরা। জীবনে কোনো আপস করেননি।’ [তথ্য : ২২ মার্চ ২০২৩, প্রতিদিনের সংবাদ]
বিজয়ের পর দেশে ফিরে আবার পড়ালেখায় মনোযোগী হন কৃষ্ণা। ১৯৭২ সালে বয়রা সরকারি মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ১৯৭৪ সালে খুলনা সিটি কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। কৃষ্ণা রহমানের বিয়ে হয় বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মতিউর রহমানের সাথে। এই মুক্তিযোদ্ধা দম্পতির দুই কন্যা হলেন সৈয়দা অনন্যা রহমান ও সৈয়দা অন্বেষা রহমান। অনন্যা রহমান হলেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সদস্য। দীর্ঘদিন ধরে নানা শারীরিক জটিলতার সাথে লড়াই করেন কৃষ্ণা রহমান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে লাগাতার প্রায় ২ মাস ধরে ভর্তি ছিলেন। অতঃপর ২৬ ডিসেম্বর ২০২৩, মঙ্গলবার সকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সেদিন বেলা সাড়ে ১২টার দিকে কৃষ্ণা রহমানের মরদেহ নিয়ে আসা হয় পল্টনের মুক্তি ভবনে। পরে কৃষ্ণা রহমানের মরদেহ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ‘গার্ড অব অনার’ প্রদানের পর গোপীবাগ পঞ্চায়েত গোরস্তানে নেওয়া হয়। সেখানে বিকেল সাড়ে ৪টায় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। শেষে তার প্রয়াত স্বামী বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মতিউর রহমানের কবরের পাশে সমাহিত করা হয় তাকে।
লেখক : সাহিত্যিক প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।