বুধবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪  |   ২৫ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   সৌদি প্রবাসীদের অনলাইন প্রতারণা থেকে সতর্ক করলো বাংলাদেশ দূতাবাস
  •   বরিশালে কৃষক দলের হামলায় জাতীয় নাগরিক কমিটির কর্মসূচি পণ্ড
  •   শ্রীনগরে যথাযোগ্য মর্যাদায় মহান বিজয় দিবস উদযাপন
  •   গুমের ভয়াবহ চিত্র: তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে চাঞ্চল্যকর তথ্য
  •   চাঁপাইনবাবগঞ্জে দেয়ালে ‘জয় বাংলা’ লেখা স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা গ্রেপ্তা

প্রকাশ : ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৪১

বিজয়ের ভিত : চেতনার ঘুনে যার স্খলিত গন্তব্য

পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
বিজয়ের ভিত : চেতনার ঘুনে যার স্খলিত গন্তব্য

উনিশশো একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে মহান বিজয় বাঙালির এক অবিস্মরণীয় অর্জন। তৎকালীন পূর্ববঙ্গ নামক পরাধীন ভূখণ্ডের বাঙালির এ অর্জন বিশ্বের ইতিহাসে এক অনন্য অর্জন। স্বাধীনতা অনেকেই পেয়েছে। কিন্তু তাতে অর্জনের মাহাত্ম্য নেই। এ অর্জন কেবল সমরে সীমাবদ্ধ নয়, এ অর্জনের মূল মাহাত্ম্য বিসর্জনে। তিরিশ লক্ষ জীবনের দীপ যে জাতি বিসর্জন দিতে পারে তাকে দাবিয়ে রাখা কঠিন এবং কার্যত অসম্ভবও বটে। যে জাতির মায়েরা-বোনেরা-মেয়েরা মুক্তির জন্যে আত্মৈশ্বর্য অকাতরে বিসর্জন দিয়ে হতে পারে বীরাঙ্গনা, সে জাতির অর্জন তখন কেবল সমর জয়ের বীরত্বের মধ্যে নয়, বিয়োগ-বেদনার গাথায় বিনিন্দিত হয়ে বাজে। প্রতিটি মহান বিজয়ের মূলে একটি প্রগাঢ় চেতনার বীজ উপ্ত থাকে। সেই চেতনা হতে উৎসারিত প্রেরণার স্রোত সংগ্রামী জনতাকে নিয়ে যায় কাক্সিক্ষত গন্তব্যে। বাঙালির বিজয়-তরণীকে কূলে ভেড়াতে যে চেতনার শিখা প্রজ্বালিত হয়েছিল তাকেই আমরা জানি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হিসেবে। উনিশশো আটচল্লিশে এসে সদ্য স্বাধীন সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান যখন ভেঙে দিলো বাঙালির শোষণমুক্তির স্বপ্ন, বাঙালির চেতনার বীজ দানা বাঁধতে শুরু করে তখনই। সেই বীজ পর্যায়ক্রমে ধারাবাহিক মাইলফলক ছুঁয়ে ছুঁয়ে পরিপক্ক হয়ে উঠে স্বাধীনতার লাল-সবুজ পতাকা হয়ে। যে চেতনা বাঙালিকে ধাবিত করে তুলেছিল অনিবার্য মুক্তির সোপানতলে, সেই চেতনাই ক্রমান্বয়ে হয়ে উঠে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এ চেতনা যতটা না ব্যাখ্যাযোগ্য তার চেয়ে অনেক বেশি অনুধাবনযোগ্য। এ চেতনার সূতিকাগার বাঙালি মনন, এ চেতনার জননী হলো বাঙালির মুক্তি-বুভুক্ষা।

বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের চেতনার চার স্তম্ভ হলো বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। কেবল এই চার স্তম্ভই যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তা নয়। চার স্তম্ভের সমন্বয় হতে ঠিকরে পড়া আলোর দ্যুতিই হলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। আমরা রবীন্দ্রনাথকে স্মরণে রেখেই বলি, কমল-হীরের পাথর হতে ঠিকরে পড়া আলো যেমন কালচার তেমনি বাঙালির এই মহান চার স্তম্ভের সমন্বয় হতে উৎসারিত আলোকনই আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এককভাবে প্রতিটি স্তম্ভ নিজস্ব মৌলিকতা দেখালেও চার স্তম্ভের সমন্বয় তৈরি করে সম্মিলিত প্রভাব যা অনেকটা অবাঙমানসগোচর অস্তিত্বের মতোই। কাজেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কোনো দৃশ্যমান বস্তু বা স্থাপনা নয় কিংবা তাকে বর্ণ বা সংকেতে উপস্থাপনের বিষয়ও নয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হতে উৎসারিত প্রেরণায় যে নান্দনিক বোধ ও কর্ম তৈরি হয় তার ভিত্তিতেই এ চেতনা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। স্বাধীনতা ও বিজয়ের আজ তেপ্পান্ন বছরে এসেও মানুষের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিষয়ে তৈরি হচ্ছে বিভ্রম ও ভ্রমাত্মক উপলব্ধি। বিজয়ের এই তেপ্পান্ন বছরে এসে আমরা কতোটুকু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করতে পেরেছি তা নিয়ে আমাদের আত্ম-অভীক্ষার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। কেবল চিৎকার করে গলা ফাটালেই সে চেতনা বাস্তবায়িত হবে না। আমরা যত ঢাক বাজাচ্ছি তত তার কার্যকর বাস্তবায়ন দেখছি না। আমাদের বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভাতে হঠাৎ করেই স্বাধীনতা-উত্তরকালে আমরা ঢুকিয়ে দিয়েছি ভূ-খণ্ডকেন্দ্রিক বাংলাদেশি কল্পিত জাতীয়তাবাদের কাঁকড়, যা সোনার পাথরবাটি ছাড়া আর কিছুই নয়। এটা নিঃসন্দেহে আয়ুব আমলে নিজেরা রবীন্দ্র সঙ্গীত রচনা করার নির্দেশের মতোই হাস্য উদ্রেককর প্রয়াস।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে অনুষঙ্গ আজ তাতে ঢুকে পড়েছে মরুময়তার ঘুন। বাঙালির পহেলা বৈশাখের জাতীয়তাবাদী চেতনাকে অপাংক্তেয় করে তোলার জোর অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পরাজিত দানবের রুধিরের উত্তরাধিকার। কথায় কথায় আজকাল বাঙালি জাতীয়তাবাদকে পরীক্ষা দিতে হচ্ছে সাম্প্রদায়িক অপশক্তির কাছে। বাঙালি ঐতিহ্যের সবকিছুকে রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক ব্যাখ্যা দিয়ে বাঙালির জাতীয়তাবাদ হরণ করার ষড়যন্ত্র চলছে। মুক্তপ্রাণ বাঙালির পক্ষে এই অপশক্তির উন্মত্ততাকে কতটুকু ঠেকিয়ে রাখা যাবে তা আন্দাজ করা মুশকিল। শোষণ ও বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে এগোতে এগোতে আমরা পিছিয়ে পড়ছি তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওঠা বানরের মতো। যদিও উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমাদের অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছে, তবুও আমাদের তৃণমূল পর্যায়ে শোষণ, বৈষম্য ও বঞ্চনার আধিক্য রয়ে গেছে আজও। বিজয়ের তিপ্পান্ন বছর পরেও আমরা শোষণমুক্ত সমাজ তৈরি করতে পারিনি। শোষণের মূল হাতিয়ার হলো দুর্নীতি। মানুষকে তথ্য জানার অধিকার দেয়ার পরও বিচিত্রভাবে শোষণের উপায় তৈরি হচ্ছে সুযোগ সন্ধানী দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষের মস্তিষ্ক হতে। দুর্নীতিকে প্রণোদনা দিতে ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির যেমন মুখ্য ভূমিকা আছে, তেমনি আছে প্রকৃত দেশপ্রেমহীনতা। বৈষম্য আজও বলবৎ আছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। বৈষম্য রাষ্ট্রীয়ভাবে যেমন উৎসাহিত হচ্ছে তেমনি সামাজিক বৈষম্য আজও আমাদের মনঃপীড়ার কারণ। আমরা সবার কাছ থেকে খেলার মাঠ কেড়ে নিয়েছি কিন্তু যাদের টাকা আছে তাদেরকে টার্ফ বানিয়ে দিচ্ছি। শিক্ষাকে পণ্যে রূপান্তরিত করে একাধিক ব্যবস্থা চালু রেখেছি। এ বৈষম্য যেদিন দূর হবে সেদিন এই বাঙালি মায়ের সন্তানেরা সবাই দেশের সম্পদে অনিবার্যরূপেই পরিগণিত হবে।

ধর্মনিরপেক্ষতাকে আজ আর কাগজে কলমেও ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। বরং ধর্মানুভূতিতে আঘাতের নাম দিয়ে সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের নতুন পথ খোলা হয়েছে। রাষ্ট্র বলছে বটে 'ধর্ম যার যার উৎসব সবার' কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না। সংবিধানকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হতে ঢের বেশি দূরে সরিয়ে আনা হয়েছে। এখন পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, চাইলেও পেছন ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিজয়ের তিপ্পান্ন বছরে আমরা আজ কেবল সেই চেতনার খোল-নলচে হাতে ধরে আছি, মূল উপাদান ছিনতাই হয়ে গেছে বহু আগেই।

যে বাঙালিকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নদ্রষ্টা সোনার বাংলা দেখার স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই বাঙালি আজ অনুপস্থিত। আমাদের দেশপ্রেম আজ কেবল ক্রিকেট খেলার মাঠেই সীমাবদ্ধ। তাও পুরোপুরি নয়। দর্শক হিসেবে বাঙালি দেশপ্রেম লালন করলেও খেলোয়াড়দের অনেকের খেলা ও আচরণে তার প্রতিফলন থাকে না। উন্নত জীবনের জন্যে আমরা প্রবাসে পাড়ি দিতে প্রস্তুত, কিন্তু স্বদেশের অপূর্ণতাকে পূর্ণতা দিতে আমাদের সেই ত্যাগের মানসিকতা নেই। আমাদের মধ্যে অর্থ পাচারের সময় দেশপ্রেম থাকে না, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের মিত্রদের সাথে বিরোধিতায় ক্ষুদ্র উছিলাতেও দেশপ্রেম জেগে উঠে।

বিজয়ের তিপ্পান্ন বছরে এসে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আটকে আছে জাদুঘরে। আমরা আজকাল কেবল 'চাই চাই' জাতীয় আন্দোলন দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি রাষ্ট্রের সম্মান ঠেকিয়ে দেই, কিন্তু রাষ্ট্রের পতাকার অবমাননাকারীদের পথ আটকে দাঁড়াই না। আমরা কথায় কথায় বিদেশি পণ্যের গুণগান গাই, কিন্তু স্বদেশি পণ্যের ব্যবহারে দেখাই চরম অনীহা। যাদের দেশপ্রেম ক্রমে ক্রমে হয়ে যায় পণ্য, তাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তিপ্পান্ন বছর পরে কী পর্যায়ে থাকতে পারে তা সহজেই বোধগম্য।

আজ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড়ো বাধা সাম্প্রদায়িক অপশক্তির উত্থান। বিভিন্নভাবে রাজনৈতিক ও সামাজিক পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে এই সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিষদাঁত ক্রমশ ধারালো হয়ে উঠেছে। অথচ স্বাধীনতাপূর্ব রাজনীতিতে অসাম্প্রদায়িক চেতনা কেবল মুখের কথা ছিল না। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া মহান মানুষ কাজে-আচরণে তা বাস্তবায়নও করেছেন সর্বতোভাবে। আলজিয়ার্সে জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে সৌদি বাদশাহ ফয়সালকে মুখের ওপর কড়া জবাব দেওয়া হয়েছিলো দেশের এক কোটি অমুসলিম জনগণের স্বার্থ সংরক্ষণ করার জন্যে। জবাবের দৃঢ়তায় এ কথা স্পষ্ট যে, নেতাদের রক্তে অসাম্প্রদায়িক চেতনা ছিল বলেই বিশ্বের শক্তিধর মুসলিম দেশের বাদশাহও সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন করে কোনো ছাড় পাননি।

যাঁরা দেশকে স্বাধীনতা এনে দিতে জীবনবাজি রেখেছিলেন তাঁদের বিশ্বাস ছিলো, ঐক্যবদ্ধ বাঙালি বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ জাতির সমতুল্য হয়ে উঠবে একদিন। আর এই একতার চৌম্বকীয় শক্তি ছিল তাঁদের অসাম্প্রদায়িক চেতনা। মুক্তিযুদ্ধের মহান স্লোগানে আমরা বলেছি, ' বাংলার মুসলিম, বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খৃস্টান-আমরা সবাই বাঙালি’। এই স্লোগানই বাংলাদেশ বিনির্মাণে বিজয়ী বীর বাঙালির দর্শনের বীজমন্ত্র। সদ্য নবজাগ্রত নয়া চীনকে আমরা দেখেছি, মানুষ সেখানে ধর্মের আফিম হতে মুক্তি পেয়ে কর্মের চাকায় আবর্তিত হয়ে নির্মাণ করে চলেছে দেশকে। সেই কর্মবাণীই আমাদের নেতারা নিয়ে এসেছিলেন তাঁদের দেশের জন্যে, জনগণের জন্যে। ধর্মনিরপেক্ষতার নির্যাস দিয়েই তাঁরা রচনা করেছিলেন দ্বিতীয় বিপ্লবের স্বপ্ন। এ স্বপ্নের চূড়ান্ত গন্তব্য বৈষম্যহীন, দারিদ্র্যমুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ছাড়া রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্থহীন। তাই মাটি ও মানুষকে কেন্দ্র করে গণমানুষের সুখ-শান্তি ও স্বপ্ন এবং আশা আকাক্সক্ষাকে অবলম্বন করে গড়ে উঠবে বাংলার নিজস্ব সাহিত্য-সংস্কৃতি, এটাই ছিলো শহিদদের আশা। ধর্মের নামে ভাড়াটিয়া সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়া মানুষের আত্মার স্পন্দনকে পিষে মারার শামিল। রাজনীতিতে যারা ধর্মের ব্যবহার করে তারা হীন এবং নীচু মানসিকতার। যারা মানুষকে ভালোবাসে তারা কোনোদিনই সাম্প্রদায়িক হতে পারে না। যারা মানুষকে ভালোবাসে তারা ধর্মের নামে মানুষকে বিভেদে দীর্ণ করতে পারে না। মানুষ প্রগতিশীল জীবন-যাপনকে ধর্মীয় চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক ভাবতে শুরু করার পর থেকেই মনুষ্যত্বের অধঃপতন শুরু। ফলে দেশজুড়ে মুক্তবুদ্ধির দীনতা তৈরি হয়। বাঙালির বাংলাদেশ বিনির্মাণের আশায় গুড়ে বালি ঢেলে দিয়ে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে রাষ্ট্রধর্মের পথে হেঁটে দেশকে সাম্প্রদায়িকতার উর্বর ভূমিতে পরিণত করে তোলা হয়। এ থেকে বুঝা যায়, বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে মননশীলতার উন্নত বীজ উপ্ত হয়নি কখনও, বরং অতি অল্পতেই ভুলে ভরা সত্যের মগজ ধোলাইয়ে দিনকে দিন অসাম্প্রদায়িক চেতনারা সংখ্যালঘু অস্তিত্বে পরিণত হয়ে গেছে। ফলে একদিকে সংবিধানে আমরা ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেও বাস্তবে ধর্মীয় রাষ্ট্রসঙ্ঘে যোগ দিয়ে নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছি।

ঘরে ঘরে বাঙালি সংস্কৃতির শক্ত বুনিয়াদ তৈরি না করে আমরা বহুধারার শিক্ষা ব্যবস্থা বলবৎ রেখেছি। ফলে আমরা সুনাগরিক তৈরির বদলে বিভেদে বিপন্ন জাতি তৈরি করেছি। এ প্রসঙ্গে জীববিজ্ঞানী জাঁ ব্যাপটিস্ট ডি ল্যামার্কের তত্ত্বটি স্মরণযোগ্য। তাঁর মতে কোন পরিবর্তন জীনগত পরিবর্তনের অংশ না হলে কেবলমাত্র বাহ্যিক পরিবর্তনে তা স্থায়ী রূপ লাভ করতে পারে না। সেই তত্ত্বের নির্যাস হতে আমরা বলতেই পারি, আমাদের অসাম্প্রদায়িকতার চেতনা মূলত আবেগপ্রধান চেতনা, তাতে বুদ্ধিবৃত্তিক অনুষঙ্গের ঘাটতি ছিল। এ কারণেই আমরা হারিয়ে ফেলেছি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের বহুদিনের লালিত সেই ঐক্যের ছবিটাকে। অনুভূতির ধর্মান্ধতা আজ আমাদের চারদিকে শ্রাবণের মসীমাখা মেঘের জাল বিস্তার করে চলেছে ক্রমশঃ।

আজকের বাংলাদেশ যেন এক সংশপ্তক রাষ্ট্র, যাকে প্রাণপণ প্রয়াসেও প্রতিক্রিয়াশীলতার বিষদাঁতের কামড় সহ্য করে যেতে হচ্ছে শেষ সলতেটুকু জ্বালিয়ে রাখার জন্যে। মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িকতার দর্শন ছিল অনেকটাই শিশির বিন্দুতে প্রতিফলিত সূর্যের সপ্তবর্ণা রশ্মির বর্ণালীর মতো। বৈচিত্র্য থাকবে কিন্তু ঐক্যও থাকবে। ধর্মীয় বৈচিত্র্য সত্ত্বেও আমরা জাতিগতভাবে বাঙালি। আমাদের একক পরিচয়-সত্তা প্রতিষ্ঠার এই প্রয়াস বারে বারে মুক্তিযোদ্ধাদের বচনে-ভাষণে, কর্মে-কুশলতায় উচ্চারিত হয়েছে।

একটা সত্য সম্পর্কে সকলের অভিন্ন অভিমত যে, এখানে আজকাল ধর্মশিক্ষাকে পরীক্ষায় নম্বর বৃদ্ধির সিঁড়ি হিসেবে চিন্তা করা হয়, নৈতিক শিক্ষার হাতিয়ার রূপে চিন্তা করা হয় না। এর কুফল আমরা আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। আমাদের সর্বধর্মীয় সংখ্যালঘু শিক্ষকেরা আজ নিজেদের গলায় জুতোর মালা নিয়ে এ গরল সময়কে চিহ্নিত করে যাচ্ছেন ইতিহাসের পাতায়। যে দেশনির্মাতারা তাঁদের শৈশবের শিক্ষককে রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায়ও সমস্ত নিয়ম ভেঙ্গে নিজেরাই এগিয়ে নিয়ে এসে পদধূলি গ্রহণ করেন, আজ তাঁদের দেশেই লাঞ্ছিত হচ্ছে শিক্ষকেরা। এই লাঞ্ছনার পেছনে সাম্প্রদায়িকতার বিষদাঁত যেমন আছে তেমনি আছে ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়াররূপে ব্যবহারের আত্মঘাতী ষড়যন্ত্র। সাম্প্রদায়িকতার সাথে আপোষ করতে করতে আজ বাংলাদেশ নামক জাতিরাষ্ট্রটির জীবনী শক্তি ক্ষয় হয়ে তলানীতে এসে ঠেকেছে। বিজয়ের তিপ্পান্ন বছরে এসে আজও আমাদের লড়াই করতে হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে। আজও আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উপভোগ করি বাঙালি নারীদের মধ্যযুগীয় তুলাদণ্ডে পরিমাপ করে অন্দর মহলে অন্তরীণ করার দুরভিসন্ধিকে। কবি আসাদ চৌধুরীর আক্ষেপ তাই আজও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে প্রতিটি বাঙালির মনে, ঠিক যেমন 'শহীদদের প্রতি' কবিতায় তিনি বলেছেন,

'তোমাদের যা বলার ছিল

বলছে কি তা বাংলাদেশ ?'

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়