বুধবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪  |   ১৯ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   সৌদি প্রবাসীদের অনলাইন প্রতারণা থেকে সতর্ক করলো বাংলাদেশ দূতাবাস
  •   বরিশালে কৃষক দলের হামলায় জাতীয় নাগরিক কমিটির কর্মসূচি পণ্ড
  •   শ্রীনগরে যথাযোগ্য মর্যাদায় মহান বিজয় দিবস উদযাপন
  •   গুমের ভয়াবহ চিত্র: তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে চাঞ্চল্যকর তথ্য
  •   চাঁপাইনবাবগঞ্জে দেয়ালে ‘জয় বাংলা’ লেখা স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা গ্রেপ্তা

প্রকাশ : ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৪০

বিজয়ের তিপ্পান্ন বছর : আঁধার কেটে আলো আসুক

অনলাইন ডেস্ক
বিজয়ের তিপ্পান্ন বছর : আঁধার কেটে আলো আসুক

আজ মহান বিজয় দিবস। আজ হতে তিপ্পান্ন বছর আগে উনিশশো একাত্তর সালের এই তারিখে পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ ও নিপীড়নের নিগঢ় হতে দীর্ঘ নয়মাস রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর বাংলাদেশ বিজয় অর্জন করে। অনন্য এ বিজয় অর্জনে যাঁরা আত্মাহুতি দিয়েছেন, যে সকল মা-বোন তাঁদের নারীত্বের ঐশ্বর্যহারা হয়েছেন, যাঁরা বেঁচে থেকেও যুদ্ধের ভয়াবহতা শরীরে ও মনে ধারণ করে আছেন দীর্ঘদিন, তাঁদের সবাইকে সশ্রদ্ধ সালাম। তাঁরা সেদিন গর্ভধারিণী মায়ের নাড়ির টানকে উপেক্ষা করে, ঘরে প্রতীক্ষমান প্রিয়তমা স্ত্রী ও আদরের পুত্র-কন্যার মমতাকে উপেক্ষা করে দেশমাতৃকার অমোঘ ডাকে রণাঙ্গনে ছুটে গিয়েছেন অকুতোভয়ে। তাঁরা সেদিন মৃত্যুর কাছে নিজেদের বিসর্জন দিয়েছিলেন বলেই আজ আমরা স্বাধীন। বিজয় আজ আমাদের গলমাল্য হয়ে শোভা পায় উত্তরাধিকারের স্পর্ধায়। বেঁচে ফিরে আসাটা অনিশ্চিত জেনেও যাঁরা সেদিন জীবনবাজি রেখেছিলেন অন্তহীন শৌর্যবীর্যে, তাঁরা প্রকৃতপক্ষে আমাদের অনিন্দিত বীর। তাঁদের নির্বাপিত জীবনদীপ জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে আমাদের বিজয়ের অনির্বাণ শিখাকে।

পৌনে দুশো বছর ইংরেজদের গোলামী করা জাতি যখন বহুল কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতাকে আনতে গিয়ে আবারও তেইশ বছরের বলিমঞ্চে আপতিত হলো, তখন যুদ্ধ আমাদের জন্যে অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়।সেদিন আমরা মৃত্যুকে তুচ্ছ করতে পেরেছিলাম বলেই একশ সাতষট্টিটি আসনের বিজয়কে মূলধন বানিয়ে ছিনিয়ে আনতে পেরেছিলাম লাল-সবুজ পতাকার গৌরবকে। বায়ান্ন হতে একাত্তরের এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় যাঁরা আমাদের নেতৃত্ব দিয়ে গন্তব্যের তরণীকে কূলে ভিড়িয়ে দিয়েছেন, তাঁদের প্রতি আমাদের বিনম্র কুর্নিশ।

তিনটি মূল উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই আমরা পথ চলেছিলাম মুক্তির। আমরা চেয়েছিলাম ভূখণ্ডের মুক্তি, অর্থনৈতিক মুক্তি এবং সাংস্কৃতিক মুক্তি। একাত্তর আমাদেরকে ভূখণ্ডের মুক্তি এনে দিলেও অর্থনৈতিক মুক্তি এবং সাংস্কৃতিক মুক্তি এনে দিতে পারেনি। সর্বক্ষেত্রে কর্কটরোগের মতো ছড়িয়ে পড়া দুর্নীতি ও সামাজিক বৈষম্য আমাদের অর্থনৈতুক মুক্তি থেকে পিছিয়ে রেখেছে। যে যায় লঙ্কায় এদেশে সে হয়ে যায় রাবণ। ক্ষমতার পালা বদল হয় বটে কিন্তু দুর্নীতিবাজরা একই রয়ে যায়। দেশ পরিচালনার চেয়ারে বসে টাকা পাচার হয়ে যায় বিদেশে। মুখে দেশপ্রেমের ফেনা তুললেও মনে ও কর্মে নিজের আখের গুছানোর ধান্ধা আমাদের মজ্জাগত।

ফলে চেয়ারে বসার আগে সফেদ ও অমলিন থাকলেও চেয়ার তাকে কাদা লাগিয়ে দেয় দুর্নীতিবাজ হিসেবে।

ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতা আমাদের কাঙ্ক্ষিত সাংস্কৃতিক মুক্তি থেকে রেখেছে ঢের দূরে। ফলে বিজয়ের সুফল আমরা আজও ঘরে ঘরে পৌঁছাতে পারিনি। বহুধাবিভক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের সমাজে তৈরি করেছে আরেক বৈষম্য। দুর্নীতিগ্রস্ত অভিভাবকেরা আজকাল শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে কিনে নিচ্ছেন বিদ্যা-বেনিয়াদের কাছ থেকে। ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা, ক্যাডেট কলেজে শিক্ষা, কিন্ডারগার্টেন শিক্ষা, মাদ্রাসা শিক্ষা, অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা আমাদের সমাজে একদিকে বৈষম্য ও অদূরদর্শিতাকে যেমন প্রকট করেছে, তেমনি শিক্ষারও বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার্থী বানিয়ে তুলেছি একদিকে, আর অন্যদিকে সনদসর্বস্ব পণ্ডিত তৈরি করে কার্যত কেরানি ব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন করেছি। আজকাল ছাত্ররা আন্দোলন করে কেরানি মার্কা চাকুরির জন্যে, গবেষণা কিংবা উদ্যোক্তা হওয়ার জন্যে নয়। আমাদের সংস্কৃতিতে শেকড়লগ্নতাকে উপড়ে ফেলে ধীরে ধীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে পাশ্চাত্য অনুকরণপ্রিয়তাকে। ফলে জগাখিচুড়ি সংস্কৃতি নিয়ে আমরা এক একটা যুগের প্রতিবন্ধীতে পরিণত হয়েছি। বিজয়ের তিপান্ন বছর পরেও আমরা এদেশে পরাজিত শক্তির প্রতিধ্বনি শুনতে পাই। এটা আমাদের জন্যে ভয়ের ও আতঙ্কের। আমরা ঐক্যবদ্ধ জাতিতে আজও পরিণত হতে পারিনি। মানবিক, সামাজিক কিংবা রাষ্ট্রীয় যে কোনো বিষয়ে এখনও বহুধা বিভক্ত। অকারণ ও অহেতুক বিরোধিতাকে মোকাবেলা করতে করতে আমরা হীনবল হয়ে পড়ি। ফলে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় দেশের উন্নয়ন আমরা সংঘটিত করতে পারিনি। চেয়ারে থাকলে আমরা স্তুতি গাই আর চেয়ার থেকে স্খলিত হলে তার শত দোষ খুঁজে পাই। এটাই আমাদের আজকের চরিত্র। বিজয়ের তিপ্পান্ন বছর পরে এসে আজ কারও কারও জাতীয় সংগীতে অনৈক্য তৈরি হয়, মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান চোখের বালি হয়ে যায়। এমনকি মানচিত্রেও হাত দিতে চায় অপরিণামদর্শী কেউ কেউ। ফলে দেশ আগানোর চেয়ে প্রতি পরিবর্তনে দেশ পিছিয়ে যায় দ্বিগুণভাবে। এরকম নাগরিক দিয়ে জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা কতটুকু বাস্তবায়িত হবে তা ভাবার বিষয়।

কিন্তু একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে আমরা যার যা কিছু ছিলো তা নিয়েই লড়াইয়ে নেমেছিলাম। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, সময় যতই কঠিন হোক না কেন, পরিস্থিতি যতই প্রতিকূল হোক না কেন, ঐক্যবদ্ধ বাঙালি ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠতে পারে যে কোনো সময়ে। আমরা সততা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্রকাঠামো তৈরি করতে পারলে দুর্নীতি ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিজয় আমাদের সুনিশ্চিত। আমাদের আজ ঘুরে দাঁড়াতে হবে অন্যায় আর অবিচারের বিরুদ্ধে। আমাদের কণ্ঠকে শাণিত করতে হবে সকল অপশাসনের বিরুদ্ধে। আমাদের হৃদয়ে লালন করতে হবে একাত্তরের মৌল চেতনাকে। বাঙালিকে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-রাজনীতি নির্বিশেষে রাষ্ট্রের ও জাতির উন্নয়ন বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে। এটা আমাদের মনে রাখতেই হবে, বিভেদে দীর্ণ জাতি কোনো কিছুই অর্জন করতে পারে না। চেয়ারে বসে কেবল বিচারের সংস্কৃতি আমাদের জাতীয় অগ্রগতির জন্যে অন্তরায়। চেয়ার আছেই মূলত ঐক্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র কাঠামোর জন্যে। দীর্ঘ তিপ্পান্ন বছরে আমি-আমার, তারা-তাদের করতে করতে আমাদের ক্ষতি হয়ে গেছে অনেক। এবার সে ক্ষতি হতে উত্তরণের পথ আমাদেরকেই খুঁজে বের করতে হবে। দুহাজার চব্বিশের অন্তিমে এসে আমাদের বলতেই হয়, অন্ধকার যত গাঢ় হোক না কেন, প্রভাতের আলো আসতে আর খুব বেশি দেরি নেই। রাত পোহাবার আর বেশি দেরি নেই।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়