প্রকাশ : ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৩:৩৩
মোবাইলের কারণে কী কী গুনাহ হয়
মোবাইল নিত্য প্রয়োজনীয় একটি যন্ত্র। এ যন্ত্রের সাহায্যে অনেক কাজ সহজে সম্পন্ন করা যায়। মোবাইলের মাধ্যমে যোগাযোগ প্রযুক্তি, তথ্য আদান-প্রদানসহ বিভিন্ন কাজ সহজে করা যায়। কিন্তু মোবাইল ফোনের অপব্যবহারের কারণে নানাবিধ সমস্যা তৈরি হচ্ছে। যে সমস্যাগুলো ব্যক্তি, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, রাষ্ট্রীয়, অফিস, আদালত, ব্যাংকিং, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ ধর্মীয় বিরূপ পড়ে থাকে। তাই একজন মুসলমান হিসেবে মোবাইল ফোনের ব্যবহারেও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে হবে।
ধর্মীয় অনুভূতির বাহিরে মোবাইল ফোন ব্যবহারে সামন্য থেকে অনেক বড় বড় গুনাহ সংগঠিত হতে পারে। যে বিষয়গুলো আমরা মোটেই ভুক্ষেপ করছি না। অথচ, মোবাইল ফোনের কারণে আমরা গুনাহগার হয়ে যাচ্ছি। এজন্য মোবাইল ফোনের অপকারিতা সম্পর্কে জেনে আমরা সচেতন হতে হয়। নিম্নে মোবাইল ফোনের অপকারিত সম্পর্কে কতগুলো বিষয় তুলে ধরা হলো :
প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা দিয়ে মোবাইল ক্রয় : প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা ব্যয় করে কোনো কাজেই করার প্রতি ইসলাম উৎসাহ প্রদান করে না। বরং যার প্রয়োজন যেটুকু ততোটুকুই ব্যবহারে ইসলাম উৎসাহ প্রদান করেছে। বর্তমানে একটি বিষয় লক্ষণীয়, অনেকেই তার প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোয়ালিটির মোবাইল ক্রয়ে আসক্ত। প্রত্যেকেই তার সামর্থ্যরে মধ্যেও প্রয়োজন অনুযায়ী মোবাইল বা স্মার্টফোন ব্যবহার করবে। কিন্তু নতুন নতুন মডেলের মোবাইল ফোন বের হলেই প্রয়োজন না থাকলেও সে মোবাইল সবার পূর্বে কিনতে হবে, এটা একটা অপচয়ের প্রতিযোগিতা। এ অপচয় থেকে আমাদের বেড়িয়ে আসতে হবে। বরং সামর্থ্য ও প্রয়োজন অনুযায়ী স্মার্টফোন কিনাই যুক্তিযুক্ত। এ বিষয়ে পবিত্র কুরআনুল কারিমে মহান আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘তোমরা আহার করো ও পান করো; কিন্তু অপচয় করবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ অপচয়কারীকে পছন্দ করেন না। (সূরা আরাফ : ৩১)
মোবাইল ক্রয় করার নিয়তের কারণে গুনাহ : মোবাইল যদি নাচ, গান দেখার নিয়তে বা অপরকে ঠকানোর জন্য, প্রতারণার জন্য কিনা হয় তাহলে মোবাইল ক্রয় করাই গুনাহ। রাসূল (সা.) বলেছেন, আমলের প্রতিদান নিয়তের ওপর নির্ভরশীল।’ (সহিহ বুখারি)
হারাম উপার্জন দিয়ে মোবাইল কিনা : ইসলামে হারাম উপার্জন হারাম করা হয়েছে। তাই হারাম উপার্জন দিয়ে মোবাইল ক্রয় করাও গুনাহ। হাদিস শরীফে রাসূল (সা.) বলেছেন, কোনো কাপড় দশ দিরহাম দ্বারা খরিদ করে এবং এর মধ্যে এক দিরহামও হারাম থাকে আল্লাহ তার এ নামাজ কবুল করবে না।
মোবাইলের সময় অপচয় : মোবাইলে অপ্রয়োজনীয় কথা বলা, লম্বা সময় কথা বলা, অপ্রয়োজনীয়ভাবে মোবাইল ব্যবহারের মাধ্যমে আমাদের মূল্যবান সময় নষ্ট হয়। অথচ দুনিয়ার হায়াত ক্ষণক্ষায়ী। কার কখন মৃত্যু চলে আসে বলা যায় না। তাই হায়াত থাকতে সময়ের সঠিক ব্যবহার করতে হবে। অথচ মোবাইলের কারণে সময়ের অপচয় অনেক বেশি হয়ে থাকে। শিশু, কিশোর, যুবক, বৃদ্ধ সকলেই মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। সময়ের অপচয়ের কারণে ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষাজীবন ধ্বংস হয়ে পড়ে। তাই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সময়ের অপচয় রোধে সচেষ্ট থাকতে হবে। আমরা আমাদের হায়াত কোন কাজে ব্যয় করেছি হাশরের ময়দানে মহান আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে।
রাসূল (সা.) সময়ের গুরত্ব বুঝানো এরশাদ করেছেন, ‘দুটি নেয়ামত বা অনুগ্রহের ব্যাপারে বহু মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত : সুস্থতা ও অবসর। (বুখারী)
মোবাইলে পরনারীর সাথে অডিও ভিডিও কথা বলা : পরনারীর সাথে কথা বলা, বা ভিডিও কলে দেখে কথা বলা ইসলামে হারাম। মোবাইলের মাধ্যমে এ হারাম কাজ দিন দিন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। মোবাইলের মাধ্যমে পরনারীর প্রতি আসক্ত হওয়ায় অনেক সংসার ভেঙ্গে যাচ্ছে। সংসারে অশান্তি বেড়ে যাচ্ছে।
পবিত্র কুরআনুল কারিমে মহান আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, “হে নবী পত্নীগণ! তোমরা অন্য নারীদের মত নও; যদি তোমরা আল্লাহ্কে ভয় কর তবে পরপুরুষের সাথে কোমল কণ্ঠে এমনভাবে কথা বলো না, যাতে অন্তরে যার ব্যাধি আছে সে প্রলুব্ধ হয়। আর তোমরা সদালাপ কর।(স্বাভাবিকভাবে কথা বল।)” (আহযাব : ৩২)
টিকটক, টুইটারে ফেক আইডি খোলা : যুবকরা যুবতীদের ছবি, বৃদ্ধরা যুবকের ছবি, নামে, বে-নামে ফেক আইডি খুলে ফেসবুক, টুইটারে অপরকে ধোকা প্রদান করা হয়ে থাকে। যা গর্হিত কাজ। অনেক যুবক যুবতীরা, নারী-পুরুষ ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচয় হয়ে প্রেম করতে থাকে। নারীরা পর পুরুষকে দেখে, পুরুষরা পর নারীকে দেখে। এভাবে গুনাহের মধ্যে জড়িয়ে পড়ে। হাদিস শরীফে রাসূল (সা.) বলেছেন, “যে ধোকা দেয় সে আমার উম্মত নয়”। (মুসলমি শরীফ)
মোবাইলে নাচ-গান শুনা : ইসলামে নাচ-গান শোনা, গান গাওয়া গুনাহের কাজ। তাই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে নাচ দেখা ও গান শোনা সহজতর হলেও আল্লাহকে ভয় করে নাচ না দেখে গান শোনা থেকে বিরত থাকতে হবে।
ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা মদ, জুয়া ও সব ধরনের বাদ্যযন্ত্র হারাম করেছেন’ (বায়হাক্বী, হাদীছ ছহীহ, মিশকাত হা/৪৫০৩ ; বাংলা ৮ম খণ্ড হা/৪৩০৪)।
অশ্লীল ভিডিও দেখা : অশ্লীলতা যুবসমাজকে ধ্বংসের দিকে ধাবিত করছে। আর অশ্লীলতার অন্যতম যন্ত্র মোবাইল। আর যুব সমাজ দিন/রাত যখন ইচ্ছা অশ্লীল ভিডিও দেখার মাধ্যমে গুনাহের সাগরে ডুবে যাচ্ছে।
মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই যারা মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার কামনা করে, তাদের জন্য আছে দুনিয়া ও আখিরাতে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। আর আল্লাহ জানেন, তোমরা জানো না।’ (সুরা : নুর, আয়াত : ১৯)
মহান আল্লাহ বলেন, আপনি বলে দিন, আমার পালনকর্তা প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য অশ্লীল বিষয়সমূহ হারাম করেছে এবং হারাম করেছেন পাপাচার, অন্যায়-অত্যাচার, আল্লাহর সাথে এমন বস্তুকে অংশীদার করা, তিনি যার দলিল অবতীর্ণ করেননি এবং আল্লাহর প্রতি এমন কথা আরোপ করা, যা তোমরা জান না।” (সূরা আরাফ : ৩৩)
মহান আল্লাহ আরো এরশাদ করেন, নিশ্চয় কান, চক্ষু ও অন্তঃকরণ এদের প্রত্যেকটিই জিজ্ঞাসিত হবে।” (সূরা ইসরা : ৩৬)
মোবাইলে মিথ্যা বলা : মোবাইলে কথা বলার সময় অনেকাংশে মিথ্যা বলার সুযোগ থাকে। এ সুযোগে কেউ কেউ মিথ্যা বলছে। মিথ্যা বলে নিজের পাপের বোঝা ভারী করছে।
আল্লাহ্ তা’আলা আরো বলেন, ‘মিথ্যাচারীরা ধ্বংস হোক’। (যারিয়াত : ১০)। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন, ‘‘অতঃপর আমরা সবাই (আল্লাহ্ তা’আলার নিকট) এ মর্মে প্রার্থনা করি যে, মিথ্যুকদের উপর আল্লাহ্ তা’আলার লা’নত পতিত হোক’’। (আল ইমরান : ৬১)। আব্দুল্লাহ্ বিন্ মাস্’ঊদ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমরা সত্যকে আঁকড়ে ধরো। কারণ, সত্য পুণ্যের পথ দেখায় আর পুণ্য জান্নাতের পথ। কোনো ব্যক্তি সর্বদা সত্য কথা বললে এবং সর্বদা সত্যের অনুসন্ধানী হলে সে শেষ পর্যন্ত আল্লাহ্ তা’আলার নিকট সত্যবাদী হিসেবেই লিখিত হয়। আর তোমরা মিথ্যা থেকে সম্পূর্ণরূপে দূরে থাকো। কারণ, মিথ্যা পাপাচারের রাস্তা দেখায় আর পাপাচার জাহান্নামের রাস্তা। কোনো ব্যক্তি সর্বদা মিথ্যা কথা বললে এবং সর্বদা মিথ্যার অনুসন্ধানী হলে সে শেষ পর্যন্ত আল্লাহ্ তা’আলার নিকট মিথ্যাবাদী রূপেই লিখিত হয়। (মুসলিম শরীফ ২৬০৭)।
স্মার্টফোন ব্যবহারের আরো কতিপয় ক্ষতি : স্মার্টফোন ব্যবহারের মাধ্যমে শিশুর কান্না নিবারণ করা হচ্ছে। খাবার খাওয়াতে স্মার্টফোন শিশুর হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। এভাবে শিশুরা মোবাইল ফোনের প্রতি আসক্ত হচ্ছে। যার ভবিষৎ খুবই ভয়ানক। মোবাইল ফোনের কারণে কত সংসার ভেঙ্গেছে। কত অশান্তি শুরু হয়েছে। কথা রেকর্ড হচ্ছে। ভিডিও কলে পরকীয়া হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা পড়ার মনোযোগী হারাচ্ছে। স্বামী-স্ত্রী অমিল হচ্ছে। যুবকরা পুরুষত্ব হারাচ্ছে। এক কথায় মোবাইল ফোন/স্মার্টফোনের অপব্যবহারের কারণে আজ শিশু থেকে শিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী, নারী-পুরুষ সকলেই বিশাল বিপদের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে।
পরিশেষে কথা হলো, স্মার্টফোন ব্যবহারে অনেক প্রয়োজনীয়তা যেমনি রয়েছে, তেমনি অপব্যবহারের কারণে বেশি অপকারিতা রয়েছে। তাই ইসলাম বুকে ধারণ করে, আল্লাহকে ভয় করে সদাসর্বদা যাবতীয় অন্যায় ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে হেফাজত রাখতে হবে।মুফতি মুহা. আবু বকর বিন ফারুক : ইমাম ও খতিব, বিষ্ণুপুর মনোহরখাদী মদিনা বাজার বাইতুল আমিন জামে মসজিদ,
চাঁদপুর সদর, চাঁদপুর।