প্রকাশ : ২৯ জুন ২০২১, ০০:০০
উপ-সম্পাদকীয়
বিম্বিত বীক্ষণ
অধ্যক্ষ রতন কুমার মজুমদার
১৯৯২ সালে কলেজ গভর্নিং বডি সিদ্ধান্ত নিলো কলেজে ডিগ্রি পর্যায় চালু করা হবে। তখন চট্টগ্রাম বিভাগের কলেজগুলো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ছিলো। শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে সকল পর্যায় শেষ করে ডিগ্রি পর্যায়ে বিএ, বিএসএস এবং বিবিএস চালু করা হলো। কলেজে নতুন ১২ জন শিক্ষক যোগদান করলো। কলেজের পরিসরও আস্তে আস্তে বাড়তে লাগলো। নূতন শিক্ষক যারা যোগদান করেছেন তারা অধিকাংশই বয়সে তরুণ। তাদের চিন্তাধারাও উন্নত। তরুণরা সবকিছু পাল্টে দিতে চায়। কিন্তু তা কি সম্ভব? তার জন্যে প্রয়োজন সময়ের।
কলেজে ডিগ্রি কোর্স চালু হওয়াতে চাঁদপুর সরকারি কলেজ তেমন একটা খুশি হতে পারেনি। কারো কারো মনোভাব এমন ছিলো, পুরান বাজার কলেজে ডিগ্রি পড়াবে কি? কেউ কেউ তা প্রকাশ্যেই বলা শুরু করলো। ঐ সময়ে শহরের তিনিটি কলেজের মধ্যে একটা ঠা-া মনস্তাত্ত্বিক লড়াই চলতে থাকলো। সেটা আরো প্রকট আকার ধারণ করলো যখন উচ্চ মাধ্যমিকে পুরান বাজার কলেজ ভাল ফলাফল করলো। সরকারি কলেজের কোনো কোনো শিক্ষকের মানসিকতা ছিলো, বেসরকারি কলেজের শিক্ষকরা অস্পৃশ্য। কলেজগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকবে, কিন্তু নিজেদের মধ্যে আন্তঃ সম্পর্কটা ভালো থাকা উচিত। সেটার খুব অভাব ছিল। কোন্ কলেজ কোন্ কলেজের ছাত্রদের আটকাতে পারবে সেটার প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। পেছনে পেছনে কেউ কেউ দুর্নামও করতে থাকে। উপরন্তু তিন কলেজের অধ্যক্ষের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ছিল। দুই সরকারি কলেজের অধ্যক্ষগণ আমাদের অধ্যক্ষকে গণায় ধরতেন না। এতে করে সবার মাঝে একটা ইগো কাজ করতো। কেউ কাউকে না ছাড়ি এমন ভাব প্রকাশিত হতে থাকলো। এর প্রভাব পড়তো গিয়ে ছাত্র-ছাত্রী এবং সমাজের উপর। যা কোনো অবস্থাতেই কাম্য ছিলো না। যেহেতু তিন কলেজের শিক্ষকদের সাথে আমার একটা ভালো সম্পর্ক ছিলো, তাই এগুলো টের পেতাম। মনে মনে ভাবতাম, আমরা সবাই শিক্ষক, কেউ সরকারি কেউ বেসরকারি। আমাদের মধ্যে যদি আন্তরিকতার সম্পর্ক থাকে তবে শিক্ষার অগ্রগতি হবে এই শহরে। কিন্তু তিন কলেজের অধ্যক্ষ এবং কিছু শিক্ষকের জন্যে তা আরো প্রকট আকার ধারণ করে।
উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে কিভাবে ভাল ফলাফল করা যায় সে বিষয়ে আমরা সবাই আগ্রহী হয়ে পড়লাম। আমরা একটা কৌশল নিলাম। এসএসসি রেজাল্ট হবার পর শহরের ভাল ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবকদের বুঝিয়ে কলেজে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করলাম। এতে কাজও হয়েছে। শহরের ভাল স্কুলগুলো থেকে অনেক ভাল ছাত্র ছাত্রী ভর্তি হওয়া শুরু করলো। সেটার ফলও পাওয়া গেল। প্রথম পর্যায়েই দুই জন বোর্ডের মেধা তালিকায় স্থান করে নিলো। এ খবরটা ছড়িয়ে পড়লে পরবর্তী বছর ভাল ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হতে শুরু করে। আমরাও আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকি ছাত্র-ছাত্রীদের নার্সিং করতে। কিছু কিছু পদক্ষেপ নেয়া হলো। শিক্ষকদের সাথে দফায় দফায় আলোচনা করে পুরোদমে নার্সিং শুরু হলো। পরের বছরেই তার ফল পাওয়া গেল। শুরু হলো পুরান বাজার কলেজের নবযাত্রা। প্রতি বছরই কলেজে কেউ না কেউ বোর্ডের মেধা তালিকায় স্থান করে নিতে থাকলো। কলেজের সুনামও ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। দূরদূরান্ত থেকে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হতে থাকে।
এর প্রেক্ষিতে যেটা হলো, চাঁদপুর সরকারি মহিলা কলেজে ছাত্রী শূন্যতা দেখা দিলো। শহরের সরকারি স্কুলের ভালো ছাত্র-ছাত্রীরা আমাদের কলেজে ভর্তির জন্যে হুমড়ি খেয়ে পড়লো। এক পর্যায়ে মহিলা কলেজে ছাত্রী সংখ্যা কমতে কমতে বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছালো। চাঁদপুর সরকারি কলেজেও মানসম্মত শিক্ষার্থীর সংকট দেখা দিলো। পুরান বাজার কলেজের বৃহস্পতি তখন তুঙ্গে।
ইতিমধ্যে চাঁদপুর জেলায় কয়েকটি বেসরকারি কলেজ পুরান বাজার কলেজকে অনুসরণ করে চেষ্টা শুরু করলো। তারাও নানাভাবে চেষ্টা করতে লাগলো ভাল ফলাফলের। কয়েকটি কলেজের সে চেষ্টা ছিলো অনৈতিকতাকে প্রাধান্য দেয়া। যার ফলে তারা ভাল ফলাফল করলো ঠিকই কিন্তু সেটা নিখাদ ছিলো না। চাঁদপুর জেলার একটি বেসরকারি কলেজ ভাল ফলাফল করতে গিয়ে যতরকম অনৈতিকতা আছে তার সবটাই প্রয়োগ করতে থাকলো। এতে করে তারা প্রতিবছরই মেধা তালিকায় স্থান করে নিতে লাগলো। তাদের এ তথাকথিত ভাল ফলাফল নিয়ে জেলার শিক্ষাঙ্গনে মুখরোচক আলোচনাও হতে থাকে। তথাকথিত ভাল ফলাফলের অপকৌশলগুলো ধীরে ধীরে জনসম্মুখে আসা শুরু করলো। কোনো কোনো সময় সেগুলো মিডিয়ায় স্থান করে নিলো।
অর্থ যে সকল অনর্থের মূল সেটার সংযোগ রয়েছে এমন তথাকথিত ভালো ফলাফলের পেছনে। ফরম পূরণের সময় অনৈতিকভাবে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে পরীক্ষায় অনৈতিকতার সুযোগ করে দিতো। সেটা হয়ে গিয়েছিল ওপেন সিক্রেট। এ প্রক্রিয়ার সাথে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত সবাই জড়িত থাকতো। ১৯৯৮ সালে সারাদেশে বন্যার প্রকোপ । চাঁদপুর জেলা প্রশাসনে ডিসি হিসেবে ছিলেন জনাব রেজাউল করিম, এডিসি জনাব সিরাজুল ইসলাম (পরবর্তীতে স্বাস্থ্য সচিব), এডিসি জনাব ফিরোজ মিয়া, সহকারী কমিশনার হিসেবে আনোয়ার হোসেন চৌধুরী (বর্তমানে অতিরিক্ত সচিব), আনিসুর রহমান মিয়া (বর্তমানে অতিরিক্ত সচিব, জনপ্রশাসন), শক্কুর মিয়া, এবিএম ফাত্তাহ, এ টি এম নাসির মিয়া, রোকনোদ্দৌলা, সোলায়মান, সাঈদ কুতুব ও আবু সাঈদ। জেলা প্রশাসন থেকে উদ্যোগ নেয়া হলো যে কোনো মূল্যে জেলায় নকলের মহোৎসব বন্ধ করতে হবে।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) জনাব সিরাজুল ইসলাম নকল প্রতিরোধ করতে গিয়ে এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হলেন। তিনি অভিভাবকসহ সমাজের সকল স্তরের লোকদের নিয়ে মতবিনিময় সভা করলেন। আগাম বার্তা দিয়ে দিলেন, কোনো অবস্থাতেই পরীক্ষার হলে নকল করতে দেয়া হবে না। কাজটি ছিল খুবই দুরূহ। যে কাজের সাথে অর্থের সংযোগ থাকে সে কাজ প্রতিহত করা মানে আগুনে নিজেকে সঁপে দেয়া। জেলা প্রশাসক জনাব রেজাউল করিম এবং অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক জনাব সিরাজুল ইসলাম সাহেব কঠোর মনোভাব নিয়ে নকল উচ্ছেদ করার ঘোষণা দিলেন।
ঐ সময়ে চাঁদপুর জেলায় উচ্চ মাধ্যমিকের ১৭টি কেন্দ্র ছিলো। এই ১৭টি কেন্দ্রের জন্যে ১৭টি ভিজিল্যান্স টীম গঠন করা হলো। প্রতি টীমে ছিলেন একজন সহকারী কমিশনার, একজন কলেজ শিক্ষক, একজন সাংবাদিক। এমনভাবে টীমের সদস্যদের বাছাই করা হলো যারা সকল বিতর্কের ঊর্ধ্বে। সহকারী কমিশনার (শিক্ষা) আনোয়ার হোসেন চৌধুরী খুবই দক্ষ এবং সুচারুরূপে টীমের কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। কোন্ টীম কোন্ কেন্দ্রে আগামীদিন ডিউটি করবে তা কারোরই জানা ছিল না। পরীক্ষার দিন সকলে ডিসি অফিসের সামনে আসলে টীমের সদস্যরা গাড়ীতে উঠতেন। গাড়ি রওনা দিলে জানা যেত টীমের সদস্যরা আজ কোথায় যাচ্ছেন। বিষয়টি গোপনীয়তার সাথেই করা হতো।
আমি যে টীমে ছিলাম সে টীমের নেতৃত্বে ছিলেন এডিসি (সার্বিক) জনাব সিরাজুল ইসলাম। আর একজন সাংবাদিক। অনেক সময় দুই তিনজন শিক্ষকও থাকতেন। ১৯৯৯ সালে এসএসসি পরীক্ষা শুরু হলো। প্রথম ইংরেজি পরীক্ষার দিন আমাদের টীম রওয়ানা হলো চাঁদপুর জেলার মতলব উপজেলার ছেঙ্গারচর কেন্দ্রে। খুব সকাল বেলা আমরা রওয়ানা হলাম। টীমের সদস্য সংখ্যা ৫ জন। মতলব ফেরি পার হয়ে বেড়িবাঁধে কাদা মটির উপর দিয়ে গাড়ি চলছে গন্তব্যের দিকে। ছেঙ্গারচর হাই স্কুল কেন্দ্রের কাছাকাছি যেতে দূর থেকে নজরে পড়লো হাজার হাজার লোকের উপস্থিতি। মনে হলো সেখানে কোনো জনসভা হবে। আমরা অতিথি হিসেবে সেখানে যাচ্ছি। ছেঙ্গারচর বাজারে পৌঁছে আমরা গাড়ি থেকে নামলাম। কেন্দ্রের দিকে এগুনো দুরূহ। মানুষ আর মানুষ। কোনো রকমে ভীড় ঠেলে ১৫ মিনিট পর আমরা স্কুলে পৌছালাম। তখনও পরীক্ষা শুরুর প্রায় ৩০ মিনিট বাকি।
আমরা কেন্দ্রে পৌঁছাবার পর উৎসুক মানুষের ভীড় বেড়ে গেল। পরীক্ষা শুরু হয়ে যাবে কিছুক্ষণ পর। পুলিশকে রীতিমত হিমশিম খেতে হচ্ছে বহিরাগতদের কেন্দ্র থেকে বের করে দিতে। প্রধান শিক্ষক জানালেন কেন্দ্রের পরীক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় আড়াই হাজারের মত। সেখানে এতো বেশি পরীক্ষার্থী হওয়ার কারণ হলো, আশেপাশের মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা, কুমিল্লা থেকে পরীক্ষার্থীরা এখানে বিশেষ সুবিধা নেয়ার জন্যে পরীক্ষা দিতে আসে। পরীক্ষার্থীদের চেহারা এবং অভিভাবকদের দেখে বুঝা গেলো তাদের অধিকাংশই অভিজাত ঘরের সন্তান।
বিদ্যালয়ের রুমে আসন হয় না বলে স্কুলের মাঠে অস্থায়ী সামিয়ানা দিয়ে আসন ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাইরে নেমে দেখলাম কেন্দ্রের চারদিকে হাজার হাজার লোক সমবেত। তখন আমার মনে হলো কোনো জনসভা হচ্ছে, জনসভা দেখতে হাজার হাজার লোক এসেছে। পরীক্ষা শুরু হলো। প্রথম ১০ মিনিট সবার কলম বন্ধ। ছাত্ররা অসহিষ্ণু হয়ে তাদের অপকর্ম শুরু করলো। আমরা টীমের ছয় জন আমাদের কাজ শুরু করলাম। যতো সব অভিনব কায়দায় নকল করা হচ্ছে। আর সে নকলে সহযোগিতা করছেন কেন্দ্রের শিক্ষক এবং সমবেত অভিভাবকরা। আমরা ভিজিল্যান্স টীমের সদস্যদের সিরাজ স্যার নির্দেশ দিলেন অভিযান পরিচালনা করতে। আমরা প্রথম সতর্ক করে দিলাম। কিন্তু কে শুনে কার কথা। একে একে ধরা পড়তে লাগলো। তাদের বহিষ্কারের জন্যে পাঠানো হচ্ছে কেন্দ্র সচিকের কাছে। অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে আরেক বিড়ম্বনার শিকার হলাম। বহিষ্কার হবার পর মেয়েরা যেভাবে কান্নাকাটি শুরু করেছে সেটা পুরো কেন্দ্রে একটি ভীতির সৃষ্টি করেছে। সারা কেন্দ্রে কান্নার রোল পড়ে গেল। আমরাও বিব্রত হলাম। সিরাজ স্যার একটা কৌশল নিলেন। তিনি বহিষ্কৃতদের তাদের অভিভাবকের হাতে তুলে দিয়ে কেন্দ্র ত্যাগ করতে বল্লেন। এতে কাজ হলো। কেন্দ্রের অবস্থা এমন ছিলো যে, আমরা ছয় জন ছাড়া বাকিরা এক পক্ষ আর আমরা বিরোধী পক্ষ। পুরো তিন ঘণ্টা অবস্থান করে ফলাফল ১৪৬ জন বহিস্কার। আমার হাতেই বহিষ্কার হয়েছে ৯৫ জন। পরীক্ষা শেষে কেন্দ্র ত্যাগ করার সময় একটু শংকিতই ছিলাম। তবে ভরসা ছিল সিরাজ স্যার সাথে আছেন। স্যার ছিলেন অত্যন্ত সাহসী এবং কঠোর। স্যারের ব্যক্তিত্বের কাছে সকলে মাথা নত করতো।
ছেঙ্গারচর বাজার পার হয়ে এসে যখন গাড়িতে উঠি তখন নিজের ভেতর একটা ভয় কাজ করেছে। পুলিশ আমাদের স্কট করে গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছে। গাড়ি কেন্দ্র ত্যাগ করার পর আমরা স্বস্তির নিঃশ^াস নিলাম। এক দুঃসাহসিক অভিযান ছিলো এটি । আজো সেটি মনে করলে শিহরিত হতে হয়। অভিজ্ঞতা হলো শিক্ষক, অভিভাবক একজোট হয়ে নকলের পক্ষে। শিক্ষক যখন নকল সহযোগিতায় জড়িয়ে পড়ে তখন শিক্ষা ব্যবস্থা বলতে কিছুই থাকে না। (চলবে)