প্রকাশ : ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:১৬
বাংলাদেশে সেবামূলক রাজনীতি ও রাষ্ট্র সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা
রাজনীতি প্রতিটি রাষ্ট্রের কেন্দ্রবিন্দু, যা জনগণের সেবায় নিয়োজিত থাকা উচিত। একটি আদর্শ রাজনৈতিক ব্যবস্থা রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও সুশাসনের মূল হাতিয়ার। কিন্তু বাস্তবে বাংলাদেশের রাজনীতি প্রায়শই ব্যক্তিস্বার্থ, ক্ষমতার লোভ এবং দুর্নীতির সাথে জড়িয়ে পড়েছে, যার ফলে সুশাসন, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং গণতন্ত্র দুর্বল হচ্ছে।
|আরো খবর
রাজনীতি এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যা জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করতে পারে এবং তাদের আশীর্বাদস্বরূপ কাজ করতে পারে। বাংলাদেশের জন্যে রাজনীতি শুধু ক্ষমতার লড়াই নয়, এটি মানুষের সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি, স্বাধীনতা এবং স্বাধীন মতামতের জন্যে লড়াইয়ের প্রতীক। তবে আমাদের বর্তমান প্রেক্ষাপটে, রাজনীতি অনেক সময় ব্যক্তিগত লাভ ও ক্ষমতা দখলের চক্রে আটকে গেছে, যেখানে জনকল্যাণের চেতনা ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে জনকল্যাণমূলক কাজের উদ্দেশ্যে প্রবেশ করলেও বাস্তবে এটি অধিকাংশ ক্ষেত্রে ক্ষমতা ও সম্পদ অর্জনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বংশানুক্রমিক রাজনীতির ফলে পরিবারের উত্তরাধিকারীরা রাজনৈতিক মঞ্চে অধিকার বিস্তার করেন, যা প্রকৃত যোগ্যদের জন্যে বাধা সৃষ্টি করে। ব্যক্তিগত স্বার্থে রাজনীতিবিদরা জনগণের প্রকৃত সমস্যা উপেক্ষা করেন এবং দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রের সম্পদ লুটপাট করেন। এতে করে জনকল্যাণমূলক কাজ পিছিয়ে পড়ে এবং জনসাধারণ তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে বুঝতে হবে যে, আমাদের রাজনৈতিক কাঠামো বহু চড়াই-উতরাই পার হয়ে তৈরি হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতাকে কেন্দ্র করে এক নতুন রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটে। কিন্তু ধীরে ধীরে, ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক প্রভাব প্রতিষ্ঠার প্রবণতা রাজনীতির প্রকৃত রূপকে বদলে দিয়েছে। পারিবারিক রাজনীতির সংস্কৃতি সাধারণ জনগণের মধ্যে হতাশা তৈরি করেছে এবং প্রকৃত যোগ্য নেতৃত্বের সুযোগ সংকুচিত হয়েছে।
রাজনীতির মূল লক্ষ্য জনকল্যাণ হলেও, অনেক ক্ষেত্রে এটি ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করার একটি মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনকল্যাণমূলক কাজ করার জন্যে রাজনীতির যে উদ্দীপনা এবং আদর্শ থাকা উচিত, সেটি অনেক ক্ষেত্রে আর কার্যকর নেই। এভাবে সাধারণ মানুষ তাদের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছেন এবং তাদের ন্যায্য অধিকার থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। তবে বিশ্বের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশ উদাহরণ হয়ে রয়েছে, যেখান থেকে বাংলাদেশের জন্যে অনুপ্রেরণা নেওয়া সম্ভব।বিশ্ব রাজনীতির উদাহরণ এবং বাংলাদেশে এর প্রতিফলন
নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড ও কানাডার মতো দেশগুলো সেবামূলক রাজনীতির মডেল হিসেবে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। এসব দেশে রাজনৈতিক নেতৃত্ব জনসেবায় নিবেদিত এবং জনগণের কল্যাণই তাদের প্রধান লক্ষ্য। উদাহরণস্বরূপ, সুইজারল্যান্ডে জনগণ সরাসরি গণতন্ত্রের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, যা তাদের প্রশাসনের অংশীদারিত্বকে নিশ্চিত করে এবং রাজনৈতিক দায়বদ্ধতাকে সুসংহত করে। এই সব উদাহরণ আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, যেখানে নেতা-কর্মীরা জনসেবাকে নিজেদের মূল মন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করেন, সেখানে উন্নয়ন ও শান্তির পথ উন্মুক্ত হয়। বাংলাদেশও এই পথে এগিয়ে যেতে পারে, যদি রাজনীতিকে ব্যক্তিগত স্বার্থ থেকে দূরে সরিয়ে জাতীয় স্বার্থে সংযুক্ত করা হয়।
বিভিন্ন দেশে সেবামূলক ও সৎ রাজনীতির চর্চা জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করছে। এসব উদাহরণে দেখা যায় যে, জনসেবাকে প্রাধান্য দিলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব :
* নরওয়ে : সরাসরি জনগণের ভোটের মাধ্যমে সৎ নেতৃত্ব নির্বাচিত হয়। এখানে সুশিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও পরিবেশ রক্ষার মাধ্যমে উন্নয়ন নিশ্চিত করা হয়েছে।
* সুইজারল্যান্ড : সরাসরি গণতন্ত্রের মাধ্যমে জনগণ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। প্রশাসন জনগণের মতামতকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে পরিচালিত হয়।
* নিউজিল্যান্ড : এই দেশের জনপ্রতিনিধিরা সততা ও জনকল্যাণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। করোনাভাইরাস মহামারিতে তারা কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে জনগণের কল্যাণে কাজ করেছে।
* কানাডা : এখানে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং সামাজিক নিরাপত্তা প্রচারের জন্যে সেবামূলক রাজনীতি বিদ্যমান। সরকার জনগণের জীবনমান উন্নয়নে নিয়োজিত রয়েছে।
এই উদাহরণগুলো আমাদের শিক্ষা দেয় যে, যেখানে সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব জনগণের সেবা নিশ্চিত করতে চায়, সেখানেই রাষ্ট্রের উন্নয়ন ঘটে এবং জনগণ মর্যাদার সঙ্গে জীবনযাপন করতে পারে।বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি :
দুর্নীতি বাংলাদেশের উন্নয়নের পথকে বাধাগ্রস্ত করছে। যখন রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের স্বার্থে ক্ষমতার অপব্যবহার করেন, তখন তা কেবল একটি জাতির মূল্যবোধকেই গ্রাস করে না, বরং সাধারণ মানুষের জীবনমানকেও বিপর্যস্ত করে। জনগণের করের অর্থ যখন ব্যক্তিগত লাভের জন্যে ব্যবহার করা হয়, তখন সামাজিক বৈষম্য আরও বৃদ্ধি পায়।
দুর্নীতি প্রতিষ্ঠিত হলে রাজনীতির প্রকৃত উদ্দেশ্য থেকে সরে যায় এবং দেশের সার্বিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। এর প্রভাব গণমাধ্যম, প্রশাসন, বিচার বিভাগ, এমনকি শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রেও পড়ে, যা একটি সমৃদ্ধ জাতি গঠনে বাধা সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের জন্যে একটি দুর্নীতিমুক্ত শাসনব্যবস্থা এবং সেবামূলক রাজনীতির চর্চা নিশ্চিত করতে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলা অপরিহার্য।
দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের ফলে সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি পায়। ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থাকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে, ফলে আইন ও ন্যায়বিচারের মান ক্ষুণ্ন হয়। এর ফলে সামাজিক বিভাজন ও আর্থিক বৈষম্য সৃষ্টি হয়। রাজনৈতিক দলের প্রভাবাধীন প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থা জনগণের স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার এবং গণতন্ত্রের শুদ্ধি প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে।
গবেষণার মতে, দেশের মোট জনসংখ্যার একটি বড়ো অংশ মনে করে দুর্নীতি রাজনৈতিক সংস্কারকে বাধাগ্রস্ত করছে। একাধিক জরিপে প্রমাণিত হয়েছে যে, বাংলাদেশের নাগরিকরা এমন নেতৃত্বের প্রত্যাশা করেন, যারা সৎ, নিষ্ঠাবান ও গণমুখী। বিশ্বব্যাংক ও টিআইবির তথ্য অনুযায়ী, দুর্নীতির কারণে দেশের রাজস্ব ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যা জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডেও বাধা সৃষ্টি করে।জনগণের অধিকার ও মুক্তির সংগ্রামের প্রয়োজন :
প্রত্যেক মানুষ স্বাধীন, সম্মানজনক এবং মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের অধিকার রাখে। যখন রাজনীতি ও শাসনব্যবস্থা জনগণের এই অধিকারকে খর্ব করে, তখন জনগণ শাসনের অবিচার ও শোষণের শৃঙ্খল থেকে মুক্তির জন্যে সংগ্রাম করতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশেও জনগণ সুশাসন ও স্বাধীনতার জন্যে একটি শক্তিশালী ও কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দাবি জানায়। জনমুক্তির জন্যে অন্যায় ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম অপরিহার্য।
বিদ্যমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ক্ষমতাসীন দল এবং বিরোধী দলের মধ্যে টানাপোড়েন, নির্বাচনী প্রচারণা ও নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতি দেশের গণতন্ত্রকে কতটা প্রভাবিত করে, তা নিয়ে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। গণমাধ্যমের ওপর চাপ এবং তথ্যপ্রযুক্তি আইনের অপব্যবহার নিয়ে মানুষের অসন্তোষ বাড়ছে, যা মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করছে।বাংলাদেশের রাষ্ট্র সংস্কারের জন্যে প্রস্তাবিত পদক্ষেপসমূহ:
বাংলাদেশে রাজনীতিকে সেবামূলক ও সৎ ব্যবস্থায় রূপান্তর করার জন্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া দরকার :
১. নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধি :
জনগণের মধ্যে সঠিক রাজনৈতিক শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে তারা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে অবগত হতে পারে এবং সৎ নেতৃত্ব নির্বাচন করতে সক্ষম হয়। শিক্ষিত ও সচেতন জনগণ অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মানসিকতা গড়ে তোলে এবং সুশাসনের দাবিতে সোচ্চার থাকে।
নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য শিক্ষার প্রসার এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অপরিহার্য। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনিক প্রতিবন্ধকতা এবং রাজনৈতিক প্রভাব নাগরিকদের সচেতনতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করে।
সুশাসন প্রতিষ্ঠায় দুর্নীতি প্রতিরোধে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন, তা অনেক সময় শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে কার্যকর করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই প্রশাসনিক সংস্থাগুলোকে আরও শক্তিশালী এবং নিরপেক্ষ করা জরুরি।
২. স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক শাসন প্রতিষ্ঠা :
সরকারের প্রতিটি স্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি। দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সকল প্রশাসনিক সংস্থাকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। এতে জনগণের প্রতি নেতৃবৃন্দের দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি পাবে এবং দুর্নীতি দমন কার্যকর হবে।
৩. নির্বাচনী ব্যবস্থায় সংস্কার :
একটি সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যাতে রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতায় আসতে শুধু জনগণের কল্যাণেই কাজ করতে ইচ্ছুক নেতারা নির্বাচন জিততে পারে। নির্বাচনে অর্থের প্রভাব কমিয়ে সাধারণ মানুষের যোগ্য প্রতিনিধিরা যেন ক্ষমতায় আসতে পারে সেজন্যে নির্বাচনী সংস্কার অপরিহার্য।
৪. বিচার ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার স্বতন্ত্রতা রক্ষা :
বিচার বিভাগ এবং প্রশাসনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে। জনগণের সুষ্ঠু বিচার এবং প্রশাসনিক সেবার জন্য এই দুই বিভাগকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। এতে জনগণ বিচার ও প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার ওপর আস্থা রাখতে পারবে।
৫. গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা :
গণমাধ্যম একটি দেশের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে কাজ করে। সরকারের ভুল পদক্ষেপ এবং সামাজিক অন্যায়গুলো জনসমক্ষে তুলে ধরতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অপরিহার্য। স্বাধীন সাংবাদিকতা জনগণের সঠিক তথ্য পাওয়ার অধিকার রক্ষা করে এবং শাসকদের জন্যে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে।
৬. পারিবারিক রাজনীতির সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা :
পারিবারিক রাজনীতির সংস্কৃতি দূর করে প্রকৃত যোগ্য ও সৎ প্রার্থীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিতে হবে। রাজনীতি যেন শুধু একটি পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে এবং যোগ্য নেতৃত্বের সুযোগ সৃষ্টি হয়।
৭. সংখ্যালঘু, বর্ণবৈষম্য ও নারীর প্রতি সমতা
বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে সংখ্যালঘুদের অধিকার ও সুরক্ষার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সমাজের কোনো একটি অংশ যখন অবহেলিত হয়, তখন তা সামগ্রিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। যদিও নারী সমাজের অবদান আজকের পৃথিবীতে সর্বত্র স্বীকৃত, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরে তাদের সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগানো হয়নি। বর্ণবৈষম্য ও লিঙ্গবৈষম্য দূর করার মাধ্যমে বাংলাদেশে রাজনীতিকে আরও অধিক অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সমৃদ্ধিশালী করা সম্ভব হবে।কীভাবে সেবামূলক রাজনীতি বাস্তবায়িত করা সম্ভব : সেবামূলক রাজনীতি প্রতিষ্ঠায় একাধিক বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। প্রথমত, জনগণকে সচেতন করতে হবে যেন তারা নিজেদের অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে অবগত হয়। এজন্যে শিক্ষা ব্যবস্থা ও সামাজিক সচেতনতামূলক কর্মসূচি নেওয়া যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের সেবামূলক ভূমিকা পালনে আরও সক্রিয় হতে হবে। তৃতীয়ত, প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে দুর্নীতিমুক্ত ও স্বচ্ছ রাখতে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ বিভিন্ন সংস্থাকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। চতুর্থত, জনমত প্রকাশের সুযোগ প্রদান এবং তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করতে গণমাধ্যমকে স্বাধীনভাবে কাজ করার অনুমতি দিতে হবে।
গণতন্ত্র, জবাবদিহিতা এবং রাজনৈতিক সংস্কার গণতন্ত্রকে অর্থবহ করতে হলে একটি শক্তিশালী ও জবাবদিহিমূলক রাজনৈতিক পরিবেশের প্রয়োজন। সুষ্ঠু নির্বাচনী প্রক্রিয়া এবং স্বচ্ছ প্রশাসনিক কাঠামো গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকাশে সহায়ক হতে পারে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা গেলে রাজনৈতিক সংস্কারের এই ধারা আরও মজবুত হবে।
জনসচেতনতা ও নাগরিকের ভূমিকা বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনে নাগরিকদের সচেতনতা অপরিহার্য। রাজনৈতিক সচেতনতা ছাড়া প্রকৃত নেতৃত্ব বেছে নেওয়া যায় না। সাধারণ মানুষের মধ্যে নেতৃত্বের যোগ্যতার মূল্যায়ন ও বাছাইয়ের ক্ষমতা তৈরি হলে, তবেই সৎ নেতৃত্ব উঠে আসবে। জনগণের মধ্যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার সাহস তৈরি করতে হবে এবং শিক্ষিত ও সচেতন সমাজই এটি করতে পারে।
সর্বোপরি, সংক্ষিপ্ত ও দীর্ঘমেয়াদী নীতির দিকনির্দেশনা
স্বল্প-মেয়াদি নীতিমালা
* কী : স্বল্প-মেয়াদি নীতিমালা হলো এমন উদ্যোগ, যা দ্রুত ফল দিতে পারে এবং তাৎক্ষণিক সমস্যার সমাধানে সহায়ক।
* কেন : দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও জনগণের সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান করতে হবে, যাতে জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা যায়।
* কীভাবে : প্রশাসনিক সংস্কার, দুর্নীতি দমন এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
* কার জন্যে : সাধারণ জনগণের কল্যাণ ও উন্নয়নের জন্যে, যাতে তারা সঠিক ও সৎ নেতৃত্ব পেতে পারে।
* কখন : বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের আলোকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই নীতিমালা বাস্তবায়ন করা জরুরি।দীর্ঘ-মেয়াদি নীতিমালা
* কার্যকরী করা : রাজনৈতিক কার্যক্রমগুলোকে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে, যাতে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যায়।
* ফলোআপ করা : প্রতিটি কার্যক্রমের সাফল্য ও ব্যর্থতা পর্যালোচনা করা এবং সেখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা।জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা
* জনগণের কাছে জবাবদিহিতা : রাজনৈতিক নেতারা ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের তাদের কাজের জন্যে জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। জনগণকে এই ক্ষমতা দেওয়া উচিত, যাতে তারা জানতে পারে তাদের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা কীভাবে তাদের স্বার্থে কাজ করছেন।
* স্বচ্ছতা : জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করতে প্রশাসন ও সরকারের সকল কার্যক্রমে স্বচ্ছতা বজায় রাখা জরুরি। জনগণের কাছে তথ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা উচিত, যাতে তারা কার্যক্রম সম্পর্কে সচেতন থাকতে পারে।
* দায়িত্বশীলতা : রাজনৈতিক নেতাদের এবং সরকারি কর্মকর্তাদের কার্যক্রম ও সিদ্ধান্তের জন্যে দায়িত্ব নিতে হবে। জনগণ তাদের কাজের ফলাফল জানার অধিকারী এবং তাদের মতামতকে মূল্যায়ন করতে হবে।
* জনগণ সকল ক্ষমতার মালিক : জনগণের অধিকার ও ক্ষমতা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তারা তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারে এবং নীতি নির্ধারণে অংশগ্রহণ করতে পারে।বাংলাদেশের রাজনীতিকে একটি সেবামূলক ক্ষেত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হলে ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জনগণের প্রকৃত কল্যাণের জন্যে কাজ করতে হবে। দুর্নীতিমুক্ত এবং নীতিনিষ্ঠ রাজনৈতিক কাঠামো দেশকে সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যেতে সহায়ক হবে। এমন একটি দেশ গড়ে তোলা উচিত, যেখানে জনগণ শান্তি, নিরাপত্তা এবং ন্যায়বিচার উপভোগ করতে পারে।
রাজনীতিকে জনগণের সেবা ও দেশের সার্বিক উন্নয়নের মূল চালিকা শক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে রাজনৈতিক সংস্কার অপরিহার্য। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে ব্যক্তিগত লাভের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার বন্ধ করে, সেবামূলক ও ন্যায়নিষ্ঠ রাজনীতি প্রতিষ্ঠার জন্যে সচেষ্ট হতে হবে। সঠিক নেতৃত্ব নির্বাচনের জন্যে জনগণের মাঝে সচেতনতা তৈরি করা, প্রশাসনিক ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষা করা এবং দুর্নীতিমুক্ত রাজনীতি প্রতিষ্ঠার জন্যে শক্তিশালী পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।
যদি রাজনীতির মূল লক্ষ্য জনগণের কল্যাণ হয়, তবে দেশ সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশে সেবা ও উন্নয়নমুখী রাজনীতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সাম্য এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে, যা দেশের প্রতিটি মানুষের জন্য স্বাধীন, সম্মানজনক এবং শান্তিময় জীবনযাপনের ভিত্তি স্থাপন করবে।
এই সংক্ষিপ্ত ও দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালাগুলো বাংলাদেশকে একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক ও জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়তা করবে। যখন জনগণ সক্রিয়ভাবে রাজনীতির অংশ হবে, তখনই দেশের উন্নয়ন সম্ভব।
এভাবেই বাংলাদেশের রাজনীতিকে একটি গণতান্ত্রিক, জনকল্যাণমুখী এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থায় পরিণত করা যাবে। জনগণ যেন একটি সুন্দর, মর্যাদাপূর্ণ ও স্বাধীন জীবনযাপন করতে পারে, এটাই হওয়া উচিত রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য।
রহমান মৃধা : সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। [email protected]