প্রকাশ : ০২ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:২২
পলিথিনের অবাধ ব্যবহার বন্ধে সরকারের মহতী উদ্যোগ
পরিবেশের শত্রু পলিথিন ব্যাগের অবাধ ব্যবহার বন্ধে সরকারের উদ্যোগে যুগোপযোগী ও কার্যকর অধ্যায়ের সূচনা হতে যাচ্ছে। মূলত চাঁদপুরসহ সারাদেশের হাট-বাজারের দোকানে, ফল ও মাছ বাজারে, কাঁচা তরকারির দোকানসহ ছোট-বড়-মাঝারি বিপণী, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার আশপাশের দোকানগুলো পলিথিন ব্যাগে সয়লাব। এর ব্যবহার এতোটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, প্রতিটি আইটেমের সওদার জন্যে দোকানি ক্রয়কৃত জিনিসপত্র পলিথিনে ভরে দিতে কোনো প্রকার কার্পণ্যবোধ করছেন না।
মোট কথা, বাজারের স্থায়ী দোকান থেকে খোলা বাজারের খুচরা যে কোনো দ্রব্য কেনা মাত্র পলিব্যাগে ঢুকিয়ে ক্রেতাকে সহাস্য বদনে দিচ্ছে বিক্রেতা। বিশেষ করে গ্রাম্য ছোট ছোট হাট বাজারের মুদি দোকানগুলোতে এ পলিথিনের ব্যবহার ও কেজি দরে অন্য দোকানিদের কাছে বিক্রি করার দৃশ্য ব্যাপক হারে দেখা যাচ্ছে।
এক শ্রেণির মোটরসাইকেল আরোহী এস আর বা বিক্রয় প্রতিনিধি গুদাম থেকে ১শ, ২শ, ২শ ৫০ ও ৫ শ’ গ্রামের প্যাকেট নিয়ে প্রতিটি দোকানে সরবরাহ করে থাকে। যারা এসআর, এসব সরবরাহ করা তাদের মাসিক বেতন বা কমিশনভিত্তিক। ঐ সব এসআরের কেউ কেউ দৈনিক আয় হিসেবে পেয়ে থাকেন বেতন বা কমিশন। অপর দিকে সব ধরনের দোকানী দোকানে বসেই ওইসব পলিথিন ব্যাগের প্যাকেট পেয়ে যান সহজে। আগে ছিলো এসব পলিথিন ব্যাগ নানা রং বেরংয়ের। এসব
বন্ধ না করা গেলে পরিবেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়া বাড়তেই থাকবে। পলিথিন বন্ধে প্রয়োজনীয় আইন আছে, কিন্তু কতোটুকু প্রয়োগ হচ্ছে তা বোঝা যাচ্ছে না। পলিথিন ব্যাগ ও প্লাস্টিক দ্রব্য ব্যবহার দেশের পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পলিথিন পরিবেশগত ভারসাম্যকে দারুণভাবে ব্যাহত করে চলছে। তাই পলিথিনমুক্ত দেশ গড়তে জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সকলকেই এগিয়ে আসা উচিত।
সম্ভবত পলিথিনের অবাধ ব্যবহার বা অপব্যবহারের মাত্রা অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধির বিষয়টি বুঝতে পেরে পরিবেশের শত্রু পলিথিন ব্যাগের অবাধ ব্যবহার বন্ধে সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, ১ অক্টোবর থেকে সুপার শপগুলোতে এবং ১ নভেম্বর থেকে সব কাঁচাবাজারে পলিথিন ও পলিপ্রপাইলিনের তৈরি ব্যাগ ব্যবহার বন্ধ করা হবে। পলিথিন বা পলিপ্রপাইলিনের ব্যাগ ব্যবহারে যে নিষেধাজ্ঞা আছে, সেটি কার্যকর করতে ১ অক্টোবর থেকে সুপার শপগুলোতে এবং ১ নভেম্বর থেকে কাঁচাবাজার গুলোতে আইনের প্রয়োগ করতে যাচ্ছি। একই সঙ্গে ১ নভেম্বর থেকে পলিথিন যারা উৎপাদন করে সেখানে আমরা আমাদের অভিযান পরিচালনা শুরু করবো। সবাই পর্যাপ্ত সময় পাচ্ছেন। আমরাও বিকল্প সরবরাহের জন্য কাজ করছি।
২৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মোহাম্মদপুরের টাউন হলের ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন কাঁচাবাজার বণিক সমিতির অফিসে পলিথিন শপিং ব্যাগ বন্ধে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা বিষয়ে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় তিনি এসব সিদ্ধান্তের কথা জানান। এর আগে পলিথিন শপিং ব্যাগ, পলিইথাইলিন বা পলিপ্রপাইলিনের তৈরি সামগ্রীর ওপর বিদ্যমান নিষেধাজ্ঞা কঠোরভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে টাউন হল কাঁচা বাজারে ক্লিন-আপ কার্যক্রম উদ্বোধন ও বাজারে পলিথিনের বিকল্প সামগ্রী বিতরণ, বাজারে বিদ্যমান পলিথিন ব্যাগসহ অন্যান্য পলিথিনজাত প্যাকেজিং সংগ্রহের জন্য বিন ও স্থায়ী নোটিশ বোর্ড স্থাপন কাজের উদ্বোধন করেন পরিবেশ উপদেষ্টা।
মতবিনিময় সভায় পরিবেশ উপদেষ্টা আরো বলেন, ১ অক্টোবর থেকে ঢাকার সুপার শপগুলোতে প্লাস্টিক ও পলিপ্রপাইলিনের ব্যাগ আর ব্যবহার বন্ধ সরকারের একক কোনো সিদ্ধান্ত নয়। এটি সুপার শপগুলোর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এর বিকল্প হিসেবে পাট, কাপড় ও কাগজের ব্যাগ ব্যবহার করা হবে। এজন্যে বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশনসহ ২০-২৫টি প্রতিষ্ঠান পাট, কাপড় ও কাগজের ব্যাগ তাদের সরবরাহ করবে। ইতোমধ্যে সুপার শপগুলো তাদের চাহিদা দিয়েছে এবং তাদের চাহিদা অনুযায়ী ব্যাগের যোগানের ব্যবস্থা করা হয়েছে ।
পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা বলেন, কাঁচা বাজারগুলো যাতে আর পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার না করে সেজন্যে আমরা বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। এটা নতুন করে নিষেধ করার কিছু নেই। এটা ২০০২ সাল থেকে আইন করে নিষিদ্ধ করা আছে। বিভিন্ন সময়ে পলিথিন উৎপাদনকারী বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে অভিযান চালানো হয়েছিল। কিন্তু মার্কেটে কখনো অভিযান চালানো হয়নি। ফলে মার্কেটগুলো দেদারসে পলিথিন এনেছে এবং পলিথিনে পণ্য দিয়েছে।
রিজওয়ানা হাসান আরো বলেন, সুপার শপের পাশাপাশি আমরা ১ নভেম্বর থেকে কাঁচা বাজারগুলোতে পলিথিন ও পলিপ্রপাইলিনের ব্যাগ ব্যবহার বন্ধে কার্যক্রম শুরু করবো। সেটি আজকের মতো আলাপ-আলোচনা নয়, আইন প্রয়োগ করা হবে। দোকান মালিক সমিতির নেতারাও আমাদের কথা দিয়েছেন, এক মাসের মধ্যে তারা পলিথিনের পরিবর্তে পাট, কাপড় বা কাগজের ব্যাগ ব্যবহার শুরু করবেন। সকলকে বুঝতে হবে, পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার ক্ষতিকর। এটা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। এ নিয়ে আমাদের সতর্ক, সচেতন ও উদ্যোগী হওয়ার সময় পার হয়ে গেছে। আমরা বরং দেরিতে শুরু করলাম।
পরিবেশের শত্রু পলিথিন ব্যাগের অবাধ ব্যবহারের রেওয়াজ যেভাবে আমাদের দেশে প্রবেশ করে :
যতদূর জানা গেছে, ১৯৪৫ সালের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিভিন্ন দেশে বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক দ্রব্যের ব্যবহার শুরু হয়। ফলে আমেরিকার জনৈক বিজ্ঞানী হালকা, শক্ত ও নমনীয় এ পলিথিন উদ্ভাবন করেন। সে থেকে ১৯৫৮ সালে সর্বপ্রথম আমেরিকায় এর উৎপাদন ও ব্যবহার শুরু হয়। অপর এক সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭৬ সালে ফিলিপাইনের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড. সোকানো গবেষণা করে ক্যারোলিনা বা এক ধরনের টেট্রন উদ্ভাবন করেন। এর ওপর ব্যাপক পরীক্ষা- নিরীক্ষা চালিয়ে আশির দশকে পলিথিন ও প্লাস্টিক দ্রব্য বাজারজাত শুরু হয়। সে থেকেই আমাদের দেশে এর প্রচলন অনুপ্রবেশ করে।
১৯৮৩ সালে বাংলাদেশের ঢাকায় সর্বপ্রথম পলিথিন উৎপাদন কারখানা স্থাপিত হয়। ধীরে ধীরে ব্যাপক চাহিদা মেটাতে ২০০০ সালে সারা দেশে ১৫ হাজার ছোট বড় পলিথিন কারখানার সংখ্যা দাঁড়ায়। প্রায় ৩০-৪০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হলেও পলিথিন দেশের সর্বত্র পরিবেশের ওপর মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করে। বিশেষ করে দেশে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হচ্ছে কোটি কোটি মানুষ। পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার যে কতোটুকু বৃদ্ধি পেয়েছে তা বলে শেষ করা যাবে না। এক কথায় দৈনন্দিন জীবনে প্রতিটি ক্ষেত্রে পলিথিনের ব্যবহার মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পায়। দেশের ছোট, বড়, শহর, বন্দর, নগর, হাট বাজার রেলস্টেশন, লঞ্চ স্টেশনের যে কোনো দোকানেই পলিথিন ব্যাগ পাওয়া যায়। ক্রয় করা মাত্রই দোকানি যাবতীয় জিনিসপত্র পলিথিন ব্যাগে ভর্তি করে সহাস্য বদনে প্রদান করে থাকে। দেশে এর ব্যবহার সকল প্রকার দ্রব্যের মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। বর্তমানে মাছও পলিথিন মুড়িয়ে বিক্রেতা দিচ্ছে।
পলিথিন ব্যাগের অবাধ ব্যবহারের বিরূপ প্রতিক্রিয়া :
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশে এক সময় প্রতিদিন ৬০ লাখ পলিথিন ব্যাগ বর্জ্য হিসেবে জমা হতো। এভাবে প্রতি বছর ১৬২ কোটি ব্যাগ জমা হতো। ৮০% ভাগই যেখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে। বাকি ২০% মাত্র অপসারণ করা সম্ভব ছিলো। এর সহজ ব্যবহার ও সহজলভ্যতার কারণে দিনদিনই এর ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। ফলে মাত্র কয়েক বছরেই আমাদের পরিবেশ মারাত্মক বিপন্নতার দিকে চলে যায় । পলিথিন পচনশীল নয় বিধায় পরিবেশের ওপর মারাত্মক হুমকি। এটা সম্পূর্ণ রাসায়নিক পদার্থ দ্বারা তৈরি।
বিজ্ঞানীদের মতে, পলিথিন বা প্লাস্টিক ক্ষয় হয় না এবং অনেক বছর অক্ষত থাকে। ইহা মাটির জন্যে খুবই ক্ষতিকর। মাটির মারাত্মক ক্ষতি করে, মাটিতে সূর্য রশ্মি পৌঁছাতে বিঘ্ন ঘটায়, ফসলের জমিতে উৎপাদন ব্যাহত করে, আগুনে পুড়লে জনস্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি করে, শহর নগর বন্দরের সকল প্রকার ড্রেনেজ ব্যবস্থার মারাত্মক বিঘ্ন সৃষ্টি করে, নালা নর্দমা বন্ধ করে মারাত্মক দুর্গন্ধ বাড়ায় বিধায় জনস্বাস্থ্যের জন্যে মারাত্মক ক্ষতিকর। শহর বা গ্রামের গৃহিণীরা তাদের রান্নাঘরের আর্বজনা ও শিশুদের মলমূত্র পলিথিনে ভরে বহুতল ভবনের জানালা দিয়ে ড্রেনে বা মানুষের চলাচলের পথে ফেলে জনস্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি করছে। পশু-পাখিরা তা’ পা দিয়ে ছড়িয়ে পরিবেশ দূষণ বাড়াচ্ছে। অপর দিকে এর ব্যাপক ব্যবহারের ফলে দেশের সোনালী আঁশের সকল প্রকার সামগ্রীর শিল্প কারখানা ধ্বংস হয়ে বেকার সমস্যা বাড়িয়েছে এবং এসব শিল্পের দ্রব্যের বিলুপ্তি ঘটিয়েছে।
পৃথিবীর উন্নত দেশেই পলিথিন বা প্লাস্টিক দ্রব্য ও ব্যাগের উৎপাদন, ব্যবহার ও বাজারজাত সম্পূর্ণ নিষেধ করা হয়েছে। এছাড়াও দ্রুত পচে যায় ও ধ্বংস হয় এমন ব্যাগ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পলিথিনের বিকল্প দ্রব্য হিসেবে উৎপাদন হচ্ছে। যার কোনোই বিরূপ প্রভাব নেই। পলিথিন ব্যাগ যেমন পরিবেশ ক্ষতি করছে, তেমনি দেশের চলমান অর্থনীতির ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। এটি সহজলভ্য ও সস্তা হওয়ায় পাটের তৈরি ব্যাগ ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায় । ফলে পাট ও পাটজাতদ্রব্যের বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বেকার সমস্যা বৃদ্ধি পায়। পলিথিন ব্যাগ উৎপাদনে নিয়োজিত মাত্র কয়েক হাজার লোক দেশের ১৬ কোটি মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করে চলছে।
প্রসঙ্গত, সর্বপ্রথম ১৯৯৪ সালে পলি ব্যাগ উৎপাদন, আমদানি ও বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ করা সত্ত্বেও উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও শ্রমিকের হুমকির ভয়ে তা আর কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। সরকার দেশের সার্বিক দিক পর্যালোচনা করে এর সকল প্রকার ব্যবহার, উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ১ জানুয়ারি ২০০২। ১ মার্চ ২০০২ থেকে সারা দেশে এর কার্যক্রম অব্যাহত থাকে। যা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক ছিলো। আমরা লক্ষ্য করতে পেরেছি, ঐ উদ্যোগটি কয়েক মাস চলমান থাকার পর সেটি ভেস্তে যায়।
তারপর ভিন্নভাবে বাজার দখল করে চলে এ পলিথিন। এমতাবস্থায় সরকার পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন ও ব্যবহার বন্ধ করে এর বিকল্প দ্রব্য উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের ব্যাপারে গুরুত্ব সহকারে পদক্ষেপ নিয়েছে। আর পলিথিনের বিকল্প দ্রব্যগুলোর দামও সহজলভ্য করার প্রক্রিয়া সৃষ্টি সহ ব্যাপক গণসচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
দেশ ও জাতীয় স্বার্থে দেশের প্রতিটি নাগরিককে পলিথিন বর্জনের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে তা কার্যকর করতে সহায়তা করতে হবে। পলিথিনের বিকল্প দ্রব্য ব্যবহারে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে। সরকারকেও এ সিদ্ধান্ত বহাল রাখতে কঠোর হতে হবে।
তথ্যসূত্র : জাতীয় পত্র-পত্রিকাসমূহ।
লেখক : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও গণমাধ্যমকর্মী।