প্রকাশ : ২৫ অক্টোবর ২০২৪, ০৭:৫৭
আইনসভার দ্বিকক্ষায়ন আইনসভা সংস্কারের পূর্বশর্ত হওয়া উচিত
কার্ল মার্ক্স শোষণহীন সমাজের স্বপ্নে শ্রমজীবী প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব দিয়ে গেছেন। জন মেনার্ড কেইন্স বেকারত্ব ও মন্দা নিরসনে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ভূমিকায় গুরুত্ব দিয়েছেন। একটা দেশের আইনকানুন, রীতি-সংস্কৃতি, বিচারিক গতি, আইনের শাসন, দুর্নীতির মাত্রা, তথ্যের প্রবাহ, কথা বলার স্বাধীনতা, গণতন্ত্রের মাত্রা, সামাজিক প্রত্যাশা--এ সবকিছুই প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রীয় প্রাতিষ্ঠানিক অঙ্গ।
একটি বিষয় নিশ্চিত করে বলা যায় যে, একটি দেশের প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নে প্রতিষ্ঠানের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি। উদাহরণ কল্পে বলা যায়, উত্তর কোরিয়ার মানুষের চেয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষ দশ গুণ বেশি পরিশ্রম করে না। কিন্তু মাথাপিছু আয় ও জীবনযাত্রার মানের বিচারে দক্ষিণ কোরিয়া উত্তর কোরিয়ার চেয়ে কমপক্ষে দশ গুণ বেশি উন্নত। যার মূল কারণ দক্ষিণ কোরিয়ার উন্নত প্রতিষ্ঠান।
একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্যে এর আইনসভা বা সংসদ অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। আর এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে রাষ্ট্রের স্বরূপ চিহ্নিত করা যায়। অর্থাৎ রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা গণতান্ত্রিক না স্বৈরতান্ত্রিক কিংবা ফ্যাসিবাদী প্রভৃতি।
গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত হলো, সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন যা ভোটাধিকারের মাধ্যমে সরকার গঠন এবং পরিচালনায় গণতান্ত্রিক বন্দোবস্ত। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে শাসনক্ষমতা জনপ্রতিনিধিদের হাতে ন্যাস্ত। আধুনিক কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের অর্থ আরও ব্যাপক। গণতন্ত্র কেবল সরকার গঠন এবং রাষ্ট্র পরিচালনার একটি পদ্ধতিই নয়, গণতন্ত্র নাগরিকদের জীবনযাপনের ধরণ, সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক বন্দোবস্ত, সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, যার ভিত্তিতে বাংলাদেশের জন্মসূত্র। সেই ধারায় একদিকে সমাজতন্ত্র আর অপরদিকে গণতন্ত্র রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলিক নীতি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত। সেই লক্ষ্যে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বৈষম্যের অবসান এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় আমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক গণতন্ত্রের মৌলিক নীতি এবং আদর্শ রূপায়নের রূপরেখা স্পষ্টভাবে সংবিধানে অনেকটা দৃশ্যমান।
বাংলাদেশের সংবিধানে গণতন্ত্র বলতে সব ধরনের সামাজিক বৈষম্যের অবসান, জাতি-ধর্ম-বর্ণ, ধনী-গরিব, গ্রাম-শহরের সুযোগের সমতা, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমাজের সব সদস্যের সমমর্যাদার স্বীকৃতিকে বোঝায়। গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক চর্চার বিকাশ এবং ব্যক্তি ও সামাজিক গণতন্ত্রের প্রতি দ্ব্যর্থহীন অঙ্গীকার সংবিধানে বিধৃত রয়েছে।
রাজনৈতিক গণতন্ত্র হলো জনসাধারণের ইচ্ছা ও সম্মতির মাধ্যমে পরিচালিত সরকার ব্যবস্থার মৌলিক দিক। আর আইনসভা একটি গণতান্ত্রিক দেশের জন্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও জার্মানি পৃথিবীর অনেক দেশের জন্যে রোল মডেল এদের রাজনীতি ও অর্থনীতির কারণে। কিন্তু এদের মধ্যে একটি বিষয়ে এক ঐতিহাসিক মিল রয়েছে। এদের প্রত্যেকেই আইনসভার সংস্কার ও শুদ্ধিসাধনে অনেক সময় নিয়েছেন এবং এদের প্রত্যেকেরই আইনসভা দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট। এই দুই স্তরের আইনসভা বা সংসদ সৃষ্টির প্রধানতম কারণ--(১) ক্ষমতার বিভাজন বা বিকেন্দ্রীকরণ; (২) আইন সৃষ্টিতে ভারসাম্য বা চেক এন্ড ব্যালান্স; (৩) বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষকে নিয়ে এক অন্তর্ভুক্তিমূলক আইনসভা গঠন।
পৃথিবীর ইতিহাসে অন্তর্ভুক্তিমূলক আইনসভা ছাড়া অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি ও অর্থনীতি রচিত হয়েছে এমন উদাহরণ নেই বললেই চলে। যেহেতু রাজনীতি অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই আইনসভা সংস্কারের প্রথম ধাপ একে দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট করা। এ প্রস্তাব বিএনপি ছাড়াও বিশ দলীয় জোটের দু-চারটি দল এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, এরও বেশ বহু বছর পূর্বে আ.স.ম. আব্দুর রবের নেতৃত্বাধীন জাসদ উক্ত প্রস্তাব দিয়ে আসছেন। এদিকে আওয়ামী লীগ ‘পলায়ন যুগ’ পার করছে। তাই দূরদর্শিতার স্বার্থে বাকি দৃশ্যমান বড় দলগুলোর উচিত হবে এ ধরনের একটি ভারসাম্যপূর্ণ সংসদের রূপরেখা দেয়া। তবে কিছু কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তির মতে, দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট সংসদ বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রে আদৌ প্রয়োজন নেই।
বাংলাদেশ ফেডারেল রাষ্ট্র নয়। একক সত্তা বিশিষ্ট জাতি-রাষ্ট্র। তারপরও কথা থাকে দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট সংসদ কীভাবে গঠিত হবে? কীভাবে প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হবেন? তারা কারা? সমাজের জ্ঞানী-গুণী অথবা সুশীল সমাজের ব্যক্তিবর্গ উচ্চকক্ষে থাকবেন, সেক্ষেত্রে তারা কোন্ পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ায় উচ্চকক্ষে নির্বাচিত হবেন তা পরিষ্কার করে কেউ বলেন নি। যারা উচ্চ কক্ষের কথা বলছেন, বিষয়টি তাদের পরিষ্কার করা দরকার ইত্যাদি ইত্যাদি।
এতো কিছুর পরও বললে বলতে হয়, বর্তমান সংসদ একটি ক্রম-অবনতিসম্পন্ন ব্যবসায়ী অ্যাসোসিয়েশন, যা সাধারণ মানুষের স্বার্থরক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে। এখানে ব্যবসায়ীর সংখ্যা ৬১
শতাংশ। বাকিদের একটা বড় অংশ অবসরপ্রাপ্ত আমলা, যাদের অনেকের সঙ্গে এলাকার মানুষের যোগাযোগ নেই। যিনি প্রধানমন্ত্রী ও সংসদীয় নেতা এবং তিনিই দলীয়প্রধানের আশপাশে থেকে প্রবল আনুগত্যের প্রমাণ দিয়েছেন-- যোগ্যতা এটুকুই। তাকে এলাকায় এনে মাস দু-একের জন্যে ‘জনদরদী’ সাজিয়ে এমপি বানানো হলো। বঞ্চিত করা হলো দীর্ঘদিনের ত্যাগী রাজনীতিকদের।
এভাবে নিকট অতীতে পতিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী নিজে রাজনীতিক হয়ে শেষতক রাজনীতিচর্চার কাজটি তুলে দিয়ে গেছেন ব্যাংক লুটেরা, দাগী খেলাপি, অর্থপাচারকারী, মাফিয়া, পারিবারিক সম্পর্কের রাজনীতির ইজারাদার, জনবিচ্ছিন্ন আমলা, পুলিশ, কখনো বা স্বর্ণ ও মাদক ব্যবসায়ীর হাতে। এতে আইনসভার চরিত্র বদলে গেছে এবং অর্থনীতি ক্রমান্বয়ে ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে, যা মেগা প্রজেক্টের মেগাবৃত্তান্ত দিয়ে ঢাকা যাচ্ছে না। ‘ঢাকার দরবেশ’ কিংবা চট্টগ্রামের ‘আউলিয়া’দের দায়িত্ব দিয়েছেন ব্যাংক খাত দেখাশোনার। তারা সযতনে অর্থখাতকে অনেকটা রক্তশূন্য করেছে। খেলাপিদের দায়মুক্তি কিংবা ব্যাংক পরিচালক নীতি যে সংসদে আলোচনা বা বিতর্ক ছাড়াই চিপাগলি দিয়ে পাস হয়ে যায়, তার প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা থাকে না।
‘সংসদ’ শব্দের আগে যতই ‘মহান’ শব্দটি যুক্ত করা হোক না কেন, এর মানুষগুলো আসলে কি মহান? যারা পাচারকৃত বা কালো টাকা সাদা বানানোর বিধান করেন তাদের অন্তত সাদা জগতের মানুষ ভাবার কোনো উপায় আছে?
যারা অন্যায্য সুবিধা নিতে ওস্তাদ, দরিদ্র দেশে শুল্কমুক্ত গাড়ি এনে কোটি কোটি টাকার আয় থেকে রাষ্ট্রকে বঞ্চিত করেন, আর তাদের হাত দিয়ে ন্যায্যতার আইন পাস হবে এমন ভাবার কোনো কারণ আছে? তাই এ জাতীয় আইনসভার সংস্কার ছাড়া কি রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক ন্যায্যতার প্রত্যাশা করা যায় ? আর যদি না যায়, তাহলে জ্ঞানী-গুণী, পেশাজীবী এবং রাজনৈতিক দলগুলো থেকে নির্বাচনে মোট ভোট প্রাপ্তির আনুপাতিক হারে সংসদ সদস্যদের সমন্বয়ে আরেকটি সমান্তরাল সংসদ চালু করলে দেশের আইন প্রণয়নে যে একটি ভারসাম্য আসবে তা উন্নত রাজনীতির অজস্র দৃষ্টান্ত দেখে নিশ্চিত করে বলা যায়। এ ধরনের ‘চেক এন্ড ব্যালেন্স’ ছাড়া বর্তমান একপেশে সংসদ একটি সমাজের স্বার্থ নিশ্চিত করবে না।
লেখক পরিচিতি : অধ্যাপক হাছান আলী সিকদার, সভাপতি, চঁাদপুর জেলা জাসদ; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রনেতা; চঁাদপুর জেলা শিক্ষক নেতা; সমাজ ও রাজনীতিবিশ্লেষক।
রচনাকাল : ০৯/১০/২০২৪।