প্রকাশ : ১৭ অক্টোবর ২০২৪, ১১:৪৪
বাংলাদেশের খেলাধুলার বিকাশ : সমস্যা, সম্ভাবনা ও সংস্কারমূলক পরামর্শ
বাংলাদেশ একটি ১৭ কোটি মানুষের দেশ, যার মধ্যে বিশাল সংখ্যক যুবসমাজ রয়েছে। কিন্তু খেলাধুলার জগতে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তেমন সফলতা অর্জন করতে পারেনি, বিশেষত ক্রিকেটের বাইরে অন্যান্য ক্রীড়ায়। দেশের গ্রামীণ ও তৃণমূল পর্যায়ে ক্রীড়া উন্নয়নের যথাযথ উদ্যোগের অভাব, কেন্দ্রিকরণ এবং খেলাধুলার সীমিত সুযোগ ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে দেশের ক্রীড়াক্ষেত্র তার প্রকৃত সম্ভাবনার কাছাকাছি পৌঁছতে পারছে না। ফ্রান্স ও সুইডেনের মতো দেশগুলোর উদাহরণ সামনে রেখে আমরা যদি কিছু কাঠামোগত পরিবর্তন আনি, তাহলে বাংলাদেশের খেলাধুলার জগতে বৈশ্বিক অবস্থানকে শক্তিশালী করা সম্ভব।
১. কেন্দ্রিকরণ বনাম বিকেন্দ্রীকরণ বাংলাদেশের খেলাধুলার একটি প্রধান সমস্যা হলো রাজধানী কেন্দ্রিকতা। প্রায় সব ধরনের খেলাধুলার অবকাঠামো, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং প্রতিযোগিতার আয়োজন রাজধানী ঢাকাকেন্দ্রিক, যা দেশের প্রান্তিক বা গ্রামীণ এলাকার প্রতিভার কাছে পৌঁছাতে ব্যর্থ। অন্যদিকে সুইডেন ও ফ্রান্সের মতো দেশগুলোতে তৃণমূল পর্যায় থেকে প্রতিভা খুঁজে বের করে জাতীয় পর্যায়ে নিয়ে আসার কার্যকর মডেল রয়েছে। তারা দেশের প্রতিটি অঞ্চলে ক্রীড়াকে গুরুত্ব দেয়।
প্রস্তাবনা :
* তৃণমূল পর্যায়ে ক্রীড়া অবকাঠামো উন্নয়ন এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা।
* জেলা, উপজেলা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজন করে প্রতিভা সন্ধান করা।
* প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের জন্যে বৃত্তি এবং বিশেষ প্রশিক্ষণের সুযোগ সৃষ্টি করা।২. ক্রিকেট কেন্দ্রিকতা থেকে মুক্তি বাংলাদেশে ক্রীড়া বলতে বর্তমানে প্রায় একমাত্র ক্রিকেটকেই বোঝানো হয়। ক্রিকেটের বাইরে ফুটবল, হকি, অ্যাথলেটিকস, সাঁতার, দাবা প্রভৃতি ক্রীড়ায় তেমন কোনো রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক গুরুত্ব দেখা যায় না। সুইডেন ও ফ্রান্সের মতো দেশে প্রতিটি খেলার জন্যে আলাদা নীতি ও উন্নয়ন পরিকল্পনা রয়েছে। এসব দেশে ফুটবল, টেনিস, হ্যান্ডবল এবং অন্যান্য খেলায় সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়।
প্রস্তাবনা :
* ক্রিকেটের বাইরে অন্যান্য ক্রীড়ায় সমান গুরুত্ব ও বিনিয়োগ করা।
* বিভিন্ন ক্রীড়ার জন্যে স্বতন্ত্র ফেডারেশন ও লিগ গঠন করা এবং প্রতিযোগিতার আয়োজন করা।
* জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন ক্রীড়ার প্রচার বাড়ানো।৩. শিক্ষা ব্যবস্থায় ক্রীড়ার অন্তর্ভুক্তি বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ক্রীড়া কার্যক্রম তেমন গুরুত্ব পায় না। স্কুল বা কলেজে ক্রীড়ার জন্যে পর্যাপ্ত সময় বরাদ্দ নেই এবং সঠিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। অথচ সুইডেন বা ফ্রান্সের মতো দেশে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্রীড়া বাধ্যতামূলক এবং ক্রীড়া শিক্ষার মাধ্যমে শারীরিক ও মানসিক বিকাশের সুযোগ তৈরি করা হয়।
প্রস্তাবনা :
* শিক্ষা কারিকুলামে খেলাধুলা বাধ্যতামূলক করা।
* স্কুল ও কলেজে প্রতিযোগিতামূলক ক্রীড়া কার্যক্রম চালু করা এবং সেগুলোতে নিয়মিত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
* শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্রীড়া কোচ ও প্রশিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়া।৪. ক্রীড়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার বর্তমানে আধুনিক ক্রীড়ায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ভূমিকা অনেক বেশি। ক্রীড়া বিজ্ঞান, ফিজিওথেরাপি, মানসিক প্রশিক্ষণ, এবং তথ্য বিশ্লেষণ এখন ক্রীড়াক্ষেত্রে সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। ফ্রান্স এবং সুইডেনের মতো দেশগুলো ক্রীড়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার করে তাদের খেলোয়াড়দের উন্নত করছে। বাংলাদেশেও এই খাতে জোর দেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
প্রস্তাবনা :
* ক্রীড়া বিজ্ঞান, ফিজিওথেরাপি এবং মনস্তাত্ত্বিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।
* খেলোয়াড়দের ফিটনেস, ডায়েট এবং পারফরম্যান্স উন্নয়নের জন্যে বিজ্ঞানভিত্তিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা।৫. নারী ক্রীড়ার উন্নয়ন বাংলাদেশে নারীদের খেলাধুলার সুযোগ এবং অবকাঠামো অত্যন্ত সীমিত। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে কিছু নারী ক্রিকেট এবং ফুটবলে ভালো সাফল্য দেখিয়েছে, তা এখনো অনেক পিছিয়ে। নারী ক্রীড়ার উন্নয়ন না হলে দেশের ক্রীড়া ক্ষেত্রের পূর্ণ সম্ভাবনা কখনোই বাস্তবায়িত হবে না।
প্রস্তাবনা :
* নারী খেলোয়াড়দের জন্যে আলাদা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং অবকাঠামো গড়ে তোলা।
* নারী ক্রীড়া লিগ এবং প্রতিযোগিতার আয়োজন করা।
* আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নারী খেলোয়াড়দের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।৬. মিডিয়া ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি বাংলাদেশে মিডিয়ার অধিকাংশ কভারেজ ক্রিকেটকেন্দ্রিক। মিডিয়া অন্যান্য খেলার প্রচারে আগ্রহী নয়। ফলে জনসাধারণের মনোযোগও সীমিত। অথচ সুইডেন বা ফ্রান্সের মতো দেশে প্রতিটি খেলাকে মিডিয়া সমর্থন দেয়, যা জনসচেতনতা বৃদ্ধি করে এবং খেলোয়াড়দের উৎসাহিত করে।
প্রস্তাবনা :
* মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে অন্যান্য খেলার প্রচার বাড়ানো।
* টিভি চ্যানেল এবং ডিজিটাল মাধ্যমে বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতার কভারেজ নিশ্চিত করা।বর্জনীয় বিষয় :
-ক্রীড়াজগৎকে শতভাগ দুর্নীতিমুক্ত রাখতে হবে
* রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ : ক্রীড়ার ক্ষেত্রে অযোগ্য রাজনৈতিক নিয়োগ ও প্রভাব খেলার মান ক্ষতিগ্রস্ত করে।
* অপর্যাপ্ত বাজেট ও বিনিয়োগ : পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ না করলে ক্রীড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়।
* ক্রীড়া অবকাঠামোর অভাব : সঠিক ক্রীড়া অবকাঠামো গড়ে তোলার ব্যর্থতা খেলোয়াড়দের প্রতিভা বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে।সংস্কারমূলক পরামর্শ
বাংলাদেশের খেলাধুলা উন্নয়নের জন্যে একটি সুসংগঠিত ও দীর্ঘমেয়াদী ক্রীড়া নীতি তৈরি করা জরুরি। সুইডেন এবং ফ্রান্সের মতো দেশগুলোর মডেল অনুসরণ করে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো নেওয়া যেতে পারে :
* তৃণমূল পর্যায়ে ক্রীড়া অবকাঠামো তৈরি করা।
* বিভিন্ন ক্রীড়ার স্বতন্ত্র উন্নয়ন পরিকল্পনা ও পৃষ্ঠপোষকতার ব্যবস্থা করা।
* বেসরকারি খাতকে খেলাধুলায় বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত করা।
* ক্রীড়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো।
-নারী ক্রীড়ার বিকাশ নিশ্চিত করা।
* মিডিয়া ও জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে মনোযোগ দেওয়া।
এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ শুধুমাত্র ক্রিকেট নয়, অন্যান্য খেলাতেও আন্তর্জাতিকভাবে তার অবস্থান শক্তিশালী করতে পারবে এবং ভবিষ্যতে একটি ক্রীড়া উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে গড়ে উঠবে।
রহমান মৃধা : সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন।