রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২০ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ১২ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

বাংলাদেশে ইসলাম আগমনের ইতিহাস

এসএম আনওয়ারুল করীম
বাংলাদেশে ইসলাম আগমনের ইতিহাস

বাংলাদেশে তিনজন সাহাবির আগমন ঘটেছে বলে ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণ মিলে। প্রখ্যাত সাহাবি সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাসের নেতৃত্বে এতদঞ্চলে আরও দু’জন সাহাবি আগমন করেন। তারা হলেন মাহমুদ ও মোহাইমিন। তাদের মাধ্যমেই বাংলায় ইসলামি দাওয়াতের বীজ বপিত হয়। সম্প্রতি লালমনিরহাটে মাটির তলদেশে যে ‘হারানো মসজিদের’ সন্ধান পাওয়া যায়, তাতে ৬৯ হিজরি সালের খোদাই করা নজির পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, তখনই এদেশে সাহাবিগণের আগমন ঘটে।

কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতক থেকে দশম শতাব্দীর মধ্যে বাংলাদেশে ইসলামের অনুপ্রবেশ ঘটে। ইসলামের আবির্ভাবের সময় এ অঞ্চলটি বঙ্গ বা বাংলা নামে পরিচিত ছিল। সেসময় বাংলা বা বঙ্গ অঞ্চলের সীমানা শুধু বর্তমান বাংলাদেশের সীমানা দ্বারাই পরিবেষ্টিত ছিল না; বরং তৎকালীন বঙ্গদেশের সীমানা ছিল বেশ বিস্তৃত।

ঐতিহাসিকদের মতে, প্রাচীন যুগে বাংলা ছিল প্রায় ৮০ হাজার বর্গমাইল বিস্তৃত এক বিশাল সমভূমি। বস্তুত এ বিশাল বাংলা অঞ্চলে কোন সময় ইসলামের আগমন ঘটে, তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা মুশকিল। তবে ঐতিহাসিকরা নানা তথ্য-উপাত্তের আলোকে বঙ্গ অঞ্চলে ইসলামের আগমনকাল সম্পর্কে নানা মত প্রকাশ করেছেন।

ঐতিহাসিকদের মতে, এদেশে ইসলামের আগমন ঘটে প্রধানত দুটি মাধ্যমে। (ক) স্থলপথ ও (খ) জলপথ বা সমুদ্রপথ।

ক. স্থলপথ : ৭১২ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ ইবনে কাসিমের সিন্ধু বিজয় গোটা ভারতবর্ষে ইসলাম প্রচারের পথ উন্মুক্ত করে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও বহু মুসলিম মুবাল্লিগ ধর্ম প্রচারের জন্য আগমন করে। এ সময় মাহমুদ ও মুহাইমিনের নেতৃত্বে একদল ধর্মপ্রচারক এদেশে আগমন করেন বলে জানা যায়। পরবর্তী সময়ে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী কর্তৃক বাংলা বিজয়ের মাধ্যমে এদেশে ধর্মপ্রচারকদের ব্যাপক হারে আগমন ঘটে। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী তৎকালীন বাংলার সেন বংশীয় রাজা লক্ষু সেনকে পরাজিত করে ইসলামের বিজয় কেতন উড্ডীন করেন। ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর বিজিত রাজ্যের সীমানা ছিল- উত্তরে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত পুর্নিয়া শহর হয়ে দেবকোট থেকে রংপুর শহর, পূর্বে ও দক্ষিণ-পূর্বে তিস্তা ও করতোয়া, দক্ষিণে গঙ্গার মূলধারা বা পদ্মা এবং পশ্চিমে কুশী নদীর নিম্নাঞ্চল থেকে গঙ্গার কিনারায় রাজমহল পাহাড় পর্যন্ত বিস্তৃত। ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর এ বিজয়ের ফলে বাংলায় ইসলাম ব্যাপকভাবে পরিচিত ও প্রসারিত হয়। এ সময় হতে দলে দলে মুসলিমরা বাংলায় এসে বসতি স্থাপন করেন এবং ইসলাম প্রচারকার্য শুরু করেন। এভাবেই বাংলা অঞ্চলে ইসলামের আগমন ঘটে বলে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন।

খ. জলপথ বা সমুদ্র পথ : ঐতিহাসিকদের মতে, বাংলাদেশে ইসলামের প্রাথমিক পরিচিতি ও প্রচারকার্য পরিচালিত হয় আরব মুসলিম বণিকদের মাধ্যমে। মুসলিম বিজয়-পূর্ব বাংলায় আগত বণিকরাই এদেশে ইসলামের পরিচয় তুলে ধরেন। এদেশে ইসলাম আগমনের সর্বপ্রধান মাধ্যম ছিল আরব-ভারত-চীন বাণিজ্য সম্পর্ক। জাহেলিয়াতের যুগ থেকেই আরব বণিকদের সঙ্গে এ অঞ্চলের বাণিজ্য সম্পর্ক প্রচলিত ছিল। রাসুল সা. ভারতীয় সুগন্ধিদ্রব্য উপহার হিসেবে লাভ করেন বলেও প্রমাণ পাওয়া যায়। ভূগোলবিদরা আরব-ভারত-চীন বাণিজ্য পথের নানা বর্ণনা লিপিবদ্ধ করে গেছেন। তাদের দেওয়া তথ্য মতে, আরব-চীন বাণিজ্য যাত্রার মূলসূত্র ছিল ভারতবর্ষ। আরব বণিকরা পারস্য উপসাগর হয়ে বেলুচিস্তানের একটি বন্দরে প্রবেশ করতেন। তারপর একে একে সিন্ধু, গুজরাট, মাদ্রাজ ও কলকাতা বন্দরে প্রবেশ করে বঙ্গোপসাগরে উপনীত হতেন। তারা এ সময় এ অঞ্চলের সিলাহাত বা বর্তমান সিলেট ও সাদজাম বা বর্তমান চট্টগ্রাম বন্দরে যাত্রাবিরতি করতেন। এরপর তারা চীন সাগরে প্রবেশ করতেন।

এভাবেই আরব থেকে চীন পর্যন্ত বাণিজ্য যাত্রায় ভারত উপমহাদেশ ও বঙ্গদেশ বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। আরবরা মধ্যবর্তী এসব বন্দরেও তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করতেন ও সফরের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সংগ্রহ করতেন।

আরব ঐতিহাসিক ও ভূগোলবিদদের বর্ণনায়ও বাংলার নানা স্থানের উল্লেখ পাওয়া যায়। ভূগোলবিদ ইবনে খুরদাদবিহ তার বর্ণনায় বাংলাদেশের চাঁদপুর নদীবন্দরের কথা উল্লেখ করেছেন। আল ইদ্রিসীর বর্ণনায় রয়েছে- বাগদাদ ও বসরা থেকে আরব বণিক এবং পর্যটকরা মেঘনার মোহনার সন্নিকটের অঞ্চলে আসা-যাওয়া করতেন। বস্তুত মহানবি সা.-এর নবুয়ত-পূর্ব বহুকাল ধরেই আরব-ভারত-চীন বাণিজ্য সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। ইসলামের আবির্ভাবের পরও এ সম্পর্ক অব্যাহত ছিল। আরব মুসলিম বণিকরা তৎকালে এ পথ ধরেই বাণিজ্য যাত্রা অব্যাহত রাখেন। ফলে ইসলামের আবির্ভাবের অল্পকালের মধ্যেই ভারতবর্ষ তথা বাংলাদেশে ইসলামের আগমন ঘটে। বাণিজ্য উপলক্ষে আগমন করলেও আগত এসব আরব মুসলিম বণিক এদেশের জনগণের মধ্যেও ইসলাম প্রচারের সুযোগ হাতছাড়া করেননি। তারা যেসব বন্দরে যাত্রাবিরতি করতেন সেখানে ইসলামের প্রচার করতেন। এভাবে খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকেই বাংলাদেশে ইসলামের অনুপ্রবেশ ঘটে।

বাংলাদেশে ইসলামের প্রবেশের প্রধানতম মাধ্যম ছিল মুসলিমদের ধর্ম প্রচার। মুসলিমরা ধর্মপ্রচারকে নিজ নিজ ধর্মীয় কর্তব্য হিসেবে পালন করেন। তাদের কাছে ইসলামকে অমুসলিমের কাছে পৌঁছে দেওয়া আর এ লক্ষ্যে কষ্ট-পরিশ্রম স্বীকার করা ছিল গৌরবের কাজ। এজন্য দেখা যায় রাসুল সা.-এর নবুয়তপ্রাপ্তির পর থেকেই ইসলাম প্রচারের কাজ শুরু হয়। মহানবির সা. ইন্তেকালের পর এ দায়িত্ব মুসলিমদের ওপর আরও ভালোভাবে অর্পিত হয়। সাহাবিরা এ সময় ইসলামের দাওয়াত নিয়ে দিক-দিগন্তে ছড়িয়ে পড়েন।

ঐতিহাসিকদের ধারণা মতে, সাহাবিদের একটি দল সর্বপ্রথম ইসলাম প্রচার করার জন্য ভারত ও বঙ্গ অঞ্চলে (বাংলাদেশে) আগমন করেন। আর তাদের মাধ্যমেই এদেশে ইসলামের সূচনা ঘটে। যেহেতু আরব-চীন বাণিজ্য সম্পর্ক বহু প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত ছিল, সেহেতু ভারত উপমহাদেশে সাহাবিদের আগমন অস্বাভাবিক ছিল না। ধারণা করা হয় যে, রাসুল সা.-এর মামা সাহাবি সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস ও মালিক ইবনে ওয়াহাব রা. আনুমানিক ৬১৭ খ্রিস্টাব্দে কতিপয় সাথিসহ ইসলামের প্রচারের জন্য চীনের উদ্দেশ্যে দুটি জাহাজ নিয়ে রওনা হন। এ যাত্রায় কাইস ইবনে হুজাইফা রা., উরওয়া ইবনে আছাছা রা., আবু কায়েস ইবনে হারিস রা. প্রমুখ সাহাবি তার সঙ্গে ছিলেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল চীনে ধর্ম প্রচার করা। এ লক্ষ্যে তারা আরব ও চীনের মধ্যবর্তী ভারতীয় বন্দরগুলোতেও অবতরণ করেন। তারা সেসব বন্দরে অবস্থানকালে ইসলাম প্রচার করেন।

শায়খ যাইনুদ্দিন সীয় ‘তোহফাতুল মুজাহিদীন’ গ্রন্থে ভারতের নানা বন্দরে এরূপ একদল আরবের ইসলাম প্রচারকের বর্ণনা উপস্থাপন করেছেন। কেননা সফরের রসদ ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংগ্রহের জন্য তৎকালে এসব বন্দরে অবতরণের কোনো বিকল্প ছিল না। সুতরাং ধরে নেওয়া যায় যে, সাহাবিরা বাংলাদেশেও ইসলাম প্রচারের সূচনা করে গিয়েছেন। মূলত এভাবেই বাংলাদেশে ইসলামের আগমন ঘটে।

বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারকগণের দ্বিতীয় দল হলো এদেশে আগত মুসলিম শাসক, বিজেতা, সৈনিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এ অঞ্চলে ইসলাম প্রচারে তারা প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ না করলেও পরোক্ষভাবে তারা ইসলাম প্রচারে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন। ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর বাংলা বিজয়ের মাধ্যমে এতদঞ্চলে এ শ্রেণির লোকদের আগমন ঘটতে থাকে। শাসনকার্যের সুবিধার্থে তারা নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেন, যা এদেশে ইসলাম প্রচারের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি করে। প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলার স্বাধীন সুলতানরা ও পরবর্তী সময়ে মোগল শাসকদের দ্বারা এ অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। সুলতান ও রাজকর্মচারীরা মুসলিম হওয়ায় নিজেরা বাস্তব জীবনে ইসলাম অনুশীলন করতেন। তাছাড়া সুলতানরা ইসলামের পৃষ্ঠপোষকতায় ছিলেন অনন্য। মসজিদ, মাদরাসাসহ ইসলাম চর্চার নানা সুযোগ-সুবিধা ও প্রতিষ্ঠান তৈরিতে তারা ছিলেন উদারহস্থ।

বাংলাদেশে ইসলামের ব্যাপক প্রচার-প্রসার ও বিকাশে এদেশে আগত আলিম, পীর মাশায়েখ ও মুবাল্লিগদের ভূমিকা ছিল অন্যতম। ইসলাম প্রচারের মূল দায়িত্ব তাদের দ্বারাই পরিচালিত হয়। সাধারণভাবে ইসলাম প্রচারক বলতে এই শ্রেণির মনীষীদের উল্লেখ করা হয়ে থাকে। সুদূর ইয়েমেন থেকে শাহজালাল রহ.-এর আগমনের মাধ্যমেও এদেশে ইসলামের অভূতপূর্ব দাওয়াতি কাজের সাধন ঘটে।

লেখক : গবেষক, মুহাদ্দিস ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়