সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২১ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার
  •   দৈনিক ইনকিলাবের প্রশাসনিক কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ্ মিজির দাফন সম্পন্ন
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা

প্রকাশ : ২৫ আগস্ট ২০২১, ০০:০০

অন্ধ হলেও অন্ধত্ব তার কাছে কোনো বাধা নয়

কাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করছেন, ভিক্ষাকে ঘৃণা করেন

অন্ধ হলেও অন্ধত্ব তার কাছে কোনো বাধা নয়
দেলোয়ার আহমেদ ॥

নাম তার হাফেজ মোঃ ইব্রাহীম খলিল। বয়স ৩৭ হবে। বৃদ্ধ মা ও পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করেন চাঁদপুর শহরের চেয়ারম্যানঘাট এলাকার জিটি সড়ক দক্ষিণে। যদিও দু চোখ অন্ধ, এটা তার কাছে কোনো বাধা নয়। তিনি ঝটপট স্মার্টলি মোবাইলে লোড বা রিচার্জ করেন। এভাবেই তো ২০০৬ সাল থেকে জীবিকা নির্বাহ করছেন গত ১৫/১৬ বছর যাবৎ।

আপনার মোবাইল নাম্বারটা একবার শুনলেই তিনি সাথে সাথে তা মনে রেখে ঝটপট সঠিকভাবে লোড বা রিচার্জ করে ফেলেন। আপনার সাথে একবার কথা বললে এক বছর পরেও তিনি আপনার কণ্ঠ বুঝে বলতে পারেন, আপনি অমুক না? সালাম দিয়ে জানতে চান, ভাই কেমন আছেন? তার স্মরণশক্তি এতো প্রখর! অন্ধত্ব তার কাছে কোনো বাধা নয়। তিনি ঘৃণা করেন ভিক্ষা করাকে। তিনি ধীরে ধীরে হেঁটে হেঁটে ঘুরে ঘুরে চাঁদপুর জেলা শহরের ব্যস্ত এলাকা চেয়ারম্যানঘাট, জিটি রোড (উত্তর) ও জিটি রোড (দক্ষিণ)-এর বিভিন্ন স্থানে এবং ষোলঘরে অবস্থিত ডিসি অফিস, জেলা জজ কোর্ট, পানি ভবন (ওয়াপদা অফিস), সদর উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্স ও অন্যান্য সরকারি ও বে-সরকারি অফিসে গিয়ে সবাইকে প্রয়োজনে মোবাইল রিচার্জ করে দেন। অনেকে শহর থেকে দূরে বা দূরের গ্রাম থেকে/বাড়িতে থেকে বা অন্য উপজেলা বা ঢাকায় থেকেও তাদের মোবাইলে রিচার্জ করতে বলেন। সাথে সাথেই তিনি তা করে থাকেন। পরে লোড বা রিচার্জের টাকাটা সংগ্রহ করে নেন।

জানতে চাইলে জেলা জজকোর্টের আইনজীবী অ্যাডঃ শরীফ মাহমুদ ফেরদাউস শাহীন, অ্যাডঃ শাহরিয়ার হোসেন পাটোয়ারী, জেলা প্রশাসক অফিসের সাখাওয়াত হোসেন, সেলিম হোসেন, জিয়াউদ্দীন বাবুল, স্কুল শিক্ষিকা শামীমা পারভীন, আইনজীবী সহকারী মোশাররফ হোসেনসহ অনেকে ইব্রাহীম খলিলের ঝটপট মোবাইল লোডের ব্যাপারটি নিশ্চিত করেন। তারা বলেন, যখনই প্রয়োজন হয়, আমরা যেখানেই থাকি তাকে ফোন দিলে তিনি সাথে সাথে লোড/রিচার্জ করে দেন। কিন্তু এখন তো করোনাকাল, বিধি বাম।

গত প্রায় দেড় বছরজুড়ে করোনাকালে তার এ কাজ ধীরে ধীরে লাটে উঠেছে। অর্থ সঙ্কটে মহা বিপদে আছেন তিনি পরিবার-পরিজন নিয়ে। আগের মতো আর রিচার্জ করে না মানুষজন। করোনা ও লকডাউনে লোকজন বের হয় না, আদালত ও অফিসেও পাবলিক তেমন আসে না। মানুষের হাতেও টাকা-পয়সার চরম অভাব। তাই লোডও কম হচ্ছে। অনেকে ভিডিও কলে কথা সেরে ফেলেন।

করোনাকালে জীবন-জীবিকা কেমন চলছে জানতে চাইলে হাঁটতে হাঁটতে বললেন অন্ধ হাফেজ ইব্রাহীম খলিল (৩৭)। তিনি শহরের ষোলঘর জিটি রোডে (দক্ষিণে) পিতার বাসায় বসবাস করেন। তার বাবা নেই, বৃদ্ধ মা আছেন। তিনি বলেন, ছোটবেলায় সাত বছরের সময় তার টাইফয়েড হয়েছিলো। গরিব বাবার চরম দারিদ্র্যের কারণে এবং সঠিক ও উন্নত চিকিৎসার অভাবে তিনি ধীরে ধরে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হয়ে পড়েন ২০০০ সালে। তিনি ক্ষোভের সাথে জানান, যে পৃথিবী তার কাছে ছিলো সুন্দর ও নয়নাভিরাম, যে সময়টাতে তিনি অন্যদের সাথে স্কুলে যেতেন ও সহপাঠীদের সাথে খেলাধুলায় মেতে উঠতেন, ঠিক সে সময়ে তিনি দৃষ্টিশক্তি হারালেন। সমস্ত পৃথিবী তার কাছে অন্ধকার জগতে পরিণত হলো। যে পৃথিবীতে কাজ করে জীবনের ক্যারিয়ার গঠন করার রঙিন স্বপ্ন ছিলো, তার জীবিকা গ্রহণ করার ইচ্ছে ছিলো প্রচণ্ড, সে পৃথিবীটা তার কাছে হয়ে গেলো পুরো অন্ধকারময়! সুন্দর পৃথিবীর সবকিছুই তার কাছে অন্ধকার। এসব জানান দেবার সময় বলার ভঙ্গিতে দুঃখবোধ ছিলো স্পষ্ট, চোখের কোণে ছিলো জল।

ইব্রাহীম খলিল তার প্রবল ইচ্ছায় চাঁদপুর শহরের ষোলঘরে প্রাইমারির পাঠ শেষ করেন। এরপর মা-বাবার ইচ্ছায় একটি হেফজ মাদ্রাসায় এবং পরে ঢাকার মোহাম্মদপুরে বাবর রোডে একটি বিখ্যাত দ্বীনি প্রতিষ্ঠানে পবিত্র কোরআন শরীফ হেফজ করলেন শুনে শুনে। এতে তার দীর্ঘ পাঁচটি বছর সময় লেগে যায়। ২০০৫ সালের শেষের দিকে বাড়ি ফিরে তিনি চিন্তা করে দেখলেন, “অন্ধ, তাই বলে ভিক্ষা করবো! তা হবে না। ভিক্ষা অসম্মানজনক কাজ। কাজ করেই জীবিকা অর্জন করা সম্ভব। আল্লাহ আমাকে দুটো হাত ও দুটো পা দিয়েছেন। স্মরণশক্তিও দিয়েছেন, কাজ বোঝার ক্ষমতাও দিয়েছেন। তাই কাজ করে আমি জীবিকা নির্বাহ করতে পারবো।’’ ইসলামী লাইনেও তিনি পড়ালেখা করেন। সংসারে তার বৃদ্ধ মা, স্ত্রী ও তার ছোট ছোট তিনটি সন্তান রয়েছে। তিনি চিন্তা করে দেখলেন, “বাড়ির কাছে ধারে হেঁটে হেঁটে মোবাইলে লোড করলে তিনি দৈনিক অল্পস্বল্প যা লাভ পাবেন, তা দিয়ে কোনো রকমে সংসার চালাতে পারবেন।’’ এভাবেই কোনো রকমে ২০০৬ সাল থেকে চলছিলো সংসার।

কিন্তু গত বছরের মার্চ মাস থেকে করোনা মহামারির কারণে অন্ধ হাফেজ ইব্রীহীম খলিল আর্থিক সংকটে পড়েন। করোনা ও লকডাউনে তার টাকা-পয়সা যা ছিলো সব শেষ। তাই খুবই কষ্টে আছেন। পরিবার-পরিজন নিয়ে খেয়ে-না খেয়ে চলছেন। সরকারি সাহায্যও পান নি। বললেন টাকার অভাবে নিজের মোবাইলে রিচার্জের ব্যবসাটাও করতে পারছেন না দীর্ঘদিন যাবৎ। তাই অনেকে লোডের জন্য ডাক দিলেও মোবাইলে লোডও করতে পারছেন না। তীব্র আর্থিক সঙ্কটে পড়ে আছেন। তিনি সরকারি সাহায্য কামনা করছেন। সরকার দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের মাসিক ভাতা দেন সাড়ে সাতশ’ টাকা, যা খুবই যৎসামান্য। দু চোখ অন্ধদের জন্যে অন্তত মাসে পাঁচ/ছয় হাজার টাকা ভাতা দিলে কোনো রকমে সন্তানদের নিয়ে চলা যেতো। আমাদের জন্যে দেশের বা সমাজের বিত্তবান ও হৃদয়বান ব্যক্তিগণ/প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসলে আমাদের মতো অন্ধদের পথচলা সহজ হতো। তিনি দুঃখ ও ক্ষোভের সাথে বলেন, “আমরা অন্ধ হওয়ায় আমাদেরতো কেউ চাকুরিও দেয় না। হাত-পা যাদের ভাঙ্গা তারা সরকারি ভাতাও পায়, চাকুরিও পায়, আমরাতো পাই না। আমাদের জন্যে কোনো সরকারি বা বেসরকারি চাকুরির কোটাও নাই। আমরা তো প্রাইমারি/হাইস্কুল/মাদ্রাসায় স্কুলের ঘণ্টা পিটাতে পারবো অন্তত। জাতীয় পতাকা টানাতে পারবো, এটা বিকেলে খুলেও আনতে পারবো, স্কুল/কলেজ খুলতে ও বন্ধ করতে পারবো। আমাদের সেন্সিবিলিটি প্রখর/তীক্ষ্ণ। যদি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও তার কন্যা পুতুল আমাদের ব্যাপারটি একটু গভীরভাবে চোখ বন্ধ করে ভাবতেন, তাহলে দেশের অন্ধদের জন্যে মহাউপকার হতো। আমরা হবো চিরকৃতজ্ঞ। তাঁরা হবেন চিরস্মরণীয়’’।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়