প্রকাশ : ২৮ জুন ২০২৩, ১৯:৪৪
ইসলামের আলোকে কোরবানির ইতিহাস, গুরুত্ব ও তাৎপর্য
জিলহজ¦ মাস হলো হিজরী সনের দ্বাদশ মাস এবং সর্বশেষ মাস। আর এ মাসেই রয়েছে বিত্তবানদের ওপর ফরজ হজ্ব এবং মানব ইতিহাসের অবিস্মরণীয় ঘটনা তথা আপন সন্তানকে কোরবানি করার ইতিহাস। কোরবানিকে আরবী ভাষায় ‘উদ্বহিয়্যাহ’ বলা হয়। এর অর্থ হলো--ওই পশু যা কোরবানির দিন জবেহ করা হয়। আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট পশু জবেহ করাই কোরবানি।
কোরবানির বিধান যুগে যুগে আল্লাহতায়ালার পক্ষ হতে অবতীর্ণ সকল শরীয়তেই বিদ্যমান ছিল। যেমন পবিত্র কুরআন শরীফে এরশাদ হয়েছে, “এবং প্রত্যকে উম্মতের জন্য আমি একটা কোরবানি নির্ধারিত করছি যেন তারা (জবেহ করার সময়) তাঁর প্রদত্ত বাকশক্তিহীন চতুষ্পদ পশুগুলোর উপর আল্লাহর নাম নেয়; তোমাদের উপাস্য একমাত্র উপাস্যই। (শুধু তাঁরই নামে জবেহ কর); সুতরাং তাঁরই সম্মুকে আত্মসমর্পণ কর।” (নিষ্ঠার সাথে অনুগত অবয়বে)। [সূরা হাজ্ব- আয়াত-৩৪]
হাদীসে পাকে উল্লেখ রয়েছে, হযরত যায়েদ ইবন আলক্বাম (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) কোরবানি কী? তিনি বল্লেন, এটা তোমাদের পিতা হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর সুন্নাত। সাহাবীরা আবার জিজ্ঞেস করলেন, এতে আমাদের কী উপকার রয়েছে ? আল্লাহর রাসূল এবার উত্তর দিলেন, কোরবানির পশুর প্রত্যেক পশমের পরিবর্তে একটি করে নেকী রয়েছে। তা যদি ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা হয়ও।
[মসনদে আহমদ, ইবনে মাজাহ, মিশকাত শরীফ ২২৬]
কোরবানির ইতিহাস ও রহস্য, মুসলিম মিল্লাতের পিতা হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর সাথে সম্পৃক্ত। মহান আল্লাহ তাঁকে একের পর এক পরীক্ষা করে সর্বশষে খলীলুল্লাহ বা নিজের বন্ধু হিসেবে ঘোষণা দেন।
প্রথমতঃ নমরুদের মাধ্যমে অগ্নিকুণ্ড নিক্ষেপের পরীক্ষা। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) চরম ধৈর্যের সাথে মহান আল্লাহর উপর দৃঢ় বিশ্বাস এবং আস্থার কারণে সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর নিজের স্ত্রী ও দুগ্ধপোষ্য সন্তানকে মরুভূমিতে নির্বাসনের নির্দেশ দেওয়া হলে তিনি সেই পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হলেন।
এভাবে বড় বড় ত্রিশ (৩০) ঊর্ধ্ব পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন তিনি। আর প্রতি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আল্লাহর বন্ধুত্বের আসনে সমাসীন হতে সক্ষম হন। সর্বশেষ পরীক্ষা নেওয়া হয় নিজের প্রাণপ্রিয়, কলিজার টুকরা আদরের সন্তানকে কোরবানির নির্দেশের মাধ্যমে।
পবিত্র হাদিসে পাকে বর্ণিত রয়েছে, হযরত ইব্রাহীম (আঃ) আল্লাহর রাস্তায় ১ হাজার বকরী, ৩শ’ গাভী এবং একশ’ উট কোরবানি দিয়েছিলেন। মহান আল্লাহর প্রতি ভালোবাসার এমন নিদর্শন দেখে মানুষ তো বটেই, ফেরেশতারাও অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। এ অবস্থায় হযরত ইব্রাহীম (আঃ) আরো আবেগাপ্লুত হয়ে বল্লেন, "আমার রবের জন্যে আমি যা দিলাম তাতো কিছুই নয়! বরং আমার কাছে যদি আরো একটা সন্তান থাকতো তাকেও আমি আল্লাহর রাস্তায় কোরবানি দিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতাম।”
এদিকে অনেকদিন অতিবাহিত হয়ে গেল। আর এ কথাটিও তাঁর স্মরণের অগোচরে চলে যায়। যখন পবিত্র মক্কায় পদার্পণ করলেন, আল্লাহ পাকের দরবারে একটি সন্তানের আবেদন করলেন।
আল্লাহ তায়ালা তাঁর পবিত্র ফরিয়াদ কবুল করলেন এবং পুত্র সন্তানের সুসংবাদ দেন। ফলে শিশুপুত্র হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালাম-এর জন্ম হয়।
অতি আদর যত্নে লালিত-পালিত শিশু ইসমাইল (আঃ)-এর বয়স যখন ৭ বছর বা ১০ বছর হলো, তখন হযরত ইব্রাহীম (আঃ) কে স্বপ্নে বলা হলো, ওহে ইব্রাহীম! এবার তুমি তোমার নিকট সর্বাপেক্ষা প্রিয় বস্তুটি আল্লাহর দরবারে কোরবানি করো! এভাবে তিন দিন একই স্বপ্ন দেখে নিশ্চত হলেন, আল্লাহ তাঁকে স্বীয় পুত্র ইসমাঈলকে কোরবানির নির্দেশ দিয়েছেন।
মহান আল্লাহর নির্দেশ মতো শিশুপুত্র হযরত ঈসমাঈল (আঃ) কে কোরবানি করার জন্যে মিনা নামক প্রান্তরে শায়িত করে ধারালো ছুরি দিয়ে বারংবার জবেহের প্রচেষ্টা চালানোর পরও শিশু ইসমাঈল (আঃ)-এর কোমল চামড়া কাটা যাচ্ছিল না। এমতাবস্থায় আরো হতাশ হৃদয়ে ভেঙ্গে পড়লেন। তখনই এক পর্যায়ে অনুভব করছিলেন কোরবানি হয়ে গেছে। বাঁধা চক্ষুযুগল যখন খুল্লেন, দেখতে পেলেন সামনে একটি দুম্বা জবেহ হয়ে আছে, যা দেখে আরো বেশি হতবাক হয়ে গেলেন।
তখন আওয়াজ এলো, “হে ইব্রাহীম! নিশ্চয় তুমি তোমার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছো। আর এভাবেই আমি পুণ্যবানদের পুরস্কৃত করি। সেদিন বেহেশত থেকে দুম্বা এনে শিশু ইসমাঈল (আঃ)-এর স্থলাভিষিক্ত করে কোরবানি কবুল করলেন।
বস্তুত হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর প্রিয় সন্তান হযরত ইসমাঈল (আঃ)কে কোরবানি দেওয়ার এ অবিস্মরণীয় ঘটনাকে প্রাণবন্ত করে রাখার জন্যই উম্মত মুহাম্মদী (সাঃ)-এর উপর কোরবানিকে ওয়াজিব করা হয়েছে। কোরবানি প্রসঙ্গে মহান আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, হে নবী! আপনি আপনার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করুন এবং কোরবানি করুন। (সুরা কাউসার-২)
অপর এক হাদীসে এসেছে, “কোরবানি পশু ক্রয়ের জন্যে যে ঘর হতে বের হয়, তার প্রত্যক কদমের পরিবর্তে একটি করে নেকী আল্লাহ তায়ালা তার আমলনামায় লিপিবদ্ধ করে দেন।”
হাদীসে পাকে আরো এসেছে, “তোমরা কোরবানির পশুকে সম্মান করো, কেননা ওটা পরকালে পুুলসিরাতের উপর তোমাদের বাহন হবে।”
কোরবানির ফজিলত সম্পর্কে অন্য হাদীসে এসেছে, প্রিয়নবী ইরশাদ করেছেন, “কোরবানিদাতার পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার পূর্বেই তার কোরবানি আল্লাহর দরবার কবুল করা হয়। যদি অন্তরের নিয়ত পরিশুদ্ধ হয়।”
মহনবী (দঃ) আরো বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে যারা কোরবানি দিবে এবং যারা কোরবানি দিতে অক্ষম তারা যেন জিলহজ্বের ১ম দিন হতে ১০ম দিন কোরবানির পশুর গলায় চুরি দেওয়া পর্যন্ত নিজের চুল, নখ, পশম ইত্যাদি কাটা থেকে বিরত থাক। এটা মুস্তাহাব আমল। এর ফলে আল্লাহতায়ালা কোরবানি অক্ষম ব্যক্তিকেও কোরবানির সাওয়াব দান করেন।
পরিশেষে বলা যায়, কোরবানির বিশাল নিয়ামাতের মূল কারণ হলো, এতে বান্দার পক্ষ থেকে মহান আল্লাহর প্রতি মুহাব্বতের এক প্রোজ্জ্বল নিদর্শন পরিলক্ষিত হয়। তাই কোরবানি হতে হবে লৌকিকতামুক্ত, ফলে তার সাথে যবেহ হবে মনের পশুত্ব! আর তা করতে না পারলে কোরবানি করার মধ্যে কোনো সার্থকতা আমাদের কপালে নসিব হবে না। আল্লাহ তায়ালা আমাদের প্রত্যকের কোরবানিকে যেন কবুল করে অফুরন্ত সাওয়াব দান করেন।
আমীন
লেখক : মুদাররিস, জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া মহিলা ফাযিল মাদরাসা, ষোলশহর, চট্টগ্রাম।
খতিব, মসজিদ-এ রহমানিয়া গাউসিয়া, বায়েজিদ, চট্টগ্রাম।
০১৮১৬-৩৭৩৫০৩