সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার
  •   দৈনিক ইনকিলাবের প্রশাসনিক কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ্ মিজির দাফন সম্পন্ন
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা

প্রকাশ : ১১ আগস্ট ২০২১, ২৩:৩৭

কেন এতো মৃত্যু, কেন এতো লাশ? অনুসন্ধান-০১

হাসপাতালে অক্সিজেন সংকটের মিথ্যা তথ্যে প্রাণ হারাচ্ছে গ্রামের মানুষ

রাসেল হাসান
হাসপাতালে অক্সিজেন সংকটের মিথ্যা তথ্যে প্রাণ হারাচ্ছে গ্রামের মানুষ

চাঁদপুরে অক্সিজেন প্লান্ট উদ্বোধন হলো, উপজেলা সরকারি হাসপাতালে করোনা বেড বাড়ানো হলো, দেয়া হলো পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী। তবুও কমছে না মৃত্যু। প্রায় প্রতিদিনই চাঁদপুরে করোনা সংক্রমণ ও উপসর্গ নিয়ে মারা যাচ্ছেন ৮ থেকে ১০ জন। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত চাঁদপুরে শুধু করোনা সংক্রমণেই মারা গেছেন ২০২ জন। উপসর্গে প্রাণ হারানো মৃতের সংখ্যাও ১শ’ ছাড়িয়েছে বহু আগে। কেন এত মৃত্যু? কেন এত লাশ? একি শুধুই নিয়তির লিখন, নাকি স্বাস্থ্য বিভাগের গাফিলতি তা খতিয়ে দেখতে দীর্ঘদিন ধরে অনুসন্ধান চালায় চাঁদপুর কণ্ঠ। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে আসার মতই পাওয়া যায় অবাক করা চাঞ্চল্যকর কিছু তথ্য। ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজকের পর্বে থাকছে অনুসন্ধান-০১।

১ আগস্ট রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে করোনায় সংক্রমিত হয়ে মারা যান হাইমচর উপজেলার ৬নং ওয়ার্ডের উত্তর আলগী গ্রামের শাহাবুদ্দিন মিজি। ২৮ জুলাই তার সন্তান জহিরুল ইসলামকে হাইমচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে ফোন করে বলা হয়েছিলো, আপনার বাবার করোনা পজিটিভ। তাকে বাড়িতে রেখে সেবা দিন। শাহাবুদ্দিন মিজি বাড়িতেই ছিলেন। দু'দিন পর তার শ্বাসকষ্ট ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। যে নম্বর থেকে কল করা হয়েছিলো সেই নম্বরে আবার ফোন করলেন জহিরুল ইসলাম। বলা হলো হাসপাতালে আনার প্রয়োজন নেই। স্বেচ্ছাসেবীদের কাছ থেকে একটি অক্সিজেন ম্যানেজ করুন। একটি পালস অক্সিমিটার কিনে নিন। পালস ৯০-এর নিচে নেমে গেলে অক্সিজেন দিবেন।

'পালস অক্সিমিটার' কী তা জানেন না জাহিরুল। জানার কথাও নয়। তার ভাষায়, ফার্মেসি থেকে কিনেছেন করোনা মাপার মেশিন। যে মেশিন আঙ্গুলের মাথায় লাগিয়ে জহির দেখলেন কিছু নম্বর ওঠানামা করছে। বাবার পালস ওঠানামার কথা জানানো হয়েছিলো হসপিটালে। ফোনে বলা হলো সব ঠিক হয়ে যাবে, নিয়মিত ঔষধ খাওয়ান।

১ আগস্ট শাহাবুদ্দিন মিজি শ্বাস নিতেই পারছিলেন না। বিছানায় যখন কাতরাচ্ছেন আর বলছিলেন ‘বাবা জহির আমারে বাঁচা। আমি মরি যাইরে বাবা..’ সন্তান তখন পাগলপ্রায়। ছেলে জহিরুল ইসলাম ছুটে গেলেন হাইমচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। কর্মরত চিকিৎসক বললেন অক্সিজেন নেই, অন্য কোথাও দেখেন। জহির আবার বাড়ি পৌঁছলেন, বাবার অবস্থা আরো অবনতি দেখে আবার গেলেন হাসপাতালে। কাঁদলেন, বললেন ‘আমার আব্বার শেষ অবস্থা। একটু অক্সিজেন দেন না স্যার।’ ডাক্তারের একই কথা অক্সিজেন নেই; কোথা থেকে দিবেন? প্রায় ১২ বার হাসপাতাল ও বাড়ি দৌড়াদোড়ি করলেন জহিরুল। মিলেনি কোনও সমাধান। নিরূপায় হয়ে বাবাকে নিয়ে পার্শ্ববর্তী ফরিদগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলেন জহির। দুপুর ১২টা থেকে ১টার মধ্যে হাসপাতালে পৌঁছার পর শাহাবুদ্দিন মিজিকে ইমার্জেন্সি রুমে নেয়া হলো। তার পালস মেপে বলা হলো রোগীর অক্সিজেন লাগবে। হাসপাতালে অক্সিজেন নেই। জহির কাঁদলেন। ডিউটি অফিসারকে অক্সিজেন ম্যানেজ করে ভর্তি করাতে অনুরোধ জানালেন। কোনো লাভ হলোনা তাতেও। ডিউটি অফিসার বলেছিলেন, অক্সিজেন নেই। অন্য হাসপাতাল দেখেন।

মূমুর্ষ বাবাকে সিএনজিতে রেখে জহির খোঁজ নিলেন চাঁদপুর জেলা সদর হাসপাতালে। জানতে পারলেন এ হাসপাতালেও অক্সিজেনের সংকট। বেড নেই, পুরো হাসপাতাল রোগীতে ঠাঁসা। শেষ পর্যন্ত সন্ধান পেলেন হাইমচর উপজেলা বিএনপির নেতৃত্বাধীন ‘হাইমচর করোনা হেল্প সেন্টার’ নামে স্বেচ্ছাসেবীরা অক্সিজেন দিচ্ছেন। হাসপাতালে ঠাঁই না পেয়ে বাড়িতে ফিরে গেলেন জহির। করোনা হেল্প সেন্টারের সমন্বয়ক মাজহারুল ইসলাম সফিক একটি সিলিন্ডার পাঠালেন। অক্সিজেন দেয়া হলো। শান্ত হলেন শাহাববুদ্দিন মিজি। চার ঘণ্টা পর আবার শ্বাসকষ্ট শুরু হলো তার। বললেন, অক্সিজেন পাচ্ছেন না। বুঝা গেলো সিলিন্ডারের অক্সিজেন শেষ। রাত তখন ১১টা। স্বেচ্ছাসেবী কর্মীদের ফোনেও পাচ্ছিলেন না তিনি। তাই খালি সিলিন্ডার কাঁধে করে কাঁদতে কাঁদতে রওনা হলেন আলগী বাজারে। পথে কোনো গাড়ি নেই, মানুষ নেই। একাকী জহিরুল আল্লাহকে ডাকছেন আর দৌড়াচ্ছেন। কাঁধে তার সিলিন্ডারের খালি বোতল।

রাতে হাইমচর করোনা হেল্প সেন্টারে পৌঁছে সব কিছু খুলে বললেন। নতুন আরেকটি সিলিন্ডার নিয়ে বাড়ি ফিরলেন জহির, সাথে আসলেন স্বেচ্ছাসেবীরা। যথা নিয়মে মুখে লাগালেন অক্সিজেন। ততক্ষণে শাহাবুদ্দিন মিজির দেহ শিথিল হয়ে গেছে। কয়েক মিনিটের মধ্যে থেমে গেছে তার হৃদকম্পন। জহির বাবার কানের কাছে গিয়ে ডাকছেন, আব্বা, ও আব্বা...। কোনো সাড়া নেই। জহির বুঝলেন, আব্বা চলে গেছেন না ফেরার দেশে।

অথচ হাইমচর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ বেলায়েত হোসেন চাঁদপুর কণ্ঠকে জানান, তার হাসপাতালে ২০টি করোনা বেড রয়েছে। যার মধ্যে রোগী ভর্তি আছে ৭টি বেডে। ফাঁকা রয়েছে আরো ১৩টি বেড। গত ১০ দিন ধরে হাসপাতালে অক্সিজেন মজুদ রয়েছে ৫০টি সিলিন্ডার। ‘১৩টি বেড ফাঁকা থাকার পরও কেন ভর্তি নেয়নি, অক্সিজেন মজুদ থাকার পরও কেন ফিরিয়ে দেয়া হয়েছিলো মৃত্যুপথযাত্রী করোনা পজিটিভ রোগীকে?’ জানতে চাইলে বিস্ময় প্রকাশ করে ডাঃ বেলায়েত হোসেন বলেন, আমার হাসপাতালে এমনটি হচ্ছে তা আমার জানা ছিলো না। হাসপাতাল থেকে অক্সিজেন নেই বলাটা দুঃখজনক।

ডাঃ বেলায়েত হোসেন বিস্ময় প্রকাশ করলেও তার হাসপাতালের এমন অঘটন যে তার সামনে আগেও ঘটেছে, মিলেছে তারও প্রমাণ। হাইমচর করোনা হেল্প সেন্টারের প্রধান সমন্বয়ক মাজহারুল ইসলাম সফিক বলেন, নীলকমল উচ্চ বিদ্যালয়ের ধর্মীয় শিক্ষক মাওলানা ইউসুফের শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়ায় আমাদের কাছে অক্সিজেনের জন্যে ফোন করেন। আমরা বলেছিলাম, আপাতত আমাদের কাছে অক্সিজেন নেই। আপনারা স্যারকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে আসুন। হাসপাতালে পৌঁছানোর পর ডিউটি অফিসার বলেছিলেন হাসপাতালে অক্সিজেন নেই। স্বেচ্ছাসেবীরা বিষয়টি মানতে পারেননি। অভিযোগ করেছিলেন হাসপাতালের কর্মকর্তা ডাঃ বেলায়েত হোসেনকে। তিনি বলেছিলেন, কে বলেছে অক্সিজেন নেই? আমি এক্ষুণি ব্যবস্থা করছি। পরে হাসপাতাল থেকেই তাকে অক্সিজেন দেয়া হয়।

মাজহারুল ইসলাম সফিক বলেন, সেদিন আমরা না থাকলে ডিউটি অফিসারের ভুল তথ্যের কারণে হয়তো মাওলানা ইউসুফের অবস্থা শাহাবুদ্দিন মিজির মতই হতো। সেদিন যদি ডাঃ বেলায়েত হোসেন ডিউটি অফিসারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেন তাহলে শাহাবুদ্দিন মিজির মত রোগীরা পরে আর প্রতারিত হতো না।

ফরিদগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে গত ১০ দিন ধরে হাসপাতালটিতে ২০টি করোনা বেড ও সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে ৫০টি অক্সিজেন সিলিন্ডার রয়েছে। ‘পর্যাপ্ত অক্সিজেন ও বেড ফাঁকা থাকা সত্ত্বেও কেন ১ আগস্ট শাহাবুদ্দিন মিজিকে বলা হয়েছিলো হাসপাতালে কোনো অক্সিজেনই নেই’ জানতে চাইলে ফরিদগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ আশরাফ আহমেদ চৌধুরী বলেন, এ ধরণের কোনো ঘটনা আমার হাসপাতালে ঘটতে পারে তা আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। আমরা রোগীকে তার পজিশন জানিয়ে বলি যে, আমরা আপাতত হাসপাতালে ভর্তি দিতে পারি, অক্সিজেন সাপোর্ট দিতে পারি, তবে তাকে জেলা সদর (জেনারেল) হাসপাতালে নিলে ভালো হয়। কিন্তু একেবারে অক্সিজেন নেই এ কথা বলাটা দুঃখজনক। আমি সিসিটিভি ফুটেজ দেখে বিষয়টি চিহ্নিত করছি। ভবিষ্যতে যেন এমনটি না ঘটে তার ব্যবস্থা নিচ্ছি।

দুটি হাসপাতালের গাফিলতিতে প্রাণ গেলো শাহাবুদ্দিন মিজির। স্বেচ্ছাসেবীদের কাছ থেকে অক্সিজেন ম্যানেজ করে নিজের অনভিজ্ঞ সন্তানই পালন করলেন চিকিৎসকের ভূমিকা। অথচ দুটি হাসপাতালেই মজুত ছিলো প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সিলিন্ডার। শুধু একজন শাহাবুদ্দিন মিজির মৃত্যুর ঘটনা সামনে নিয়ে আনা হলো। এমন বহু শাহাবুদ্দিন মিজি আছে যারা হাসপাতালের ভুল তথ্যের করণে বলি হতে হয়, হারাতে হয় স্বজনকে। স্বজনহারার শোকে চাপা পড়ে যায় এমন ঘটনাগুলো।

এ ঘটনা শুধু ফরিদগঞ্জ বা হাইমচর উপজেলা হাসপাতালেরই নয়, জেলার প্রায় প্রতিটি উপজেলা হাসপাতালেই এমন ঘটনা ঘটছে অহরহ। চাঁদপুর কণ্ঠের অনুসন্ধানে মিলেছে তার প্রমাণ। আগামীকাল অনুসন্ধান-০২-এ প্রকাশ পাবে আরো একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা। দিন শেষে প্রশ্ন একটাই, কেন এতো মৃত্যু, কেনো এতো লাশ? সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নিবেন কি কর্তৃপক্ষ?

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়