প্রকাশ : ০৭ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০
যাকাতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
মুফতি মুহাঃ আবু বকর বিন ফারুক
‘যাকাত’ শব্দের আভিধানিক অর্থ বৃদ্ধি ও উন্নতি। যাকাত শব্দের আভিধানিক আরেকটি অর্থ হয় (তাতহির), যার বাংলা অনুবাদ পবিত্র করা। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন- ‘সে নিশ্চিত সফল হয়েছে যে তাকে (নফসকে) পবিত্র করেছে’। [সূরা আশ-শামস, আয়াত: ৯]
যাকাতের কারণে সম্পদ বৃদ্ধি পায়, তাই যাকাতকে যাকাত বলা হয়। যাকাতের কারণে নেকিও বর্ধিত হয়। আরেকটি কারণ হলো, যাকাত নফসকে কৃপণতার ন্যায় বদ অভ্যাস থেকে পবিত্র করে, তাই অভিধানের দ্বিতীয় অর্থও শরঈ‘ যাকাতে পাওয়া যায়।
ইসলামী পরিভাষায়, নির্দিষ্ট সম্পদের ভেতর শরী‘আত কর্তৃক নির্ধারিত পরিমাণকে যাকাত বলা হয়, যা বিশেষ শ্রেণি ও নির্দিষ্ট খাতে ব্যয় করতে হয়। জ্ঞাতব্য যে, কুরআন, সুন্নাহ ও মুসলিম উম্মাহর ঐকমত্যে যাকাত ফরয, এতে কারও দ্বিমত নেই।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘পাঁচটি বস্তুর ওপর ইসলামের ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছে। এ কথার সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূল, সালাত কায়েম করা, যাকাত আদায় করা, বাইতুল্লাহর হজ করা এবং রমযানের সাওম পালন করা’। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৮; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৬)
আল্লাহ তা’য়ালা বলেন - যারা জাকাতের ব্যাপারে কর্মতৎপর হয়। (সূরা মুমিনূন- আয়াত: ২৩:৪)
আল্লাহ তা’য়ালা বলেন-সালাত কায়েম কর জাকাত দাও এবং যারা আমার সামনে নত হয় (রুকুকারী) তাদের সাথে তোমরাও নত হও (রুকু কর)। (সূরা বাকারা- আয়াত: ০২:৪৩)
আল্লাহ তা’য়ালা বলেন- যারা জাকাত আদায় করে না, তারাই আখেরাত অস্বীকারকারী। (সূরা হামিম আস সাজদাহ- আয়াত: ৪১:৭)
এছাড়া সূরা বাক্বারা- ৮৩, ২৩, ১৭৭, ২১১, ২৬১, ২৭১, ২৭৩, ২৭৪, ২৭৭। সূরা মায়েদা- ১২, সূরা মারইয়ামণ্ড ৩১, ৫৫। সূরা মুমিনুল- ১৪। সূরা ফাতির-২৯, ৩০। সূরা রুমণ্ড ৩৯। সূরা মা’আরিফ- ২৪, ২৫। ইমরান- ৯২। সূরা তওবা- ৪১, ৩৪ ও ৩৫।
হযরত জারির ইবনে আবদুল্লাহ বলেন, আমি নবী করীম (সাঃ)-এর নিকট বাইয়াত গ্রহণ করেছি নামাজ কায়েম করার জন্য, জাকাত দেয়ার জন্য এবং প্রত্যেক মুসলমানের কল্যাণ কামনার জন্য। (বুখারী: বাবু ক্বাওলিন নাবিয়্যি আদ দ্বীনু আন নাসিহাতু, ৫৫; মুসলিম: বাবু বায়ানি আন্নাদ দ্বিনা আননাসিহাতু, ৮৩)
যাকাতের উপকারিতা : যাকাতের উপকারিতার মধ্যে অন্যতম হলো, যাকাত ধনী ও গরীবের মধ্যে ভালোবাসার সেতু বন্ধনকে সুদৃঢ় ও মজবুত করে। কারণ, সাধারণত মানুষের স্বভাব হলো, যে তার প্রতি দয়া করে, তাকেই সে মহব্বত করে, ভালোবাসে।
যাকাতের আরেকটি উপকারিতা হলো, যাকাত আত্মাকে পাক-পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করে। যাকাত দেওয়ার মাধ্যমে কৃপণতার মতো ঘৃণিত চরিত্র থেকে দূরে থাকা যায়। যেমনটি কুরআনে করীম যাকাতের এ অর্থের দিক ইঙ্গিত করেছেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘তাদের সম্পদ থেকে সদাকা নাও। এর মাধ্যমে তাদেরকে তুমি পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করবে। আর তাদের জন্য দো‘আ কর, নিশ্চয় তোমার দো‘আ তাদের জন্য প্রশান্তিকর। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ’। [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ১০৩]
যাকাতের আরেকটি উপকারিতা হলো, অভাবগ্রস্ত ও হত-দরিদ্র জন গোষ্ঠীর প্রতি দয়া, অনুগ্রহ ও সহানুভূতি করতে একজন মুসলিমকে অভ্যস্ত ও যোগ্য করে গড়ে তোলে।
যাকাতের আরেকটি উপকারিতা হলো, যাকাত দেওয়ার কারণে আল্লাহর পক্ষ থেকে বরকত লাভ, সম্পদ বৃদ্ধি ও প্রতিদান অর্জন হওয়া। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আর তোমরা যা কিছু আল্লাহর জন্য ব্যয় কর তিনি তার বিনিময় দেবেন এবং তিনিই উত্তম রিযিকদাতা’। [সূরা সাবা, আয়াত: ৩৯]
বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত হাদীসে কুদসীতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামণ্ডএর বাণী, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন,
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘হে আদম সন্তান, তোমরা খরচ কর, আমি তোমাদের ওপর খরচ করব’। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫৩৫২, সহীহ মুসলিম হাদীস নং ৯৯৩)
যাকাত আদায় না করার শাস্তি :
যারা যাকাত আদায়ে উদাসীনতা দেখায় এবং কৃপণতা করে তাদের বিষয়ে কুরআনে করীমে কঠিন হুমকি এসেছে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আর যারা সোনা ও রূপা পুঞ্জীভূত করে রাখে, আর তা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে না, তুমি তাদের বেদনাদায়ক আযাবের সুসংবাদ দাও। যেদিন জাহান্নামের আগুনে তা গরম করা হবে, অতঃপর তা দ্বারা তাদের কপালে, পার্শ্বে এবং পিঠে সেঁক দেওয়া হবে। (আর বলা হবে) ‘এটা তা-ই যা তোমরা নিজদের জন্য জমা করে রেখেছিলে। সুতরাং তোমরা যা জমা করেছিলে তার স্বাদ উপভোগ কর’। [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ৩৫, ৩৬]
যে সম্পদের যাকাত দেওয়া হয় না, তা অবশ্যই তা গচ্ছিত মাল যদ্বারা তার মালিককে কিয়ামতের দিন শাস্তি দেয়া হবে।
যেমনটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত বিশুদ্ধ হাদীসে এসেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘সোনা রূপার মালিক যদি এর যাকাত আদায় না করে, তবে কিয়ামতের দিন এ ধন সম্পদকে আগুনের পাত বানানো হবে এবং জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে। তারপর এগুলো দ্বারা তার পার্শ্ব, ললাট ও পিঠে দাগ দেওয়া হবে। যখনই ঠাণ্ডা হবে পূণরায় তা উত্তপ্ত করা হবে -এমন দিন যেদিনের পরিমাণ দুনিয়ার পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান হবে। এভাবে বান্দার পরিণতি জান্নাত বা জাহান্নাম নির্ধারণ না হওয়া পর্যন্ত শাস্তি চলতে থাকবে’। [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৯৮৭]
তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উট, গরু ও ছাগলের মালিকদের বিষয়ে আলোচনা করেন যারা তাদের পশুর যাকাত আদায় করে না। তিনি তাদের জানিয়ে দেন যে, নিশ্চয় তাদেরকে কিয়ামতের দিন যাকাত না দেওয়ার কারণে শাস্তি দেওয়া হবে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘যাকে আল্লাহ তা‘আলা সম্পদ দান করেছেন, কিন্তু সে এ যাকাত আদায় করে নি, কিয়ামতের দিন তার সম্পদকে টেকো মাথা বিশিষ্ট বিষধর সাপের আকৃতি দান করে তার গলায় মালা পরিয়ে দেওয়া হবে, সাপটি তার মুখের দুই পার্শ্ব কামড় দিয়ে বলতে থাকবে, আমি তোমার সম্পদ আমি তোমার জমাকৃত সম্পদ’। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৪০৩]
তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তা‘আলার বাণী তিলাওয়াত করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আর আল্লাহ যাদেরকে তাঁর অনুগ্রহ থেকে যা দান করেছেন তা নিয়ে যারা কৃপণতা করে তারা যেন ধারণা না করে যে, তা তাদের জন্য কল্যাণকর, বরং তা তাদের জন্য অকল্যাণকর। যা নিয়ে তারা কৃপণতা করেছিল, কিয়ামত দিবসে তা দিয়ে তাদের বেড়ি পরানো হবে। আর আসমানসমূহ ও যমীনের উত্তরাধিকার আল্লাহরই জন্য। আর তোমরা যা আমল কর সে ব্যাপারে আল্লাহ সম্যক জ্ঞাত’। [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৮০]
যে ধরনের সম্পদে যাকাত ওয়াজিব হয়। চার ধরনের মালের মধ্যে যাকাত ওয়াজিব হয় :
(১) যমীন থেকে উৎপাদিত ফসল।
(২) চতুষ্পদ জন্তু।
(৩) স্বর্ণ- রৌপ্য।
(৪) ব্যবসায়িক মালামাল বা পণ্য।
উল্লিখিত চার শ্রেণির সম্পদে যাকাত ওয়াজিব হওয়ার জন্য নির্ধারিত একটি পরিমাণ রয়েছে, তার কম হলে তাতে যাকাত ওয়াজিব হয় না।
ফল ও উৎপাদিত ফসলের যাকাতের নিসাব, পাঁচ ওসক। আর এক ওসকের পরিমাণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সা‘ দ্বারা ষাট সা‘। ফলে খেজুর কিসমিস, গম, ভুট্টা ও চাউল ইত্যাদির মধ্যে যাকাতের নিসাব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সা‘ দ্বারা তিনশত সা‘। এক সা‘-এর পরিমাণ হলো, একজন মাধ্যম আকৃতির লোকের দুই হাত ভর্তি চার কোষ। তাতে যাকাতের পরিমাণ হলো, এক-দশমাংশ যদি এ ফসল উৎপাদনে পানি সেচ দেওয়ার জন্য তার কোনো কষ্ট করতে হয় নি। যেমন, বৃষ্টির পানি, নদী, বন্যা বা নালার পানি দ্বারা ফসল চাষ করেছে। আর যদি টাকা খরচা করে, সেচে পানি, ডিপ মেশিন নলকূপ ইত্যাদি পানি দিয়ে থাকে তখন তার মধ্যে এক-দশমাংশের অর্ধেক যাকাত দিতে হবে। যেমনটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বিশুদ্ধ সনদে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট হাদীস বর্ণিত।
উট, গরু, ছাগল ইত্যাদির চতুষ্পদ জন্তুর নিসাবের বিস্তারিত আলোচনা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত হাদীসে রয়েছে। যাদের সক্ষমতা রয়েছে এমন আগ্রহীদের জন্য জরুরি হলো, তারা যেন জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞাসা করে যাকাতের জরুরি বিধানগুলো জেনে নেয়। যদি এ রিসালাটি সংক্ষিপ্ত করার ইচ্ছা না থাকত, তাহলে মানুষের উপকারের প্রতি লক্ষ্য রেখে তা বিস্তারিত আলোচনা করতাম।
আর রূপার নিসাব হলো, একশ চল্লিশ মিসকাল। এর পরিমাণ সৌদি আরবের মুদ্রা অনুযায়ী পঁয়ষট্টি রিয়াল।
আর স্বর্ণের নিসাব বিশ মিসকাল। বিশ মিসকাল সমান বিরানব্বই গ্রাম।
আর যারা এ পরিমাণ স্বর্ণ, চাঁদি অথবা যে কোনো একটির মালিক হবে এবং তার ওপর এক বছর অতিবাহিত হবে, তাদেরকে চল্লিশ ভাগের এক ভাগ যাকাত হিসেবে অবশ্যই প্রদান করতে হবে। লভ্যাংশ সাধারণত মূল সম্পদেরই অংশ, তাই তার ওপর এক বছর অতিবাহিত হওয়ার কোনো দরকার নেই। যেমনিভাবে জন্তুর ক্ষেত্রে মূল সম্পদের ওপর বছর অতিবাহিত হলে এবং মূল জন্তু নিসাব পরিমাণ হলে যাকাত ওয়াজিব হওয়ার জন্য তার থেকে উৎপন্ন বাচ্চাদের ওপর বছর অতিবাহিত হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।
স্বর্ণ, চাঁদি ও নগদ অর্থ যা বর্তমানে মানুষ বিভিন্ন নামে যেমন, ডলার, রিয়াল, টাকা ও রুপি ইত্যাদি ব্যবহার করে থাকে, যখন তা স্বর্ণ বা চাঁদির মূল্য সমপরিমাণ হয় এবং তার ওপর বছর অতিবাহিত হয়, তখন তাতে যাকাত ওয়াজিব হবে।
যাকাতের শর্ত সমূহ :
স্বাধীন, পূর্ণবয়স্ক মুসলিম নর-নারীর কাছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলে কতিপয় শর্তসাপেক্ষে তার উপর যাকাত ফরয হয়ে থাকে। যেমন :
১. সম্পদের উপর পূর্ণ মালিকানা : সম্পদের উপর যাকাত ওয়াজিব হওয়ার জন্য সম্পদের মালিকানা সুনির্দিষ্ট হওয়া আবশ্যক। অর্থাৎ সম্পদ, মালিকের অধিকারে থাকা, সম্পদের উপর অন্যের অধিকার বা মালিকানা না থাকা এবং নিজের ইচ্ছামতো সম্পদ ভোগ ও ব্যবহার করার পূর্ণ অধিকার থাকা। যেসকল সম্পদের মালিকানা সুসস্পষ্ট নয়, সেসকল সম্পদের কোনো যাকাত নেই, যেমন: সরকারি মালিকানাধীন সম্পদ। অনুরূপভাবে জনকল্যাণমূলক কাজের জন্য ওয়ক্ফকৃত সম্পদের উপরেও যাকাত ধার্য হবে না। তবে ওয়াক্ফ যদি কোনো ব্যক্তি বা গোত্রের জন্য হয়, তবে তার উপর যাকাত দিতে হবে।
২. সম্পদ উৎপাদনক্ষম হওয়া : যাকাতের জন্য সম্পদকে অবশ্যই উৎপাদনক্ষম, প্রবৃদ্ধিশীল হতে হবে, অর্থাৎ সম্পদ বৃদ্ধি পাবার যোগ্যতাই যথেষ্ট। যেমন: গরু, মহিষ, ব্যবসায়ের মাল, নগদ অর্থ ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ক্রীত যন্ত্রপাতি ইত্যাদি মালামাল বর্ধনশীল। অর্থাৎ যেসকল মালামাল নিজের প্রবৃদ্ধি সাধনে সক্ষম নয়, সেসবের উপর যাকাত ধার্য হবে না, যেমন: ব্যক্তিগত ব্যবহারের মালামাল, চলাচলের বাহন ইত্যাদি।
৩. নিসাব পরিমাণ সম্পদ : যাকাত ফরয হওয়ার তৃতীয় শর্ত হচ্ছে শরীয়ত নির্ধারিত সীমাতিরিক্ত সম্পদ থাকা। সাধারণ ৫২.৫ তোলা রূপা বা ৭.৫ তোলা স্বর্ণ বা উভয়টি মিলে ৫২.৫ তোলা রূপার সমমূল্যের সম্পদ থাকলে সে সম্পদের যাকাত দিতে হয়। পশুর ক্ষেত্রে এই পরিমাণ বিভিন্ন
৪. মৌলিক প্রয়োজনাতিরিক্ত সম্পদ থাকা : সারা বছরের মৌলিক প্রয়োজন মিটিয়ে যে সম্পদ উদ্ধৃত থাকবে, শুধুমাত্র তার উপরই যাকাত ফরয হবে। এপ্রসঙ্গে আল-কুরআনে উল্লেখ রয়েছে:লোকজন আপনার নিকট (মুহাম্মদের [স.] নিকট) জানতে চায়, তারা আল্লাহর পথে কী ব্যয় করবে? বলুন, যা প্রয়োজনের অতিরিক্ত। আল্লাহ এভাবেই তোমাদের জন্য সুস্পষ্ট বিধান বলে দেন।
মুহাম্মদের [স.] সহচর আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস [রা.] বলেছেন, ‘অতিরিক্ত বলতে পরিবারের ব্যয় বহনের পর যা অতিরিক্ত বা অবশিষ্ট থাকে তাকে বুঝায়।’
জনাব ইউসুফ আল কারযাভী'র মতে স্ত্রী, পুত্র, পরিজন, ও পিতামাতা এবং নিকটাত্মীয়দের ভরণ-পোষণও মৌলিক প্রয়োজনের অন্তর্ভুক্ত।
৫.ঋণমুক্ততা : নিসাব পরিমাণ সম্পদ হলেও ব্যক্তির ঋণমুক্ততা, যাকাত ওয়াজিব হওয়ার অন্যতম শর্ত। যদি সম্পদের মালিক এত পরিমাণ ঋণগ্রস্থ হন যা, নিসাব পরিমাণ সম্পদও মিটাতে অক্ষম বা নিসাব পরিমাণ সম্পদ তার চেয়ে কম হয়, তার উপর যাকাত ফরয হবে না।
ঋণ পরিশোধের পর নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলেই কেবল যাকাত ওয়াজিব হয়। তবে এক্ষেত্রে দ্বিতীয় মতটি হলো: যে ঋণ কিস্তিতে পরিশোধ করতে হয় সে ঋণের ক্ষেত্রে যেবছর যে পরিমাণ ঋণ পরিশোধ করতে হয়, সেবছর সে পরিমাণ ঋণ বাদ দিয়ে বাকিটুকুর উপর যাকাত দিতে হয়। কিন্তু ঋণ বাবদ যাকাত অব্যাহতি নেয়ার পর অবশ্যই ঋণ পরিশোধ করতে হবে। অন্যথায় সে সম্পদের উপর যাকাত দিতে হবে।
৬. সম্পদ এক বছর আয়ত্তাধীন থাকা : নিসাব পরিমাণ স্বীয় সম্পদ ১ বছর নিজ আয়ত্তাধীন থাকা যাকাত ওয়াজিব হওয়ার পূর্বশর্ত। তবে কৃষিজাত ফসল, খনিজ সম্পদ ইত্যাদির যাকাত (উশর) প্রতিবার ফসল তোলার সময়ই দিতে হবে। ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে ও কোম্পানীর ক্ষেত্রে বছর শেষে উদ্বর্তপত্রে (Balance Sheet) বর্ণিত সম্পদ ও দায়-দেনা অনুসারে যাকাতের পরিমাণ নির্ধারিত হবে।
মহিলাদের ব্যবহারিক অলংকারের যাকাত : টাকার সাথে সংযোগ করা হবে, মহিলাদের ব্যবহারিক স্বর্ণ ও রূপা, যদিও তা ব্যবহারের জন্য হয়ে থাকে। আলেমদের বিশুদ্ধ মত অনুযায়ী মহিলাদের ব্যবহারিক স্বর্ণ বা চাঁদি যদি নিসাব পরিমাণ পৌঁছে থাকে এবং তার ওপর এক বছর অতিবাহিত হয়, তাতে যাকাত দিতে হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণীর ব্যাপকতাই এর প্রমাণ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
“সোনা রূপার মালিক যদি এর যাকাত আদায় না করে, তবে কিয়ামতের দিন এ ধন সম্পদকে তার শাস্তির জন্য আগুনের পাত বানানো হবে”।[সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৯৮৭]
এ ছাড়াও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে হাদীস বর্ণিত, একজন মহিলার হাতে স্বর্ণের দু’টি চুড়ি দেখে তিনি বললেন-
তুমি কি এর যাকাত আদায় কর? সে বলল, না, তখন আল্লাহর রাসূল বললেন, তুমি কি পছন্দ কর যে, কিয়ামতের দিন আগুনের দু’টি চুড়ি তোমাকে পরিয়ে দেওয়া হোক? এরপর তিনি চুড়ি দু’টি খুলে ফেললেন এবং রাসূলের দরবারে ফেলে দিয়ে বললেন, এ দু’টি চুড়ি আল্লাহ জন্য এবং তার রাসূলের জন্য। [আবূ দাউদ, হাদীস নং ১৫৬৩; নাসাঈ, হাদীস নং ২৪৭৯]
উম্মে সালমা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, স্বর্ণের কিছু অলংকার তিনি ব্যবহার করতেন, তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, এগুলো কি গচ্ছিত সম্পদ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
যে সম্পদ যাকাতের নিসাব পরিমাণ পৌঁছার পর তার যাকাত আদায় করা হয়, তা গচ্ছিত সম্পদ নয়। [আবু দাউদ, হাদীস নং ১৫৬৪। ] একই অর্থে আরও একাধিক হাদীস বর্ণিত রয়েছে।
ব্যবসায়িক মালের যাকাত : আর যে সব মালামাল ব্যবসার উদ্দেশ্যে সঞ্চয় করা হয়, তা বছর শেষে মূল্য নির্ধারণ করে চল্লিশ ভাগের এক ভাগ যাকাত হিসেবে বের করতে হবে। চাই তার মূল্য স্বর্ণ ও চাঁদির সমপরিমাণ হোক বা না হোক অথবা অধিক হোক। এর প্রমাণ সামুরা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হাদীস, তিনি বলেন,
‘অতঃপর, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের যে সম্পদ ব্যবসার উদ্দেশ্যে প্রস্তুত রাখা হত, তা থেকে যাকাত বের করার আদেশ দিতেন’। [আবু দাউদ, হাদীস নং ১৫৬২]
ব্যবসার উদ্দেশ্যে ক্রয় করা যমীন, গাড়ি, বাড়ি, পানির মেশিন ইত্যাদি ব্যবসায়িক পণ্যের অন্তর্ভুক্ত। বছর শেষে মূল্য হিসাব করে এ সব সম্পদের যাকাত অবশ্যই দিতে হবে। যে সব ঘর-বাড়ি ভাড়া দেওয়ার জন্য নির্মাণ করা হয়েছে, বছর অতিবাহিত হওয়ার পর ভাড়ার টাকার ওপর একবছর পূর্ণ হলে অবশ্যই যাকাত দিতে হবে; কিন্তু মূল বাড়ি-ঘরের ওপর যাকাত দিতে হবে না। কারণ, তা ব্যবসার উদ্দেশ্যে নির্মাণ করা হয়নি।
অনুরূপভাবে ভাড়ার গাড়ি ও ব্যবহারিক গাড়ি যদি তা ব্যবসার উদ্দেশ্যে ক্রয় করা না হয়, বরং ব্যবহারের উদ্দেশ্যে ক্রয় করা হয়, তাতে যাকাত দিতে হবে না। আর যদি গাড়ি ভাড়ার টাকা নিসাব পরিমাণ হয় এবং তার ওপর এক বছর অতিবাহিত হয়, তাহলে অবশ্যই তাকে যাকাত দিতে হবে। আর যদি কোনো ব্যক্তি যমীন ক্রয়, বিবাহ, ঋণ পরিশোধ ও খরচা করা ইত্যাদি যে কোনো উদ্দেশ্যে টাকা সঞ্চয় করার পর তা যদি তা নিসাব পরিমাণ হয় এবং তার ওপর এক বছর অতিবাহিত হয়, তাহলে তাকে অবশ্যই যাকাত দিতে হবে। কারণ, শরী‘আতের দলীলসমূহ এ ধরনের সম্পদের ওপর যাকাত ওয়াজিব হওয়া বিষয়ে ব্যাপক।
অনুরূপভাবে ইয়াতীম ও পাগলের মাল যদি নিসাব পরিমাণ পৌঁছে এবং তার ওপর এক বছর অতিবাহিত হয়, বছর শেষে জমহুর আলেমদের মতে অভিভাবকদের ওপর তাদের পক্ষ থেকে যাকাত দেওয়া ওয়াজিব। যাকাত বিষয়ক দলীলসমূহের ব্যাপকতা এর প্রমাণ। যেমন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মু‘আয ইবন জাবাল রাদিয়াল্লাহু আনহুকে যখন ইয়ামেনের দিকে প্রেরণ করেন, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাকে বলেন-
‘তুমি তাদের জানিয়ে দাও যে, আল্লাহ তা‘আলা তাদের ওপর যাকাত ফরয করেছেন। যা তাদের ধনীদের থেকে নেওয়া হবে এবং তাদের গরীবদের মধ্যে বণ্টন করা হবে’। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং১৩৯৫; সহীহ মুসলিম হাদীস নং ১৯]
যারা যাকাত খাওয়ার উপযুক্ত : যাকাত আল্লাহর হক, সুতরাং যে যাকাত খাওয়া উপযুক্ত নয়। যাকাতের মাল দিয়ে তাকে সহানুভূতি দেখানোর কোনো অবকাশ নেই এবং যাকাতের মাল নিজের কোনো উপকারে বা ক্ষতি থেকে বাঁচা, সম্পদ রক্ষা এবং দুর্নাম গোছানোর জন্য ব্যবহার করার কোনো সুযোগ নেই। বরং একজন মুসলিমের ওপর ওয়াজিব হলো, যাকাতের মাল তার প্রকৃত পাওনাদারকে নিঃস্বার্থভাবে খুশি মনে আল্লাহকে রাজি খুশি করা উদ্দেশ্যে পৌঁছে দেওয়া, যাতে সে দায় মুক্ত হয় এবং অধিক সাওয়াবের অধিকারী হয়। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে কারীমে যাকাতের বিভিন্ন শ্রেণির পাওনাদারদের বিষয়টি সু-স্পষ্ট করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘নিশ্চয় সাদাকাহ হচ্ছে ফকীর ও মিসকীনদের জন্য এবং এতে নিয়োজিত কর্মচারীদের জন্য, আর যাদের অন্তর আকৃষ্ট করতে হয় তাদের জন্য; (তা বণ্টন করা যায়) দাস আযাদ করার ক্ষেত্রে, ঋণগ্রস্তদের মধ্যে, আল্লাহর রাস্তায় এবং মুসাফিরদের মধ্যে। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত, আর আল্লাহ মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়’। [সূরা আত-তাওবাহ, আয়ত: ৬০]
আল্লাহর দু’টি মহান নাম দ্বারা আয়াতটি শেষ করা দ্বারা স্বীয় বান্দাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে এ কথার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলা তার স্বীয় বান্দাদের অবস্থা এবং তাদের মধ্যে যারা সাদাকাহ খাওয়ার উপযুক্ত আর যারা উপযুক্ত নয় তাদের সম্পর্কে সম্যক অবগত রয়েছেন এবং তিনি তার শরী‘আত ও পরিমাণ নির্ধারণ বিষয়ে প্রজ্ঞাবান। ফলে তিনি সবকিছুই যথাযথ উপযুক্ত স্থানে প্রয়োগ করেন। যদিও অধিকাংশ মানুষের নিকট তার হিকমতের অনেক রহস্যই অজ্ঞাত; যাতে বান্দাগণ তার শরী‘আতের প্রতি সন্তুষ্ট থাকে এবং তার হুকুমের প্রতি অনুগত থাকে।
যাকাতমুক্ত সম্পদ সম্পর্কে ইসলাম ধর্মের বাণীবাহক মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেছেন, বাসস্থানের জন্য নির্মিত ঘরসমূহ, ঘরে ব্যবহার্য দ্রব্যাদি, আরোহণের জন্য পশু, চাষাবাদ ও অন্যান্য আবশ্যকীয় কাজে ব্যবহৃত পশু ও দাস-দাসী, কাঁচা তরিতরকারিসমূহ এবং মৌসুমী ফলসমূহ যা বেশিদিন সংরক্ষণ করা যায় না, অল্পদিনে নষ্ট হয়ে যায়, এমন ফসলে যাকাত নেই। যদিও হানাফি মাযহাব অনুসারে নিজে নিজে উৎপন্ন দ্রব্যাদি, যথা বৃক্ষ, ঘাস এবং বাঁশব্যতীত অন্য সমস্ত শস্যাদি, তরিতরকারি ও ফলসমূহের যাকাত দিতে হয়। হাদিসের আলোকে যেসকল সম্পদসমূহকে যাকাত থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে, সেগুলো হলো: জমি ও বাড়িঘর; মিল, ফ্যাক্টরি, ওয়্যারহাউজ বা গুদাম ইত্যাদি; দোকান; এক বছরের কম বয়সের গবাদি পশু; ব্যবহার্য যাবতীয় পোশাক; বই, খাতা, কাগজ ও মুদ্রিত সামগ্রী; গৃহের যাবতীয় আসবাবপত্র, বাসন-কোসন ও সরঞ্জামাদি, তৈলচিত্র ও স্ট্যাম্প; অফিসের যাবতীয় আসবাব, যন্ত্রপাতি, সরঞ্জাম ও নথি; গৃহপালিত সকলপ্রকার মুরগী ও পাখি; কলকব্জা, যন্ত্রপাতি ও হাতিয়ার ইত্যাদি যাবতীয় মূলধনসামগ্রী; চলাচলের যন্তু ও গাড়ি; যুদ্ধাস্ত্র ও যুদ্ধ-সরঞ্জাম; ক্ষণস্থায়ী বা পঁচনশীল যাবতীয় কৃষিপণ্য; বপন করার জন্য সংরক্ষিত বীজ; যাকাতবর্ষের মধ্যে পেয়ে সেবছরই ব্যয়িত সম্পদ; দাতব্য বা জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানের সম্পদ, যা জনস্বার্থে নিয়োজিত; সরকারি মালিকানাধীন নগদ অর্থ, স্বর্ণ-রৌপ্য এবং অন্যান্য সম্পদ। যে ঋণ, ফেরত পাবার আশা নেই (স্থায়ী কুঋণ), তার উপর যাকাত ধার্য হবে না।
আল্লাহর প্রতি আমাদের কামনা, যেন তিনি আমাদের ও মুসলিমদের তার দীন বুঝার তাওফীক দেন, তার সাথে মু‘আমালায় সততা দান করেন এবং তার সন্তুষ্টি অর্জনের প্রতি দ্রুত অগ্রসর হওয়ার তাওফীক দেন। আর আল্লাহর কাছে আমাদের আরও কামনা যে, তিনি যেন আমাদের তার ক্ষোভের কারণসমূহ থেকে রক্ষা করেন। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা ও বান্দাদের অতি নিকটে। সালাত ও সালাম নাযিল হোক তার বান্দা ও রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ওপর ও তার পরিবারবর্গ এবং সাথী-সঙ্গীদের ওপর।
লেখক : ইমাম ও খতিব, বিষ্ণুপুর মনোহরখাদী মদিনা বাজার বাইতুল আমিন জামে মসজিদ, চাঁদপুর সদর, চাঁদপুর।