প্রকাশ : ০৪ আগস্ট ২০২১, ১৩:১৪
কুকুর প্রেমী মজিদ ভাই
করোনায় মানুষের পাশাপাশি বিপর্যস্ত নিরীহ পশুগুলোও। লকডাউনে খাবারের দোকান বন্ধ, ফুটপাতে, পার্কে নেই মানুষের কোলাহল। হকারদেরও দেখা যায় না আগের মত। -এমন দুঃসময়ে কি খাচ্ছে পথের কুকুরগুলো, তা নিয়ে ভাবে না কেউ। ওদেরও যে জীবন আছে, ক্ষুধা আছে তা অনেকের ভাবনার বাইরে থাকলেও 'মজিদ ভাই' তাদের নিয়ে ভাবেন। নিয়ম করে দিনে দু'বার খাবার দেন কুকুরগুলোকে।
ঘটনাটি রাজধানীর হাতিরঝিল এফডিসি মোড় এলাকায়। হাতিরঝিল বোট কাউন্টারে প্রহরীর দায়িত্ব পালন করেন আব্দুল মজিদ। সবার কাছে 'মজিদ ভাই' হিসেবে পরিচিত। মাস শেষে সামান্য যে কয় টাকা বেতন পান তা দিয়ে সংসার চালাতেই হিমশিম খেতে হয়। তবুও হাতিরঝিলে ঘুরে বেড়ানো ৫টি কুকুর প্রতিদিন খাবার পায় তার কাছ থেকে।
দুপুর বা সন্ধ্যা হলেই কুকুররা দল বেধে আব্দুল মজিদের আশে পাশে ঘুরে বেড়ায়। লেজ নেড়ে, জিহ্বায় ঠোঁট ভিজিয়ে জানান দেয় তাদের ক্ষুধা লাগার কথা। মজিদ ভাই কুকুরের ভাষা বোঝেন। তাদের সাথে কথা বলেন। কুকুরের আনাগোনা বাড়লেই উত্তর পাবে না জেনেও একের পর এক প্রশ্ন করে যান। বলেন, 'কিরে ক্ষিধা লাগছে? পুরা সকাল কই ঘুরলি? খাবার জোটে নাই? দাড়া আইতাছি। দেখি আজকে কি কেনা যায়।'
নিজে নিজে কথা বলতে বলতে 'মজিদ ভাই' পাশের অর্ধেক সাটার নামানো দোকানে গেলেন। কুঁজো হয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন। ফেরার সময় নিয়ে আসলেন ১ বাক্স বিস্কুট। প্রহরীর কাজ করা হাতের লাঠিটা পিঠের দিকে প্যান্টে কুঁজে একটি একটি করে প্যাকেট ছিড়ে ছিটিয়ে দিলেন। কুকুররা খাচ্ছে, মজিদ ভাই পুলকিত চোখে তাদের দিকে চেয়ে আছেন।
কাছে গিয়ে আব্দুল মজিদকে প্রশ্ন করলাম, 'এগুলো কি নষ্ট বিস্কুট?' উত্তরে মজিদ ভাই অবাক হয়ে বললেন, নাহ। নষ্ট হইবো ক্যা? ভালো বিস্কুট। এই দেহেন আমি একটা খাই। বলেই কুকুরের সামনে থেকে এক টুকরো বিস্কুট তুলে খাওয়া শুরু করলেন।
চাঁদপুর কণ্ঠ থেকে প্রশ্ন করলাম, 'টাকা কে দেয়?' বললেন, কে আর দিবো? আমি দেই। করোনা আসার পর থেইকা অগরে খাওয়া না দিলে আমারই পেটের ভাত হজম হয় না।
'এত টাকা খরচ হয় যে, মাস শেষে কষ্ট হয় না?' তৃতীয় প্রশ্নের উত্তরে আবারো অবাক করলেন তিনি। বললেন, কষ্ট হইবো ক্যান? আমার পোলাডা বাইচ্চ থাকলে ওরে খাওয়াইতাম না? ওর খাওয়া এখন পশুগুলারে খাওয়াই। ওরা দোয়া করলে পোলাটা ভালো থাকবো আল্লাহর কাছে।
'কি হয়েছিলো আপনার ছেলের?' প্রশ্নটি শুনতে হয়তো প্রস্তুত ছিলেন না মজিদ ভাই। স্তব্ধ হয়ে রইলেন কিছু সময়। চোখে মৃদু জল আসলো। ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন, দুই বছর আগে খেলতে গিয়া মগবাজার ট্রেনের নিচে কাটা পড়ছিলো। পেটের উপর দিয়া ট্রেন গেছে গা। খবর পাইয়া গিয়া দেখি দুই পা আর মাথা ছাড়া কিচ্ছু নাই। নাড়িভূড়ি ট্রেনের চাকা টাইনা নিয়া গেছে। যে কয় টুকরা পাইছি তা খুইজা আইনা ময়মনসিংহ গ্রামের বাড়ি নিয়া কবর দিছি। এখন তিন মাইয়াই ভরসা। পোলা নাই। কেউ আর ঘন ঘন আইসা কয় না, আব্বা টাকা দাও চিপস খামু। তাই কুকুরগুলারেই রোজ খাওয়াই। খাওয়াইয়া শান্তি পাই।
বলতে বলতে মজিদ ভাই রুমাল বের করে চোখ মুছলেন। পকেট থেকে টিস্যু বের করে চোখ মুছলেন প্রতিবেদকও। প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্যই তড়িঘড়ি করে পরের প্রশ্ন, 'আচ্ছা ভাই, দিন কতবার খাওয়া দেন ওদের?' বললেন, দুইবার। দুপুরে একবার আসে। সন্ধ্যায় একবার আসে। ওগো লেজ নাড়ানো দেখলেই আমি বুঝি ক্ষিধা লাগছে। দোকানে গিয়া কখনো বিস্কুট, কখনো রুটি, কখনো বাটার বন দেই। খাইয়া কোনোটা বইসা থাকে, কোনোটা যায়গা।
মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসার নজির দেশ জুড়েই হাজারো আছে। কিন্তু পথের নিরীহ প্রাণীর প্রতি মানুষের ভালোবাসা সারা বাংলাদেশেই বিরল। যে ক'জন আছেন তাদের মধ্যে নিঃসন্দেহে মজিদ ভাই অন্যতম। কুকুরের ভালোবাসায় তিনি পিতৃস্নেহ খুঁজে পান। ভুলে থাকেন পারেন সন্তান হারা ব্যথা।