সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ২৮ জুলাই ২০২১, ০৯:২৬

মাদকের ভয়াল থাবা

মাহাবুবুর রহমান সেলিম
মাদকের ভয়াল থাবা

পরিবারের একটি সুন্দর স্বপ্ন থাকে তার সন্তানকে নিয়ে। টানাটানির সংসারে মাসিক খরচের চাপ মাথায় নিয়েই উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায় মা বাবা সন্তানের জন্য যথাসাধ্য খরচ যুগিয়ে থাকেন। কিন্তু যদি সেই পরিবারের সন্তানটি মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন তাহলে তার চাইতে দুঃখ আর কি হতে পারে। সাম্প্রতিককালের প্রতিবেদনে দেখা যায় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা বড় অংশ আসে উচ্চ মধ্যবিত্ত এবং বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে। আর সেই পরিবারকে সেমিস্টারের টাকা যোগান দিতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। বিশেষ করে সংসারে যারা হাল ধরে আছেন তাদেরকে। আর সেই সন্তান যদি মাদকাসক্ত হয় এবং

বিপথগামী হয়ে যায়, তখন সেই পরিবারটি হয়ে পরে একান্ত অসহায়। পরিবারের স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সর্বশেষ পরিসংখ্যানে ফুটে উঠেছে, বিভিন্ন মাদকসেবী ও মাদক চোরাচালানের পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলছে। পরিবেশ এবং পরিস্থিতির কারণে এমনকি বিপথগামী মাদকাসক্ত বন্ধুবান্ধবদের পাল্লায় পরে ধীরে ধীরে ভালো মানুষগুলো ঝুঁকে পড়ছে মাদকের বেড়াজালে। ধনী পরিবারের

হচ্ছে স্বপ্নভঙ্গ অন্যদিকে মধ্যবিত্ত আর দরিদ্র পরিবারের গলায় ঝুলছে ফাঁস। এই করোনার সময়ও মাদক গ্রহণের প্রবণতা মোটেই কমেনি বরং বেড়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলি বন্ধ সেই সুবাদে অন লাইনের কার্যক্রম ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। মাদক ব্যবসায়ীরা এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে তাদের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ, বিভিন্ন অনলাইন সাপ্লাই চেইন এমনকি কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে তাদের মাদক স্বর্গরাজ্য তৈরি করেছে। মাদক ব্যবসায়ীরা মূলত টার্গেট করে তরুণ প্রজন্মকে। তাই দেখা যাচ্ছে মাদক গ্রহণকারী শতকরা নব্বই জনই হচ্ছে তরুণ। হতাশা ছাড়া, বিনোদন এবং অতি কৌতূহল তরুণদের মাদকের প্রতি ঝুঁকে পড়ার অন্যতম কারণ বটে। সাম্প্রতিককালে আমাদের দেশে হেলুসিনোজেনস ( Hallucinogens) গোত্রভুক্ত মাদকের সন্ধান পাওয়া পাওয়া গেছে। মাদকতায় আসক্ত একদল তরুণ গ্রেপ্তার হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চমকে উঠে। যুবকেরা ছিল একেবারেই নির্বিকার প্রতিক্রিয়াহীন উল্টো তারা ছিল হাসিমুখি। আসলে হ্যালসিনোজেনস শব্দের উৎপত্তি ল্যাটিন শব্দ ( Allucinan) থেকে। এর অর্থ দাঁড়ায় Dream to wonder in mind এতে মানুষের আবেগ অনুভূতি এবং তার প্রকাশ সহ বিভিন্ন মানসিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া গুলো কে বদলে দেয়, অথবা বিকৃত করে ফেলে। চিন্তা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। আপন শক্তি, তাগিদ, আকাঙ্ক্ষা, উৎসাহ সহ সকল চেতনা হারিয়ে যায় মাদকে।আমাদের মস্তিষ্ক যে সব তথ্য পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে গ্ৰহন করে, এবং প্রত্যক্ষণের মাধ্যমে বোধ এবং উপলব্ধি তৈরি করে। তারপর এ সব তথ্য সঠিকভাবে যথাযথ আবেগ অনুভূতির জন্ম দেয়। যা স্বরনশক্তি বা অবহিতকরণ প্রক্রিয়ায় কার্যকরী ভূমিকা নিয়োজিত করে মস্তিষ্ক। কার্যকরী চিন্তা ও যুক্তি আরোপের ক্ষমতা, সমস্যা সমাধানে ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এবং কগনিটিভ প্রসেসের গুরুত্বপূর্ণ অনুষদ। এই মাদক তা বদলে দেয় এবং বিকৃত করে দেয়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, উনিশশো নব্ব‌ই সাল অনুযায়ী অ্যালকোহল ছাড়া অন্য কোন মাদকদ্রব্যের চাষাবাদ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বহন,-পরিবহন ,আমদানি-রপ্তানি ,সরবরাহ ,বেচাকেনা, ধারণ, সংরক্ষন, গুদামজাত, প্রদর্শন, প্রয়োগ এমন কোন কিছু ব্যবহার করা যাবে না। এই আইন ভঙ্গ কারীদের জন্য রয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থেকে শুরু করে মৃত্যুদণ্ডের বিধান পর্যন্ত। নিঃসঙ্গতা, চরম হতাশা, একাকীত্ব হচ্ছে মাদকাসক্ত হওয়ার কারণ। তাছাড়া অনেক গোপন দুষ্টচক্র অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে যুব সমাজকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিচ্ছে অতি সুকৌশলে। মাদকের করাল গ্রাসে একটি ব্যক্তির সুন্দর সম্ভাবনাময় জীবন সমূলে ধ্বংস করে। তথা পুরো পরিবার সমাজ দেশ তথা সমগ্র জাতিকে তিলে তিলে শেষ করে। তরুণেরা নেশায় আসক্ত হয়ে যদি সাময়িক আনন্দ খুঁজে পায়, কিন্তু এর ফলে নিজের জীবনে বয়ে আনে এক চরম দূর্দশা। আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্র আমাদের তরুণদের ধ্বংস করতে সর্বদাই তৎপর তারা মাদকের জালে জড়িয়ে ফেলেছে গোটা সমাজকে। আমাদের সমাজের মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিতে চাইছে। বাইরের কুচক্রীদের স্বার্থ হাসিল যাদের মূল উদ্দেশ্য। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ বিশাল অংকের ঘুষের আয় মুলত মানুষকে আকৃষ্ট করে ভোগবিলাস ব্যভিচার এবং মাদক। নৈতিক অবক্ষয়ের চিত্রই ফুটে ওঠে। অপরাধ জগতের রূপ ফুটে ওঠে এবং সামাজিক অবক্ষয় ডেকে আনে। বিপন্ন জনগোষ্ঠী এই ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়ার শিকার হন। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য উপায় খুঁজে বের করতে হবে। আমরা আশা করি সচেতন জনগনের একটি অগ্রগামী অংশ নিজেদেরকে সঙ্ঘবদ্ধ করে একটি ঐক্যবদ্ধ মাদক বিরোধী সংগঠন গড়ে তুলতে আগ্রহ প্রকাশ করবে।

যদি একে জঘন্যতম অপরাধ হিসেবে বিবেচনায় আনি। এর থেকে সঠিক পরিত্রাণের উপায় খুঁজে বের করি তাহলে অবশ্যই দুর্নীতির সকল যোগসূত্রতা খুঁজে বের করতে হবে।

বাংলাদেশ মাদক বিরোধী আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড ব্যবস্থা থাকলেও আইনটিতে কিছুটা ত্রুটি রয়েছে। প্রাচীন প্রচলিত আইনের তাফসীরে বেশকিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত নেই যেমন গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত মাস্টারমাইন্ড বা যারা গড ফাদার তাদের কে প্রচলিত আইনে সোপর্দ করার কোন ব্যবস্থা নেই। শুধু আইন সংশোধন করে যারা মাদকের ব্যবসা এবং মাদক তৈরি করে শুধু তাদেরকেই আইনের আওতায় এনে আইনানুগ বিধান তৈরির উদ্যোগ গ্ৰহনকরা হয়েছে। মাদক তৈরি, বিক্রি, পরিবহন এবং সেবনের সাথে জড়িত তাদের সবাই সমান ভাবে দোষী। গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায় এ পর্যন্ত শত শত ব্যক্তি নিহত হয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে। আঞ্চলিক ভাষায় যাদেরকে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে বলে দাবি করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর দিক নির্দেশনা মোতাবেক মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স অভ্যাহত থাকবে। নানা ধরনের সামাজিক সমস্যার মধ্যে মাদক একটি 'গুরুতর সমস্যা' হিসেবে চিহ্নিত। গত ৩রা মে রেব সদর দপ্তরে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জঙ্গিবাদের মতো কঠিন সমস্যার মোকাবিলায় যেমন রেব সাফল্য দেখিয়েছে, তেমনি মাদক নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা নিতে তারা সক্ষম হবে। তিনি এই আশা ব্যক্ত করেন। বিশ্বে প্রতিবছর আশি লক্ষ সহ, বাংলাদেশের লক্ষাধিক লোক মৃত্যুবরণ করে। মাদকের এই ভয়াল ছোবল থেকে আমাদের দেশের তরুণ ও যুব সমাজকে বাঁচাতে হবে‌। নিবিড় তত্ত্বাবধানে, নৈতিক মূল্যবোধ তৈরি, সেইসাথে সমস্ত তরুণ ও যুব সমাজের মনে মাদকের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা সৃষ্টি করতে হবে। মাদকাসক্তি সব ধরনের অপরাধের মূল। যা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাদকের বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধ ঘোষণা করেছি বলে উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা দেন। এটা একটা বিশেষ অভিযান অবশ্যই পরিস্থিতির বিবেচনায় এর ধরন প্রকৃতির পরিবর্তন আসবে এবং পরিস্থিতি আসলে বলে দিবে এই অভিযান কতদিন চলবে। আইন সংশোধন করে, যারা মাদক ব্যবসায় জড়িত এবং মাদক তৈরি করে তাদেরকে আইনের আওতায় এনে আইনানুগ বিধান তৈরীর উদ্যোগ মাত্র।মাদক ব্যবসায়ীরা অত্যন্ত চতুরতার সাথে নিজ নিজ এলাকায় মাদক দ্রব্য আনা নেওয়ার জন্য বিশাল সিন্ডিকেট গড়ে তোলে এবং ব্যবসায়ী ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকে এবং তাদের রয়েছে গভীর নেটওয়ার্ক যা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে। অনেক ক্ষেত্রে মাদক বিক্রিতে রাজী না হলে অনেক অসহায় নিরীহ মানুষের অযথা নানা হয়রানির ফাঁদে পড়তে হয়। তাদের বিরুদ্ধে উল্টো মামলা হয় মাদক আইনে যা সত্যিই অনেক দুঃখজনক। কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার সহায়তায় যা হয়ে থাকে।

এল এস ডি

এটি একটি ভয়ঙ্কর ড্রাগ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য বিভাগের আওতাধীন মাদক বিষয়ক গবেষণা সংস্থা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ড্রাগ আ্যবিউজের তথ্য অনুসারে জানা যায়, ডি -লাইসারজিক এসিড ডায়েথিলামাইড বা এল এস ডি রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি পদার্থ তৈরি হয় যা বিভিন্ন ধরনের শস্যের গায়ে জন্মানো এক বিশেষ ছত্রাক। যা শরীরের লাইসারজিক এসিড থেকে উৎপত্তি একটি স্বচ্ছ গন্ধহীন পদার্থ যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন এর মতে এটি তরল ট্যাবলেট বা ক্যাপসুল এবং পাউডের আকারে পাওয়া যায়। তাই এল এস ডি কে সাইকাডেলিক মাদক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এটি জীবনের শেষ মাদক, সেবনের পর মানুষের মধ্যে তৈরি হয় নিষ্ঠুর খুনের প্রবণতা। হত্যা করার প্রবণতা হয়ে উঠে প্রবল। এই মাদক ছড়িয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে।এই এলএসডি ড্রাগ মস্তিষ্কে ভয়ঙ্কর প্রভাব সৃষ্টি করে। তাই এটি এ যাবৎকালের সেরা অভিশপ্ত ড্রাগ। উনিশশো আটশট্টি সালে বিশ্বব্যাপী এলএসডি নিষিদ্ধ করা হয়। এটি নিষিদ্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ও গ্রেট বৃটেনের প্রায় দশ শতাংশ মানুষ এই ড্রাগে আসক্ত ছিল। সাধারণত ব্লটিং পেপারের উপরে এই তরল মাদক ফেলে, সেই কাগজটি শুঁকে শুঁকে নেশা করে মাদকসেবীরা।

উনিশশো আটত্রিশ সালে আলবার্ট হফম্যান নামক একজন সুইচ রসায়নবিদ ফাঙ্গাস নিয়ে কাজ করতে গিয়ে এলএসডি আবিষ্কার করেন। প্রথমদিকে এটি ওষুধ হিসেবে ব্যবহার হতো। পরবর্তীকালে এটি মস্তিষ্কের ক্ষতি হয় বলে তা নিষিদ্ধ করা হয়। অনেক বিজ্ঞানীদের মতে সাধারণত এল এস ডি নেওয়ার পর একজন মানুষ চোখ বন্ধ করেও দেখতে পায়। তার এই দেখা এবং দৃশ্য সবসময় পৃথিবীর বাইরে বা কোনো স্মৃতি থেকে আসে না বরং তাদের কল্পনাশক্তি অনেকখানি বেড়ে যায়। মস্তিষ্কের অন্যান্য যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারে ভেঙে পড়ে। অনেক সময় মাদকের প্রভাব কেটে গেলেও ঐ রকম অনুভূতি থেকে যায়। মানুষের স্মৃতি ভান্ডার খুলে যায়, এমনকি নেশার চূড়ান্ত পর্যায়ে কেউ বা মাতৃগর্ভের স্মূতিও মনে করতে পারেন। তবে অনেক ক্ষেত্রে অধিকাংশ মানুষ সেসব স্মৃতির ভার সহ্য করতে পারে না। এর ফলে মাদকাসক্তি এই মানুষগুলোর মস্তিষ্ক বিকৃতি সম্ভাবনা থাকে। অনেক সময় এই মাদক সেবীরা স্মৃতির চূড়ান্ত স্তরে পৌঁছানোর আগেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। চোখের মণির বিকৃতি ঘটে। ব্লাড প্রেসার ও শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। এর অন্য নাম হলো এল এস ডি-২৫, অ্যসিড ও ডেলিসাইড। আমরা এটাও জানি মাদকের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী অভিযান শুরু হয়েছে। যদিও এটা পুরনো খবর তথাপি এরই মাঝে মাদক ব্যবসায়ীরা প্রতিকূলতার সাথে নানা কৌশলে মাদক পাচার এবং ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে মাদক ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফার লোভে মাদকে আনছে ভেজাল। ফলে মাদকসেবীরা বিকল্প হিসেবে বেছে নিচ্ছে সেইসাথে ইয়াবা, সেই সাথে হেরোইন ও ফেনসিডিল। এই সব ভেজালের কারনে মাদকসেবীদের মধ্যে নানারকম ভয়ঙ্কর পরিবর্তন ঘটছে। বিশেষ করে নতুন নতুন রোগের আবির্ভাব। সম্প্রতি সবচেয়ে ভয়ের কারণ হচ্ছে ভেজাল অ্যালকোহল। এই ভেজাল মদ খেয়ে প্রায়‌ই মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। তাছাড়া অতিরিক্ত ভেজাল সেবনে অনেক সময় প্রতিবন্ধী, লিভার সিরোসিস ও কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।

বর্তমান বাংলাদেশে বহুল জনপ্রিয় এবং খুবই আলোচিত মাদক হচ্ছে ইয়াবা। ইয়াবা যা থাই অর্থ পাগলা ঔষধ, ইতিহাস সূত্রে প্রাপ্ত এই নেশাজাতীয় ট্যাবলেট মূলত মায়ানমারের শান্ প্রদেশের পাহাড়ি অঞ্চলে ঘোড়াদের খাওয়ানো হতো। কারন ঘোড়া পাহাড়ের দুর্বেদ্ধ পথে কোন গাড়ি চালাতে চাইত না। এই ড্রাগ তৈরি করে বার্মিজরা সেবন করাতো ঘোড়াদের এবং পাগল বানিয়ে কঠিন কাজকে সহজতর করতো। থাইল্যান্ডে এর নাম 'ম্যাড ড্রাগ' ইন্ডিয়াতে 'ভুলভুলাইয়া' আর বাংলাদেশে 'বাবা' ছাড়া আরও নাম হচ্ছে যেমন 'নাজি স্পিড হিটলার্স' ড্রাগ' এবং চকোলী ইত্যাদি নামে। পরবর্তীকালে এ ঘোড়ার ট্যাবলেট প্রচন্ড কায়িক শ্রমে নিযুক্তি মানুষ সেবন শুরু করে। পরবর্তীতে আরও জানা যায় থাই ও ভিয়েতনামের প্রস্টিটিউটরা এই ড্রাগ সেবন করে থাকে। নিজেরা এর কুফল সম্পর্কে যথেষ্ট সজাগ। তাই সেখানে সেবনকারীর সংখ্যা অতি সীমিত। ইয়াবা মাদকটির আসল উপাদান ম্যাথ‌‌এ্য‌মফিটিমিন। যাএক সময় সর্দি ও নাক বন্ধ হয়ে যাওয়ার ওষুধ হিসেবে ব্যবহার ব্যবহৃত হতো। এমনকি ওজন কমানোর চিকিৎসায়। তথ্যসূত্র জানা যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে সৈন্যদের মাঝে ক্লান্তি দূর এবং সজাগ থাকতে এইটা খুবই কার্যকরী ভূমিকা রাখে। তাই তাদের কাছে তা ছিল জনপ্রিয়। একসময় যখন এর কুফল দীর্ঘমেয়াদি অত্যন্ত ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া উদঘাটিত হতে থাকায় বিশ্বজুড়ে এর ব্যবহার নিষিদ্ধ হয়ে যায়। এবং এক সময় মেথাএ্যমফিটামিনের

সঙ্গে ক্যাফেইন মিশিয়ে একটি ভয়ঙ্কর অভিশপ্ত পূর্ণাঙ্গ মাদক হিসেবে আবির্ভূত হয়, ইয়াবা মাদক নামে। থাইল্যান্ড এর উৎপাদন করে থাকে সবচাইতে বেশি এবং বিশ্বব্যাপী এর সরবরাহ চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে ইয়াবা মাদক তৈরি হচ্ছে

হাইড্রোক্লোরিক এসিড, এসিটোন (মূলত নেলপালিশ রিমুভার) রেড ফসফরাস এবং ব্যাটারির লিথিয়াম ও সালফিউরিক অ্যাসিড তা থেকে। যা সত্যিই অতি ভয়াবহ এবং আঁতকে উঠার মতো। তবে তরুণ-তরুণীদের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য মূল উপাদান এর সাথে মেশানো হয় কমলা, আঙ্গুর, ও ভ্যানিলা ফ্লেভার। এবং সাথে লাল কমলা ও সবুজ রং। এবং দেখতে অনেকটা ক্যান্ডির মতো এবং স্বাদ অনেকটা তাই। ফলে আসক্ত ব্যক্তিরা এর কুফল বুঝতে পারে না। বরং ইয়াবার আনন্দে উত্তেজিত মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের সাময়িকভাবে ভুলিয়ে দেয়, জীবনের ক্ষণস্থায়ী সব যন্ত্রণা। পক্ষান্তরে বুঝতে অক্ষম তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে প্রতিক্ষণ মৃত্যু। ধারণা করা হচ্ছে দেশে ইয়াবা আসক্ত মাদকা সম্পন্ন ব্যক্তি সংখ্যা ৭০ লাখের মতো, বা আরো অনেক বেশি হতে পারে। তথ্যে আরো জানা যায় ৫৮ শতাংশ মানুষ ইয়াবা আর ২৮ শতাংশ ফেনসিডিল এবং হেরোইন আসক্ত। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায় দুই হাজার বিশ সালে দেশে তিন কোটি ৬৮ লাখ ৮১ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার হয়েছে। যা ২০১৯ সালে ছিল তিন কোটি ৪লাখ ৪৬ হাজার পিস। গাঁজা ছিল ২০২০ সালে ৫০ হাজার ২শত ৭৯ কেজি। এবং হিরোইন ছিলো ২০০শত ১০ দশমিক ৪৪ কেজি। কিন্তু আমাদের সবসময় একটা জিনিস লক্ষ্য রাখতে হবে ব্যক্তিগত ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে বা প্রতিশোধ চরিতার্থ করতে, মাদক মামলায় কাউকে জড়িয়ে ফেলা না হয়। এ ব্যাপারে সবাইকে নিরাপদ ও সজাগ থাকার অনুরোধ। ২০১৭ সালে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, মাদক আইনে মামলা হয়েছে ১১,৬১২ টি। যার মধ্যে মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে ২৫৪৪টি। মাদক নির্মূলে হটলাইন আছে যা মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সাথে সাধারণ জনগণকে সম্পৃক্ত করাই এর মূল উদ্দেশ্য। মাদক নিয়ন্ত্রণে সরিষার ভূত যাতে অন্তরায় না হয় তা নিশ্চিত করতে বাধ্যতামূলক ডোপ টেস্টের বিস্তার ঘটানো দরকার অবশ্যই। মাদক ও মানবাধিকার সঙ্কট আবারো উল্লেখ্য মাদকের ন্যয় সামাজিক ব্যাধিতে রীতিমত বিপর্যস্ত নতুন প্রজন্ম। উদ্বিগ্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং অভিভাবকসহ সমাজের নানা স্তরের মানুষ। ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা সহ সুস্থ ধারার সংস্কৃতি সীমিত হয়ে পড়ায়, এই মাদক ব্যাধী সমাজে ছড়িয়ে পড়েছ ধীরে ধীরে। ভেজাল মাদক ইতিমধ্যেই কেড়ে নিয়েছে অনেক পিতা-মাতার আদরের সন্তান। অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় চলছে মাদক ব্যবসা যার বেশিরভাগই থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাই সচেতন নাগরিক হিসেবে দৃঢ় মানসিকতা,স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ এবং নির্ভীক কার্যকলাপ পরিচালনা করলেই এই ভয়াবহষ্ট ব্যাধি থেকে সমাজ ও জাতিকে রক্ষা করা সম্ভব হবে। নিজের সন্তানটি কোথায় যাচ্ছে, কি করছে, সেদিকে নজর দেওয়া কিন্তু একজন সচেতন অভিভাবকের দায়িত্ব। মনে রাখা দরকার যে কোন পরিবার ও সমাজের জন্য মাদকাসক্ত ব্যক্তি প্রচন্ড হুমকিস্বরূপ। তারা সমাজের ক্ষতিকর এবং বোঝা। টাকার অভাব দেখা দিলে মাদকাসক্ত ব্যক্তি ছিনতাই, খুন সহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। তাই দেশ ও জাতির উন্নয়নের অন্যতম অন্তরায় মাদক দ্রব্য। এবং মাদকের ছোবলে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে দেশের যুবসমাজ। ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ মাদক প্রবণ দেশ। কেননা বাংলাদেশের অবস্থান গোল্ডেন ট্রাইংগেল, গোল্ডেন ক্রিসেন্ট এবং গোল্ডেন ওয়েজ এর মধ্যবর্তী স্থান। একারণেই এদেশে মাদকদ্রব্য নাগালের মধ্যে এবং সহজলভ্য। তাই দেশ ও জাতির কল্যাণে এবং উন্নয়নে মাদককে অবশ্যই না বলতে হবে। তাই সবাই মাদককে না এবং না বলুন। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে মাদকদ্রব্যের ব্যবহারও অতি প্রাচীন। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের বিভিন্ন কৌশল এবং বাণিজ্যিক স্বার্থে এই উপমহাদেশে প্রথম আফিম চাষ ও আফিম ব্যবসা শুরু করে। এজন্য কোম্পানি কিছু বিশেষ কর্মকর্তা নিয়োগ দেয় এবং তার তৎ সংলগ্ন কিছু আইন প্রণয়ন করে। আঠারোশো সাতান্ন সালে আফিম ব্যবসাকে সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন এনে, আফিম আইন প্রবর্তন এবং ব্রিটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশে আফিম উৎপাদন করে, এরপর চীনসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে রপ্তানি করে বিপুল অর্থ উপার্জন করে। শুধু তাই নয় আঠারোশো আটাত্তর সালে আফিম আইন সংশোধন করে আফিম অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করে এবং তা থেকে প্রচুর রাজস্ব আদায় করে। উনিশশো নয় সালে আরেকটি আইন বে‌ঙ্গল এক্সাইজ আ্যক্ট ও বেঙ্গল এক্সাইজ ডিপার্টম্যন্ট প্রতিষ্ঠা করা হয়। মদ, গাজা, আফিম সহ বিভিন্ন মাদকের ব্যাপক প্রসার ঘটলে ব্রিটিশ সরকার The Dangerous Act- 1930 প্রণয়ন করে। উনিশশো বত্রিশ সালে The Opum smoking Act 1932 এবং উনিশশো ঊনচল্লিশ শালে The Dengeurous Drug's rules-1939 প্রনয়ন করে। ভারত বিভক্তির সময় ঊনিশ সাতচল্লিশ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর,মুসলমানদের জন্য মদ পান নিয়ন্ত্রণে, ঊনিশত পঞ্চাশ সালে The prohibition Rules -1950 প্রণয়ন করা হয়। এবং ঊনিশত সাতান্ন সালে The Opium Sales Rules-1957প্রনীতহয় তৎকালীন পাকিস্তান আমলে। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সৃষ্টির পর ঊনিশশত ৭৬

সালে পাকিস্তান আমলে ষাটের দশকের রচিত এক্সাইজ এন্ড ট্যাস্যেশন ডিপার্টমেন্ট কে পুনরায় পুনর্বিন্যাস করণের মাধ্যমে নরকটিকস এন্ড লিকার পরিদপ্তর নামে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অধীনে ন্যস্ত করা হয়। কোডিন মিশ্রিত কফ সিরাপ, অ্যালকোহলযুক্ত কতিপয় হেলথ টনিক, ট্যাবলেট ও শিরাপ ইত্যাদির উৎপাদন ও বিপণন নিষিদ্ধ করা হয়, ঊনিশ চুরাশি সালে। মৃতসঞ্জীবনী সূরা এবং গাঁজার চাষ নিষিদ্ধ হয় ঊনিশ ৭৮ সালে। সবশেষে ঊনিশ ৮৯ সালে সমস্ত গাঁজার দোকান বন্ধ করে দেওয়া হয়। নারকটিকস এন্ড লিকার এই পরিদপ্তর টির পুরো উদ্দেশ্য ছিল দেশে উৎপাদিত মাদকদ্রব্য থেকে রাজস্ব আদায় করা। আশির দশকে সারা বিশ্বে যখন আশঙ্কাজনকভাবে মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার বৃদ্ধি পায়, তখন মাদকের ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জনমনে গণসচেতনতা বিকাশ ঘটে। তারই ফলশ্রুতিতে ঊনিশ ৯০ সালের দোসরা জানুয়ারি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ ঊনিশ ৯০ প্রনিত হয়। এবং নরকটিকস এন্ড লিকার পরিদপ্তরের স্থলে সেই বৎসরেই তৎকালীন রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ের অধীন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয়। এবং নয়‌ই সেপ্টেম্বর ঊনিশ ৯১ সালে এই অধিদপ্তরকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ করা হয়।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়