প্রকাশ : ০৯ আগস্ট ২০২২, ০০:০০
কারবালা প্রান্তরে সাইয়েদাহ রমণীদের অবদান
জোবেদা খানম
মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআন পাকের সূরা শুরার ২৩নং আয়াতে ইরশাদ ফরমান, “হে হাবীব আপনি বলে দিন, আমি তোমাদের কারো কাছে আমার দাওয়াতের জন্য (আমার) আত্মীয়-স্বজনের প্রতি সৌহার্দ্য ব্যতীত আর কিছুই চাই না। [আল-কুরআন]। এ আয়াতে পাক নাযিল হওযার পর হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু রাসুলে পাকের খিদমতে আরয করলেন, “ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনার নিকটতম আত্মীয় কারা, যাদেরকে ভালোবাসা আমাদের উপর ওয়াজিব করা হয়েছে? উত্তরে তিনি ইরশাদ করলেন, এরা হলো আলী ও ফাতেমা এবং তাঁদের দু সন্তান।
|আরো খবর
অন্যদিকে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীসে পাকে ইরশাদ করেছেন, “আমি তোমাদের মাঝে অতি উত্তম ও গুরুত্বপূর্ণ দুটি বস্তু রেখে যাচ্ছি, এর একটি হচ্ছে আল্লাহর কিতাব যাতে রয়েছে সঠিক পথনির্দেশনা ও আলোকবর্তিকা। তোমরা একে মেনে চলো এবং মজবুতভাবে ধারণ করো। আর দ্বিতীয় বস্তুটি হচ্ছে আমার আহলে বায়ত। প্রিয়তম রাসূল বারবার বলেন, আমার আহলে বায়তের ব্যাপারে আমি তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি।
উপরোক্ত আয়াতে কারিমা ও হাদীসে পাক লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, হযরত নূহের কিশতি খ্যাত আহলে বায়তে রাসূলের মর্যাদা স্বয়ং কুরআনে আল্লাহ্ রাব্বুল ইজ্জত ও তাঁর প্রিয় হাবীব হুজুর সরওয়ারে কায়েনাত রহমাতুল্লিল আলামীন বর্ণনা করেছেন। এতদসত্ত্বেও পথভ্রষ্ট দুরাচারী পাপিষ্ঠ ইয়াযিদ ৬১ হিজরীর ১০ মহররম ইসলামের মর্মান্তিক ইতিহাসের স্বাক্ষর সে কারবালার ময়দানে আহলে বায়তের সম্মানিত ৭২ জন সদস্যের কাফেলার সবাইকে অবর্ণনীয় ও করুণভাবে শহীদ করে ফেলে ও সে চরম বেদনাবিধূর সময়ে কারবালার প্রান্তরে নবী পরিবারের শাহযাদাদের পাশাপাশি সাইয়্যেদাহ্ রমণীদের ভূমিকাও ছিলো অসামান্য। সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশীয় ও অন্দরমহলে কঠোরভাবে পর্দানশীন সাইয়্যেদাহ্ রমণীগণের মধ্যে যাঁরা ইমামে আলী মকাম সাইয়্যেদুশ্ শুহাদা হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর সাথে কারবালায় গমন করেছিলেন তাঁরা প্রত্যেকেই অন্যায়ের বিপক্ষে দৃঢ়চেতা মনোবলধারী ও সত্যের পক্ষে শক্তিশালী ছিলেন; যাঁদের স্মরণ ও কারবালা প্রান্তরে অবদানসমূহের কথা পর্যালোচনা করলে প্রত্যেক মুমিন মুসলমান নারী মাত্রই দারুণভাবে উৎসাহিত হবে। তাই মহররম মাসে আশুরার এ মহিমান্বিত পরিসরে কারবালা ময়দানের উল্লেখযোগ্য পাঁচজন সাইয়্যেদাহ্ রমণীর আত্মত্যাগ ও সীমাহীন কষ্টের শিক্ষণীয় আদর্শিক ঘটনাবলি এ নিবন্ধে আলোচনা করার প্রয়াস পাচ্ছি-
সাইয়্যেদাহ্ বিবি যয়নব ও সাইয়্যেদাহ্ উম্মে কুলসুম রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আহুমা : সাইয়্যেদাহদ্বয় উভয়েই ছিলেন হুযুর পুরনুর সরওয়ায়ে কায়েনাত সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র স্নেহের নাতনী, হযরত আলী মুরতাদ্বা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও সাইয়্যেদা বতুল মা ফাতেমা যাহরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমার কন্যা এবং ইমামে আলী মকাম সাইয়্যেদুশ্ শোহাদা হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর সহোদরা (বোন)। যাঁদের পিতা হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর শুভ জন্ম হয়েছিলো রব্বে কায়েনাতের কা’বাতুল্লাহ্ শরীফে এবং মাতা প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের নয়নমণি মা ফাতেমা যাহরা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহার জন্ম হয়েছে দোজাহানের শাহানশাহ হুযুর রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র ঘরে মা খাদীযাতুৎ তাহেরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার পবিত্র গর্ভে। সে ঔরসে নূরানী শাহযাদীদ্বয়ের জন্ম। তাঁরাই হলেন, সাইয়্যেদা বিবি যয়নব ও উম্মে কুলসুম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা।
জন্মের পর কান মোবারকে আযানের সুমধুর সুর ভেসে এসেছিল স্বয়ং রাসূলূল্লাহ্র নূরানী কণ্ঠে এবং নবীজির প্রিয় দুই কন্যার পছন্দসই নামে তাঁদের নামকরণও করেন স্বয়ং হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা আহমদ মুজতবা সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম। যে মায়ের বরকতময় কোলে ছিল সাইয়্যেদাদ্বয়ের প্রথম দরসগাহ্। তিনিই হলেন নবী-নন্দিনী মা ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা যাঁর শানে আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা রহমাতুল্লাহি আলায়হি এরশাদ করেন, জিসকা আঁচল না দেখা মাহো মেহর নে/উস নিদা-য়ে নুয্হাত পে লা-খো সালাম’। (যার মাথার পবিত্র আঁচল মোবারক পর্যন্ত দেখেনি সূর্য-চন্দ্র, পর্দা ও পবিত্রতার সে অতুলনীয় আহ্বানকে জানাই লাখো সালাম।)
এমন অদ্বিতীয় খাতুনে জান্নাতের লালন-পালন পর্দা-পবিত্রতার প্রশিক্ষণ ও দ্বীনী তরবিয়তে বেড়ে উঠেন তাঁরা দুই বোন, মাত্র পাঁচ বা মতান্তরে সাত বছর বয়সে সম্পূর্ণ কুরআন পাকের হিফজ সম্পন্ন করেন বিবি যয়নব রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা। আর ‘প্রিয়নবীর ইলমের শহরের দরজা’ খ্যাত হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর পিতৃত্বের কাছেই জ্ঞান-প্রজ্ঞার প্রশিক্ষণ অর্জন করেন।
শিশু যয়নব রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা যখন কান্না করতেন তখন ভাই ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু কোলে নিলে শান্ত হয়ে যেতেন এবং এক দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে দেখে থাকতেন। বড় হওয়ার পরও প্রগাঢ় ভালোবাসার দরুন কোনো ইবাদত শুরু করার আগে তিনি ভাই হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর দিকে আগে এক পলক দেখে নিয়ে পরে নামাজ ও ইবাদত শুরু করতেন। সাইয়্যেদার বয়স যখন মাত্র ছয় বা সাত বছর, তখন তাঁর প্রিয় নানাজান রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে হারান। এর কিছুদিন পর মা হযরত ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা ইন্তেকাল করেন। দুঃখ ভারাক্রান্ত ছোট্ট শিশু যয়নব রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা সে বয়স থেকেই রীতিমত সংসার ও ছোট ভাই-বোনদের দেখাশোনা আরম্ভ করেন। তিনি মদিনা শরীফের নারীদের ক্বোরআন শিক্ষা দিতেন; এমনকি কুফাতে রাজধানী স্থানান্তরের পর সেখানেও সর্বপ্রথম নারীদেরকে দরসে কুরআন মাহফিল করেন সাইয়্যেদা বিবি যয়নব। তিনি ছিলেন অত্যন্ত জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাময়ী নারী। পাঠদানের সাবলীলতা ও পদ্ধতির কারণে তার প্রশংসা নারী মহলে ছড়িয়ে পড়ে। তখন থেকেই তাঁকে বলা হতো ‘ফাসিহাহ’ (প্রজ্ঞাময়ী বক্তা) এবং ‘বালীগাহ্’ (দুর্দান্ত বাকপটু); এক অর্থে পিতার অলঙ্কার হওয়ার সব বৈশিষ্ট্যই তিনি ধারণ করেছিলেন। কুফায় অবস্থানকালেও ঈদের দিন মদীনা মুনাওয়ারা থেকে গরিব-দুঃখী মহিলারা এসে নিজেদের কষ্টের কথা সাইয়্যেদাহর কাছে ব্যক্ত করে দোয়া ও অনন্য বদান্যতার বিনিময় হাদিয়া নিয়ে যেতেন। আহলে বায়তে রসূলের জীবনের প্রতিটি পরতে পরতেই যেন জ্বলজ্যান্ত সুন্নতে রসূল’র বাস্তবমুখী শিক্ষা। কারবালার কঠিন পরিস্থিতিতে পুরো পরিবারের ছোট শিশু থেকে বড় বড় বীর যোদ্ধা ভাইয়েরা শহীদ হয়ে গিয়েছেন অথচ সে করুণ অবস্থায়ও ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুকে ঘোড়ায় আরোহন করে ময়দানে যাওয়ার সময় সকল পুরুষ বীর সেনাদের শহিদী মৃত্যুজনিত অনুপস্থিতিতে খালি কাফেলায় একজন নারী হয়েও ইমামের ঘোড়ার রেকাব মুবারক ধরে যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা প্রদর্শনকপূর্বক তাঁকে মেরাজে রসূলের সুন্নাত অনুযায়ী বাহনে না তুলে প্রস্থান করতে দেননি এ সাইয়্যেদাহ্। জোর হিম্মত ও শক্তি যুগিয়ে, অন্যদিকে কাফেলার আহলে বায়ত সম্ভ্রান্ত নারী-শিশুদের অভিভাবকত্ব করেন তিনি। বীরত্বপূর্ণ দূরদর্শীতার সাথে ভাইদেরকে পরামর্শ দান ও সাহস যোগানো ও প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহযোগিতাসহ ইমাম আলী মাক্বামের শাহাদাতের নিদারুণ কঠিনতম ঘটনার পরবর্তীতে একজন মহিলা হয়েও যিনি যোগ্যতার পরিচয় দেন, তিনিই হলেন সাইয়্যেদাহ্ হযরত যায়নাব রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা।
যে কঠিন সময়ে পুরো কাফেলার বীরত্বের ঝংকারওয়ালা গাযী আব্বাস আলমদার রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুসহ সকল পুরুষ সদস্য শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করে নিয়েছিলেন। নারীসূলভ ন¤্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও ঐতিহাসিকদের ভাষায় ‘দুঃস্বপ্নের দুর্বিসহ রাত’ খ্যাত সেই কালোরাতে সারারাত ভাঙ্গা খঞ্জর হাতে দৃঢ়তার সাথে কারবালার ময়দানে লুটিয়ে থাকা নবী পরিবারের লাশ মোবারকগুলোকে পাহারা দিয়ে, কাফেলার সবাইকে সামলে নেয়ার দুর্লভ দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আহলে বায়তের অন্যতম সদস্যা বিনি যয়নাব। কারবালার পরবর্তীতে মুসলমানদের উপর আবর্তিত অন্ধকারাচ্ছন্ন বিপদের ঘনঘটার সময় হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর জায়গায় দাঁড়িয়ে সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়াতে অকল্পনীয় ভূমিকা রাখেন। দুরাচারী পাপিষ্ঠ ইয়াযিদ বাহিনী কর্তৃক সম্ভ্রান্ত নারীদের অলংকার ছিনিয়ে নেয়ার সময়েও পর্দা রক্ষার্থে পরপুরুষের স্পর্শ রোধ করে সাজ অলঙ্কার খুলে দিয়ে পর্দার অমূল্য নমুনা কায়েম করেন। শোহাদায়ে কারবালার এমন কুরবানীর পরেও আসরের নামাজ যদি ছুটে যায় তাহলে হাদীস শরীফ অনুযায়ী অনাদায়ী থাকার পরিণামের সাবধান বাণী শুনিয়ে, ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু যে কারবালা শোকার্ত শাহাদাতের ইতিহাসের ৬১ হিজরির ১০ মহররম শেষবারের মতো সপরিবারে একসাথে ফজরের নামাজ আদায় করার মাধ্যমে আরম্ভ করেছিলেন, সে দুর্বিসহ পরিস্থিতিতেও সাইয়্যেদাহ্ বিবি যয়নাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা যেনো আসরের নামাজ আদায় করার মাধ্যমে সেটিরই সমাপ্ত করেছিলেন।
সাইয়্যেদাহ্ ফাতেমা ও সাইয়্যেদাহ্ উম্মে সকীনা বিনতে হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুমা : তাঁরা উভয়ে ছিলেন জান্নাতী যুবকদের সরতাজ হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর প্রিয় কন্যা ও ইমাম যয়নুল আবেদীন রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু, শহীদ আলী আকবর ও শিশু শহীদ আলী আসগরের বোন। বড় বোন সাইয়্যেদাহ্ ফাতিমা বিনতে হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর নামকরণও করা হয়েছিলো রমণীকুলে অদ্বিতীয়া খাতুনে জান্নাত মা ফাতেমা জাহরা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহার নামে এবং ছোটজন সাইয়্যেদাহ্ উম্মে সকীনা বিনতে হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু ছিলেন কারবালার ময়দানে নবী পরিবারের সব চাইতে কনিষ্ঠ মেয়ে সদস্যা, যার বয়স ছিলো মাত্র সাত বছর। এত ছোট বয়সে অমন নিষ্ঠুর লুণ্ঠনের ঘটনার সাক্ষী হয়েও উক্ত সাইয়্যেদাহ্ ভগ্নীদ্বয় অবলম্বন করেছিলেন সীমাহীন ধৈর্য্যরে পথ। যার হৃদয়বিদারক বর্ণনা নিম্নে দেয়া হয়েছে।
যওজায়ে ইমাম হোসাইন সাইয়্যেদাহ্ হযরত রুবাব রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা : হযরত রুবাব বিনতে ইমরাউল কায়েস বিন আদী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু, যিনি জন্মসূত্রে নবীবংশের না হলেও ইমাম আলী মক্বামের সহধর্মিণী এবং হযরত সাইয়্যেদাহ্ উম্মে সকীনা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহার সম্মানিত জননী ছিলেন। কারবালার প্রান্তরে মর্মান্তিকভাবে সন্তান হারানোর পরেও ধৈর্য্য ও সাহসিকতার চরমরূপ ধারণ করে কারবালা প্রান্তরে আহলে বায়ত কাফেলার সর্বকনিষ্ঠ দুগ্ধপোষ্য ছেলে আলী আসগরকে নিয়ে প্রিয় স্বামীর খেদমতে আরয করলেন, বাচ্চাটিকে একটু দেখুন তৃষ্ণায় তাঁর অবস্থাটা কেমন হয়ে যাচ্ছে, তাঁর অস্থিরতা আর কান্না আমি আর সহ্য করতে পারছি না, হৃদয়টা চৌচির হয়ে যাচ্ছে। দোহাই আল্লাহর! ঐ পাষাণ জালিমদের একটু দেখিয়ে আনুন, হয়তো ওর অবস্থা দেখে কারো না কারো রহম হয়ে যাবে-শিশুর উপর তো সবারই করুণা হয়। ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু যখন কোলে তুলে বুকে জড়িয়ে স্বীয় পুষ্প রূপ শিশুকে নিয়ে পাপিষ্ঠদের কাছে ফোরাতের তীরে উপস্থিত হয়ে দোহাই দিয়ে এ নিষ্পাপ শিশুর জন্যে পানি চাইলেন, তখন হারমালা নামক দুর্বৃত্ত সেই ছোট্ট আসগরের পিপাসার্ত কণ্ঠনালীকেই তীরবিদ্ধ করে দিয়ে রক্তে রঞ্জিত করে দিলো। তাঁবুতে বিবির ধারণা ছিলো অবাধ শিশুর করুণ দশা দেখে নির্দয় পাষাণচিত্তের অবশ্যই দয়া হবে কিন্তু তার বদলে যখন তাঁদের আশার কলিকে খুন-রঙিন দেখতে পেলেন, বুক ফেটে গেলেও তাঁরা ধৈর্য্য ধরেছিলেন। এভাবেই তারপর একে একে শেষ আশ্রয়স্থল প্রাণী প্রয় স্বামী ইমামে পাককে হারিয়েও সর্বোচ্চ সংযত হয়ে বাকি জীবন বেদনায় জর্জরিত অবস্থায় কাটিয়ে দিয়েছিলেন হযরত রুবাব রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা।
ইমামপত্নী অত্যন্ত নেককার ও দ্বীনদার ছিলেন। ইমাম শহীদ হওয়ার পরপরই বহুজন বিয়ের প্রস্তাব পাঠানো সত্ত্বেও তিনি জবাব দিয়েছিলেন, ‘রাসূল-ঘরে বিবি হবার সৌভাগ্য আমার হয়েছে, এরপর আমি আর কারো ঘরের আশ্রয়ে যেতে চাই না। কারবালার ঘটনার বছরখানেকের মাঝেই তিনি ইন্তেকাল করেন।
ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুও তাঁকে ও সাইয়্যেদাহ্ সকীনাকে এতটাই ভালোবাসতেন যে, একবার এরশাদ করেছিলেন, ‘‘আমার জীবনের শপথ, আমি ঐ ঘরটাকেও ভালবাসি যেখানে আমার সকীনা ও রুবাব রয়েছে।’’
ময়দানে কারবালা থেকে সাইয়্যেদাহ্ বিবি যয়নব ও সকীনা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহার সুন্নতে রসূলের পাবন্দীর শিক্ষা এক পর্যায়ে গভীর রাতের অন্ধকারে হুরের বিধবা স্ত্রী ঠাণ্ডা পানি নিয়ে সাইয়্যেদার খেদমতে আসলে ভ্রাতুষ্পুত্র আলী আকবর, নবজাতক শিশু আসগর, কাসিমের বুকফাটা তৃষ্ণার সাথে কথা ভেবে অস্থিরচিত্ত হয়ে দীর্ঘদিনের পানির বিন্দুবিহীন পিপাসার পরেও পানি ফিরিয়ে দেন, অবশেষে হুরের স্ত্রী মা ফাতেমার দোহায় দিলে পানি গ্রহণ করলেও নিজে পান না করে এমন করুণ অবস্থাতেও রাসূলূল্লাহ সুন্নাত অনুসরণ করে সর্বপ্রথম কাফেলার সব চাইতে ছোট শাহযাদী সাইয়্যেদা সকীনাকে বেহুঁশ থেকে পানি ছিটিয়ে পানি পান করতে দিলেন। এদিকে সকীনা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা ফুফীজান যয়নব পানি পান করেছেন কি না জিজ্ঞেস করে যখন জানতে পারলেন যে, নানাজানের সুন্নত অনুযায়ী আকাঙ্ক্ষিত খাদ্যদ্রব্য উপস্থিত হলে ছোট শিশুকে আগে দিতে হয় তখন তিনিও অন্ধকার রাতে কারবালার ময়দানের দিকে ছুটে যাচ্ছিলেন, যয়নব ছুটে গিয়ে তাঁকে থামালে সাত বছরের ছোট সকীনা বলে উঠলেন, ‘‘ফুফী, কাফেলায় আমাকে সবচাইতে ছোট ভেবে পানি দিয়েছেন কিন্তু নানাজানের শিক্ষা অনুযায়ী আমি আমার চেয়ে ছোট আমার ভাই দুগ্ধ শিশু আলী আসগরকে পানি দিতে যাচ্ছি। (আল্লাহু আকবর), অথচ তখন আলী আজগর শহীদ হয়ে গিয়েছিলেন। শিক্ষা ও উত্তম তরবিয়াতের কারণে সাইয়্যেদা ছোট শাহজাদীরও কেমন গভীরতম সুন্নতের পাবন্দীর উপলব্ধি।
কারবালা-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহেও সাইয়্যেদাহ্ যয়নবের অতুলনীয় অবদান লক্ষণীয়। এভাবেই ইতিহাসের নিন্দিত ও দুর্বিসহ কারবালা ময়দান থেকে আহলে বায়তের অবশিষ্ট কাফেলাকে যখন ইবনে যিয়াদের সামনে আনা হল সে ময়লা পোশাক পরিহিতা সাইয়্যেদা যয়নবের প্রতি দম্ভসূচক বেয়াদবীমূলক উক্তি করে বসলে তাঁর বাড়াবাড়িকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে তিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘‘আল্লাহর শোকর, তিনি আমাদেরকে প্রিয়নবীর আওলাদ হওয়ার কারণে সম্মানিত করেছেন। তিনি আমাদের তাঁর ইচ্ছা মোতাবেক পুতঃপবিত্র করেছেন। তুমি যেমন বলছ, সে রূপ নয়। নিঃসন্দেহে দুরাচারী ব্যক্তিই লাঞ্ছিত হয় এবং অপরাধীরাই মিথ্যা প্রতিপন্ন হয়।’ এত জঘন্য নির্যাতনের পরেও পাপিষ্ঠ যখন ইমাম হুসাইনের শানে কপট ব্যাখ্যা প্রদান করে জালেমানা প্রতারণার ঘটনাটিকে বিপথে ভিন্নদিকে পরিচালনা করার চেষ্টা করছিল তখন সাইয়্যেদা যয়নব দুর্বৃত্ত ইয়াজিদের মুখের উপর নির্দ্বিধায় সত্য প্রকাশে সাহসী ভূমিকা পালন করেছিলেন। এমনকি ইয়াযিদের সভায় দুরাচারী এক সিরীয় যখন ফাতেমা বিনতে হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর প্রতি কুমন্তব্য করার
চেষ্টা করলো তখন সাইয়্যেদার হুঙ্কার ও বাক্যবানে জর্জরিত হয়ে ইয়াজিদ পর্যন্ত পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিলো।
খুতবাতে সাইয়্যেদাহ্ : সাইয়্যেদাহ্ যয়নব ও উম্মে কুলসুম ইয়াযিদের জঘন্যতম পাপের দম্ভোক্তির জবাব দিতে সমবেত জনতার জন্য ইতিহাসে বিখ্যাত বেশ কয়েকটি খুতবা প্রদান করেন, প্রবন্ধ সংক্ষিপ্ত করার জন্য এখানে উল্লেখযোগ্য কতিপয় ভাষণের কিয়দংশ উপস্থাপিত হল-
হযরত যয়নব বিনতে আলী আল্লাহর প্রশংসা ও সালাত-সালাম দিয়ে তাঁর খুৎবা শুরু করেন, ‘হে ইয়াজিদ! তুমি কী ভেবেছ যে আমাদের লোকদের শাহাদাত এবং নিজেদের বন্দীদশার কারণে আমরা নত ও তুচ্ছ হয়ে উঠেছি? তুমি মনে করেছ যে ধর্মপরায়ণ ব্যক্তিদের হত্যা করে তুমি মহান হয়ে গেছ এবং সর্বশক্তিমান তোমাকে বিশেষ অনুগ্রহ ও দয়া দেখাবে? তবে আল্লাহ্ যা বলেছেন তা তুমি ভুলে গিয়েছো ‘কাফিররা অবশ্যই এটা ভাবার কারণ নেই যে আমার অবকাশ তাদের ভালোর জন্য, আমি তাদের সময় দিই যাতে তারা তাদের পাপ বাড়িয়ে নেয়। বস্তুত তাদের জন্য রয়েছে অপমানজনক শাস্তি।’ [আল কুরআন-৩:১৭৮]। এটি কি ন্যায়বিচার যে, তুমি নিজের মহিলা ও দাস-কন্যাদের নিরাপদ রেখে মহানবীর অসহায় কন্যাদের দ্রুততর উটের পিঠে চড়িয়ে তাদের শত্রুদের হাতে দিয়েছ, যাতে তারা তাদের এক শহর থেকে অন্য শহরে নিয়ে যেতে পারে? সাইয়্যেদা যয়নব ইয়াজিদকে তার তথাকথিত বিজয়ের জন্য খুশী হতে বারণ করে সূরা আলে ইমরানের ১৬৯ নম্বর আয়াত পাঠ করেন এবং জোর দিয়ে বলেন, ন্যায়বিচারের জন্য শহীদ ব্যক্তিরা বিজয়ী এবং আল্লাহর গজবে ইয়াজিদের সুখ শেষ হবে।
ধ্বংসলীলার সমাপনান্তে কুফাবাসীর মিথ্যা রোনাজারী দেখে তিনি হামদ ও সালাতের পর অনলবর্ষী আরেক বক্তব্যে বরেন, ‘হে বে-ঈমান প্রবঞ্চক কুফাবাসী। এখন তোমরা কান্না-মাতম করছো? খোদা তোমাদের চিরকাল কাঁদাবেন। তোমাদের এ মাতম কখনো থামবে না, হাসির তুলনায় তোমাদের কান্না হবে অধিক, তোমরা নিজেদের ঈমানকে ধোঁকা আর চাতুরীর ছল বানিয়েছ। হে কুফাবাসী! তোমরা কি জানো তোমরা রাসূলের কোন হৃদপি-কে টুকরো করেছো? নবী-খান্দানের সারবস্তু, খাতুনে জান্নাতের অন্তপুরবাসিনী নির্মলচিত্ত কন্যাদেরকেও তোমরা বে-পর্দা করেছো, তোমরা নিজেদের জন্যে আখিরাতে খুব খারাপ অর্জন পাঠালে, খোদা তোমাদের উপর তাঁর গযব নাযিল করবেন এবং অনন্তকালের জন্য তোমাদেরকে জাহান্নামে দাখিল করবেন।’’
রক্তাক্ত কারবালা থেকে ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর পুত্র ও সুযোগ্য উত্তরসূরি, নবীবংশের রত্ন ইমাম যয়নুল আবেদীনকে শত্রুদের কবল থেকে রক্ষা করে আহলে বায়তের পুরো কাফেলাসহ মদীনা মুনাওয়ারা পর্যন্ত পৌঁছানোর মাধ্যমেই যেনো এ মহীয়সী সাইয়্যেদার মর্মস্পর্শী অভিযানের অন্তিমরেখা অঙ্কিত হয় এবং প্রিয় নবীজীর রওযা পাকে এসে এতোদিনের আটকে রাখা দুঃখগাঁথার বাঁধন যেনো খুলে যায়।
এমনটিই ছিলো কারবালার প্রান্তরে নবী পরিবারের অন্যতম সাইয়্যেদা বিবি যয়নবর চিরস্মরণীয ধৈর্য, সাধনা ও সাহসিকতার তুলনাহীন ঐতিহাসিক ভূমিকা, এমনকি কারবালার পুরো ইতিহাসকে প্রামাণিকভাবে উপস্থাপন, কুফাবাসী ও দুরাচারী ইয়াযিদের মুনাফেকী-বানোয়াট অপব্যাখ্যাকে রহিত করে আসল সত্যকে পুরো মুসলিম জাতির সামনে দৃঢ়তার সাথে প্রতিষ্ঠা করার জন্য হোসাইনী মুসলমানেরা তাঁর অবদানের প্রতি চিরঋণী হয়ে থাকবে।
অতএব, প্রত্যেক মু’মিন মুসলমান নারী মাত্রই কারবালা প্রান্তরের বেদনাবিধূর ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়ার পাশাপাশি সম্ভ্রান্ত সাইয়্যেদা রমণীদের আদর্শ থেকে শিক্ষা নিয়ে জীবন গড়ার প্রত্যয় এবং আহলে বায়তের প্রতি অন্তরের অন্তস্থল থেকে সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পোষণ করা এবং ইয়াজিদী মুনাফেকীর প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন আমাদের ঈমানী চেতনার অংশ ও কারবালার মহামহিম আত্মত্যাগের হুসাইনী শিক্ষা।
তথ্যসূত্র :
* মুসতাদরাক-ইমাম হাকীম, মাখদুম আশরাফ জাহাঙ্গীর সামনানী (রহ.)’র লাত্বায়েফে আশরাফী। * মাদারেজুন নুবুওয়্যাত- শেখ আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.), ইযালাতুল খিফা-শাহ্ ওয়াউিল্লাহ্ (রহ.)। * তাবারী ২৬২/৬, ইবনে আসীর ৩৩/৪, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ১৯৩/৮। * গাউসিয়া তারবিয়াতী নেসাব, সপ্তম সংস্করণ, ১২ মে ২০১৩। প্রকাশনায়- আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট। * শামে কারবালা, আল্লামা মুহাম্মদ শফী উকাড়ভী (রহ.), অনুবাদণ্ড মুহাম্মদ আনিসুজ্জমান, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৫ অক্টোবর, আলা হযরত রিসার্চ এন্ড পাবলিকেশন্স। * বার মাসের আমল ও ফযীলত, হাফেয মাওলানা ওসমান গণি, সপ্তম প্রকাশ, ২৫ মার্চ ২০১৯, চিশতী প্রকাশনী। * প্রবন্ধ সিরিজ, সৈয়দা উসতুআনা হান্নান, ১১ সেপ্টেম্বর ও আগস্ট ২০২০, দৈনিক যুগান্তর পত্রিকা।