প্রকাশ : ০৯ আগস্ট ২০২২, ০০:০০
কারবালার ঐতিহাসিক ঘটনা
মুফতি মুহাঃ আবু বকর বিন ফারুক
৬১ হিজরির ১০ মহররম কারবালা প্রান্তরে ইমাম হোসাইন (রাঃ) ৭৩ জন সঙ্গী-সাথী নিয়ে এজিদ বাহিনীর হাতে শাহাদাত বরণ করেন। আশুরার দিন। কূফা থেকে ১২শ চিঠির আমন্ত্রণে পর্যবেক্ষণের জন্যে চাচাতো ভাই মুসলিম বিন আকিলকে কূফাতে পাঠান, তিনি দুই ছেলে মুহাম্মাদ ও ইব্রাহীম সাথে নিয়ে কূফাতে যান। ৪০ হাজার লোক হোসাইন (রাঃ)-এর নামে তাঁর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন। কুফার গভর্নর নোমান বিন বশিরকে অপসারণ করে উবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদকে গভর্নর নিয়োগ দেন। কূফার গোত্রের বড় বড় সর্দারকে বন্দি করেন। মুসলিম বিন আকিলকে আটক হতে শাহাদাত বরণ করিয়ে দেন। ফোরাত নদী অবরুদ্ধ করে রেখে ইমাম হোসাইন (রাঃ)-এর কাফেলাকে পানি থেকে বিরত রাখে। জুমআর দিন পাপীষ্ঠ সীমার ইমাম হোসাইন (রাঃ)-এর বুকে চেপে বসে, হোসাইন (রাঃ) জুমআর ২ রাকয়াত নামাজ পড়ার সুযোগ নিয়ে নামাজ পড়ার সাথে সাথেই তাঁকে সীমার শাহাদাত বরণ করিয়ে দেয়।
|আরো খবর
সৈয়্যদুশ শোহদা হযরত ইমাম হুসাইন (রাদি আল্লাহু তা’আলা আনহু) চতুর্থ হিজরির শাবান মাসের ৫ তারিখ পবিত্র মদীনা শরীফে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের পর সরকারে মদীনা (সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহে ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর কানে আজান দিয়ে দুআ করেছিলেন। সাত দিন পর আকীকা করে ‘হুসাইন’ নাম রাখা হয়েছিলো।
হাদীছ শরীফে বর্ণিত আছে, হাসান ও হুসাইন জান্নাতী নামসমূহের মধ্যকার দুটি নাম। এর আগে আরবের জাহিলিয়াত যুগে এ দু নামের প্রচলন ছিলো না। হযরত হাসান ও হুসাইন (রাদি আল্লাহ তা’আলা আনহু) হুযুর আকরম (সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম)-এর খুবই প্রিয় পাত্র ছিলেন। তাদের ফজিলত সম্পর্কে অনেক হাদীছ বর্ণিত আছে। হুযুর (সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেছেন, অর্থাৎ নিশ্চয়ই হাসান-হুসাইন দুনিয়াতে আমার দুটি ফুল। আপন সন্তান থেকেও তিনি (সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) তাদেরকে অধিক ভালবাসতেন।
হযরত আল্লামা জামী (রহমতুল্লাহে তা’আলা আলাইহে) বর্ণনা করেন, একদিন সরকারে দু’আলম (সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) হযরত ইমাম হোসাইন (রাদি আল্লাহু তা’আলা আনহু)কে ডানে ও স্বীয় সাহেবজাদা হযরত ইব্রাহিম (রাদি আল্লাহু তা’য়ালা আনহু)কে বামে বসিয়েছিলেন। এমতাবস্থায় হযরত জিব্রাইল (আলাইহিস সালাম) উপস্থিত হয়ে আরয করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! (সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহ তা’আলা এ দুজনকে আপনার কাছে এক সঙ্গে রাখতে দেবেন না। ওনাদের মধ্যে একজনকে ফিরিয়ে নিবেন। অতএব, আপনি এ দুজনের মধ্যে যাকে ইচ্ছে পছন্দ করুন। হুযুর (সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) ফরমালেন, যদি হুসাইনকে নিয়ে যায়, তাহলে ওর বিরহে ফাতেমা ও আলীর খুবই কষ্ট হবে এবং আমার মনটাও ক্ষুণ্ন হবে আর যদি ইব্রহিমের ওফাত হয়, তাহলে সবচে বেশি দুঃখ একমাত্র আমিই পাবো। এজন্যে নিজে দুঃখ পাওয়াটাই আমি পছন্দ করি। এ ঘটনার তিন দিন পর হযরত ইব্রাহিম (রাদি আল্লাহু তা’আলা আনহু) ইন্তেকাল করেন। এরপর থেকে যখনই হযরত ইমাম হুসাইন (রাদি আল্লাহু তা’আলা আনহু) হুযুর (সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম)-এর সমীপে আসতেন, হুযুর ওকে মুবারকবাদ দিতেন, ওর কপালে চুমু দিতেন এবং উপস্থিত লোকদেরকে সম্বোধন করে বলতেন, আমি হুসাইনের জন্যে আপন সন্তান ইব্রাহিমকে কোরবানি দিয়েছি। (শওয়াহেদুন নবুয়াত)। হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাদি আল্লাহু তা’আলা আনহু) ইরশাদ ফরমায়েছেন অর্থাৎ হাসান-হুসাইন জান্নাতী যুবকদের সরদার।
হযরত আবু হুরাইরা (রাদি আল্লাহু তা’আলা আনহু) থেকে বর্ণিত, রসূলে আকরম (সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) একদিন এমন অবস্থায় বাহিরে তশরীফ আনলেন যে, তাঁর এক কাঁধের উপর হযরত হাসান এবং অন্য কাঁধের উপর হযরত হুসাইনকে বসিয়ে ছিলেন। এভাবেই আমাদের সামনে তশরীফ আনলেন এবং ফরমালেন। অর্থাৎ যে এ দুজনকে মহব্বত করলো, সে আমাকে মহব্বত করলো আর যে এদের সাথে দুশমনী করলো, সে আমার সাথে দুশমনী করলো।
হযরত ইমাম হুসাইন (রাদি আল্লাহু তা’আলা আনহু)-এর জন্মের সাথে সাথে হুযুর (সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম)-এর বদৌলতে তাঁর শাহাদাতের কথা সবার জানাজানি হয়ে গিয়েছিলো। হযরত আলী, হযরত ফাতেমাতুয যোহর, অন্যান্য সাহাবায়ে কিরাম ও আহলে বায়তের সংশ্লিষ্ট সবাই (রাদি আল্লাহু তা’আলা আনহুম) হুসাইন (রাদি আল্লাহু তা’আলা আনহু)-এর শৈশব অবস্থায় জানতে পেরেছিলেন যে, এ ছেলেকে একান্ত নির্মমভাবে শহীদ করা হবে এবং। ময়দান তাঁর রক্তে রঞ্জিত হবে। তাঁর (রাঃ) শাহাদাতের ভবিষ্যদ্বাণী-সম্বলিত অনেক হাদীছ বর্ণিত আছে।
হযরত উম্মুল ফজল বিনতে হারেছ (রাদি আল্লাহু তা’আলা আনহা) (হযরত আব্বাস (রাঃ)-এর স্ত্রী) বলেন, আমি একদিন নবী করীম (সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম)-এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে ইমাম হুসাইন (রাদি আল্লাহু তা’আলা আনহু)কে তাঁর কোলে দিলাম। এরপর আমি দেখলাম, হুযুর (সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম)-এর চোখ মুবারক থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। আমি আরয করলাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) ব্যাপার কী? তিনি ফরমালেন, আমার কাছে জিব্রাইল (আলাইহিস সালাম) এসে খবর দিয়ে গেলো (আমার উম্মত আমার এ শিশুকে শহীদ করবে।) হযরত উম্মুল ফজল বলেন, আমি আশ্চর্য হয়ে আরয করলাম, “ইয়া রাসুলল্লাহ, এ শিশুকে শহীদ করবে! হুযুর (সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) ফরমালেন, তাঁ! জিব্রাইল (আলাইহিস সালাম)-এর শাহাদত স্থলের লাল মাটিও এনেছেন।
হযরত ইবনে সাদ (রাঃ), হযরত শাবী (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন, হযরত আলী (রাদি আল্লাহ তা’আলা আনহু) জংগে সিফফীনের সময় কারবালার পথ দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলেন এবং সেই জায়গার নাম জানতে চাইলেন। লোকেরা বললো, এ জায়গার নাম কারবালা। কারবালার নাম শুনেই তিনি এতো কান্নাকাটি করলেন যে, মাটি চোখের পানিতে ভিজে গিয়েছিলো। অতঃপর ফরমালেন, আমি একদিন হুযুর (সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহে ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম)-এর খেদমতে হাজির হয়ে দেখতে পেলাম, তিনি (সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহে ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম) কাঁদছেন। আমি আরয করলাম, ইয়া রাসুলল্লাহ! (সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহে ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম) আপনি কেনো কাঁদছেন? ফরমালেন, এ মাত্র জিব্রাইল এসে আমাকে খবর দিয়ে গেলো। আমার ছেলে (দৌহিত্র) হুসাইনকে ফোরাত নদীর তীরে সেই জায়গায় শহীদ করা হবে, যে জায়গার নাম কারবালা (সওয়ায়েকে মুহারাকা)
বিভিন্ন হাদীছ থেকে জানা যায় যে, ইমাম হুসাইন (রাদি আল্লাহু তা’আলা আনহু)-এর শাহাদাত সম্পর্কে হুযুর (সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহে ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম) অনেকবার ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। ইমাম হুসাইন (রাদি আল্লাহু তা’আলা আনহু)-এর শৈশব কালেই এটা সবার জানাজানি হয়ে গিয়েছিলো। হুযুর (সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহে ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম) খোদাওয়া তা’আলার ইচ্ছায় রেজামন্দি জ্ঞাপন করেন।
হযরত আমীরে মুয়াবিয়া (রাঃ)-এর ইন্তেকালের পর ইয়াজিদ সিংহাসনে আরোহন করলো এবং সিংহাসনে আরোহন করার সাথে সাথেই তার মনের মধ্যে সীমাহীন অহংকার ও গর্ববোধের সৃষ্টি হলো। যার ফলে সে এমন কাজকর্ম শুরু করলো, যা পবিত্র শরীয়তের সম্পূর্ণ বিপরীত। মানুষ ক্ষমতার মোহে বিভোর হয়ে অনেক সময় ধরাকে সরা জ্ঞান করে।
যে সব গণ্যমান্য ব্যক্তি আছেন তারা তার এ রাজত্ব মেনে নিবেন না; তারা তারপরই হাতে বায়াত করবেন না; তাঁদের অস্বীকৃতির কারণে অন্যদের মধ্যেও অস্বীকৃতির প্রভাব বিস্তৃত হবে। এজন্যে এটাই সমীচীন হবে যে, আমি তাঁদের বায়াত তলব করবো। যদি তারা অস্বীকার করেন, তখন তাদেরকে কতল করাবো, যাতে আমার রাস্তার এ সব বড় বড় প্রতিবন্ধকতা অপসারিত হয় এবং আমার খেলাফতের রাস্তা যেনো কণ্টক মুক্ত হয়ে যায়। তাই সে ক্ষমতায় আরোহণ করার পর পরই হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ), হযরত আবদুল্লাহ বি জুবাইর (রাঃ) হযরত আবদুল্লাহ বিন উমর (রাঃ) প্রমূখ থেকে বায়াত তলব করলো। এ সব ব্যক্তি বিশেষ সম্মানিত ছিলেন এবং বিশেষ গণ্যমান্যদের বংশধর ছিলেন। তাই তারা কীভাবে ফাসিক-ফাজির ইয়াজিদের হাতে বায়াত করতে পারেন? সুতরাং তারা অস্বীকার করলেন এবং এটা তাদের মর্যাদাগত আচরণই ছিলো। অস্বীকার করার পর হযরত আবদুল্লাহ বিন উমর (রাঃ) ও হযরত আবদুল্লাহ বিন জুবাইর (রাঃ) মদীনা শরীফ থেকে মক্কা শরীফ চলে গেলেন। হযরত হুসাইন (রাঃ) মদীনার গভর্নর ওয়ালিদের আহ্বানে তাঁর দরবারে তশরীফ নিয়ে গেলেন, তার সঙ্গে আলোচনা করলেন। মদীনার গভর্নর বললো, ইয়াজিদ আপনার বায়াত তলব করেছেন। তিনি বললেন, আমি ইয়াজিদের হাতে বায়াত করতে পারি না। ইয়াজিদ হলো ফাসিক-ফাজির। এ ধরনের অনুপযুক্ত লোকের হাতে আমি বায়াত করতে পারি না। আমি কোনো অবস্থাতেই ওর হাতে বায়াত করতে রাজি নই। তিনি সুস্পষ্টভাবে অস্বীকার করলেন। এটা ছিল তাঁর মর্যাদাগত আচরণ। দেখুন, তিনি যদি বায়াত করতেন, তাহলে নিজের প্রাণ বাঁচতে, পরিবার-পরিজন বাঁচতো, এমনও হয়তো হতো যে, অগাধ সম্পত্তির মালিকও তিনি হয়ে যেতেন। কিন্তু ইসলামের আইন-কানুন ছত্রভঙ্গ হয়ে যেতো এবং কিয়ামত পর্যন্ত ফাসিক-ফাজিরের আনুগত্য বৈধ হয়ে যেতো এবং তাদের কাছে ইমাম হুসাইন (রাঃ)-এর আনুগত্য প্রধান দলিল হিসাবে পরিণত হতো। লোকেরা বলতো, ইমাম হুসাইন (রাঃ) যখন ফাসিক-ফাজিরের আনুগত্য স্বীকার করেছেন, তাহলে নিশ্চয় এটা জায়েয। কিন্তু ইমাম হুসাইন (রাঃ) অস্বীকারের মাধ্যমে দুনিয়াবাসীর সামনে প্রমাণ করে দিলেন, হুসাইন (রাঃ) শত দুঃখণ্ডকষ্ট ভোগ করতে পারেন, অনেক বিপদণ্ডআপদের মোকাবেলা করতে পারেন, এমন কী আপন পরিজনের শহীদ হওয়াটা অবলোকন করতে পারেন; নিজেও বর্বরোচিত ভাবে শাহাদাত বরণ করতে পারেন, কিন্তু ইসলামের নেজাম ছত্রভঙ্গ হওয়া কিছুতেই সহ্য করতে পারেন না, নিজের নানাজান (সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহে ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম)-এর ধর্ম ধ্বংস হওয়াটা কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না। ইমাম হুসাইন (রাঃ) নিজের কাজ ও কর্মপন্থা দ্বারা তা প্রমাণিত করেছেন এবং দুনিয়াবাসীকে এটা দেখিয়ে দিয়েছেন, খোদার বান্দার এটাই শান যে, বাতিলের সামনে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে যান এবং তীর তলোয়ারের সামনে বুক পেতে দেন, কিন্তু কখনও বাতিলের সামনে মাথানত করেন না। ইমাম হুসাইন (রাঃ) নিজের আমল দ্বারা তাঁর উচ্চ মর্যাদার পরিচয় দান করেছেন এবং জনগণের সামনে নিজের পদ মর্যাদা তুলে ধরেছেন।
ইমাম হুসাইন (রাঃ) এভাবে অস্বীকার করে ওয়ালিদের দরবার থেকে আপনজনদের কাছে ফিরে আসলেন এবং সবাইকে একত্রিত করে বললেন, আমার প্রিয়জনেরা! যদি আমি মদীনা শহরে অবস্থান করি, আমাকে ইয়াজিদের হাতে বায়াত করার জন্যে বাধ্য করবে, কিন্তু আমি কখনও বায়াত করতে পারবো না। বাধ্য করলে নিশ্চয় যুদ্ধ হবে, ফ্যাসাদ হবে, কিন্তু আমি চাই না আমার কারণে মদীনা শরীফে লড়াই বা ফ্যাসাদ হোক। আমার মতে এটাই সমীচীন হবে যে, এখান থেকে হিজরত করে মক্কা শরীফে চলে যাওয়া। নিজের আপনজনেরা বললেন, আপনি আমাদের সর্দার, আমাদেরকে যা হুকুম করবেন তা মেনে নেবো। অতঃপর তিনি (রাঃ) মদীনা শরীফ থেকে হিজরত করার সিদ্ধান্ত নিলেন। আহ! অবস্থা কেমন সঙ্গীন হয়ে গিয়েছিল যে, ইমাম হুসাইন (রাঃ)কে সেই মদীনা শরীফ ত্যাগ করতে হচ্ছিলো, যে মদীনা শরীফে তাঁর (রাঃ) নানাজান (সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহে ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম)-এর রওজা মুবারক অবস্থিত। তাঁর (রাঃ) নানাজান (সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহে ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম)-এর রওজা মুবারক যিয়ারত করার উদ্দেশ্যে হাজার হাজার টাকাণ্ডপয়সা ব্যয় করে, আপনজনদের বিরহ-বেদনা সহ্য করে, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দূর-দূরান্ত থেকে লোকেরা আসে এই মদীনায়। কিন্তু আফসোস, আজ সেই মদীনা তিনি (রাঃ) ত্যাগ করছেন, যেই মদীনা তাঁরই (রাঃ) ছিলো। নবীজী (সাল্লাল্লাহ তা’আলা আলাইহে ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম)-এর নয়নের তারা ছিলেন তিনি। ক্রন্দনরত তিনি নানাজান (সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহে ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম)-এর রওজা পাকে উপস্থিত হয়ে বিদায়ী সালাম পেশ করলেন এবং অশ্রুসজল নয়নে নানাজান (সাল্লাল্লাহ তা’আলা আলাইহে ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম)-এর অনুমতি নিয়ে আত্মীয়-পরিজনসহ মদীনা শরীফ থেকে হিজরত করে মক্কায় চলে গেলেন।
মক্কা শরীফ তিনি (রাঃ) কেনো গিয়েছিলেন? আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ ফরমান, (যে হেরেম শরীফে প্রবেশ করলো, সে নিরাপদ আশ্রয়ে এসে গেলো। কেননা হেরেম শরীফের অভ্যন্তরে ঝগড়া-বিবাদ, খুন-খারাবী না জায়েয, হারাম। আজকাল সাপ-বিচ্ছু ইত্যাদি মারা যায়। কিন্তু যে সব পশু-পাখি মানুষের কোনো ক্ষতি করে না। ওইগুলো মারা জায়েয নাই। মুমিনদের ইজ্জত-শান আলাদা, তাদের মান-সম্মান অনেক উচ্চ হয়ে থাকে। তাই ইমাম হুসাইন (রাঃ) চিন্তা করলেন যে, হেরেম শরীফের সীমানায় অবস্থান করে আল্লাহ তা’আলার ইবাদত-বন্দেগীতে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবে, এ মনোভাব নিয়ে তিনি (রাঃ) মদীনা শরীফ থেকে মক্কা শরীফ চলে আসলেন।
কুফার চিঠি
মক্কা শরীফে আগমনের সাথে সাথে কুফা থেকে লাগাতার চিঠিপত্র এবং সংবাদণ্ডবাহক আসতে শুরু করলো। অল্প সময়ের মধ্যে হুসাইন (রাঃ)-এর কাছে দেড়শ চিঠি এসে পৌঁছলো। অপর এক বর্ণনায় বারশ’ চিঠি এসেছিলো। কোনো কোনো উলামায়ে কিরাম তাঁদের কিতাবে বারশ’ চিঠির কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু অধিকাংশ কিতাবে দেড়শ’ চিঠির কথা উল্লেখিত আছে। দেড়শ’ চিঠিই বিশেষ নির্ভরযোগ্য। কারণ সেই যুগে ডাক আদান-প্রদান অত সহজ ছিলো না। লোকেরা চিঠি-পত্র, পুত্র বাহকের মাধ্যমে প্রেরণ করতো এবং পত্র-বাহক পায়ে হেঁটে বা ঘোড়ায় চড়ে গন্তব্যস্থানে চিঠি পৌঁছিয়ে দিতো। এমতবস্থায় দেড়শ’ চিঠি পৌঁছাটা অত সহজ ব্যাপার নয়। যা হোক, ধরা যাক ইমাম হুসাইন (রাঃ)-এর কাছে দেড়শ ’ চিঠি পৌঁছেছিলো। প্রত্যেক চিঠির বিষয়বস্তু ছিলো খুবই আকর্ষণীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যেক চিঠির সার সংক্ষেপ হচ্ছে “হে ইমাম হুসাইন (রাঃ)! আমরা আপনার পিতা হযরত আলী (রাঃ)-এরই অনুসারী এবং আহলে বায়তের ভক্ত। আমরাতো হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ)কে সমর্থন করিনি, আর তার অনুপযুক্ত ছেলে ইয়াজিদকে মানার প্রশ্নই উঠতে পারে না। আমরা আপনার পিতা আমীরুল মুমেনিন হযরত আলী (রাঃ) ও আপনার ভাই হযরত হাসান (রাঃ)-এর সমর্থনকারী। আমরা ইয়াজিদের অনুসারী নই। ইয়াজিদ এখন তখতারোহন করেছে, কিন্তু আমরা ইয়াজিদকে খলিফা বা ইমাম মানতে পারি না। আপনাকেই বরহক ইমাম, বরহক খলিফা মনে করি। আপনি মেহেরবাণী করে কুফায় তশরীফ নিয়ে আসুন। আমরা আপনার হাতে বায়াত করবো এবং আপনাকে খলিফা হিসেবে গ্রহণ করবো। আপনার জন্যে আমাদের জানমাল কুরবান করতে প্রস্তুত এবং আপনার হাতে বায়াত করে আপনার অনুসরণে জিন্দেগী অতিবাহিত করতে ইচ্ছুক। তাই আপনি আমাদের কাছে তশরীফ আনুন, আমাদের প্রতি মেহেরবাণী করুন এবং আমাদেরকে আপনার সুহবতে রেখে আপনার ফয়েজ-বরকত দ্বারা আমাদেরকে উপকৃত করুন।” সমস্ত কাবিলা-খানদানের থেকে তাঁর (রাঃ) কাছে এই ধরনের চিঠি এসেছিলো। অনেকেই এই ধরনের চিঠিও লিখেছিলো, ‘হে মহান ইমাম! আপনি যদি আমাদের কাছে না আসেন, আমাদেরকে বাধ্য হয়ে ইয়াজিদের হাতে বায়াত করতে হবে। কারণ সরকারের মোকাবেলা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কাল কিয়ামতের মাঠে আল্লাহ তা’আলা যখন জিজ্ঞেস করবেন, কেনো আমরা নালায়েক ইয়াজিদের হাতে বায়াত গ্রহণ করলাম, তখন আমরা পরিষ্কার বলবো, হে মাওলা! আমরা আপনার নবী করিম (সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম)-এর দৌহিত্রের কাছে চিঠি লিখেছিলাম, সংবাদ পাঠিয়েছিলাম, জান-মাল কোরবানি করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলাম, কিন্তু তিনি (রাঃ) যেহেতু তশরীফ আনেননি এবং আমরা সরকারের বিরোধিতা করতে পারিনি, সেহেতু আমরা বাধ্য হয়ে ইয়াজিদের হাতে বায়াত করেছি। তাই হে ইমাম! আপনি স্মরণ রাখবেন।
এ ধরনের চিঠির প্রেক্ষিতে সত্যতা যাচাই ও বাস্তবতা দেখার জন্য সকলের পরামর্শে চাচাত ভাই মুসলিম বিন আকিল কে কূফায় প্রেরণ করেন। মুসলিম বিন আকিল মক্কা থেকে মদিনাতে এসে সকলের সাথে দেখা করে কূফার পথে রওয়ানা দেন। তাঁর দু ছেলে মুহাম্মাদ ও ইব্রাহীম তার সাথে গেলেন।
যখন কুফাবাসীরা খবর পেলো যে, হযরত মুসলিম, হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)-এর প্রতিনিধি হয়ে এসেছেন, তখন কুফাবাসীরা দলে দলে এসে তার হাতে বায়াত হতে লাগলো। অল্প দিনের মধ্যে চল্লিশ হাজার লোক তার হাতে বায়াত হয়ে গেলো এবং এমন ভালোবাসা ও মহব্বত দেখালো যে, হযরত মুসলিম (রাঃ) অবিভূত হয়ে গেলেন। তিনি যেখানে যাচ্ছেন, শত শত লোক তার সাথে যাচ্ছে, দিন-রাত মেহমানদারী করছে, হাত-পায়ে চুমু খাচ্ছে এবং একান্ত আনুগত্যের পরিচয় দিচ্ছে। এতে হযরত ইমাম মুসলিম (রাঃ) ভীষণভাবে আকৃষ্ট হলেন এবং মনে মনে বললেন, এরাতো সত্যিই ইমাম হুসাইন (রাঃ)-এর বড়ই আশেক এবং তার জন্য একেবারে পাগল। তিনি আরও বলেন, আমাকে পেয়ে তাদের যে অবস্থা হয়েছে, জানি না, হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) আসলে তারা কী যে করবে। হযরত ইমাম মুসলিম এভাবে পরিতৃপ্ত হয়ে সমস্ত অবস্থার বর্ণনা দিয়ে হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)-এর কাছে চিঠি লিখলেন, “চল্লিশ হাজার লোক বায়াত হয়েছে, সব সময় আমার সাথেই রয়েছে, আমার যথেষ্ট খেদমত করছে এবং তাদের অন্তরে আপনার (রাঃ) প্রতি অসীম মহব্বত রয়েছে। তাই আপনি আমার চিঠি পাওয়া মাত্রই চলে আসুন। এখানকার অবস্থা খুবই সন্তোষজনক।” এভাবে হযরত মুসলিম, হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)-এর কাছে চিঠি লিখলেন।
তখন কুফার গভর্নর ‘নোমান বিন বশীর’ যিনি হযরত ইমাম মুসলিম (রাঃ)-এর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিকার নেননি, তাকে পদচ্যুত করলো এবং তার স্থলে ইবনে জিয়াদ, যার আসল নাম ছিল, ‘উবায়দুল্লাহ’ যে বড় জালিম ও ক্যাডার ব্যক্তি ছিলো এবং যে বসরার গভর্নর ছিলো, ওকে কুফার গভর্নর নিয়োগ করলো। তার কাছে চিঠি লিখলো, তুমি বসরার গভর্নরও থাকবে, সাথে সাথে তোমাকে কুফার গভর্নর নিয়োগ করা হলো। তুমি শীঘ্রই কুফা এসে আমার বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহের সৃষ্টি হয়েছে, তা যেভাবে হোক দমিয়ে ফেলে। এ ব্যাপারে যা করতে হয়, তা করার জন্যে তোমাকে পূর্ণ ইখতিয়ার দেয়া হলো। যেভাবেই হোক, যে ধরনের পদক্ষেপই নিতে হোক না। কেনো, এ বিদ্রোহকে নির্মূল করে দাও। ইবনে জিয়াদ ইয়াজিদের পক্ষ থেকে পূর্ণ ক্ষমতা নিয়ে কুফায় আসলো। সে কীভাবে কুফায় আসল, এর একটা দীর্ঘ কাহিনি আছে। সেই বিষয়ে এখানে আলোচনা করছি না। সে কুফায় এসে সর্বপ্রথম যে কাজটি করলো, তা হচ্ছে, যতো বড় বড় সর্দার ছিলো এবং যারা হযরত মুসলিম (রঃ)-এর সাথে ছিলো ও বায়াত গ্রহণ করেছিলো, তাদের সবাইকে বন্দী করে ফেললো এবং বন্দী করার পর কুফার গভর্নর ভুবনে নজরবন্দি করে রাখলো। এ খবর বিদ্যুৎবেগে সমগ্র কুফায় ছড়িয়ে পড়লো এবং সমস্ত লোক হতভম্ব ও অস্থির হয়ে গেলো, সবাই চিন্তিত হয়ে পড়লো, এখন কী করা যায়। সমস্ত বড় বড় সর্দারকে বন্দী করে ফেলছে এবং ইমাম মুসলিমকে বন্দীর কৌশল নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছে।
এ খবর পেয়ে মুসলিম বিন আকিল চল্লিশ হাজার লোক নিয়ে কুফার গভর্নর ভবন ঘেরাও করলো। ইবনে জিয়াদ বড় বড় সর্দারকে গভর্নর ভবনের ছাদে নিয়ে তাদের বলতে বললেন, হে আমাদের আপনজনরা তোমরা এখান থেকে চলে যাও, তা না হলে আমাদের শেষ করে দিবে। এরপর থেকে কিছু লোক এদিক সেদিক চলে যেতে যেতে অনেক লোক চলে গেলো। মাগরিবের সময় মাত্র
৫০০ লোক ছিলো। মুসলিম বিন আকিল পাঁচশ লোক নিয়ে জামে মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করলেন। নামাজ শেষ করে দেখলেন সবাই চলে গেছে। বিশ্বাসঘাতকতা করল কূফাবাসী।
মুসলিম বিন আকিল ভক্তরের কাছে চলে এলেন ভক্তরা সবাই দরজা বন্ধ করে রাখলো। রাঁতে এক বুড়ির ঘরে তিনি থাকলেন। বুড়ি খুব খুশি হলো। বুড়ির ছেলে ইবনে জিয়াদের ঘোষণা হাজার দেরহামের লোভে গভর্নর ভবনে সংবাদ পৌঁছে দিলো। তাঁকে কৌশলে গভর্নর ভবনে নিয়ে গেলেন পরামর্শের নাম করে। গভর্নর ভবনের দরজায় প্রবেশের সাথে সাথে তলোয়ারের আঘাতে তাঁকে শহীদ করা হয়। ইন্নালিল্লাহি অ-ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
কেউ কেউ বলেন, তিনি ইবনে জিয়াদের সাথে দেখা করের। ইবনে জিয়াদ তাঁকে হোসাইন (রাঃ)কে বুঝিয়ে তাঁকে খলিফা মানার জন্যে বলে। তিনি তাঁতে রাজি না হওয়ায় গভর্নর ভবনের ছাদে নিয়ে তাঁর মাথা শরীর থেকে আলাদা করে বিচ্ছিন্ন দেহ শহরে শহরে ঘুরায় এবং তাঁর সন্তদের হত্যা করা হয়। অবশেষে মুসলিম বিন আকিলের চিঠি পেয়ে সকলের সাথে পরামর্শ করে ইমাম হোসাইন (রাঃ) স্ব-পরিবারে কূফার উদ্দেশে রওয়ানা হন।
ইমাম হুসাইন (রাঃ) প্রিয়জন ও আপনজনদের নিয়ে মক্কা শরীফ থেকে যাত্রা করলেন। কারণ, উনার কাছে চিঠি পৌঁছেছিলো যে, কুফার অবস্থা খুবই সন্তোষজনক, তিনি যেনো বিনা দ্বিধায় অনতিবিলম্বে তশরীফ নিয়ে আসেন। তিনি , বোন, ছেলেমেয়ে এমনকি দুগ্ধপোষ্য শিশুদেরকেও সঙ্গে নিলেন এবং মক্কা মুকাররমা থেকে বের হলেন। উলামায়ে কিরাম লিখেছেন যে, তার (রাঃ) কাফেলায় তিরাশিজন ছিলো, যাদের মধ্যে মহিলা, দুগ্ধপোষ্য শিশুও ছিলো। তাঁর (রাঃ) সঙ্গে কয়েকজন যুবক বন্ধু-বান্ধবও ছিলো। আল্লাহ! আল্লাহ! এখানে একটি কথা বিশেষভাবে স্মরণীয় যে, ইমাম হুসাইন (রাঃ) যুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে কিংবা মোকাবিলা করার উদ্দেশ্যে বের হননি। আপনারা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন যে যারা যুদ্ধ বা মোকাবিলা করার উদ্দেশ্যে বের হয়, তারা কখনো মেয়েলোক ও দুগ্ধপোষ্য শিশুদের নিয়ে বের হয় না। হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)-এর নিজের বিবি ও দুগ্ধপোষ্য শিশুদের নিয়ে বের হওয়াটা এটাই প্রমাণিত করে যে, তিনি যুদ্ধ কিংবা মোকাবিলার উদ্দেশ্যে বের হনি। তাঁর (রাঃ) কাছে তো চিঠি এসেছে যে, সেখানকার অবস্থা খুবই সন্তোষজনক, চল্লিশ হাজার লোক বায়াত করেছে, কুফাবাসীরা দারুণ মেহমানদারী করছে। তাই তিনি তাঁর আপনজনদের নিয়ে বের হয়েছেন এবং যুদ্ধ করার কোনো অস্ত্রশস্ত্র রাখেননি। হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) মক্কা শরীফ থেকে কুফার উদ্দেশ্যে বের হয়ে কিছু দূর যাবার পর পথে তিনি হযরত ইমাম মুসলিম (রাঃ)-এর শাহাদাত বরণের খবর পেলেন।
কুফা থেকে দুই মঞ্জিল দূরত্বে কারবালার প্রান্তরে যখন ওঁরা পৌঁছলেন, তখন হুর বিন ইয়াজিদ রিয়াহী এক হাজার সৈন্য নিয়ে ইমাম হুসাইন (রাঃ)-এর সাথে মোলাকাত করলেন এবং বললেন, জনাব ইমামে আ’লা (রাঃ)! আমি আপনাকে গ্রেফতার করার জন্যে এসেছি। হুরের সাথে কথা হলো, ইমাম রাতে তাঁর সাথীদের নিয়ে চলে যাবে। কিন্তু রাঁতে রওনা দেয়ার পর ও সারারাত চলার পর সকালে সে স্থানেই নিজেদের দেখতে পেলো। এভাবে তিন রাত একই ঘটনার পুনরায় ঘটলো। ৪র্থ রাতে এক পথিককে জিজ্ঞাসা করলেন এ স্থানের নাম কী? তিনি বললেন কারবালা। ইমাম হোসাইন (রাঃ) বুঝতে পারলেন প্রিয় নানজির ভবিষ্যদ্বাণী আমি কারবালাতে শহীদ। উনি সাথীদের বললেন বিষয়টি। এবং সেখানেই তাঁবু করলেন। আস্তে আস্তে ২২ হাজার। সৈন্য আসলো। অথচ শিশু, মহিলাসহ ইমাম বাহিনী মাত্র ৮৩ জন।
ইমাম হুসাইন (রাঃ) যখন দেখলেন, এদের উদ্দেশ্য খুবই খারাপ, অবস্থা খুবই সঙ্গীন রূপ ধারণ করছে, তখন তিনি তাদের সামনে তিনটি শর্ত পেশ করলেন। তিনি (রাঃ) বললেন, “শুন! কুফাবাসীরা আমার কাছে চিঠি লিখেছে এবং চিঠিতে এমন কথা লিখা ছিলো, যার জন্য শরীয়ত মতে আমি এখানে আসতে বাধ্য হয়েছি। এখন যখন তারা বেঈমানী করেছে, আমি তোমাদের সামনে তিনটা শর্ত পেশ করছি; তোমাদের যেটা ইচ্ছা সেটা গ্রহণ করো এবং সেই অনুসারে কার্য সম্পাদন কর। শর্তগুলো, (১) হয়তো আমাকে মক্কায় চলে যেতে দাও। সেখানে গিয়ে হেরেম শরীফে অবস্থান করে ইবাদত-বন্দেগীতে নিয়োজিত থেকে বাকি জীবনটা অতিবাহিত করবো। (২) যদি মক্কায় যেতে না দাও, তা হলে অন্য কোনো দেশে যাওয়ার সুযোগ দাও, যেখানে কাফির বা মুশরিকরা বসবাস করে। ঐখানে আমি আমার সমস্ত জীবন দ্বীনের তাবলীগে ব্যয় করবো এবং ওদেরকে মুসম্মান বানানোর প্রচেষ্টা চালাতে থাকব। আর (৩) যদি অন্য কোন দেশেও যেতে না দাও, তা হলে এমন করতে পার যে আমাকে ইয়াজিদের কাছে নিয়ে চলো। আমি তার সাথে বসে আলোচনা করবো হয়তো কোন সন্ধিও হয়ে যেতে পারে, এই নাজুক অবস্থার উন্নতিও হতে পারে এবং রক্তপাতের সম্ভাবনাও দূরীভূত হতে পারে। ইয়াজিদ বাহিনী এ তিনটি শর্ত কুফার গভর্নর ইবনে জিয়াদের কাছে পাঠিয়ে দিলো।
সে এ শর্তগুলোর কথা শুনে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল এবং আমর বিন সা’দ, যিনি সেনাপতি ছিলো, তাকে লিখলো যে, আমি তোমাকে সালিশকার বা বিচারক বানিয়ে পাঠাইনি যে, তুমি আমার এবং হযরত হুসাইন (রাঃ)-এর মধ্যে সন্ধি করার ব্যবস্থা করবে; আমি তোমাকে পাঠিয়েছি হুসাইন (রাঃ)কে বায়াত করতে বলার জন্যে অথবা তার সাথে যুদ্ধ করে তার মস্তক আমার কাছে পাঠিয়ে দেয়ার জন্যে। অথচ তুমি সন্ধির চিন্তা-ভাবনা করছো এবং-এর জন্য বিভিন্ন তদবীর করছো। আমি আবার তোমাকে শেষবারের মত নির্দেশ দিচ্ছি, ইমাম হুসাইন (রাঃ) যদি বায়াত করতে অস্বীকার করেন, তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ কর এবং তাঁর মস্তক কেটে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও।
হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) তাঁর প্রস্তুতি শুরু করলেন, নবী করিম (সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম)-এর পাগড়ী মুবারক মাথার উপর রাখলেন, সৈয়দুশ শুহাদা হযরত হামযা (রাঃ)-এর ঢাল পিঠের উপর রাখলেন। বড় ভাই হযরত ইমাম হাসান (রাঃ)-এর কোমর বন্ধনী নিজ কোমরে বাঁধলেন এবং আব্বাজান শেরে খোদা হযরত আলী মুর্ভূজা (রাঃ)-এর তলোয়ার জুলফিকার হাতে নিলেন। অতঃপর কারবালার দুলহা, কারবালার সুলতান শাহীন শাহে কারবালা হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) ময়দানের দিকে যাত্রা দিলেন।
হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)-এর শাহাদাত
নিজেদের মারাত্মক পরিণতির কথা উপলব্ধি করে আমর বিন সা’আদ নির্দেশ দিলো, সবাই মিলে চারিদিক থেকে ওনাকে (রাঃ) লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ কর। নির্দেশমত ইয়াজিদী বাহিনী নবী (সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম)-এর দৌহিত্রকে চারিদিক থেকে ঘিরে বৃষ্টির মতো তীর নিক্ষেপ করতে লাগলো। ফলে চারিদিক থেকে তীর এসে হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)কে আঘাত হানতে লাগলো। কোনটা হোড়র গায়ে লাগছিলো, কোনটা তার (রাঃ) নিজের গায়ে পড়ছিলো। এভাবে যখন তীরের আঘাতে তার (রাঃ) পবিত্র শরীর ঝাঁঝরা হয়ে ফিনকি দিয়ে সারা শরীর থেকে রক্ত বের হতে লাগলো, তখন তিনি (রাঃ) বার বার মুখে হাত দিয়ে বললেন, বদখত! তোমরাতো তোমাদের নবী (সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম)-এর লেহাজও করলে না। তোমরা নবী (সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম)-এর বংশধরকে হত্যা করেছো। শরীর থেকে রক্ত বের হয়ে গিয়ে একেবারে রক্তশূন্য হয়ে গেলেন এবং আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে ঘোড়া থেকে পড়ে গেলেন। সে মুহূর্তে হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) ঘোড়া থেকে পড়ে গেলেন, ঘোড়া থেকে পতিত হওয়ার পর কমবখত সীমার, হাওলা বিন ইয়াজিদ, সেনান বিন আনস প্রমুখ বড় বড় জালিম এগিয়ে আসলো এবং হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)-এর শরীরের উপর চেপে বসলো। সীমার বুকের উপর বসলো। হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) বুকের উপর সীমারকে দেখে বললেন, আমার নানাজান (সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) ঠিকই বলেছেন, ‘এক হিংস্র কুকুর আমার আহলে বায়তের রক্তের উপর মুখ দিচ্ছে’, আমার নানাজান (সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম)-এর কথা ষোল আনা সত্য, তুমিই আমার হত্যাকারী। আজ জুমার দিন, এ সময় লোকেরা আল্লাহর দরবারে সিজদারত। আমার মস্তকটা তখনই আমার শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করো, যখন আমিও সিজদারত থাকি। হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) সিজদায় মাথা রাখলেন এবং তসবীহ পাঠ করে বললেন, মওলা! যদি হুসাইন (রাঃ)-এর কোরবানি তোমার দরবারে গৃহীত হয়, তাহলে এর ছওয়াব নানাজান (সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম)-এর উম্মতের উপর বখশিশ করে দাও। হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)-এর মস্তক মুবারক যখন শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেললো তখন তাঁর (রাঃ) ঘোড়া স্বীয় কপালকে তার (রাঃ) রক্তে রঞ্জিত করলো এবং দৌড়ে চলে যেতে লাগলো, তখন সীমার লোকদেরকে বললো, ঘোড়াটিকে ধরো, কিন্তু যতজন লোক ঘোড়াটি ধরতে এগিয়ে গেলো, সে সবাইকে আক্রমণ করলো এবং দাঁত আর পা দিয়ে জখম করে ওদেরকে শেষ করে দিলো। সতের জন লোককে এভাবে খতম করলো। শেষ পর্যন্ত সীমার বললো, ছেড়ে দাও, দেখি কী করে। ঘোড়া ছুটে গিয়ে তাঁবুর কাছে গেলো এবং কান্না ও চিৎকার করতে লাগলো।
হযরত সৈয়দা জয়নাব (রাঃ) যখন ঘোড়ার কান্না ও চিৎকার শুনলেন, তখন হযরত সৈয়দা সখিনা (রাঃ)কে ডেকে বললেন, বেটি! একটু দাঁড়াও, আমি বের হয়ে দেখে আসি, সম্ভবত তোমার আব্বা এসেছেন। মজলুম বোন বের হয়ে দেখলেন, ঘোড়ার জ্বিন খালি এবং ঘোড়ার কপাল রক্তরঞ্জিত। তা দেখে হযরত সৈয়দা জয়নাব (রাঃ) বুঝতে পারলেন, হযরত হুসাইন (রাঃ) শাহাদাত বরণ করেন।
পরিশেষে বলবো, হযরত ইমাম হোসাইন (রাঃ) প্রথমত, ফাসেকের হাতে বায়াত গ্রহণ করেননি। দ্বিতীয়, মদিনাতে রক্তপাত ঠেকাতে মক্কা চলে গেলেন। তৃতীয়, তিনি কূফার মানুষের আমন্ত্রণকে আমানত ভেবে তাঁর জবাবদিহিতার স্থান থেকে সেখানে যেতে চাইলেন। চতুর্থত, কারবালা থেকে ফিরে আসতে চাইলেন, কিন্তু ৩ দিন পর্যন্ত সারা রাত পথ চলার পর সকালে কারবালাতেই নিজেদের দেখেন। পঞ্চম, হুর বিন যিয়াদসহ যারাই সেনাপতি এসেছেন সবার মাধ্যমে চেষ্টা করেছেন যুদ্ধ এড়ানো। কিন্তু তাঁরা তাঁকে বাধ্য করে প্রথম আক্রণ করেছেন তিনি জবাব দেয়ার চেষ্টা করেছেন। ষষ্ঠ, তিনি যুদ্ধ করতে গেলো মহিলা ও শিশুদের নিতেন না, বরং তিনি মেহমান হিসেবে যেতে ছিলেন। সব মিলিয়ে তিনি ইসলামের জন্যে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করে শাহাদাত বরণ করেছেন। যেনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথানত করে অন্যায় মেনে নেয়া যায় না।
লেখক : ইমাম ও খতিব, বিষ্ণুপুর মদিনা বাজার বাইতুল আমিন জামে মসজিদ, চাঁদপুর সদর, চাঁদপুর।