মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর, ২০২৪  |   ১৯ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া, স্ত্রীর আত্মহত্যা
  •   ভারতকে কড়া বার্তা শ্রম উপদেষ্টার
  •   আধুনিক নৌ টার্মিনাল প্রকল্প পরিদর্শনে চাঁদপুরে নৌপরিবহণ উপদেষ্টা
  •   ডাকাতিয়া নদী ও সিআইপি অভ্যন্তরস্থ খাল খননসহ ৫ দফা দাবিতে সংগ্রাম কমিটির সংবাদ সম্মেলন

প্রকাশ : ০৬ জুন ২০২২, ০০:০০

চন্দ্রদ্বীপের দীপ : কলামশিল্পের বিশ্বকর্মা

পীযূষ কান্তি বড়ুয়া

চন্দ্রদ্বীপের দীপ : কলামশিল্পের বিশ্বকর্মা
অনলাইন ডেস্ক

অমরতা স্বর্গের জন্যে সংরক্ষিত এ কথা আজ অর্থহীন। কায়াধারী অমরতার চেয়ে কর্মধারী অমরতাই আজ নন্দিত, বন্দিত। তাই নশ্বর মানুষ যখন তার কর্মে অমরতা পায় তখন তাতে খুশি হয়ে ওঠে স্বয়ং পৃথিবী ও পৃথিবীর জনক। জীবনের মহত্বও আসলে তাণ্ডই। দেহের অমরতার চেয়ে কর্মের অমরতার দিকে ধাবিত হওয়া। পৃথিবীর সিংহভাগ মানুষ যেদিন এই কর্মের অমরতায় ব্রতী হবে, সেদিনই পৃথিবী স্বর্গ হয়ে উঠবে সুকর্মের সৌরভে। কর্মে অমরত্ব পাওয়া মানুষেরাই দেহান্তরিত হয়ে দীপ জ্বালিয়ে রাখেন জীবিত মানুষের পথ-নির্দেশে। সদ্য দেহান্তরিত বরেণ্য সাংবাদিক ও লেখক আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী এমনই এক কর্মের অনির্বাণ দীপ হয়ে বিদায় নিলেন পৃথিবীর ধূলি হতে হতে অনন্ত আকাশে।

ইতিহাসের চন্দ্রদ্বীপ বরিশালের জলমগ্ন জনপদ উলানিয়া হতে যে দৈবদীপ জ্বলে উঠেছিল শিশুর দুচোখে, সেই দীপখানি অনির্বাণ রেখেই আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী আজ হয়েছেন চিরজীবী। মাদ্রাসায় শৈশবের পাঠ নিয়ে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হতে জ্ঞানের জাগিয়ে তোলা পিপাসাকে তিনি কলমে ছড়িয়ে দিয়েছেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। পরিণত বয়সে তাঁর পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক একটা কলাম যেন এক একটা পাঠশালা। ইতিহাস-সাহিত্য-রাজনীতি-দর্শন ও সমকালের যুগপৎ শিক্ষা তাঁর কলামেই পূর্ণতা পেতো পরবর্তী কলামের তৃষা জাগিয়ে। প্রগতিকে কলমে ধারণ করে আধুনিক মনস্কতার যে বাহন তিনি ছুটিয়ে এনে জ্ঞানমানসকে জড়ো করেছেন একুশ শতকের বটতলায়, তাতে উপ্ত হয়েছে বাঙালির ভবিষ্যতের অক্ষয় চেতনার অজর বীজ। প্রতিক্রিয়াশীল ও স্বাধীনতাবিরোধী পত্রিকা ছাড়া বাংলাদেশের সকল পত্রিকাতেই তাঁর লেখা ছড়াতো আলো, কুড়িয়ে নিতো মন্ত্রমুগ্ধ পাঠকের অতৃপ্ত পিপাসাকে। কোন কোন পরিবারে তিনপ্রজন্মই তাঁর কলমের জাদুমন্ত্রের বুভুক্ষু পাঠক। কোন কোন পত্রিকা পরিবারের অন্দরমহলে প্রবেশের সুযোগ পেতো কেবল তাঁর কলামের জোরেই। একজন গাফ্ফার চৌধুরীর দেহান্তর তাই এক বদ্বীপ শূন্যতার মতোই চেপে বসে বাঙালির সন্তপ্ত হৃদয়জুড়ে।

১৯৩৪ সালের ১২ ডিসেম্বর হতে ২০২২ সালের ১৯ মে, এ কেবল একটি জীবনের সীমারেখা নয়, এ এক প্রতিষ্ঠানেরও অন্তহীন মহিমা। সাংবাদিকতা, সাহিত্য, চলচ্চিত্র ও সংগীত এবং তার পাশাপাশি রাজনৈতিক কলামের সৌন্দর্যে তিনি যে সোনার তরী বেয়ে উপনীত হয়েছেন মহাকালের মোহনায়, তাতে তাঁর কর্মফসলে ভরে উঠেছে লোকোত্তর জগতের হিসেবের গোলা।

তাঁর জীবন হতে একথা বলতেই হয়, একটি মহাজীবন গড়ে তুলতে হলে অন্য মহাজীবনের সংস্রবে আসা চাই। নচেৎ সেই জীবনের সলতেয় দীপখানি প্রদীপ্ত হয়ে ওঠার শক্তি অর্জন করে না। প্রয়াত আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী সাংবাদিক হিসেবে যাঁদের হাতে নির্মিত হয়ে উঠেছিলেন তাঁদের একজন হচ্ছেন তাফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, যাঁর রাজনৈতিক কলাম স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর পিপাসা মেটাতো। সওগাত সম্পাদক নাসিরউদ্দীনের সাহচর্য তাঁকে করে তুলেছে পরিশীলিত। ১৯৪৯ সালে সওগাত পত্রিকায় যার প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়, পরবর্তীকালে তিনিই সে পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্বে অভিষিক্ত হন। 'দৈনিক ইনসাফ'-এর মাধ্যমে যিনি সাংবাদিক হিসেবে জন্মলাভ করেন, তাঁর হাতেই একসময় 'চাবুক' তুলে দেন তাফাজ্জল হেসেন মানিক মিয়া। ভাগ্য পরিবর্তনে মুদ্রণশিল্পের ব্যবসায় এলেও তিনি দুবছরের মাথায় বুঝে যান, তাঁর রক্তে ও মগজে সাংবাদিকতা। তাই ঘরের ছেলে ফিরে আসেন ঘরে। গাফ্ফার চৌধুরীর কলামের শক্তি তাঁর প্রজ্ঞায়। এই প্রজ্ঞা কেবল গ্রন্থলব্ধ নয়, বরং তাঁর জীবনলব্ধ। সমকালীন বিষয়কে ইতিহাসের বিষয়ের সাথে সমতানে বেঁধে তিনি তাতে মেশাতেন স্বীয় দর্শন। তাঁর বিশ্লেষণে যেমন যাদু ছিল তেমনি ছিল তথ্যনিষ্ঠতা। আক্রমণ থাকলেও তাতে থাকতে সাহিত্যমান। স্বল্পশ্রুত বিষয়কে সংশ্লিষ্ট করে কলামের রুচি বাড়িয়ে তুলতেন তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে।

হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য গাফ্ফার চৌধুরী মুজিবের কাছে ছিলেন 'মুসিবদ'। রসবোধে টইটম্বুর বঙ্গবন্ধু তাঁর স্নেহের সাংবাদিক মুসাকে আপদ, ফয়েজকে বিপদ ও গাফ্ফারকে ডাকতেন মুসিবদ বলে। ১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে এই মুসিবদকেই তিনি সঙ্গে করে নিয়ে যান স্নেহের ধারা উপচে দিয়ে। আওয়ামী রাজনীতির অন্ধ সমর্থক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী যুদ্ধোত্তর সমালোচনামুখর এবং বঙ্গবন্ধুর নামে অশোভন মন্তব্য করলেও তিনিই তাঁর প্রগতির ধারাকে সমুন্নত রেখে কলামের বল্লম নিয়ে পাশে থেকেছেন মুজিব-তনয়ার। হেন কোনো সমকালীন বিষয় নেই যাতে তিনি নিজে উপযাচক হয়ে কলামের পাঠশালায় মুজিব-তনয়াকে উদ্দেশ্য করে পরামর্শ দেননি। মৌলবাদ ও স্বাধীনতাবিরোধীদের তিনি তাঁর কলমের হাতিয়ারে যেভাবে সামলেছেন তা কিংবদন্তিতুল্য। চুয়াত্তরে স্ত্রীর চিকিৎসার্থে এলিজাবেথের দেশে গেলেও স্বদেশের সকল খবর থাকতো তাঁর নখের গোড়ায়। তাঁর কাছ থেকে দুটো কথা জানতে এদেশের পাঠক বসে থাকতো চাতক-প্রাণ হয়ে।

'বঙ্গবন্ধু আবার যখন ফিরবেন' কিংবা ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি' তাঁকে মুজিবভক্ত হিসেবে পরিচিতি দিলেও তাঁকে অমরতা এনে দিয়েছে একুশের গীতিকবিতা। বাঙালির মহান ভাষা আন্দোলনের শোক ও শক্তিকে তিনি যেভাবে তাৎক্ষণিক গীতিকবিতার প্রতিটি শব্দে খোদাই করে তুলেছেন, তা অবর্ণনীয়, অতুলনীয়। তাতে সুরারোপ করে যেমন অমর হয়েছেন শহিদ আলতাফ মাহমুদ, তেমনি সেই গানের কবিতায় মর্ত্যে থেকেও অমর হয়ে উঠেছেন আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী। একুশের প্রথম শহিদ রফিককে মৃত্যুশয্যায় ছটফট করতে দেখা আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রুকে সেদিন যেভাবে শিল্পীর কণ্ঠে ঝরিয়ে তুলেছিলেন, তাঁর সেই বিনিন্দিত নান্দনিকতাই আজ বাংলামায়ের অশ্রুকে রক্তক্ষরণে রূপান্তরিত করেছে তাঁর প্রয়াণে। বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হলেও তাঁর অসামান্য প্রাপ্তি হলো কোটি কোটি পাঠকের অকুণ্ঠ ভালোবাসা। চন্দ্রদ্বীপের জলমগ্ন জনপদের শিশুটি আজ জগতসভায় একুশের প্রভাতফেরির কণ্ঠস্বর হয়ে বিশ্বজনীন হয়ে উঠেছে। পুরাণমতে, বিশ্বকর্মার হাতে যেমন জগতের শিল্পকর্মের ভার বর্তেছে, তেমনি চন্দ্রদ্বীপের গাফ্ফার চৌধুরীও যেন কলামশিল্পের দায়িত্ব নিয়ে মায়ের গর্ভ ধন্য করে তুলেছেন। তাঁর প্রয়াণে কলামশিল্প যেমন পিলারহীন হয়ে উঠেছে, তেমনি কলমশিল্পও হয়ে গেছে অভিভাবকহীন। কলম যে শুধু ধারালো হয় না, নান্দনিকও হয়, তা তাঁর কর্মের সুবর্ণস্রোত হতেই দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। বাঙালির লুপ্তপ্রায় প্রভাতফেরি তাঁর গীতিকবিকে মনে করিয়ে দিবে অনন্তকাল।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়