প্রকাশ : ২০ জুন ২০২১, ১০:৫৪
বিম্বিত বীক্ষণ
পর্ব-১১
|আরো খবর
১৯৮৯ সালে বেসরকারি শিক্ষকদের এমপিও আসতো ৩ মাস পরপর। সে কথাগুলো ভাবলে শুধু মনে হতো, সত্যিই কি শিক্ষকতা মহান পেশা? চাকুরিতে জয়েন করেই আরেক যুদ্ধ শুরু হলো। এমপিওভুক্তির জন্যে কাগজপত্র ডিজি অফিসে পাঠাতে হবে। তারপর সেখানকার কর্তা ব্যক্তিরা যাচাই-বাছাই করে দেখবে এমপিও দেয়া যাবে কিনা। এই যাচাই-বাছাইয়ের নামে যে পরিমাণ হয়রানি করা হতো তার বিন্দুমাত্রও এখন নেই। সেখানে উৎকোচ দিলে সব অনিয়ম নিয়ম হয়ে যেতো, আর না দিলে নিয়ম অনিয়ম হয়ে যেতো। ঐ সময়টায় উৎকোচ ছাড়া এমপিও হয়েছে এমন কেউ বলতে পারবে না। এ টাকা নাকি নিচ থেকে উপর পর্যন্ত সবার পকেটে যেত। একজন শিক্ষকের জন্যে এটা যে কী পরিমাণ বেদনার-অপমানের তখন বুঝেছি। শিক্ষকতায় প্রবেশ করেই যখন এমপিও করতে টাকা দিতে হয় তখন সেই শিক্ষকের নৈতিকতায় চির ধরে। যাচাই-বাছাই শেষে উপরি না দিলে মাসের পর মাস ফেলে রাখা হতো। এ বিষয়টি তখন প্রথা হয়ে গিয়েছিল। একেক পদের রেট একেক রকম ছিল। আমাকে যখন বলা হলো ডিজি অফিসে টাকা না দিলে এমপিও হবে না। আমি বল্লাম, কেন টাকা দিবো? আমি তখন বুঝতাম না জানতাম না এটাই নিয়ম। বলেই ফেল্লাম, আমি টাকা দিবো না ঘুষ দিবো না। আমাকে তখন সিনিয়র কয়েজন শিক্ষক বোঝালেন এটাই নিয়ম, টাকা না দিলে মাসের পর মাস পড়ে থাকবে। আমি তখন তরুণ শিক্ষক, টাকা-পয়সার প্রতি আমার আগ্রহ নেই, যা এখন পর্যন্ত ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছি বলে আমি মনে করি। পারিবারিক কারণেই খুব একটা অর্থকষ্ট আমার ছিলো না। তাই একটু ডেমকেয়ার ভাব ছিল, যা এখনো আছে। সিনিয়রদের পীড়াপীড়িতে এক পর্যায়ে আমি রাজি হলাম। তবে বল্লাম ঘুষ দিতে আমি ঢাকা ডিজি অফিসে যাবো না। আমি টাকা দিয়ে দিবো কলেজ অফিসে। তারা দিয়ে আসুক। যতটুকু মনে পড়ে, ১৯৮৯ সালে আমি তিন হাজার টাকা দিয়েছিলাম। তবে আমি জিদ করে ঢাকা যাইনি। এর তিন মাস পর আমার এমপিও হয়ে আসলো। একবার চিন্তা করুন, এখন এমপিও হওয়া কতটা সহজ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যাকে অশেষ কৃতজ্ঞতা এবং ধন্যবাদ এখন একজন শিক্ষকের এমপিও করতে তেমন হয়রানি হতে হয় না। বিকেন্দ্রীকরণ এবং ডিজিটাল করার করণে এখন আর কাউকে ডিজি অফিসে যেতে হয় না। অনলাইনে আবেদন করলে ঘরে বসে এমপিও’র টাকা পেয়ে যাবেন। বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য এটি ছিল এক লজ্জাজনক অবস্থা। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, ডিজি অফিসে যারা কর্মকর্তা ছিলেন তারাও কিন্তু সরকারি কলেজের শিক্ষক। যারা নিজেদের ক্যাডার সার্ভিসের লোক মনে করেন, নিজেদের কুলিন মনে করেন।
যদিও আমি এখন পুরান বাজার কলেজে চাকুরি করি, তথাপি আমার সখ্যতা ছিল চাঁদপুর কলেজ এবং চাঁদপুর মহিলা কলেজের শিক্ষকদের সাথে। ঐ সময় চাঁদপুর কলেজে এবং মহিলা কলেজে যারা জয়েন করেছেন তাদের সাথে আমার ছিলো বন্ধুত্বের সম্পর্ক। দিনগুলো ভালোই কেটে যাচ্ছিল। আস্তে আস্তে বুঝতে শুরু করলাম শিক্ষকতা সত্যিই সম্মানের পেশা। বাইরে গেলে মানুষ সম্মানের চোখে দেখতো। চাঁদপুর সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রধান জনাব খুরশেদুল ইসলাম স্যার ছিলেন খুবই সজ্জন মানুষ। স্যারের বাড়ি ছিলো ব্রাহ্মণবাড়িয়া। তিনি ছিলেন সাংবাদিক হাসনাইন খুরশেদের বাবা। স্যারের ছেলে-মেয়েরাও ছিলেন স্যারের মত অসাধারণ। কেন জানি স্যার আমাকে খুব স্নেহ, আদর এবং বিশ^াস করতেন। স্যার একদিন আমাকে খবর দিলেন। আমি গেলাম। স্যার বল্লেন, তিনি ইংরেজি বিষয়ের প্রধান পরীক্ষক হয়েছেন, তাঁর সাথে পরীক্ষার উত্তরপত্র নিরীক্ষণের কাজ করতে হবে। আমি রাজি হয়ে গেলাম। কাজ শুরু হলো। আমরা পাঁচজন নিরীক্ষণের কাজ করছি। চাঁদপুর কলেজের শামছুদ্দিন স্যার, শহীদ উল্যা স্যার, সেকান্দর স্যার, আমি এবং উষা দা। স্যার আমাকে এবং উষা দাকে ডেকে নিয়ে বল্লেন, আপনাদের দুজনকে আমি খুব বিশ^াস করি। ভালোভাবে নিরীক্ষণ করবেন এবং কিছু নির্দেশনা দিয়ে দিলেন। তখন সিলেট এবং চট্টগ্রাম বোর্ড ছিল না। সবাই কুমিল্লা বোর্ডের অধীন ছিল।
কাজ শুরু করার কয়েকদিন পরই চাঁদপুরে ছাত্র-ছাত্রীদের আনাগোনা বেড়ে গেল। বিশেষ করে সিলেট এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলের ছেলেরা বোর্ড থেকে জেনে নিত তাদের উত্তরপত্র কার কাছে গিছে। বোর্ডের এক শ্রেণির অসাধু লোক তাদেরকে অর্থের বিনিময়ে সেটা বলে দিত। এরা প্রধান পরীক্ষক স্যারের কাছে যাওয়ার সাহস পেত না। মাঝে মাঝে এরা আমাদের কাছে আসতো। আমরা যে নিরীক্ষক হিসেবে কাজ করি সেটা তাদেরকে বলতামই না। এমনও অভিজ্ঞতা আছে যে, নানা জায়গার ছেলেরা এসে এখানে হোটেলগুলোতে থাকতো। কোনোভাবে একটু যোগাযোগ করা যায় কিনা। তবে কিছু দালাল জুটে যেত। দালালরা ছেলেদের ব্ল্যাকমেইল করতো। বলতো, স্যারদের সাথে যোগাযোগ করেছি তোমাকে পাস করিয়ে দেয়া হবে, তবে এই পরিমাণ টাকা দিতে হবে। তারাও সেই ফাঁদে পা দিয়ে টাকা দিত। কিন্তু দালালরা আমাদের ধারে কাছেও আসতো না। তখনকার উত্তরপত্র মূল্যায়নে এমন অবস্থা ছিল। খুরশেদ স্যার কেন আমাকে এতোটা বিশ^াস করতেন জানি না। একদিন আমাকে বল্লেন, যদি দেখেন সামান্য কিছু নাম্বারের জন্যে ছাত্র ফেল করছে তবে সহানুভূতির সাথে দেখবেন এবং পাস করিয়ে দেবেন। আমি স্যারের এ বিশ^াসের মূল্য অন্তর দিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছি। কোনোদিনও স্যারের বিশ^াস হারাইনি। শুধু মনে মনে ভাবতাম, স্যার আমাকে যে বিশ^াস করেছেন কোনো কিছুর বিনিময়ে সেটা আমি নষ্ট হতে দিবো না। স্যার আমার অনুপস্থিতিতে এ কথাগুলো অন্যদের বলতেন। আরো বলতেন, প্রথম কাজেই রতন বাবু দক্ষতার পরিচয় দিল। স্যারের কথা আজীবন আমার মনে থাকবে। স্যার প্রয়াত হয়েছেন অনেকদিন হলো, এখনো স্যারকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। স্যারের ছোট ছেলে ছিল তুষি। কী অমায়িক ছেলে! ওকে কোনোদিন ভুলতে পারবো না।
ভাল কাজ করলে, বিশ^াসের সাথে কাজ করলে সেটার মূল্য পাওয়া যায় -সেটা কিছুদিন পর দেখা গেল। খুরশেদ স্যার তখন চাঁদপুর সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ। একদিন আমাকে খবর দিলেন। আমি গেলাম। স্যার বল্লেন, কলেজে ভূগোলের কোনো শিক্ষক নেই, আপনাকে কলেজে পার্টটাইম কিছু ক্লাস নিতে হবে। আমি আমার অধ্যক্ষের অনুমতি নিয়ে ক্লাস নেয়া শুরু করলাম। ক্লাসে অনেক ছাত্রী। সে আরেক অভিজ্ঞতা। প্রথম যেদিন ক্লাসে গেলাম ছাত্রীরা চোখ বড় বড় করে তাকায়। হয়তো ভেবেছে, হ্যাংলা পাতলা অল্পবয়সি এই ছেলে কী করে শিক্ষক হয়। দু-চারটে ক্লাস নেয়ার পর তারা আমার ক্লাসের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠলো। দুই কলেজেই আমাকে নিয়মিত ক্লাস নিতে হয়। আমার আরেকটা সৌভাগ্য হলো, চাঁদপুর শহরে আমি তিনটি কলেজেই অধ্যাপনা করেছি। সাথে আমি এটাও বুঝতে শুরু করলাম, তিন কলেজেই আমার বহু ভক্ত ছাত্র-ছাত্রী আছে। আমার তখন দম ফেলবার সময় নেই।
এরি মধ্যে দুদিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি গেলাম। পরিবারের সবাই খুব খুশি। তাদের অধ্যাপক ছেলে বাড়ি এসেছে। সবচেয়ে বেশি খুশি আমার মা এবং জেঠু। জেঠু আমাকে খুব আদর করতেন। বাড়ির আশ-পাশের লোকেরাই কানাঘুষা করতে থাকে আমাকে নিয়ে যে, ছোট বাবুর মেঝ ছেলে প্রফেসর হয়েছে। তাদের কাছে প্রফেসর আর প্রভাষকের কোনো ভেদ নেই। আমার বাবা এবং জেঠু দুই ভাই। এলাকায় জেঠুকে বড় বাবু এবং বাবাকে ছোট বাবু বলে লোকজন সম্বোধন করতো। আমাদের পরিবারকে সবাই শ্রদ্ধার চোখে দেখতো। সকলের সাথে আমাদের ছিলো আন্তরিক সম্পর্ক। বোঝা গেলো আমার পরিবারের সাথে গ্রামের মানুষও খুশি আমার অধ্যাপনার কথা শুনে। স্কুল জীবনের দুই তিনজন বন্ধুর সাথে দেখা করলাম। তারাও ইতিমধ্যে জেনেছে আমি অধ্যাপনা করছি। আমি তাদের সাথে দেখা করতে গেছি, তারাও অবাক হয়েছে। তারাও আমাকে সমীহ করে ‘আপনি আপনি’ বলা শুরু করলো। আমি তাদের দিয়েছি এক ধমক। বল্লাম, আমিতো তোদের বন্ধু রতু। (গ্রামে আমাকে সবাই রতু বলে ডাকতো)। তাদের সাথে অনেক গল্প করলাম।
আমি বরাবরই একটু আড্ডাবাজ ছিলাম। চায়ের দোকানে বসে চা খাওয়া, কোথাও গিয়ে আড্ডা দেয়া ছিলো আমার মজ্জাগত। কিন্তু শিক্ষকতা আমার সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। আমার নিজের মধ্যেই একটা বোধ জাগ্রত হলো, এ পেশার প্রতি সম্মান রেখে আমাকে কিছু কিছু অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। যদিও তা ছিলো কষ্টকর। কাজ জানলে বা কাজ বেশি করলে একটা বিড়ম্বনাও আছে। কলেজে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ তারিক উল্যা স্যার এবং প্রীতি স্যার যেকোনো কাজে আমাকে ডাকবেন। আমাকে কাজটা করে দিতে বলতেন। বিশেষ করে হাতের লেখার কারণে। মাঝে মাঝে বিরক্তও হতাম। ছাত্রাবস্থায় আমার হাতের লেখা মোটামুটি ভালো ছিল। কিন্তু বর্তমানে সেটা আর নেই ডিজিটাল যুগের কারণে। এখন হাতের লেখা উঠেই গেছে। অনভ্যাসে বিদ্যা নাশ। আমারও এখন হয়েছে তা-ই। আগের মত আর হাতের লেখা নেই। আস্তে আস্তে সহকর্মীদের সাথেও মানিয়ে নিতে থাকলাম। আমার একটা অভ্যাস, কাজ করতে পছন্দ করি। কোনো কোনো সহকর্মী বলতেন, এতো কাজ করে লাভ কি? এখন আমি বুঝি আমার কাজই আমাকে বর্তমানে এখানে নিয়ে এসেছে।
লেখক : অধ্যক্ষ, পুরানবাজার ডিগ্রি কলেজ, চাঁদপুর।