শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২০ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।
  •   রাষ্ট্রীয় পদে আসীন হচ্ছেন খবরে আসামিপক্ষে শুনানি করলেন না সমাজী।

প্রকাশ : ২০ জুন ২০২১, ১০:৫২

আজ ২০ জুন বিশ্ব বাবা দিবস

বাবা : সন্তান ও পরিবারের বৃক্ষ

এ.এস.এম. শফিকুর রহমান
বাবা : সন্তান ও পরিবারের বৃক্ষ

শুরু করছি ব্রিটিশ দুই নাগরিক সহোদর দুই ভ্রাতা নাইজেল স্মালার এবং অড্রিন স্মালারের বাবা সম্পর্কে একটি উক্তি দিয়ে। উক্তিটি এ রূপ ‘এই হচ্ছে গড়াই ব্রিজ, আর এই হচ্ছে আমাদের বাবা’। উল্লেখ্য তাদের বাবা অল্ড উইন স্মলার পেশায় ছিলেন ইস্ট বেঙ্গল রেলওয়ের একজন প্রকৌশলী। ১৯৩৭ সালে কুষ্টিয়ার কুমারখাালিতে গড়াই নদীর উপর রেলওয়ে সেতুর কাজ শুরু হলে তিনি ছিলেন এর সার্বিক দায়িত্বে। ১৯৩৯ সালে ব্রিজটির কাজ শেষ হয়। ব্রিটিশ নাগরিক অল্ড উইন তার নেতৃত্বে নির্মিত গড়াই ব্রিজের নির্মাণকালীন সময়ের বেশ ক’টি ছবি উঠিয়ে রেখেছিলেন। ১৯৫১ সালে চাকুরি শেষে ব্রিটেনে ফিরে অল্ড উইন গড়াই ব্রিজ নির্মাণের ছবি এবং কুষ্টিয়া জেলার ইতিহাস-ঐতিহ্য তার ছেলেমেয়েদের অবহিত করেন। বাবা অল্ডউইনের কীর্তি দেখতে ব্রিটেন থেকে কুষ্টিয়ার গড়াই নদীতে সহোদর দুই ভাই এসেছিলেন গত ২৮ এপ্রিল ২০২১ সালে। সেতু এলাকায় গিয়ে দুই ভাই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। বাবার সৃষ্টি তারা ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখেন। যেনো বাবাকেই দেখছেন গভীর মমতায়। এ এক অন্য অনুভূতি। ব্রিজ তৈরির সময়ের তোলা ছবি দেখিয়ে তারা বলেন, এই হচ্ছে গড়াই ব্রিজ, আর এই আমাদের বাবা।

ব্রিটিশ নাগরিক দুই সহোদর ভাইয়ের এই উক্তির উদ্ধৃতি দেয়া হলো এজন্যে যে, আজ জুন মাসের তৃতীয় রোববার বিশ্ব বাবা দিবস। করোনাকালীন বিপর্যয়কর পরিস্থিতির কারণে জাঁকজমকভাবে না হলেও অন্তত সাদামাটাভাবে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ন্যায় আমাদের দেশেও দিবসটি পালন করা হবে। বাবাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্যে প্রত্যেকেই ঘরোয়াভাবে হলেও আমাদের দেশে প্রচলিত রেওয়াজে কিছু অনুষ্ঠান করবে বলে আমার বিশ্বাস। আয়োজন করে বাবাদের স্মরণ ও আত্মার মাগফেরাতে দোয়া করবেন।

মায়েদের পাশাপাশি বাবারাও যে সন্তানের প্রতি দায়িত্বশীল এটি বোঝানোর জন্যেই এ দিবসটি পালন করা হয়। পৃথিবীর সব পিতার প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা প্রকাশের ইচ্ছে থেকেই বাবা দিবস পালন শুরু হয়। ১৯১০ সালে সেনোরা লুইস নামে এক ভদ্র মহিলার একান্ত প্রচেষ্টায় প্রথমবারের মতো বাবা দিবস উদ্যাপিত হয় আমেরিকার পশ্চিম ভার্জিনিয়ার এক গির্জায়। সেনোরা ছিলেন ছয় ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড়। সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে তার মা ইলেন মার্ট যখন মারা যান, তখন সেনোরার বয়স ছিল ১৬ বছর। মায়ের মৃত্যুর পর বাবা উইলিয়াম স্মার্ট সন্তানদের মানুষ করার দায়িত্ব নেন। সারাক্ষণ তিনি তাদের দেখে শুনে রাখতেন। শত ব্যস্ততার মধ্যেও মায়ের অভাব সন্তানদের বুঝতে দেননি। সেনোরা লুইমের ধারাবাহিক ও বহু প্রচেষ্টায় এই বাবা দিবসটি অবশেষে আমেরিকায় স্থায়ীভাবে পালন শুরু হয়। কারো মতে ১৯৬৬ সালে প্রেসিডেন্ট লিওন বি-জনসনের আমলে, আবার কারো মতে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিকসনের আমলে ১৯৭১ সাল থেকে। তখন থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গুরুত্ব সহকারে দিবসটি পালন করা হয়। এই দিবসটি প্রতিষ্ঠায় সেনোরা স্মার্টের অক্লান্ত পরিশ্রম ও অবদানের জন্যে ১৯৭৪ সালে তাঁকে বিশেষ সম্মাননা দেয়া হয়।

মোঘল স¤্রাট বাবর সন্তানের জন্যে পিতার ভালোবাসার এক অনন্য উদাহরণ হয়ে আছেন। প্রাণপ্রিয় ছেলে হুমায়ুনের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা প্রদর্শন করে তিনি বিশ্বের ইতিহাসে ¯েœহবৎসল বাবা হিসেবে অনন্য নজির স্থাপন করেছেন। তিনি রোগাক্রান্ত ছেলের প্রাণ রক্ষায় নিজের জীবন ত্যাগে বিন্দুমাত্র দ্বিধা বোধ করেন নি। এমন স্বার্থহীন যার ভালোবাসা, সেই পিতাকে সন্তানের খুশির জন্যে জীবনের অনেক কিছু ত্যাগ করতে হয়। এই পৃথিবীর অনেক বাবাই আছে, যারা কল্পনার অতীত এবং চিন্তার বাইরে। প্রাচীন ইরানের মহাকাব্য শাহনামায় সোহরাব রুস্তমের অর্থাৎ পিতা পুত্রের অমর কাহিনী আজ সারা বিশ্বে প্রচারিত। শক্তি ও সাহসের জন্যে পৃথিবীর মানুষের কাছে কিংবদন্তির মহানায়ক হিসেবে রুস্তম ছেলে সোহরাবের বুকে তলোয়ার ঢুকিয়ে হত্যা করেন। পরক্ষণেই ছেলে সোহরাবের জন্যে রুস্তমের বুকফাটা হাহাকার আর বিলাপে এক বেদনা বিধূর পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। মহাবীর রুস্তম ছেলেকে আর ফিরে না পাওয়ায় সোহরাবের দেহ নিজ বক্ষে ধারণ করে বলেছিলেন, বীর হিসেবে যুদ্ধে একবার জিতেছি, কিন্তু পিতা হিসেবে আমি চিরতরে হেরে গেছি। মোগল স¤্রাট শাহজাহান এক সময় এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী বস্তু হলো পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ। স¤্রাট শাহজাহানের কন্যা জাহানারা বন্দি অবস্থায় পিতা শাহজাহানের দেখভাল করতেন। বাবা শাহাজাহানের সেবা-যতেœ নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়ে এক অনন্য উদাহরণ প্রতিষ্ঠা করেছেন। অতঃপর শাহজাহান কন্যা জাহানারার প্রেমকে মেনে নিতে পারেননি। নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছেন কন্যার প্রেমিককে।

বাবা শুধু সন্তানের জন্মদান করেন না। জন্মের পরে মায়ের সাথে সন্তানের লেখাপড়া ও কর্মক্ষম করে প্রতিষ্ঠিত করা পর্যন্ত সার্বক্ষণিকভাবে দেখভাল করেন। পরিবারের প্রতিটি সন্তানকে প্রতিষ্ঠিত করার কাজে বাবার অবদান মায়ের চেয়ে কম নয়। কারণ হৃদয়ের অকৃত্রিম বন্ধনে আবদ্ধ বাবা এবং সন্তান। তাই সন্তানের চোখ দিয়ে পানি পড়লে বাবার চোখ দিয়ে রক্ত ঝরে। সন্তান অসুস্থ হলে বাবার হৃদয় পুড়ে যায়। সন্তান কষ্ট পেলে বাবার অন্তর খাঁ খাঁ করে, আর ব্যথা পেলে বাবার চোখ-মুখ বেদনায় আপ্লুত হয়। অর্থাৎ সন্তানের প্রতি বাবাদের ভালোবাসা বর্ষার নদীর উপচেপড়া ঢেউয়ের মতো, ঝর্ণার ঝর ঝর ধারার মতো, সকালের সোনা ঝরা রোদের মতো, আর বৃষ্টির টুপটাপ শব্দের মতে। এসব বিবেচনায় বাবা চিরকালই সন্তানের জন্যে বৃক্ষ। আবার প্রাণরস দান করে ফল সতেজ রাখা বৃক্ষের ধর্ম, তেমনি বাবাও প্রাণরস দান করে সন্তান ও পরিবারকে। সন্তান ও পরিবারের সকল চাহিদা পূরণে বাবারাই প্রাণ রস দিয়ে যান সন্তান ও গোটা পরিবারকে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বাবা শুধু সন্তানের জন্যে নয়, গোটা পরিবারের জন্যে বৃক্ষ হিসেবে কাজ করে যান নিঃস্বার্থভাবে। আর এইভাবেই জন্মদাতা বাবাদের ভালোবাসা, আদর, ¯েœহ সন্তানের প্রতি মায়ার জালে বন্দি আছে সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত। থাকবে ধ্বংসের শেষ দিন পর্যন্ত। সন্তানকে ভালো করে বাবা পরিবারকে ভালো করেন। আর পরিবার ভালো হলে সমাজ ভালো হয়, রাষ্ট্র ভালো হয়। আর এই কাজে বাবার অবদান নিঃসন্দেহে বৃক্ষের মতো।

সন্তানের জন্যে এমন স্বার্থহীন ভালোবাসার সেই বাবাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা আর ভালোবাসা জানানোর জন্যে আজ এই বাবা দিববস। এই দিবসে সন্তানদের জন্যে সুযোগ আসে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে বাবাকে শ্রদ্ধা জানানোর। বাবা দিবস পালনের ফলে পরিবারে এবং সমাজে বাবাদের অবদান মূল্যায়ন করা হয়। এই অনুভূতি বাবাদের খুব আনন্দ দেয়। অনেক সন্তানই আছে যারা তাদের বাবা-মায়ের প্রতি মনোযোগী নয়। বাবা দিবস পিতা-মাতার প্রতি সন্তানদের দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এ ক্ষেত্রে তাই বলা যায়, পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করতে বাবা দিবসের গুরুত্ব আছে অনেক। মোট কথা, আমাদের পরিবার এবং সমাজে বাবাদের যে গুরুত্ব তা আলাদাভাবে তুলে ধরাই বাবা দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য। অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় কোনো কোনো বাবার বিতর্কিত কর্মকা- সন্তানের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হলেও দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার জন্য বাবার অবদানকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।

সেনোরা স্মার্ট কর্তৃক শুরু করা এই বাবা দিবসের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে আমার বাবার কথা উল্লেখ না করে পারলাম না। কারণ সেনোরা স্মার্টের জীবনের সাথে কিছুটা হলেও আমার ছোটবেলার জীবনের মিল পাওয়া যায়। আমার যখন বয়স ৪ মাস, তখন আমার মা মারা যান। বাবা মরহুম আলহাজ্ব আব্দুর রশিদ পাটওয়ারী ছিলেন পেশায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। মা মারা যাওয়ার পর থেকে আমার মরহুমা দাদীর সহযোগিতায় আমার বাবা আমাকে লালন পালন করেছেন। শুনেছি বাবা আমাকে এতো ¯েœহ করতেন যে, একবার ৪/৫ বছর বয়সে আমি রোগাক্রান্ত হয়ে আশংকাজনক অবস্থায় পড়লে আমাকে দেখে বাবা কাঁদতে কাঁদতে দাঁড়ানো থেকে চৌকিতে ঘুরে পড়ে মাথায় প্রচ- আঘাত পান। শিক্ষকতা করাকালে তিনি আমাকে নিয়ে জায়গীর থাকতেন এবং আমার পড়াশোনার দেখভাল করতেন। বাবার ইচ্ছা ছিলো তিনি আমাকে উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার শিক্ষায় শিক্ষিত করবেন। কিন্তু বাবার ইচ্ছাপূরণ করতে পারিনি। মরহুম বাবার সেই অকৃত্রিম ¯েœহের জন্যে আজ বাবা দিবসে তাঁকে স্মরণ করে শ্রদ্ধার সাথে অনুরোধ করছি, বাবা! আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। কারণ আপনার আদর্শ, ইচ্ছা, নিয়ম-নীতি, শিষ্টাচার ও মূল্যবোধকে আমার জীবনে ধরে রাখতে পারেনি। প্রতিষ্ঠিত হতে পারিনি আপনার কাক্সিক্ষত সিএসপি কর্মকর্তা হিসেবে। হতে পারিনি আপনার মতো একজন আদর্শ বাবা। নাইজেল স্মালার ভ্রাতৃদ্বয় বাবার সৃষ্টিকর্ম রোমন্থন করে এবং শাহজাহান কন্যা জাহানারা পিতার সেবা-যতœ করে যে উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন সেই অনুপ্রেরণায় আমার সন্তান ও পৃথিবীর সকল সন্তান অনুরূপভাবে আজ বাবাদের স্মরণ করবে এবং তাদের জন্যে প্রাণ খুলে দোয়া করবে এটাই আমার প্রত্যাশা।

শেষ করছি প্রখ্যাত সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমদের লেখা দিয়ে, তাঁর লেখা ‘নিউইয়র্কের নীল আকাশে ঝক ঝকে রোদ’ গ্রন্থে বাবা সম্পর্কে তাঁর একটি মন্তব্য দিয়ে। তিনি লিখেছেন, পরিবারের সকলকে নিয়ে লস অ্যাঞ্জেলসে গিয়েছি। বন্ধুর বাসায় উঠি, রাতে ক্যাম্পিং করতে জঙ্গলে গিয়েছি। গভীর রাতে ২য় মেয়ে শিলার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। দেখি শিলা বসে আছে আর ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমি বললাম, মা তোমার কী হয়েছে? শিলা বললো, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। আমি তাকে সারারাত তার পাশে বসার কথা বলি, তখন শীলা এক পর্যায়ে আমার কাঁধে মাথা রেখে নিশ্চিত মনে ঘুমালো। সকালে ঘুম ভাঙ্গলে শিলা বলে, বাবা তুমি একজন আদর্শ ও ভালো বাবা। জবাবে আমি বললাম, পৃথিবীতে অসংখ্য খারাপ মানুষ আছে, কিন্তু একজন খারাপ বাবাও নাই।

লেখক : এ.এস.এম. শফিকুর রহমান-সংগঠক ও সমাজকর্মী। মোবাইল ফোন : ০১৬৭০-৮৭৯৫৮৯

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়