প্রকাশ : ১১ জানুয়ারি ২০২২, ০৯:৪৫
শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষায় সচেতন হোন
তরুণ শিক্ষার্থীদেরকে বলা হয় একটি জাতির মূল চালিকা শক্তি ও ভবিষ্যতের প্রজন্মের কান্ডারি। একটি জাতির অস্তিত্ব রক্ষার পাশাপাশি নিরাপদ সমাজ বিনির্মাণ ও উন্নত রাষ্ট্র গঠনে তারুণ্যের মেধা ও কর্মের শক্তির বিকল্প নেই। বাংলাদেশে তরুণ শিক্ষার্থী সমাজের সাহসী ভূমিকার ইতিহাস বেশ সমৃদ্ধ। বাংলাদেশের মানুষের অধিকার সংরক্ষণের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন, মাতৃভাষা বাংলার আন্দোলন, স্বাধীনতা যুদ্ধ, স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতনসহ দেশের আপামর জনগণের মৌলিক অধিকারগুলোর স্বার্থ রক্ষায় সবসময় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সামরিক শাসন আমলে ছাত্র সমাজ একটি সংগঠিত আপোষহীন শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। জাতীয় সংকটে জনগণের অধিকার রক্ষার পাশাপাশি নিজেদের শিক্ষার মৌলিক অধিকারকেও তুলে ধরছে তারুণ্যে এই শক্তি। শিক্ষা কোনো সুযোগ নয় বরং অধিকার এই দাবি সকলের আগে ছাত্ররাই তুলে ধরেছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো স্বাধীনতা ৫০বছরেও শিক্ষার্থীদের মৌলিক অধিকার এখনো নিশ্চিত হয়নি।
বর্তমানে দেশের তরুণ শিক্ষার্থীদের প্রতি দৃষ্টিক্ষেপন করলে দেখা যায় তারা পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে লাঞ্চনা, নির্যাতন ও অবমূল্যায়নের শিকার হচ্ছে। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের আঙিনাগুলোতে কথিত নেতা, রাজনৈতিক দল ও স্থানীয় প্রভাবশালী লোক কর্তৃক প্রভাবিত হয়ে শিক্ষার্থীরা ভুল পথের দিকে ধাবিত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের হলে সীট পাওয়া নিয়ে জটিলতা, গণরুমের থাকার অযোগ্য পরিবেশ, হলের ডাইনিংগুলোতে অস্বাস্থ্যকর ও মানহীন খাবার, সেশনজটের জটিল সমীকরণ ইত্যাদি বিষয়গুলো শিক্ষার্থীদের মনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্থানীয় লোকদের আধিপত্য বিস্তারের ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নানান ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। আবার দেখা যায় স্থানীয় এসব লোকদের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ প্রশাসন নিজেই ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন শিক্ষার্থীদের ন্যায্য অধিকারের দাবিগুলোকে প্রতিহত করতে। ছাত্রীদের হলগুলোর সামনে এসব স্থানীয় ও কথিত ছাত্রনেতাদের বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গিতে ইভটিজিং ও হয়রানির ঘটনাগুলো এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাড়িয়েছে। প্রশাসন এসব বিষয় দেখেও যেন দেখে না। দেশের বেশিরভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শহর থেকে দূরে অবস্থিত হওয়ায় অথবা শিক্ষার্থীদের আবাসস্থল থেকে কলেজ দূরে হওয়ায় প্রতিনিয়ত তাদেরকে পাবলিক বাসে চড়ে আসতে হয়। প্রায়সময় বাসের ভাড়াকে কেন্দ্র করে বাসের মালিক-শ্রমিকের দ্বারা শিক্ষার্থীরা নির্যাতিত হয়। পাবলিক বাসে ও চলার পথে ছাত্রীরা যৌন হেনস্তার শিকার হোন। এমন অসংখ্য অপ্রত্যাশিত ঘটনা হরহামেশাই ঘটে চলছে তরুণ শিক্ষার্থীদের সাথে। বিশেষ করে বুয়েটের ছাত্র আবরার হত্যাকান্ড ও বিভিন্ন সময়ে শিক্ষার্থীদের উপর হামলার ঘটনাগুলো শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
সমাজের অন্যায়, অসংহতি, অপরাধ নিয়ে ছাত্রসমাজ যদি কথা না বলে সেটা জাতির জন্যই অমঙ্গল। আজকের ছাত্রসমাজ মাঝে যদি নীতি-নৈতিকতার ঘাটতি থাকে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার সৎ সাহস না থাকে, তাহলে কিভাবে জনসাধারণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের নৈতিক চেতনা জাগ্রত হবে? তরুণদের চেতনাগত ঘাটতি থাকার মানেই দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খল সমাজ ব্যবস্থার দিকে ধাবিত হওয়া। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে শিক্ষার্থীদের নৈতিক অবক্ষয় একটি জাতির নৈতিক ও আদর্শিক চেতনার অবক্ষয়।
শিক্ষার্থীরা নির্যাতন ও অবহেলার শিকার হওয়ার ফলে সমাজের মানুষের প্রতি বিরুপ মনোভাব সৃষ্টি হচ্ছে। এই অসন্তোষ মনোভাবের ফলাফল স্বরুপ দেখা যাবে যখন এই তরুণরা কর্মজীবনে পদার্পণ করবে তখন জনসাধারণের অধিকার আদায়ে ততটা সচেতন থাকার প্রয়োজনবোধ তাদের বিবেকে জাগ্রত হবে না। কেননা তরুণ বয়সে মানুষের মন হয়ে থাকে কাদামাটির মত তখন যে শিক্ষা পরিবার ও সমাজ ব্যবস্থা থেকে পায়, সেই শিক্ষার প্রতিফলনই কর্মজীবনে গিয়ে প্রকাশিত হয়। এই জন্যই বলা হয়, শিক্ষার্থীরা হলো একটা জাতির শক্তি আর এই শক্তিকে যেভাবে পরিচর্যা করা হবে তা সেই ভাবেই আলো দিবে। অথচ দেশে প্রতিনিয়তই বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোর তরুণ শিক্ষার্থীরা নির্যাতন ও প্রতিহিংসার শিকার হচ্ছে। এরকম নির্যাতন ও অবমূল্যায়নের পিছনে উদ্দেশ্য কি তা আমাদের ভাবতে হবে। এটা কি বিশেষ কোনো ব্যক্তিকেন্দ্রিক ষড়যন্ত্র যারা সুন্দর ও স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে কখনোই চাই না, নাকি কোন গোষ্ঠীর যারা বাংলাদেশের বর্তমান সামগ্রিক উন্নতির অগ্রযাত্রাকে রোধ করতে চায়? কারণ ষড়যন্ত্রকারীরা ভালোভাবেই জানে সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চাইলে তরুণ শিক্ষার্থীদের মনে অবহেলা বা বিশৃঙ্খলার চাপ সৃষ্টি করতে হবে। একটা বিষয় সর্বজনীন স্বীকৃত যে, আজকের বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি এবং প্রাণ উজাড় করে বাংলা ভাষায় কথা বলার পিছনের অন্যতম শক্তি ও চেতনা হিসেবে কাজ করেছে এই তরুণ শিক্ষার্থী সমাজ।
একটা বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে দেশের এই তরুণ শিক্ষার্থীদের থেকে শুধু উন্নত নাগরিকই নয়, বরং দেশ পরিচালনার নেতা, আমলা থেকে শুরু করে উচ্চস্তরের নানান পেশাজীবী তৈরি হয়। তাদের সার্বিক নিরাপত্তা ও মৌলিক অধিকার নিয়ে বারবার যদি প্রশ্ন উঠে তাহলে সরকার কোন আলো নিয়ে দেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখবে। শিক্ষার্থীরা এদেশের সর্বস্তরের মানুষের জন্য সন্তানতুল্য সম্পদ ও ভবিষ্যত বাংলাদেশের চালিকা শক্তি। আজকের শিক্ষার্থীরাই আগামীর বাংলাদেশ নেতৃত্ব ও দেশ পরিচালনার মাঝি হিসেবে কাজ করবে। তাদের সুপ্ত মনে যদি অবহেলা ও নির্যাতনের চাপ পড়তে থাকে তাহলে তারা যখন দেশ পরিচালনার দায়িত্বে অর্পিত হবে, তখন তাদের অবহেলিত মনোভাবের প্রভাব জনসাধারণের উপরেই পড়বে। কারণ মানুষের মনের কষ্ট ও শোষণের স্মৃতি সহজেই মুছে যায় না। শিক্ষার্থীদের সাথে ঘটতে থাকা এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলোর সুষ্ঠু বিচারব্যবস্থাই পারে সমাজের বিচারহীনতার সংস্কৃতি দূর করে শান্তিপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে। কারণ আজকের শিক্ষার্থীরা যখন প্রত্যক্ষ করবে যে সমাজে অন্যায়ের যথার্থ শাস্তি হচ্ছে তখন তারা এখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে ভবিষ্যৎ কর্মজীবনে ন্যায় বিচার বাস্তবায়নে উদ্বুদ্ধ হবে। তাই আমাদের সবার উচিত শিক্ষার্থীদের প্রতি সদয় হওয়া, তাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে সহযোগী হয়ে কাজ করা, নিরাপদ শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাদেরকে নির্যাতন ও অবহেলা থেকে নিরাপদ রাখার ব্যাপারে সচেতন থাকা।
লেখক : মুরাদ হোসেন, শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও সাংগঠনিক সম্পাদক, চাঁদপুর জেলা স্টুডেন্টস' এ্যাসোসিয়েশন- চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ইমেইল : [email protected], মোবাইল : 01521795832