শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।
  •   রাষ্ট্রীয় পদে আসীন হচ্ছেন খবরে আসামিপক্ষে শুনানি করলেন না সমাজী।

প্রকাশ : ২৮ মে ২০২৪, ২১:২৩

চাঁদপুরে ঘূর্ণিঝড় রেমালের ভয়াবহ তাণ্ডব

শহর রক্ষাবাঁধে ব্যাপক ভাঙ্গন, আতঙ্কে এলাকাবাসী

মিজানুর রহমান
চাঁদপুরে ঘূর্ণিঝড় রেমালের ভয়াবহ তাণ্ডব

রোববার রাত আটটার দিকে উপকূলে আছড়ে পড়ার ব্যাপক তাণ্ডব চালাতে শুরু করে রেমাল। আঘাত হানার পর কিছুটা দুর্বল হয়ে স্থল নিম্নচাপে রূপ নিলেও প্রায় ৩৬ ঘণ্টা বাংলাদেশের ভূখণ্ডে অবস্থান করে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি চালায়। এর প্রভাব থেকে বাদ যায়নি নদীবেষ্টিত উপকূলীয় জেলা চাঁদপুর।

সোমবার বিকেল হতে রাত ১০টা পর্যন্ত প্রায় ৭ ঘণ্টা ধরে চলে মেঘনার ঢেউয়ের তাণ্ডব। নদীর পানি অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে জোয়ার-জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয় শহর রক্ষাবাঁধের আটটি পয়েন্টের প্রায় কয়েকশ’ মিটার এলাকা। বসতঘর, গোয়ালঘর, মসজিদ মাদ্রাসা মন্দিরসহ বিভিন্ন স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে সোমবার সকাল থেকে চাঁদপুরের উপর দিয়ে তুমুল ঝড় বৃষ্টি বয়ে যায়। চাঁদপুরে পদ্মা-মেঘনা নদী সাগরের মত উত্তাল হয়ে বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ে শহর রক্ষাবাঁধ ও নদী তীরবর্তী এলাকায় ব্যাপক তাণ্ডব চালিয়েছে।

এদিনের প্রবল ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে চাঁদপুর শহর রক্ষাবাঁধের পুরাণবাজার রনাগোয়াল হতে হরিসভা, বাকালিপট্টি, দোলমন্দির পর্যন্ত ১৬৫ মিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাঁধের পাশে থাকা ১০-১৫টি বসতঘর, গোয়ালঘর ও দুটি মন্দিরের অংশ বিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাব ও নিম্নচাপ কেটে যাবার পর নদী ভাঙ্গনসহ বিভিন্ন স্থাপনার ক্ষতির চিহ্ন ফুটে উঠেছে। ২৭ মে সোমবার বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত মেঘনা নদীর বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ে চাঁদপুর শহর রক্ষাবাঁধের ওপর। যা সমুদ্রের ঢেউও হার মেনেছে এখানে। গতকাল মঙ্গলবার সকালে নদী এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে রেখে যাওয়া ক্ষত চিহ্ন ফুটে ওঠে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের স্থানীয় প্রতিনিধি, এমনকি চাঁদপুর পৌরসভার মেয়রও ছুটে আসেন নদীর ভাঙ্গন স্থান দেখার জন্য।

স্থানীয়রা জানান, সোমবার বিকেল থেকে এসব পদ্মা মেঘনা নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়। এ সময় তীব্র ঝড়ো বাতাসের সঙ্গে বড় বড় ঢেউ চাঁদপুর শহর রক্ষাবাঁধে আঘাত এনে নদী ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয়ে। বিশেষ করে পুরাণবাজার রনাগোয়াল, হরিসভা, পুরাতন ফায়ার সার্ভিস, মাছবাজার, বাকালী পট্টি, রামঠাকুর দোলমন্দির ও বাজার সংলগ্ন তালুকদার বাড়ির প্রায় ১০ থেকে ১৫টি বসতঘর মেঘনার প্রবল ঢেউয়ের তোড়ে ভেঙে নদীতে তলিয়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে আরও অনেক পরিবার ঘর-বাড়ি ছেড়ে মালপত্র সরিয়ে নিয়েছে। চাঁদপুর পৌর প্যানেল মেয়র মোহাম্মদ আলী মাঝি বলেন, বিকেল ৩টার পর মেঘনা নদী ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে। এলাকাবাসী জানান, এমন ঢেউ আমরা আগে কখনো দেখেনি। পৌরসভার সাবেক কমিশনার নজু বেপারী জানান, এই ঝড়ের কারণে পুরাণবাজার হরিসভা এলাকার মন্টু গাজীর ভাড়াটিয়া বাবুল ঢালীর বসতঘর ও মাংস ব্যবসায়ী শাহাদাতের বসতঘর, গরুর খামার নদীতে বিলীন হয়। তার দুটি গরু নিখোঁজ হয়। ক্ষতিগ্রস্ত নদীর পাড়ের পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়ানোর জন্যে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়েছে। এদিকে এই খবর পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজন বালিভর্তি জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন রোধের চেষ্টা চালায়।

এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ড, চাঁদপুর পওর বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী জহুরুল ইসলাম বলেন, ঘূর্ণিঝড় রেমেলের প্রভাবে মেঘনা নদীতে জোয়ারে পানি বৃদ্ধি পেয়ে জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয় এবং প্রবল বেগে দমকা ঝড়ো বাতাস বয়ে যায়। এতে সাগরের মত বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ে বাঁধের উপর।

চাঁদপুর শহর রক্ষাবাঁধের পুরাণবাজার অংশের ৮টি পয়েন্টের প্রায় ১৬৫ মিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত জায়গাগুলো সংরক্ষণে পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজন বালিভর্তি জিওব্যাগ ফেলে ভাঙ্গন রোধে কাজ শুরু করছেন।

ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী চাঁদপুর চেম্বার অব কমার্সের সিনিয়র পরিচালক সালাহ উদ্দিন মোঃ বাবর জানান, নদীর পাড় তাদের জায়গার ওপর বাবা-মায়ের নামে একটি মাদ্রাসা করা হয়। সেটি জলোচ্ছ্বাস ঢেউয়ের আঘাতে প্রায় পাঁচ থেকে ছয় লক্ষ টাকার ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে।

পাশের আরেকজন ব্যবসায়ী গিয়াসউদ্দিন চৌধুরী বলেন, রাত এগারোটা পর্যন্ত তিনি তার সরিষা তেলের মিলের ভেতর ছিলেন এবং দেখেছেন অনবরত ঢেউয়ের তাণ্ডব। ঢেউ সুনামিতে বা উত্তাল সাগরে হতে দেখেছেন। তার মিলের পেছনের অনেক সিসি ব্লক দেবে গেছে।

বাকালী পট্টির মাংস ব্যবসায়ী সাহাদাত জানান, তার বসতঘর, গোয়াল ঘরের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। গোয়াল ঘরের দুটি গবাদি পশুর এখনো খোঁজ পাননি।

হরিসভা জগন্নাথ মন্দিরের পরিচালনা কমিটির সহদেব ডাক্তার জানান, এই ঝড়ের তাণ্ডবে হরিসভা মন্দির এলাকার দুটি মন্দির ও ৮-১০টি বসত ঘরের অনেক ক্ষতি হয়েছে।

কার্তিক সাহা বলেন, বর্ষা এলে প্রতি বছর নদীতে ভাঙ্গন দেখা দেয়। এরই মধ্যে অনেকেই বসতভিটা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। ভাঙ্গন দেখা দিলে কর্মকর্তারা আসেন নদীতে বালির বস্তা ফেলতে। আমরা স্থায়ী সমাধান চাই। যে পরিস্থিতি, রাতে বাড়ি-ঘর টেকে কি-না শঙ্কিত।

ক্ষতিগ্রস্ত সাবিত্রি সাহা ও সবিতা সাহা বলেন, ঘর ভাঙ্গনের আর কিছু নেই। আমরা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত। বাঁধ ভাঙ্গার কারণে এবারও ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরকারের কাছে দাবি করছি, এখানে যাতে দ্রুত স্থায়ী বাঁধ করা হয়।

২৮ মে মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টায় গিয়ে দেখা যায়, শহরের পুরাণবাজার হরিসভা মন্দির ও বাকালি পট্টি এলাকাসহ কটি স্থানে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। ভাঙ্গন স্থানে শ্রমিকরা জিও টেক্সটাইল ব্যাগ ফেলা অব্যাহত রেখেছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীসহ অন্য কর্মকর্তারা কাজের তদারকি করছেন।

খবর পেয়ে ভাঙ্গন স্থান পরিদর্শন করেছেন চাঁদপুর পৌরসভার মেয়র জিল্লুর রহমান জুয়েল। তিনি বলেন, স্থানীয় সংসদ সদস্য ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি এমপির পক্ষ থেকে আমি ভাঙ্গন কবলিত এলাকার মানুষের কাছে ছুটে এসেছি। নদী ভাঙ্গনে পুরাণবাজার এলাকায় ১০-১২টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদেরকে সহযোগিতা করা হবে। আপনারা জানেন, আমাদের মন্ত্রী মহোদয়ের প্রচেষ্টায় চাঁদপুর শহর রক্ষায় এখানে স্থায়ী বাঁধ হবে, সেটির টেন্ডার প্রক্রিয়া চলছমান আছে। ৮২৭ কোটি টাকার শহররক্ষা বাঁধ প্রকল্পটি হয়ে গেলে আর আমাদের মধ্যে আতঙ্ক থাকবে না।

জেলা প্রশাসক কামরুল হাসান বলেন, পুরাণবাজার শহর রক্ষা বাঁধে ভাঙ্গনের খবর পেয়েছি। এরই মধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজন ভাঙ্গন রোধে কাজ শুরু করেছে। ভাঙ্গন রোধে প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থাগ্রহণ করা হবে। আশাকরি, বড় ধরনের কোনো সমস্যা হবে না।

এদিকে, ঘূর্ণিঝড় রেমালের কারণে চাঁদপুরে গ্রামীণ রাস্তাঘাটের অনেক ক্ষতি হয়েছে। বহু গাছপালা উপড়ে পড়েছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বসতঘরের চালা উড়ে গেছে। চাঁদপুর থেকে লঞ্চ ও ফেরি চলাচল বন্ধ ছিলো দুদিন। প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল চাঁদপুরবাসী।

স্থানীয় আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানানো হয়, সোমবার বিকেল ৩টা হতে রাত ৯টা পর্যন্ত চাঁদপুর জেলায় ১০১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আর সকালে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ৭২ মিলিমিটার। দুপুর আড়াইটার পর থেকে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিলো ঘণ্টায় ৩১ নটিক্যাল মাইল বা ৫৭ কিলোমিটার।

এদিকে, শতভাগ বিদ্যুৎ সংযোগ চালু না হওয়ায় চাঁদপুরের জেলা প্রশাসকের চিঠির আলোকে ঘূর্ণিঝড় রেমালের কারণে ২৭ মে সোমবার সারাদিন চাঁদপুর জেলায় ভারী বৃষ্টিপাত এবং ঝড়ো হাওয়ায় গাছ উপড়ে ফরিদগঞ্জ ও কচুয়া উপজেলায় বিদ্যুৎ লাইনে ব্যাপক ক্ষতি হয়। সোমবার সারাদিন চাঁদপুর জেলায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন ছিল। এমতাবস্থায় কচুয়া ও ফরিদগঞ্জ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন সূত্রে এ তথ্য জানানো হয়।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়