প্রকাশ : ০৯ নভেম্বর ২০২১, ২২:২৪
সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার ১১ বছরের কারাদণ্ড
জালিয়াতির মাধ্যমে ফারমার্স ব্যাংক থেকে চার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাতের মামলায় সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে (এস কে সিনহা) ১১ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। ৯ নভেম্বর মঙ্গলবার ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ এর বিচারক শেখ নাজমুল আলম এই রায় দেন। একই মামলায় অন্যান্য আট আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। দুজনকে খালাস দেওয়া হয়েছে।
|আরো খবর
বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম সাবেক কোন বিচারপতিকে দুর্নীতির দায়ে কারাদণ্ড দেওয়া হলো। মানি লন্ডারিং আইনে সাত বছরের কারাদণ্ড এবং অর্থ আত্মসাতের দায়ে চার বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয় এসকে সিনহাকে। তবে উভয় সাজা একসঙ্গে চলবে বলে আদালত রায়ে উল্লেখ করেছেন। এ কারণে সাত বছরের সাজা খাটতে হবে এসকে সিনহা কে।
এস কে সিনহার বিরুদ্ধে দুদকের আরও এক মামলাএস কে সিনহার বিরুদ্ধে দুদকের আরও এক মামলা। এস কে সিনহাসহ চারজন পলাতক থাকায় তাদের অনুপস্থিতিতে রায় ঘোষণা করা হয়। আদালত রায়ে উল্লেখ করেন, তারা গ্রেপ্তার হওয়ার পর অথবা আদালতে আত্মসমর্পণ করার পর তাদের ক্ষেত্রে এই রায় কার্যকর হবে।
আসামিদের মধ্যে ফারমার্স ব্যাংকের (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) অডিট কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী ওরফে বাবুল চিশতীকে অভিযোগ কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয়। জামিনপ্রাপ্ত অন্যান্য আসামি আদালতে হাজির ছিলেন। মামলার অপর আসামিরা হলেন-ফারমার্স ব্যাংকের (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) সাবেক ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট স্বপন কুমার রায়, ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট সাফিউদ্দিন আসকারী, ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. লুৎফুল হক, টাঙ্গাইলের বাসিন্দা মো. শাহজাহান, একই এলাকার নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা, রনজিৎ চন্দ্র সাহা ও তার স্ত্রী সান্ত্রী রায়।
মোহাম্মদ শাহজাহান ও নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা খালাস পেয়েছেন। ২০১৯ সালের ১০ জুলাই ঋণ জালিয়াতি ও চার কোটি টাকা আত্মসাতে জড়িত থাকার অভিযোগে এস কে সিনহাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়, ঢাকা-১ এ মামলা করা হয়। মামলার বাদী দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন।
২০১৯ সালের ১০ ডিসেম্বর আদালতে এস কে সিনহাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা দুদকের পরিচালক বেনজীর আহমেদ। ২০২০ সালের ১৩ আগস্ট ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ এর বিচারক শেখ নাজমুল আলম এস কে সিনহাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে অসৎ উদ্দেশ্যে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ফারমার্স ব্যাংকে ভুয়া ঋণ সৃষ্টি করে সেই টাকা বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর, উত্তোলন ও পাচার করেছেন, যা দণ্ডবিধির ৪০৯ / ৪২০ / ১০৯ ধারা, ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারা এবং ২০১২ সালের মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ৪ (২) (৩) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
মামলার বিবরণে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর আসামি শাহজাহান ও নিরঞ্জন চন্দ্র ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখায় আলাদা দুইটি অ্যাকাউন্ট খোলেন। ব্যবসা বাড়ানোর জন্য পরদিন তারা ওই ব্যাংক থেকে দুই কোটি টাকা করে মোট চার কোটি টাকা ঋণের আবেদন করেন।
তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং ঋণের আবেদনে উত্তরার ১০ নম্বর সেক্টরের ১২ নম্বর রোডের ৫১ নম্বর বাড়ির ঠিকানা ব্যবহার করা হয়, যার মালিক ছিলেন তখনকার প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা। ঋণের জামানত হিসেবে আসামি রনজিৎ চন্দ্রের স্ত্রী সান্ত্রী রায়ের নামে সাভারের ৩২ শতাংশ জমির কথা উল্লেখ করা হয় ঋণের আবেদনে। ওই দম্পতি এস কে সিনহার পূর্ব পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ বলে উল্লেখ করা হয়েছে মামলার এজাহারে।
ব্যাংকটির তৎকালীন এমডি এ কে এম শামীম কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই, ব্যাংকের নিয়ম-নীতি না মেনে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঋণ দুটি অনুমোদন করেন। মামলার এজাহারে বলা হয়, ৭ নভেম্বর ঋণের আবেদন হওয়ার পর 'অস্বাভাবিক দ্রুততার' সঙ্গে তা অনুমোদন করা হয়। পরদিন মোট চার কোটি টাকার দুটি পে-অর্ডার ইস্যু করা হয় এস কে সিনহার নামে। ৯ নভেম্বর সোনালী ব্যাংকের সুপ্রিম কোর্ট শাখায় এস কে সিনহার অ্যাকাউন্টে জমা হয়।
পরে বিভিন্ন সময়ে ক্যাশ, চেক ও পে-অর্ডারের মাধ্যমে ওই টাকা উত্তোলন করা হয়। এর মধ্যে এস কে সিনহার ভাইয়ের নামে শাহজালাল ব্যাংকের উত্তরা শাখার অ্যাকাউন্টে দুটি চেকে দুই কোটি ২৩ লাখ ৫৯ হাজার টাকা স্থানান্তর করা হয় ওই বছরের ২৮ নভেম্বর।
এজাহারে আরও বলা হয়, আসামি রনজিৎ চন্দ্র ঋণ দ্রুত অনুমোদনের জন্য প্রধান বিচারপতির প্রভাব ব্যবহার করেন। রনজিৎ চন্দ্রের ভাতিজা হলেন ঋণ গ্রহীতা নিরঞ্জন এবং অপর ঋণ গ্রহীতা শাহজাহান ও রনজিৎ ছোটবেলার বন্ধু। ঋণ গ্রহীতা দুইজনই অত্যন্ত গরিব ও দুস্থ। তারা কখনও ব্যবসা-বাণিজ্য করেননি।
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় এবং কিছু পর্যবেক্ষণের কারণে ক্ষমতাসীনদের তোপের মুখে ২০১৭ সালের অক্টোবরের শুরুতে ছুটিতে যান তখনকার প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা। প্রথমে অস্ট্রেলিয়া যান। তারপর সিঙ্গাপুরে যান। সেখান থেকেই তিনি পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন। দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করে আসা বিচারপতি সিনহা যুক্তরাষ্ট্রে বসেই ২০১৮ সালে একটি বই প্রকাশ করেন। তাতে তিনি দাবি করেন, তাকে ‘পদত্যাগে বাধ্য করে নির্বাসনে’ পাঠানো হয়েছে।
ওই বছর ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে আবেদন করেছিলেন এস কে সিনহা। নিউ জার্সিতে ছোট ভাই অনন্ত কুমার সিনহার নামে কেনা একটি বাড়িতেই সে সময় তিনি থাকছিলেন। পরে ২০১৯ সালের জুলাই মাসে খবর আসে সিনহা যুক্তরাষ্ট্র থেকে কানাডায় গিয়ে সেখানে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন। বিচারপতি সিনহা ছুটি নিয়ে বিদেশ যাওয়ার পর তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থ পাচার, আর্থিক অনিয়ম ও নৈতিক স্খলনসহ সুনির্দিষ্ট ১১টি অভিযোগ পাওয়ার কথা সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল। বাকি বিষয়গুলো নিয়ে পরে আর কোনো অগ্রগতি হয়নি।