সোমবার, ২১ এপ্রিল, ২০২৫  |   ৩০ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ইউসুফ গাজী গ্রেফতার

প্রকাশ : ২১ এপ্রিল ২০২৫, ১৮:০১

কথার বাইরে ফাইল নড়ত না’: চাঁদপুর পৌরসভায় একচ্ছত্র ক্ষমতার ‘মাফিয়া’ সিন্ডিকেট?

বিশেষ অনুসন্ধানী প্রতিবেদক
কথার বাইরে ফাইল নড়ত না’: চাঁদপুর পৌরসভায় একচ্ছত্র ক্ষমতার ‘মাফিয়া’ সিন্ডিকেট?
ছবি : সংগৃহীত

চাঁদপুর পৌরসভার ‘আয় বহির্ভূত সম্পদ সাম্রাজ্য’: তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান, একে একে বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য

নিজস্ব প্রতিবেদক, চাঁদপুর | বিশেষ প্রতিবেদন

চাঁদপুর শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত পৌরসভা, যেখানে সাধারণ নাগরিকের নাগরিক সেবার প্রত্যাশা সবচেয়ে বেশি। অথচ এই প্রতিষ্ঠানের তিন প্রভাবশালী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সম্প্রতি আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধান শুরু হওয়ায় জনমনে প্রশ্ন উঠেছে—এতদিন ধরে কীভাবে তারা থেকে গেলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে?

দুদকের সূত্র বলছে, অভিযুক্ত কর্মকর্তারা হলেন—নির্বাহী কর্মকর্তা আবুল কালাম ভূঁইয়া, প্রশাসনিক কর্মকর্তা মফিজ উদ্দিন হাওলাদার, এবং নগর পরিকল্পনাবিদ সাজ্জাদ ইসলাম। অভিযোগ অনুযায়ী, দীর্ঘদিন ধরে এই কর্মকর্তারা দুর্নীতি, ঘুষ ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ গড়ে তুলেছেন


‘চিঠি গেছে, তদন্ত শুরু’—দুদকের দৃঢ় অবস্থান

দুদক চাঁদপুর কার্যালয়ের সদ্য বিদায়ী উপপরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম জানান,

“আমার দায়িত্বকালে পৌরসভার তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আয়বহির্ভূত সম্পদের অভিযোগ আসে। যাচাই-বাছাই শেষে তাদের সম্পদের বিবরণী চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়।”

চিঠি পাওয়ার পর আবুল কালাম ভূঁইয়ামফিজ উদ্দিন হাওলাদার নিজেদের সম্পদের বিবরণী জমা দিলেও সাজ্জাদ ইসলাম এখন পর্যন্ত কোনোরকম সাড়া দেননি


আবুল কালাম ভূঁইয়ার ‘দেড় যুগের সাম্রাজ্য’

প্রায় দেড় যুগ ধরে নির্বাহী কর্মকর্তা পদে থেকে পৌরসভার অনেক কিছুই তার নিয়ন্ত্রণে ছিল। সূত্র জানায়, তার অধীনে পৌরসভার প্রকল্প অনুমোদন, টেন্ডার, ইজারা ও জনবল নিয়োগসহ সবকিছুতে ছিল তার প্রভাব।

“কালাম সাহেবের কথার বাইরে কোনো ফাইল নড়ত না। তাকে বাদ দিয়ে চাঁদপুর পৌরসভার কোনো বৈঠক কল্পনা করা যায় না।”

তার নামে ও পরিবারের সদস্যদের নামে রয়েছে চাঁদপুর শহরে ও ঢাকায় একাধিক ফ্ল্যাট, গাড়ি ও জমি। অথচ সরকারি নথি অনুযায়ী তার সর্বোচ্চ মাসিক বেতন ৮০ হাজার টাকা

দুদকে জমা দেওয়া সম্পদ বিবরণীতে তিনি কিছু সম্পত্তির উল্লেখ করলেও অনেক কিছু গোপন করেছেন বলে সন্দেহ করছেন তদন্তকারীরা। একটি সূত্র জানায়, তার স্ত্রী এবং সন্তানদের নামে কিছু ব্যাংক একাউন্ট ও ফ্ল্যাটের খোঁজ মিলেছে, যা তিনি বিবরণীতে উল্লেখ করেননি।


মফিজ উদ্দিন হাওলাদার: ‘বহুতল বাড়ি ছাড়া আর কিছু নেই’—এই দাবি কি সত্যি?

প্রায় দুই যুগ ধরে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মফিজ হাওলাদার। তার দাবি,

“শহরের পালপাড়ায় একটি বহুতল বাড়ি ছাড়া আমার কোনো উল্লেখযোগ্য সম্পদ নেই।”

কিন্তু অনুসন্ধানে উঠে এসেছে ভিন্ন চিত্র। জানা গেছে, তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের নামে রক্ষিত রয়েছে অন্তত চারটি প্লট—যার মধ্যে দুটি ঢাকার বাড্ডা ও কুড়িল এলাকায়

এছাড়া, তিনি বিভিন্ন প্রকল্প অনুমোদন ও জনবল নিয়োগে ঘুষ লেনদেনের মধ্যস্থতাকারী হিসেবেও কাজ করতেন। হকার লাইসেন্স অনুমোদনের ক্ষেত্রেও ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

“পৌর ভবনের সব দরজার চাবি যেন তার পকেটে থাকত। টাকা ছাড়া কোনো ফাইল সরতো না।”


সাজ্জাদ ইসলাম: নীরবতা কি অপরাধ ঢাকতে?

সবার মধ্যে সবচেয়ে সন্দেহজনক আচরণ করছেন নগর পরিকল্পনাবিদ সাজ্জাদ ইসলাম। তিনি দুদকের চিঠির জবাব দেননি, সম্পদ বিবরণীও জমা দেননি

“যে কর্মকর্তা সম্পদের বিবরণী জমা না দিয়ে নীরব থাকেন, সেখানে নিশ্চয়ই লুকোচুরি আছে।”

স্থানীয়রা বলছেন, তিনি নির্মাণ অনুমোদন ও জোন প্ল্যান ভাঙার মাধ্যমে মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। তার নাম জড়িয়েছে একাধিক বহুতল আবাসিক প্রকল্পের সঙ্গে।


চাঁদপুর শহরের মানুষের চোখ খুলেছে

এই অনুসন্ধান শুরুর পর শহরের মানুষ যেন দীর্ঘদিনের এক সন্দেহের সত্যতা খুঁজে পাচ্ছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হক বলেন,

“আমরা এতদিন জানতাম না পৌরসভায় কীভাবে এত দুর্নীতি হয়। এখন একটু একটু করে বুঝছি।”

নগর উন্নয়নের নামে পরিকল্পনাহীন রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, নিম্নমানের ইট-বালু ব্যবহার, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা—সবকিছুই এখন প্রশ্নবিদ্ধ।


প্রশাসক বলছেন ‘ব্যক্তিগত বিষয়’, নাগরিকরা বলছেন ‘জনস্বার্থের প্রশ্ন’

চাঁদপুর পৌর প্রশাসক গোলাম জাকারিয়া বলেন,

“যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হয়েছে, বিষয়টি তাদের নিজস্ব ব্যাপার। আমি তাদের ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ড সম্পর্কে কিছু বলবো না।”

কিন্তু নাগরিকদের মতে, “এটি মোটেও ব্যক্তিগত বিষয় নয়। জনগণের অর্থ, নাগরিক সেবা ও স্বচ্ছতার প্রশ্ন এটি।”


দুদকের পরবর্তী ধাপ কী?

দুদক সূত্র জানায়, তিনজনের সম্পদের খতিয়ান যাচাইয়ে এখন কাজ করছে বিশেষ টিম। তারা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, রেজিস্ট্রি অফিস, শেয়ার বাজার ও এনবিআরের তথ্য সংগ্রহ করছে।

যদি তারা মিথ্যা বা গোপন তথ্য দেন, তাহলে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর অধীনে মামলার প্রস্তুতি নেওয়া হবে।


উপসংহার: জনতার প্রশ্ন—‘এতদিন কে পাহারা দিচ্ছিল দুর্নীতিবাজদের?’

পৌরসভার মতো একটি জনগণের প্রতিষ্ঠান যদি এভাবে লুটপাটে পরিণত হয়, তাহলে সাধারণ নাগরিক কোথায় যাবেন? কে দেখবে এসব দুর্নীতির হিসাব?

একজন প্রবীণ সাংবাদিক বলেন,

“এটা একদিনে হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে একই কর্মকর্তারা একই পদে থেকে ‘মাফিয়া প্রশাসন’ গড়ে তুলেছে। এখনই সময় ভাঙার।”


“একই পদে ১৫-২০ বছর থেকে কেউ যদি সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে, তার উৎস জনগণের জানার অধিকার আছে।” —সামাজিক আন্দোলনকারীর বক্তব্য

ডিসিকে/ এমজেডএইচ

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়