প্রকাশ : ১৬ এপ্রিল ২০২৫, ১৬:৩৭
"হুমকির ভয়ে বাঘও বানাতে পারিনি": পোড়া ভিটেয় শিল্পীর হাহাকার!
চারুকলার 'ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি' নিয়ে বিতর্কিত মোটিফ: শিল্পীর বাড়িতে আগুন, পুড়লো ৩০ শিল্পকর্ম

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের পহেলা বৈশাখের বর্ষবরণ শোভাযাত্রাকে ঘিরে তৈরি হওয়া 'ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি' মোটিফ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে চলমান বিতর্ক এক ভয়াবহ মোড় নিয়েছে। ওই মোটিফ তৈরির অভিযোগে শিল্পী মানবেন্দ্র ঘোষের বাড়িতে মধ্যরাতে আগুন দিয়েছে একদল দুর্বৃত্ত। এতে পুড়ে গেছে তার বহু মূল্যবান শিল্পকর্ম ও ঘরবাড়ি।
|আরো খবর
মঙ্গলবার দিবাগত রাত আনুমানিক ৩টার দিকে মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার গড়পাড়া বাজার এলাকার নিজ বাড়িতে এই অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে বলে নিশ্চিত করেছেন ভাস্কর মানবেন্দ্র ঘোষ নিজেই।
"আমি বানাইনি ফ্যাসিবাদের মুখ, আমি বানিয়েছি বাঘ"
ঘটনার পর বিবিসি বাংলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মানবেন্দ্র ঘোষ বলেন, “আমি ওই ফ্যাসিবাদের মুখ বানাইনি। আমি দায়িত্বে ছিলাম বাঘের মোটিফ বানানোর। হুমকির ভয়ে আমি সেটাও মনোযোগ দিয়ে বানাতে পারিনি।”
তিনি জানান, বর্ষবরণ শোভাযাত্রায় তিনি শুধু বাঘের মোটিফে কাজ করেন। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে তার বিরুদ্ধে 'ফ্যাসিবাদের মুখ বানানোর’ অপবাদ দিয়ে নানারকম হুমকি দেওয়া হচ্ছিল।
হুমকি পাওয়ার কারণে গতকাল রাতেই তিনি মানিকগঞ্জ থানায় গিয়ে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। কিন্তু জিডি করে বাড়ি ফেরার কয়েক ঘণ্টার মাথায় তার বাড়ির একটি স্টুডিও ঘরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
পুড়ে গেছে শিল্পের স্মৃতিআগুনে তার প্রায় ৩০টিরও বেশি শিল্পকর্ম পুড়ে গেছে কিংবা চিরতরে বিকৃত হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন মানবেন্দ্র ঘোষ।
“আমি পাঁচ বছর ধরে এই বাড়িতে ছিলাম। ঢাকায় স্টুডিও ছেড়ে এখানে স্থায়ীভাবে শিল্পচর্চা করছিলাম। ওই পাকা টিনশেড ঘরটা ছিল আমার স্টুডিও। ঘরে ছিল আমার বহু বছরের স্মৃতি আর শিল্পকর্ম,” বলেন তিনি।
তিনি আরো জানান, আগুনে তাদের গবাদিপশুও আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। প্রথমে আগুনের গন্ধ পান গরুর দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা কর্মচারী। তিনিই পরিবারের সদস্যদের ডেকে তোলেন। কিন্তু ততক্ষণে আগুনে ঘরটির সবকিছু ছাই হয়ে যায়। প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া: "তদন্ত শুরু, সন্দেহভাজন শনাক্ত"
ঘটনার পরপরই স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সক্রিয় হয়। মানিকগঞ্জের পুলিশ সুপার মোছা. ইয়াসমিন খাতুন জানিয়েছেন, “আমরা ইতোমধ্যেই একজন সন্দেহভাজনকে শনাক্ত করেছি। তার জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। তদন্তের স্বার্থে তার নাম প্রকাশ করছি না।”
তিনি বলেন, “ভুক্তভোগীদের পক্ষ থেকে মামলা করার প্রস্তুতি চলছে। ঘটনা তদন্তে পুলিশের একটি বিশেষ দল কাজ শুরু করেছে। কারও জড়িত থাকার প্রমাণ মিললে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
সরকার বলছে: 'জুলাইয়ে বিতাড়িত আওয়ামী লীগের উসকানি'বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেন, “গত কয়েকদিন ধরে জুলাইয়ে বিতাড়িত আওয়ামী লীগ অনলাইনে মানবেন্দ্র ঘোষকে আক্রমণের উসকানি দিয়ে আসছিল তাদের ভাষ্য অনুযায়ী ‘হাসিনার এফিজি’ বানানোর অপরাধে। এদের প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনা হবে।”
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকেও এ বিষয়ে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়, “মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িটি পুনর্নির্মাণে উদ্যোগ নেওয়া হবে। তদন্ত শেষে দোষীদের আইনের আওতায় আনা হবে।”
থানার ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ?এই ঘটনায় মানিকগঞ্জ সদর থানার ওসি আমান উল্লাহর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এ নিয়ে স্থানীয়ভাবে প্রশ্ন উঠেছে, থানায় জিডি করার পরপরই যদি এমন ঘটনা ঘটে, তবে নিরাপত্তার ভূমিকা নিয়ে ভাবনার অবকাশ আছে।
শিল্পীর পাশে দাঁড়ানোর আহ্বানঘটনার পর থেকেই সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, ভিন্ন মত, ব্যঙ্গ কিংবা প্রতীকী প্রতিবাদের জায়গায় এমন আক্রমণ কোনো গণতান্ত্রিক সমাজে কল্পনাও করা যায় না।
সুশীল সমাজের অনেকে বলছেন, এই ঘটনা শুধু একটি শিল্পীর ঘরে আগুন লাগানোর ঘটনা নয়— এটি শিল্প, স্বাধীনতা ও প্রতীকী প্রতিবাদের ওপর একটি পরিকল্পিত আগ্রাসন।
"আগুনে ঘরটা তো গেছেই, সাথে অনেক মূল্যবান তৈজসপত্র ও স্মৃতিও গেছে।" — মানবেন্দ্র ঘোষ, ভাস্কর
ডিসিকে/এমজেডএইচ