প্রকাশ : ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯:০৪
মেঘনায় জাহাজে ৭ খুন পরিকল্পিত : দাবি স্বজনদের
এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড ধরেই আমরা এগুচ্ছি : নৌ এসপি।। লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর
হাইমচরে মেঘনা নদীর ঈশানবালা মাঝেরচর এলাকায় সারভর্তি জাহাজ এমভি আল-বাখেরার মাস্টার ও সুকানিসহ ৭জনকে কুপিয়ে খুনের ঘটনাটি কেউ কেউ ডাকাতি বললেও স্বজনদের দাবি, এটি একটি পরিকল্পিত নির্মম হত্যাকাণ্ড। হত্যাকাণ্ডের প্রতিটি দৃশ্য সম্পর্কে জেনে এমন মন্তব্য করছেন তারা। পুলিশও এই ঘটনাকে সন্দেহের মধ্যে রেখে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এদিকে ময়না তদন্ত শেষে চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালের মর্গ থেকে নিহতদের মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। মঙ্গলবার (২৪ ডিসেম্বর ২০২৪) দুপুরে চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন, নৌ পুলিশের এসপি ও জেলা পুলিশ কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে সাতজনের মরদেহ পর্যায়ক্রমে তাদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এই লাশগুলো নেয়ার জন্যে আগে থেকেই সাতটি অ্যাম্বুলেন্স মর্গের সামনে রাখা ছিলো। আইনি প্রক্রিয়া শেষ করে স্বজনরা নিহতদের মরদেহ অ্যাম্বুলেন্সে করে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যায়। এর আগে সোমবার (২৩ ডিসেম্বর ২০২৪) বিকেলে হাইমচরের ঈশানবালা মেঘনা নদীর মাঝেরচর এলাকায় নোঙ্গর করা অবস্থায় এমভি আল-বাখেরা জাহাজ থেকে নিহতদের মরদেহ ও আহতদের উদ্ধার করে কোস্ট গার্ড ও নৌ পুলিশ। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত হাইমচর থানায় কোনো মামলা হয়নি। জেলা প্রশাসক বলেছেন, চাঞ্চল্যকর এ ঘটনার হত্যা মামলা হিসেবে হাইমচর থানায় মঙ্গলবার মামলা হবে এবং গঠিত তদন্ত কমিটিকে আগামী ১০ কার্যদিবসে তদন্ত রিপোর্ট প্রদান করার জন্যে বলা হয়েছে। মঙ্গলবার সকাল ১০টার পর থেকে মরদেহগুলো ময়না তদন্তের জন্যে মর্গে নেয়া হয়। সেখানে তাদের স্বজনদের মধ্যে অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। নিহতদের স্বজনদের কান্না কোনোভাবেই থামানো যায়নি। হত্যার শিকার জাহাজের লস্কর শেখ সবুজের (৩৫) ছোট ভাই সাদিকুর রহমান বলেন, জাহাজের মাস্টার গোলাম কিবরিয়া আমার মামা। তার মাধ্যমেই আমার ছোট ভাই সবুজ কাজে আসেন। তিনি লস্কর হিসেবে কাজ করেন। গত ১দিন আগে আমার সাথে ভাইয়ের কথা হয়েছে। যে মর্মান্তিক ঘটনায় আমার ভাই হত্যার শিকার হয়েছে, আমি চাই এমন নৃশংস ঘটনা যাতে আর না ঘটে। এই জাহাজে থাকা প্রত্যেকটি হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করছি। ঘটনাটি যাতে করে কেউ ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা না করে আমি এটিও দাবি করছি। এই হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে একই ধরনের দাবি জানালেন জাহাজের মাস্টার গোলাম কিবরিয়ার ভাই আউয়াল হোসেন। তিনি বলেন, এই মাসেই আমার ভাইয়ের চাকরির মেয়াদ শেষ হতো। তিনি ১ জানুয়ারি থেকে অবসরে যেতেন। তার দুই মেয়ে ও এক ছেলে। বড়ো মেয়ের জানুয়ারি মাসে বিয়ে হওয়ার কথা। কিন্তু এ ঘটনার পরে সব পরিকল্পনাই শেষ। হত্যার শিকার আমিনুল মুন্সীর বড়ো ভাই মো. হুমায়ুন ও ইঞ্জিন চালক সালাউদ্দিনের মামাতো ভাই জাহাঙ্গীর বলেন, ঘটনাটি আমরা ডাকাতি শুনলেও খুনের ঘটনার দৃশ্য দেখে মনে হয়েছে এটি পরিকল্পিত হত্যা। কারণ, প্রত্যেকটি মরদেহের মাথায় ধারলো অস্ত্রের আঘাত। যারা হত্যার শিকার হয়েছেন সকলেরই প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র জাহাজে পাওয়া গেছে। এমনকি জাহাজে থাকা ৫ জনকে উদ্ধারের সময় তাদেরকে শোয়া অবস্থায় পাওয়া গেছে। গুরুতর আহত তিনজনকে চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে আনা হলে এদের মধ্যে আরো দুজন মারা যায়। এদিকে সারবোঝাই এমভি আল-বাখেরা জাহাজের লোকদের নির্মমভাবে হত্যা ও আহতের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করেছে শিল্প মন্ত্রণালয়। কমিটিকে আগামী পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। চার সদস্যের তদন্ত কমিটিতে মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবকে আহ্বায়ক এবং যুগ্ম সচিবকে সদস্য সচিব করা হয়েছে। কমিটিকে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের কারণ, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ও দায়-দায়িত্ব নিরূপণ, অনুরূপ নৌ-দুর্ঘটনা রোধে ভবিষ্যতে করণীয় নির্ধারণ করে সুস্পষ্ট সুপারিশসহ একটি প্রতিবেদন আগামী পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে দাখিলের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। নৌ-পুলিশ চাঁদপুর অঞ্চলের পুলিশ সুপার সৈয়দ মুশফিকুর রহমান বলেন, ৮ জন নয়, সেখানে আমরা ৯ জন থাকার খবর পাচ্ছি। এরই মধ্যে আমাদের কাছে আরো নানা তথ্য আসছে। এটা প্রথমদিকে ডাকাতি মনে হলেও এখন এটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড ধরেই আমরা এগুচ্ছি। নৌপথে অস্থিরতা তৈরি করতেই এমনটি করা হয়েছে কিনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ময়না তদন্তের পর লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তরের করা হয়েছে। এদিকে স্বজনদের সাথে কথা বলে নিহত সাতজনের পুরো পরিচয় মিলেছে। নিহত ৭ জন হলেন : জাহাজের মাস্টার গোলাম কিবরিয়া ফরিদপুর জেলা সদরের জোয়াইর গ্রামের মৃত আনিস বিশ্বাসের ছেলে। লস্কর শেখ সবুজ (৩৫) তারই আপন ভাগিনা। সবুজ একই গ্রামের মৃত আতাউর রহমানের ছেলে। সুকানি আমিনুল মুন্সী নড়াইল জেলার লোহাগড়া থানার ইটনা ইউনিয়নের পাঙ্খারচর গ্রামের মৃত মজিবুর রহমানের ছেলে। লস্কর মো. মাজেদুল (১৬) মাগুরা জেলার মোহাম্মদপুর থানার মো. আনিছুর রহমানের ছেলে। একই উপজেলা ও পলাশবাড়িয়া গ্রামের লস্কর সজিবুল ইসলাম (২৬) দাউদ হোসেনের ছেলে। আর ইঞ্জিন চালক মো. সালাউদ্দিন (৪০) নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলার লাহোরিয়া ১১ নলি গ্রামের মৃত আবেদ মোল্লার ছেলে এবং বাবুর্চি কাজী রানা (২৪) মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলার ভাগ্যকুল গ্রামের কাজী দেলোয়ার হোসেনের ছেলে। হাইমচর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মহিউদ্দিন সুমন বলেন, ঘটনার পর নিহত ৭জনেরই ময়না তদন্ত শেষে পরিবারের নিকট মরদেহ হস্তান্তর এবং একই সাথে পরিবারের পক্ষ থেকে মামলার প্রস্তুতি চলছে। চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন বলেন, নিহত ৭জনের পরিবারকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২৫ হাজার টাকা করে দেয়া হয়েছে । এ ঘটনায় নিহতদের পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় মামলা হবে। এদিকে এ বিষয়ে নৌযান শ্রমিক ফেডারেশন নেতা হারুনুর রশিদ বলেন, সেভেন মার্ডারের ঘটনায় জড়িতদের ৭২ ঘন্টার মধ্যে গ্রেফতার, প্রত্যেককে ২০ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ এবং সকল জাহাজের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জোর দাবি জানাচ্ছি।