বুধবার, ২৫ জুন, ২০২৫  |   ৩৩ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ২৫ জুন ২০২৫, ০৯:২০

সুরের কথায় জীবনের গল্প বলা এক গীতিকবি : মিলন খান

অনলাইন ডেস্ক
সুরের কথায় জীবনের গল্প বলা এক গীতিকবি : মিলন খান

বাংলাদেশের আধুনিক গানের ভুবনে একটি বিশিষ্ট নাম, চাঁদপুরের কৃতী সন্তান মিলন খান। গানের জগতে যিনি শুধু একজন গীতিকবি নন, বরং একজন নিপুণ স্রষ্টা, যিনি শব্দের শরীরকে সুরের আত্মায় রূপ দেন। তাঁর লেখা গানগুলো যেন মাটি ও মন থেকে উঠে আসা বাস্তব জীবনের গল্প, হৃদয়ের অনুভব, সমাজের প্রতিচ্ছবি। ‘ময়না’ গান দিয়ে শুরু, তারপর থেকেই সহস্র গানে তার প্রতিভার ঝলক। ১৯৮৮ সালে লিজেন্ড আইয়ুব বাচ্চুর কণ্ঠে ‘ময়না’ গানটির মাধ্যমে যে যাত্রা শুরু, তা আজও বহমান, নব নব মাত্রায় বিকশিত হচ্ছে।

চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনা-ডাকাতিয়ার হৃদয়ে জন্ম নেওয়া মিলন খান ছোটবেলা থেকেই ছন্দের ঢেউ আর সুরের কলতানে অভ্যস্ত। তাঁর বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও জীবনবোধে রয়েছে নদীঘেরা প্রকৃতির প্রভাব। যার প্রকাশ ঘটেছে তার অসংখ্য গান ও সৃষ্টিতে। গানের বাইরে একজন শিক্ষিত, আধুনিক, বহুমাত্রিক মানুষ মিলন খান।

চাঁদপুরের পদ্মা, মেঘনা, ডাকাতিয়ার বুকেই তাঁর জন্ম ও শৈশব। প্রকৃতির এই রূপ-রস-গন্ধই যেন তাঁর প্রতিটি লেখায় বারবার ফিরে আসে। চাঁদপুর হাসান আলী স্কুল থেকে এসএসসি, চাঁদপুর সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষে পরবর্তীতে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি (এজি) এবং ঢাকার ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ (মার্কেটিং) সম্পন্ন করে তিনি পেশাগত জীবনের শুরু করেছিলেন শিক্ষকতা দিয়ে। তবে সৃজনশীলতার ডাকে সাড়া দিয়ে সেই টানেই ১৯৯৮ সাল থেকে নিজেকে পুরোপুরি উৎসর্গ করেছেন গানের জন্যে।

আজ তিনি সহস্রাধিক গানের রচয়িতা। তাঁর লেখা গান গেয়েছেন বাংলাদেশের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী এন্ড্রু কিশোর, তপন চৌধুরী, ডলি সায়ন্তনী, রবি চৌধুরী, আসিফ আকবর, মনির খান, এস ডি রুবেলসহ দেশের নামকরা সব শিল্পী। কিছু গান প্রজন্মকে ছুঁয়ে গেছে, কিছু গান মানুষের জীবনের অংশ হয়ে গেছে। যেমন-- ডায়েরির পাতাগুলো ছিঁড়ে ফেলেছি, তুমি নীলাকাশ, ভুলে যাও বন্ধু, সাদা কাফনে আমাকে জড়াতে পারবে, কিংবা সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত মেঘনা পাড়ে যাবো নারে, গাইবো না আর গান। প্রতিটি গানে মিলন খানের শব্দ-সুরের জাদু অনস্বীকার্য।

তিনি শুধু একজন গীতিকার নন, বরং এক সংগ্রামী সৃষ্টিশীল মানুষ, যিনি গানের মাধ্যমে সময়, সমাজ ও ব্যক্তিমানসকে তুলে ধরেছেন নিপুণ শৈল্পিকতায়। তাঁর মতে, ভালো কথা ও ভালো সুরের সাথে প্রেম করো। এই বক্তব্যই যেন তাঁর শিল্পীসত্তার সারকথা।

এক সাক্ষাৎকারে আমরা জানবো তার দীর্ঘ পথচলার অভিজ্ঞতা, সৃষ্টিশীল যন্ত্রণার নেপথ্য গল্প, গান নিয়ে তাঁর ভাবনা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা।

চলুন, কথা বলি বাংলার জনপ্রিয় গীতিকবি চাঁদপুরের কৃতীসন্তান মিলন খানের সঙ্গে, যার প্রতিটি গান যেন সময়ের বুক চিরে উঠে আসা এক একটি জীবন্ত কবিতা।

গুণী এই গীতিকারের সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন চাঁদপুর কণ্ঠের সংস্কৃতি অঙ্গনের বিভাগীয় সম্পাদক কবির হোসেন মিজি। নিচে তা হুবহু তুলে ধরা হলো--

সংস্কৃতি অঙ্গন : আপনার গীতিকার জীবনের শুরুটা কীভাবে হয়েছিল? প্রথম গানটি কী ছিল এবং সেটি কাকে দিয়ে গাওয়ানো হয়েছিল?

মিলন খান : হঠাৎই মনে হলো যা লিখছি এগুলো গান, কবিতা নয়। ১৯৮৮ সালে আমার লেখা প্রথম গান ময়না, মহাতারকা আইয়ুব বাচ্চু র প্রথম সুপার হিট গান।

সংস্কৃতি অঙ্গন : ছোটবেলা থেকেই কি গান বা কবিতার প্রতি ঝোঁক ছিল? নাকি গীতিকার হয়ে ওঠা হঠাৎ করেই?

মিলন খান : প্রাইমারি স্কুল থেকেই ছড়া কবিতা লিখতাম। তারই ধারাবাহিকতা বলা যায়।

সংস্কৃতি অঙ্গন : আপনার প্রেরণার উৎস কী? কোন্ কোন্ লেখক, কবি বা গীতিকার আপনাকে প্রভাবিত করেছেন?

মিলন খান : মেঘনা, ডাকাতিয়া ও ব্রক্ষপুত্র-- এই তিনের কাছে আমার অনেক ঋণ।

সংস্কৃতি অঙ্গন : একজন গীতিকারের জীবনে কেমন জীবনযাপন হয়? বাইরে থেকে অনেকটাই রহস্যময় মনে হয়?

মিলন খান : আমি পরিধিতে থাকি, নিজের মধ্যে নিজে থাকি।

সংস্কৃতি অঙ্গন : আপনি যখন একটি গান লেখেন, তখন প্রথমে কোন্ বিষয়টি মাথায় আসে—শব্দ, সুর, না আবেগ?

মিলন খান : হঠাৎ হঠাৎই গান আসে, রুটিন করে বসে লিখিনি কখনো। কিছু কিছু লাইন আসে, ধীরে ধীরে গান হয়ে সাজে।

সংস্কৃতি অঙ্গন : গান লেখার সময় আপনি কীভাবে শব্দ ও অনুভবের ভারসাম্য রক্ষা করেন?

মিলন খান : একটা ঘোর, ঘোর থেকে ভোর।

সংস্কৃতি অঙ্গন : আপনি কীভাবে সিদ্ধান্ত নেন, কোন্ গানটি কোন্ শিল্পীর জন্যে উপযুক্ত?

মিলন খান : ওভাবে হয় না। গান লেখার পর যাকে কাছে পাই, বা যার কথা মনে পড়ে, তাকে দিয়ে করি।

সংস্কৃতি অঙ্গন : একটি গান লেখার পেছনে সাধারণত কতোটা সময় দেন? কোন্ গানটি সবচেয়ে কম সময়ে লিখেছেন?

মিলন খান : ঠিক নেই। কোনো লেখা ১৫/২০ দিনও লেগেছে। কোনোটা আবার এক দেড় ঘন্টায় লেখা হয়ে গেছে।

সংস্কৃতি অঙ্গন : আপনি যেসব জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পীর জন্যে লিখেছেন, তাঁদের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা কেমন ছিলো?

মিলন খান : অভিজ্ঞতা মিশ্র, সুখ-দুঃখ ও আনন্দ-বেদনার। তা বলতে গেলে অনেক কথা বলতে হবে।

সংস্কৃতি অঙ্গন : কোনো গান লেখার পর সেটি গায়ক/গায়িকার কণ্ঠে জীবন্ত হয়ে উঠলে আপনার অনুভূতি কেমন হয়?

মিলন খান : ভালো লাগে, আশা জাগে আরও লেখার।

সংস্কৃতি অঙ্গন : আপনার লেখা গানে যেসব জনপ্রিয় শিল্পী কণ্ঠ দিয়েছেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন শিল্পীর নাম জানতে পারি?

মিলন খান : ময়না-আইয়ুব বাচ্চু; ডাইরির পাতাগুলো, পাথর কালো রাত-তপন চৌধুরী; বুকের জমিন-শুভ্র দেব; সাদা কাফনে আমাকে জড়াতে পারবে-রবি চৌধুরী; বিরহী প্রহর, নিতাইগন্জে জমছে মেলা-ডলি সায়ন্তনী; আমার স্বপ্নের নায়িকা তুমি-আসিফ।

সংস্কৃতি অঙ্গন : আপনি কি মনে করেন আজকালকার শিল্পীরা গানের কথা ও গভীরতাকে যথাযথ গুরুত্ব দিচ্ছেন?

মিলন খান : কিছু কিছু মানুষ সবসময়ই ভালো কাজ করতে চায়।

সংস্কৃতি অঙ্গন : আপনি একাধিক যুগ ধরে গান লিখছেন। আপনার চোখে ৮০/৯০ দশকের গানের কথার সঙ্গে আজকের গানের কথার পার্থক্য কী?

মিলন খান : আগে হেভিওয়েট গান বেশি হতো, এখন লাইটওয়েট বেশি হয়।

সংস্কৃতি অঙ্গন : আপনি কি মনে করেন, এখনকার শ্রোতারা গানের কথা আগের মতো গুরুত্ব দিয়ে শোনেন?

মিলন খান : যার যা ভালো লাগে সে তা-ই শুনে। ভালো শ্রোতা, ভালো গান সবসময়ই কম রচিত হয়।

সংস্কৃতি অঙ্গন : আজকের আধুনিক প্রযুক্তির যুগে গীতিকারের ভূমিকা কীভাবে বদলে গেছে বলে মনে করেন?

মিলন খান : না আমার কাছে বদলে যাওয়ার তেমন কিছু মনে হয়নি।

সংস্কৃতি অঙ্গন : আপনার লেখা এমন কোনো গান আছে, যা আপনার খুব কাছের? যার পেছনে ব্যক্তিগত কোনো গল্প আছে?

মিলন খান : আমার অনেক গানই আমার জীবনের গল্প।

সংস্কৃতি অঙ্গন : একজন নতুন গীতিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে চাইলে কী কী গুণ থাকা উচিত বলে আপনি মনে করেন?

মিলন খান : ধৈর্য, সহ্য, প্রচুর পড়াশোনা, অন্তত হাজার হাজার গান শোনার কান থাকা উচিত।

সংস্কৃতি অঙ্গন : এখনো কি গান লেখা আপনার কাছে আগের মতোই আনন্দের?

মিলন খান : আমি এখনো লেখাটা এনজয় করি।

সংস্কৃতি অঙ্গন : ভবিষ্যতে কি গীতিকার হিসেবে কোনো ভিন্ন ধারার কাজ করার ইচ্ছা আছে? যেমন চলচ্চিত্র, নাটক, আন্তর্জাতিক প্রজেক্ট?

মিলন খান : আমি আমার মতো বলি। আমি আমার মতো চলি, আমি আমার মতো লিখি। কল্পনা পরিকল্পনার কিছু নেই।

সংস্কৃতি অঙ্গন : আজকের তরুণ গীতিকারদের উদ্দেশ্যে আপনি কী বার্তা দিতে চান?

মিলন খান : ভাবো, ভাবনাটা প্র্যাকটিস করো।

সংস্কৃতি অঙ্গন : যদি আপনার জীবনের গান লেখা নিয়ে একটি বই লেখা হয়, বইটির নাম কী হতে পারে?

মিলন খান : পাথর কালো রাত।

সংস্কৃতি অঙ্গন : আপনি চাঁদপুরের মানুষ, এই প্রকৃতি, সংস্কৃতি বা মানুষ আপনার গানের কথায় কতোটা প্রভাব ফেলেছে?

মিলন খান : আমি আকাশের তারা গুণে, পাখির গান শুনে, নদীর ঢেউ গুণে লিখতে শিখেছি।

সংস্কৃতি অঙ্গন : চাঁদপুরের শিল্প সাহিত্য কিংবা সংস্কৃতি চর্চার পরিবেশ নিয়ে আপনি কী বলবেন? নতুন প্রজন্মের জন্যে এই জেলার কি অবদান রয়েছে বলে মনে করেন?

মিলন খান : ভালো থেকো চাঁদপুর, আমার প্রিয় জলের নগর।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়