রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ১৯ অক্টোবর ২০২২, ১৩:১৯

বঙ্গবন্ধুর মহিউদ্দিনের সেইসব দিন

অনলাইন ডেস্ক
বঙ্গবন্ধুর মহিউদ্দিনের সেইসব দিন

মোহাম্মদ মহিউদ্দিন―স্বাধীনতার আগে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিরাপত্তার দিকটি দেখতেন। স্বাধীনতার পরে জাতির জনক যখন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হন তখন প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তার সরকারি দায়িত্ব পান মহিউদ্দিন। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতির পদে আসেন। সেখানেও প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা হিসেবে যুক্ত থাকেন মোহাম্মদ মহিউদ্দিন। বছর সাতেক বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে ছিলেন তিনি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক সপরিবারে নিহত। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের রোষের মুখে তিন বছর কারাবন্দি থাকতে হয় মহিউদ্দিনকে। মুক্তির পর মুন্সিগঞ্জ আওয়ামী লীগে সক্রিয় হন। দুই যুগ ধরে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। জাতির জনকের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে কাটানো সাতটি বছর তাঁর জীবনের স্মরণীয় অধ্যায়। তা আবার স্মরণ করলেন মোহাম্মদ মহিউদ্দিন। সেই স্মৃতি থেকেই শ্রুতলিখন করেছেন অ্যাডভোকেট সোহানা তাহমিনা।

তখন ১৯৬৬ সাল। ছয় দফার জন্য বঙ্গবন্ধুকে কারাবন্দি করা হয়। আমি তখন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র। ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত। আমাদের নেতা ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমদ ও সিরাজুল আলম খান। আন্দোলন-সংগ্রাম নিয়ে পরামর্শ করতে প্রায়ই তারা রাজবন্দি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে জেলখানায় যেতেন। তাদের কাছেই কোনো কারণে ছয় দফার আন্দোলনে আমার সক্রিয়তার কথা জানতে পারেন বঙ্গবন্ধু। আমাকে একদিন নিয়ে যেতে বললেন। নেতারা আমাকে নিয়ে গেলেন রাজবন্দি বঙ্গবন্ধুর কাছে। নেতাদের সঙ্গে আলোচনার ফাঁকেই বঙ্গবন্ধু আমাকে উদ্দেশ্য করে কিছু পরামর্শ দিলেন। এতে বঙ্গবন্ধুর প্রতি আমার শ্রদ্ধা আরও কয়েক গুণ বেড়ে গেল।

পরে অনেক ঘটনা। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হয়। ১৯৬৯ সালে ১১ দফা প্রণয়নের মাধ্যমে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়, উত্তাল আন্দোলন শুরু হয়। গণঅভ্যুত্থানে আইয়ুব খান পদত্যাগে বাধ্য হলেন। জনরোষের কারণে বঙ্গবন্ধুর মামলা প্রত্যাহার করা হয়, তিনি মুক্তিলাভ করেন। জেল থেকে বের হওয়ার পর থেকেই বঙ্গবন্ধু আমাকে তাঁর কাছে রেখে দেন। তখন থেকেই আমি বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার বিষয়গুলো দেখতাম।

ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণের মঞ্চে বঙ্গবন্ধুর ঠিক পেছনেই আমাকে দেখা যায়। বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিচ্ছেন, আমি পেছনে দাঁড়িয়ে শুনছি। ভাষণের সময় তিনি অনর্গল কথা বলছেন। ভবিষ্যতের দিনগুলোয় কী করতে হবে, তিনি আজই তা বলে দিচ্ছেন। আমার মনে হলো উনি মানুষ নন, স্বর্গীয় কোনো দেবতা এসব কথা বলছেন। তিনি জনতার উদ্দেশে বললেন, ‘... প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। ... আমি যদি হুকুম দিবার না পারি...।’ পরে কিন্তু এই ভবিষ্যদ্বাণীই বাস্তব হয়েছিল। সাতই মার্চের ভাষণের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমি পেছনে ছিলাম। ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষের প্রতি পাকিস্তানি শাসকদের ২৩ বছরের অত্যাচার-জুলুম, বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরেছেন। এরপর তিনি পাকিস্তানের জয়গান কেন গাইবেন? ‘জয় পাকিস্তান’ বা ‘জিয়ে পাকিস্তান’ কেন বলবেন?

২৫ মার্চ রাতে আমি বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাড়িতেই ছিলাম। সন্ধ্যার দিকে বাসায় উপস্থিত লোকদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘বাসায় যেকোনো সময় পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ করতে পারে। তোমরা এখানে থেকো না।’ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মতো সব কর্মী নিজ নিজ বাসায় চলে গেল। আমি ও বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী হাজী গোলাম মোরশেদ বাড়িতে থেকে গেলাম। বঙ্গবন্ধু আবার আমাদের বললেন, ‘আমার সঙ্গে মরে লাভ কী? বাইরে থাকলে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দেশকে মুক্ত করতে পারবে।’

তবু আমরা দুজন থেকে গেলাম। বাসার নিচতলায় অফিস রুমে আমরা বসেছিলাম। বিভিন্ন স্থান থেকে ফোন আসছে। লোকজন জানতে চাইছে বঙ্গবন্ধু কোথায়, কী অবস্থায় আছেন? রাত ১২টার দিকে শেষ ফোন এলো। আমিই ফোন ধরলাম। প্রফেসর ডা. বি. চৌধুরীর বাবা মো. কফিলউদ্দিন চৌধুরী সাহেব ফোনে জানতে চাইলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর কি অবস্থা?’ আমি বললাম, ‘বঙ্গবন্ধু বাসায় আছেন।’ এই কথা শুনে তিনি বললেন, ‘জানতে পারলাম বঙ্গবন্ধুর বাসায় হামলা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাহলে কী এসব মিথ্যা কথা?’ তার কথার সময়েই বাইরে গাড়ি ও গুলির শব্দ শোনা গেল। লোকজনেরও চিৎকার শুনতে পেলাম।

‘বাড়িতে হামলা শুরু হয়েছে’ এ কথা বলেই আমি ফোন রেখে দিলাম। দোতলায় গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে জানালাম পাকিস্তানি বাহিনী এসেছে। এই খবর দিয়ে নিচে নামার সঙ্গে সঙ্গে হানাদাররা আমার উপর হামলা শুরু করল। নির্যাতনের একপর্যায়ে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলার ভান করলাম। ওরা তখন বলল, ‘শালা মর গেয়া।’ তারপর আমার চুল ধরে, পা ধরে টেনেহিঁচড়ে ঘরের কোণায় ফেলে রাখল। হানাদাররা রিসিপশন রুমে মোরশেদ সাহেবকে পেয়ে পিটাতে শুরু করে। কাজের ছেলে আবদুল রান্নার ঘরের স্টোর রুমে লুকিয়ে ছিল।

গুলি করতে করতে পাকিস্তানি সেনারা দোতলায় বঙ্গবন্ধুর বেডরুমে গিয়ে দরজা ভাঙার জন্য আঘাত করতে লাগল। কেউ কেউ নিচ থেকেই বেডরুমের জানালা লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে লাগল। বঙ্গবন্ধু তখন মাঝের রুমে পায়চারি করছিলেন। চারদিকে গুলির শব্দ। দোতলায় দরজা থেকে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘ডোন্ট ফায়ার, ডোন্ট ফায়ার, আই অ্যাম কামিং আউট।’ এরপর সেনারা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে চলে গেল। পাাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর বঙ্গমাতা (বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব) মোমবাতি জ্বেলে নিচে আসলেন। তাকে দেখে আমি দাঁড়ালাম। তিনি আমাকে বললেন, ‘আপনার ভাইকে নিয়ে গেছে।’ আমি বললাম, ‘আমি সব দেখেছি।’ বঙ্গমাতা, শেখ রাসেল, গৃহকর্মী আবদুল ও আমি একই সঙ্গে দোতলায় হারিকেন জ্বালিয়ে বসে রাত পার করলাম।

২৬ মার্চ সকালে শেখ কামাল আসলেন। রাতের সব ঘটনা শুনলেন। এই অবস্থায় বঙ্গমাতাকে বাসায় রাখা নিরাপদ হবে না। তাকে নিরাপদ স্থানে রাখতে হবে। বঙ্গবন্ধুর বাসার পাশের বাসায় থাকতেন ডা. সামাদ সাহেব। ওই বিপদের সময় তার ছেলে বঙ্গমাতাকে তাদের বাড়িতে নেয়ার জন্য আসলেন। ডা. সামাদের বাড়ির নাম ছিল ‘সড়ায়েখাম।’ এটি উর্দুতে লেখা থাকায় পাকিস্তানিরা এই বাড়িতে কখনো হামলা করেনি। ওই বাসায় যেতে হলে দেয়াল টপকে যেতে হবে। আমি একটি টুল দিয়ে বঙ্গমাতাকে দেয়াল টপকাতে বললাম। দেয়ালের ওপর আমি উপুড় হয়ে বসলাম, এরপর বঙ্গমাতাকে বললাম, ‘আমার পিঠে পা দিয়ে ধীরে ধীরে নামেন।’ তিনি আমার পিঠে সম্পূর্ণ ভার না দিয়ে নামতে গিয়ে নিচে পড়ে গেলেন। পড়ে গিয়ে তিনি ‘মাগো’ বলে আওয়াজ করে উঠলেন। সেই আওয়াজ এখনো আমার কানে বাজে।

২৬ মার্চ সারা দিন আমি ও শেখ কামাল ডা. সামাদ সাহেবের বাসায় ছিলাম। রাতে থাকার জন্য সেখান থেকে ৩২ নম্বরের বাসায় চলে আসি। বাড়ির সমস্ত ফটক লাগিয়ে আমি ও শেখ কামাল দোতলায় ঘুমিয়ে যাই। গভীর রাতে গুলির আওয়াজে আমাদের ঘুম ভেঙে যায়। দোতলা থেকে তারা বুঝতে পারেন যে, পাকিস্তানি কমান্ডোর নিচতলার কলাপসিবল গেট ভাঙছে দোতলায় ওঠার জন্য। আমি আর শেখ কামাল তখনি দেয়াল টপকে নিরাপদ স্থান খুঁজতে থাকি। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির পেছনের দিকে কিছুটা দূরে বেতারের কর্মকর্তা বাহাউদ্দিন সাহেবের বাড়ি ছিল। ওই বাসায়ই আশ্রয় নিতে হয় আমাদের। পরদিন সকালে আমি ও শেখ কামাল বঙ্গমাতার সঙ্গে দেখা করার জন্য ডা. সামাদ সাহেবের বাসায় যাই। বঙ্গমাতা আমাদের দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তার ধারণা ছিল পাকিস্তানিরা শেখ কামাল ও আমাকে হত্যা করে লাশ নিয়ে গেছে। এমন সময় পাকিস্তানি বাহিনী ডা. সামাদ সাহেবের বাসার গেটের সামনে আসে। বঙ্গমাতা আমাদের বললেন, ‘তোমরা আর এখানে এসো না।’ আমরা তখন সেখান থেকে আবার পালিয়ে যাই। পরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে আমি আগরতলা চলে যাই।

১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু যখন প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন, তখন আমি প্রধানমন্ত্রীর প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পাই। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার নিলে আমি রাষ্ট্রপতির প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা হিসেবে রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ে যোগ দেই। বঙ্গবন্ধু সকাল ৯টার মধ্যেই বাসা থেকে বের হতেন। আমাকে তাই সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে তৈরি থাকতে হতো। ঢাকায় থাকলে প্রায় সময়ই দুপুরের খাবারের জন্য বাসায় আসতেন বঙ্গবন্ধু। ছেলে রাসেল ও নাতি জয়কে নিয়ে সবসময় শিশুসুলভ খেলা করতেন, ওদের আনন্দ দিতেন। দেশের প্রধান হয়েও বঙ্গবন্ধু সাধারণ মানুষ থেকে দূরে সরে যাননি। একটা ছোট ঘটনা থেকে তা বুঝা যায়। বঙ্গবন্ধু প্রায়ই অফিস শেষে করে বাড়ি ফেরার পথে হঠাৎ-ই যেন তাঁর মনে হলোÑ ‘চলো মিরপুরের বস্তির মানুষের অবস্থা কেমন আছে দেখে আসি।’ আবার কখনো কখনো চকবাজারে গিয়ে বাজারের অবস্থা দেখে আসতেন। একদিন কাজের সুবিধা ও নিরাপত্তার জন্য আমি বঙ্গবন্ধুকে বললাম, ‘স্যার আমাকে দুটি ওয়াকিটকি কিনে দিলে কাজের জন্য খুব সুবিধা হতো।’ বঙ্গবন্ধু আমার কথায় গুরুত্ব দিলেন না। পরে ই. এ. চৌধুরী (সাবেক এসপি) সাহেবকে ব্যাপারটি আমি জানাই। ই. এ চৌধুরী একদিন বঙ্গবন্ধুকে বললেন, ‘স্যার মহিউদ্দিনকে দুইটা ওয়াকিটকি কিনে দিলে নিরাপত্তার কাজ করতে ওর সুবিধা হয়।’ বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘ঠিক আছে দুইটা ওয়াকিটকির দাম কত?’ তখন তিনি জানালেন ৩০-৪০ হাজার টাকা হবে। বঙ্গবন্ধু ধমক দিয়ে বললেন, ‘আমার দেশের মানুষ ঠিকমতো দুই বেলা পেট ভরে ভাত খেতে পায় না, আর আমি ওকে ৪০ হাজার টাকা দিয়ে ওয়াকিটকি কিনে দেব? এমন নিরাপত্তা আমার কোনো প্রয়োজন নেই। বিশাল নিরাপত্তা থাকার পরও কত নেতাকেই তো মেরে ফেলেছে। মৃত্যু আসবে মরব।’

১৯৭০ সালের নির্বাচনের সময় বঙ্গবন্ধু গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের কাছে এতই জনপ্রিয় ছিলেন যে, অনেকে শুধু দেখেই নয়, হাত দিয়ে ধরতে চাইতেন। নিরাপত্তার জন্য আমি বাধা দিলে বঙ্গবন্ধু ধমক দিয়ে বলতেন, ‘মহিউদ্দিন তুই কাকে বাধা দিস, গ্রামের এই দরিদ্র মানুষের মধ্যে থেকেই আমার জন্ম, এই মানুষের ভালোবাসার কারণেই আমি আজ নেতা, এরা গ্রামের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে আসে আমাকে দেখতে, হৃদয়ের টানে। এই মাটি ও মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে আমি আন্দোলন-সংগ্রামে সাহস, শক্তি পাই, অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করি। সমাজের এই অবহেলিত, লাঞ্ছিত, বঞ্চিত দরিদ্র মানুষকে সামরিক শাসন ও শোষণের হাত থেকে বাঁচাতে হবে। আমার প্রতি তাদের বিশ্বাস ও আস্থার প্রতি সম্মান দেখ।’ এরপর থেকে বঙ্গবন্ধুকে কখনো সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আড়াল করার চেষ্টা করিনি।

অনেক ঘটনা মনে পড়ে। সকাল সাড়ে আটটায় বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে ডিউটিতে যেতাম। একদিন বঙ্গবন্ধুর বাসার দোতলায় গিয়েছি। দেখি, বঙ্গবন্ধু গোসলখানা থেকে পা মুছতে মুছতে বের হচ্ছেন। আমাকে দেখে বললেন, ‘টেবিলের উপর তোর একটা চিঠি এসেছে, চিঠিটা দেখ।’ চিঠিটা হাতে নিয়ে খামটা খুলতেই বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘চিঠির খামের উপর কি লেখা আছে সেটা পড়।’ আমি খামের উপরের লেখাটি পড়লাম, লেখা ছিলÑ ‘বঙ্গবন্ধুর মহিউদ্দিন, ৩২ নম্বর ধানমন্ডি।’ আমি বিষয়টি বুঝতে পারলাম না। তখন বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আবার পড়।’ লেখাটা আবার পড়লাম, এই লেখাটি উপলব্ধি করতে পারলাম না। এর গভীরতা বুঝতে পারলাম না। বঙ্গবন্ধু তখন বললেন, ‘‘কী লিখেছে, ‘বঙ্গবন্ধুর মহিউদ্দিন’, এটা মেনে চলবি।” তখন আমি এর মর্ম বুঝতে পারলাম।

বঙ্গবন্ধুর শেষ কর্মদিবস আমারও নিরাপত্তা কর্মকর্তা হিসেবে শেষ কর্মদিবস। দিনটি পঁচাত্তরের ১৪ আগস্ট। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সকাল ৯টার মধ্যে অফিসে আসি। অফিস ছিল নতুন গণভবনে, যথারীতি কার্যক্রম শেষ করে বিকালে রাজনৈতিক বিভিন্ন লোকজনের সঙ্গে তিনি সাক্ষাৎ করেন। বিকালে নেতা-নেত্রীদের সঙ্গে আবদুল মতিন চৌধুরীও (তখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য) ছিলেন। তিনি আমাকে বললেন, ‘আগামীকাল বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ে গুরুত্বপুর্ণ ভাষণ দেবেন। এদিকে সময় নষ্ট না করে বঙ্গবন্ধুকে বাসায় নিয়ে যাও। ওনাকে কালকের অনুষ্ঠানের ব্যাপারে ভাবতে দাও।’

তার কথা মতো আমি বঙ্গবন্ধুকে বাসায় নেওয়ার জন্য প্রতিদিনের মতো বঙ্গবন্ধুর চশমা, তামাকের বেগ টেবিল থেকে হাতে নেই। তখন বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারলেন, তাকে বাড়ি যাওয়ার জন্য ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধু আমাকে ধমক দিয়ে ওইগুলো টেবিলে রাখতে নির্দেশ দিলেন। আমি বঙ্গবন্ধুকে উঠাতে পারলাম না। মতিন চৌধুরী সাহেব বললেন, ‘কী ব্যাপার?’ আমি বললাম, ‘আমি তো উঠাতে পারছি না।’ তিনি বললেন ‘আমার সঙ্গে আসো।’ তখন তিনি বঙ্গবন্ধুর সামনে গিয়ে আমাকে জোরে বলতে লাগলেন ‘মহিউদ্দিন গাড়ি লাগিয়েছ।’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ গাড়ি প্রস্তুত।’ বঙ্গবন্ধু তখন তাকে বললেন, ‘আপনিও আমার পেছনে লেগেছেন।’

বঙ্গবন্ধু চেয়ার থেকে উঠে ৩২ নম্বর বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিলেন। রাত সাড়ে ৮টা-৯টার দিকে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ৩২ নম্বর বাড়িতে গণভবনের দিকে চলে আসলাম। সেখানে এক নৈশভোজে যোগ দিলাম। নৈশভোজ শেষে আমি ও তোফায়েল আহমদ ভাই একসঙ্গে গণভবন থেকে বের হলাম। তোফায়েল ভাই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করার কথা বললেন। রাত অনেক হয়েছে বলে আমি আর গেলাম না। কারণ বেশি রাতে আমাকে দেখলে বঙ্গবন্ধু অসন্তুষ্ট হতে পারেন। তোফায়েল ভাই আমাকে ৩২ নম্বর বাসার নিচে রেখে উপরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। এই সময় আমার সঙ্গে কাজী গোলাম মোস্তফা সাহেবের দেখা হয়। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘লিডার কী করছেন?’ আমি বললাম, ‘স্যার উপরে আছেন।’ তিনি তখন উপরে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর তোফায়েল ভাই নিচে নেমে আসলেন। আমি ও তোফায়েল ভাই বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেই। তাকে তার বাড়িতে নামিয়ে আমি রাত প্রায় একটার দিকে নিজের বাসায় ফিরি।

এরপর গোলাগুলির আওয়াজে কর্মচারীরা আমাকে ঘুম থেকে উঠায়। রমনা থানার পাশেই ছিল আমার বাসা। আমি ভাবলাম, বঙ্গবন্ধু আগামীকাল বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন, এই অনুষ্ঠান বানচাল করার জন্য হয়ত দুষ্কৃতকারীরা অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করছে। সেলিনা হক নামে এক নেত্রী শেষরাতে আমাকে ফোন করে জানালেন, বঙ্গবন্ধুর বাসায় দুষ্কৃতকারীরা হামলা করেছে। আমি তখন বঙ্গবন্ধুর বাসায় যাওয়ার কোনো পরিবহন না থাকার কারণে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের স্টাফদের ফোন করি। কিন্তু কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। ঘটনা জানতে কিছুক্ষণ পর তৌফিক ইমাম সাহেব ফোন করলেন। আমি ধারণা থেকে বললাম, ‘বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে দুষ্কৃতকারীরা এই কাজ করছে।’

লাল ফোনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ফোন করলাম, কিন্তু কেউ ফোন ধরেনি। তখনি বঙ্গবন্ধুর বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিলাম। ২৭ নম্বর ধানমন্ডি বয়েজ স্কুলের সামনে যাওয়ার পর ওখানকার লোকজন আমাকে আর সামনে যেতে দিল না। তারা বললেন, সামনে আর্মি আর রক্ষীবাহিনীদের মধ্যে গোলাগুলি হচ্ছে। আমি ভাবলাম আমাকে দেখলে সবাই চিনতে পারবে, এই ভেবে আমি বাধা থাকার পরও সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। সামনে গিয়ে দেখি বৃষ্টির মতো আগুনের গোলা সামনের দিকে এগিয়ে আসছে। ভাবলাম গুলি তো আর আমাকে চিনবে না। বাসায় ফিরে টেলিফোনে যোগাযোগ করতে লাগলাম। একপর্যায়ে জানতে পারলাম বঙ্গবন্ধুর উপর হামলা হয়েছে। কিছুক্ষণ পর রেডিওর খবরে শোনা গেল, খোন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুকে উৎখাত করা হয়েছে। এই সময় ফরাসউদ্দিন সাহেব (বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সচিব) আমাকে ফোন করে বঙ্গবন্ধুর অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলেন। তার কিছুক্ষণ পর ড্রইং রুমে রেডিওতে শুনি, ‘আমি মেজর ডালিম বলছি, স্বৈরাচারী সরকার শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে।’

১৯৭৫ সালের ২৮ অক্টোবর আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। রাখা হয় জেলখানার দুই নম্বর নতুন সেলে। জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে দেখেছি। খাবার দিতে আসা মিঞা সাহেব (জেল পুলিশ) ৩ নভেম্বর চার আঙুলের ইশারায় জানিয়েছিলেন, জাতীয় চার নেতাকে মেরে ফেলা হয়েছে। দুই দিন পর চার নেতার লাশ জেলখানা থেকে সরানো হয়। প্রায় সাড়ে ৩ বছর আমাকে কারাগারে কাটাতে হয়। উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয়ে জেল থেকে বের হই। জেলে থাকার সময় তৎকালীন সরকার কখনো লোভ-লালসা, কখনো ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের দলে যোগ দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। তখন আমার একটাই বক্তব্য ছিল, ‘যার পায়ের নিচে থেকেছি, তার পায়ের নিচে থেকে মৃত্যুবরণ করতে পারিনি। এখন কোনো পদ-পদবির লোভ-লালসা কিংবা ভয়ভীতি দেখিয়ে আমাকে বঙ্গবন্ধুর দল থেকে কেউ সরাতে পারবে না।’ আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য হলো, বঙ্গবন্ধুর পায়ের তলে স্থান পেয়েছিলাম। আর আমার জীবনের সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য হলো, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মরতে পারিনি।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়