প্রকাশ : ১০ মার্চ ২০২৫, ০৯:৩৭
পাকস্থলীর অম্লতা বা গ্যাস্ট্রিক অ্যাসিডিটি

বিষয়টা খুবই সাধারণ। আম বাঙালির কাছে আবহমান কাল হতেই তা অম্বল নামে পরিচিত। তাঁরা জানতেন, দেরি করে বেলা ফেলে খাবার খেলেই পেটে অম্বল হয়, গ্যাস হয়। বাংলা সাহিত্যের অনেক কালজয়ী উপন্যাস বা গল্পে এই অম্বলের কথা বার বার এসেছে। পেটে অ্যাসিডিটি বা গ্যাস হওয়াকে ছোটবেলায় অনেকের মুখেই চাপ সৃষ্টি বলে শুনেছি। বায়ুচড়া বিষয়টিও এমন। পেটে গ্যাস বেড়ে গেলেই কারও মাথা ঘোরাতো, বমি বমি পেতো। কেমন যেন অস্বস্তি লাগতো। বিষয়গুলো আবহমান কালের হলেও আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান আজকাল তার বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছে।
পেটে অম্বল বা অ্যাসিডিটি অতি সাধারণ হলেও কখনও কখনও তা মেডিক্যাল ইমার্জেন্সি হিসেবে উদ্ভূত হয়। তখন হাসপাতাল-নার্সিং হোমে যেমন দৌড়াদৌড়ি করা লাগে তেমনি কখনও কখনও যমে-দমে টানাটানিও হয়।
পাকস্থলী হলো আমাদের পরিপাকতন্ত্রের একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ যা ইংরেজি ‘জে’ আকৃতির থলির মতো এবং আমাদের আহারকৃত অপাচিত বা অর্ধপাচ্য বা পাচনযোগ্য খাবার জমা রাখে বা ধারণ করে। সাধারণত খাদ্য গ্রহণের পর পাকস্থলী দেড় থেকে আড়াই ঘন্টা মতো খাবার জমা রাখে। তারপর এই খাবার পূর্ণ পাচন ও বর্জ্য অংশের নিষ্ক্রান্তির জন্যে অন্ত্রে গমন করে। খাদ্য পাকস্থলীতে আসলে পাকস্থলীর অন্তর্গাত্র হতে পাকস্থলী রস নিঃসৃত হয়। একে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় গ্যাস্ট্রিক জুস বলে। এতে কী কী থাকে? এতে থাকে প্রধানত পানি,হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড, পেপসিন ও নানারকম ইলেক্ট্রোলাইট যেমন : পটাসিয়াম, সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম ইত্যাদি। একটি কথা প্রায়ই শোনা যায়, পাকস্থলী খাবার হজম করলেও নিজে হজম হয় না কেন। এর কারণ হলো পাকস্থলীর অন্তর্গাত্র মিউকাস ঝিল্লি দ্বারা আবৃত এবং মিউসিন নামক রাসায়নিক পদার্থ এই ঝিল্লির রক্ষাকারী আবরক হিসেবে কাজ করে। গ্যাস্ট্রিক রসের কাজ হলো খাদ্যে মিশে থাকা বাইরের জীবাণুকে নিষ্ক্রিয় করা, খাদ্যকে মণ্ডে পরিণত করা এবং খাদ্য পরিপাকের জন্যে উপযুক্ত রাসায়নিক পরিবেশ বজায় রাখা। পাকস্থলীতে খাদ্য পৌঁছা মাত্রই পাকস্থলীর গাত্র স্ফীতির কারণে উদ্দীপনা তৈরি হয় এবং রস নিঃসৃত হয়। পাকস্থলীর রসের অম্লধর্মিতার কারণে তীব্র এসিডিয় পরিবেশ বজায় থাকে।
পাকস্থলীর রোগব্যাধি
পাকস্থলী বিভিন্ন কারণে নানা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। পাকস্থলীর অন্তর্গাত্রের আবরণে ক্যান্সার হতে পারে। এই ক্যান্সার বংশগত জিনের কারণে যেমন হয়, তেমনি শুটকিতে ব্যবহৃত ডিডিটি বা ক্ষতিকর রাসায়নিকের কারণেও উস্কে উঠতে পারে। যারা খুব বেশি ঝাল খায় তারাও পাকস্থলীর ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অধিক। কারণ অতিরিক্ত ঝাল কার্সিনোজেনিক বা ক্যান্সার কোষের উস্কানিদাতা। যারা ধূমপান ও অ্যালকোহল সেবনে অভ্যস্ত তাদের ক্ষেত্রেও ক্যান্সার জিন উস্কানি পেতে পারে। আবার অতিরিক্ত ঝাল এবং নিকোটিন ও অ্যালকোহল সেবনে পাকস্থলীর আকসারও হতে পারে। পাকস্থলীর ভিতরের আবরণের নিরবচ্ছিন্নতায় ক্ষত হলে গ্যাস্ট্রিক আলসার হয়। এই আলসার যেমন পাকস্থলীর অতি অ্যাসিড নিঃসরণে হয়, তেমনি একধরনের ব্যাক্টেরিয়া অণুজীবের কারণেও হতে পারে। এই অণুজীবের নাম হেলিকোব্যাক্টর পাইলোরি। আবার অতিরিক্ত মসনসিক চাপের কারণে পাকস্থলীতে অতিরিক্ত অ্যাসিড নিঃসরণ হয়। এটাও পাকস্থলীর আলসার বা পেপটিক আলসারের জন্যে দায়ী। জীবাণু ও অতিরিক্ত অ্যাসিড বা জৈব রাসায়নিক কারণে পাকস্থলীর মিউকাস ঝিল্লির প্রদাহ হলে গ্যাস্ট্রাইটিস হতে পারে। খাবারে জীবাণু সংক্রমণ হলে গ্যাস্ট্রোএন্টেরাইটিস হতে পারে। যদি কোন কারণে পাকস্থলীর খাবার উল্টো দিকে অন্ননালীতে উঠে আসে বা পাকস্থলীর অ্যাসিড অন্ননালী দিয়ে উপরের দিকে ছুটে যায় তবে তাকে গ্যাস্ট্রোইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ বা সংক্ষেপে জার্ড বলে। অনেকসময় পাকস্থলীর শেষপ্রান্তে নিচের দিকে কোন কারণে ধারণকৃত খাদ্য নির্গমনে বাধা পেলে তাকে গ্যাস্ট্রিক আউটলেট অবস্ট্রাকশন বলে। পাকস্থলীর সন্নিহিত নিচের অংশটাকে বলে ডিওডেনাম। ডিওডেনামের অন্তর্গাত্রের উপরিতলে ক্ষত হলে তাকে ডিওডেনাল আলসার বলে। কখনও কখনও পাকস্থলীর অন্তর্গাত্রের ভেতরের দিকে পলিপের মতো ছোট ছোট কিছু অভিক্ষেপ দেখা দিতে পারে। এগিলো জন্মগত ত্রুটি হিসেবে চিহ্নিত। এদের বলে মেকেলের ডাইভার্টিকুলাম। এ কারণেও আক্রান্ত ব্যক্তি পেটে ব্যথা অনুভব করতে পারে।
পাকস্থলীর অম্লতা বা গ্যাস্ট্রিক অ্যাসিডিটির লক্ষণ
১. পেটে নাভির ওপরের অংশে, বুকের নিচের (কড়ি বলে চিহ্নিত, এপিগ্যাস্ট্রিয়াম) অংশে ব্যথা হয়। খালিপেটে ব্যথা হলে পাকস্থলীর আলসার অথবা পাকস্থলীর অ্যাসিডিটি বলে অনুমিত হয়। ভরা পেটে বা খাদ্যগ্রহণের পরে নাভির কিঞ্চিৎ ওপরে ব্যথা হলে তাকে ডিওডেনাল আলসার বলে অনুমান করা যায়।
২. অতিরিক্ত অ্যাসিডিটির কারণে বুকে জ্বালাপোড়া করে।
৩. বমি বমি ভাব হয় এবং কখনো কখনো বমি হয়।
৪. পেটে গ্যাস জমে, পেট ভরা ভরা বলে মনে হয়।
৫. ক্ষিদে থাকা সত্ত্বেও খাওয়ার রুচি তৈরি হয় না।
৬. অল্প আহার গ্রহণে পেট টইটম্বুর হওয়ার অস্বস্তিকর অনুভূতি তৈরি হয় এবং ঊর্ধ্বশ্বাস দেখা দেয়।
৭. অতিরিক্ত ঢেকুর আসে।
৮. কখনও কখনও গলা জ্যাম জ্যাম মনে হয়। গলার নিম্নাংশে কিছু একটা ঢিপ দিয়ে রয়েছে বলে মনে হয়।
৯. সকালে দাঁত ব্রাশ করতে গেলে বমি ভাব হয়।
১০. অ্যাসিড বাষ্পের কারণে মুখে তেতো ভাব আসে। কখনও কখনও লবণকটা পানিতে জিভ আর্দ্র হয়ে ওঠে।
পাকস্থলীর অ্যাসিডিটি নিয়ন্ত্রণে চিকিৎসা
পাকস্থলীতে খাদ্য হজম করতে হলে এবং পরবর্তী পরিপাকের জন্যে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হলে অম্লীয় পরিবেশ জরুরি। অর্থাৎ পাকস্থলী রস নিঃসরণের মাধ্যমে অ্যাসিড নিঃসরণ না হলে পাকস্থলীতে খাদ্য হজম হবে না। তবে অতিরিক্ত অ্যাসিড যাতে নিঃসৃত না হয়, সেজন্যে কিছু কিছু প্রতিকার ও সাবধানতা দরকার। প্রথমত জীবনাচরণ পরিবর্তন ও জীবনশৃঙ্খলা মেনে চলা এবং দ্বিতীয়ত নির্দিষ্ট ঔষধ সেবনের মাধ্যমে পাকস্থলীতে অ্যাসিড নিঃসরণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
১. জীবনাচরণ পরিবর্তন ও জীবনশৃঙ্খলা অনুসরণ :
ক. প্রতিদিন একই সময়ে খাদ্যগ্রহণ করা। কেননা, খাদ্য গ্রহণ করতে করতে একসময় পাকস্থলীর স্নায়ুতন্ত্রের সুনির্দিষ্ট উদ্দীপনা তৈরি হয়ে যায়, কখন অ্যাসিড ও পাচক রস নিঃসৃত হবে। কোনোদিন খাদ্যগ্রহণে দেরি হলে ঐ সময়ে অ্যাসিড কিন্তু উদ্দীপনার কারণে ঠিক সময়ে নিঃসৃত হয়ে যায়। ফলে খাবারশূন্য পাকস্থলীর গায়ে অ্যাসিড তার ক্রিয়া চালিয়ে যায়। এভাবে কয়েকদিন ঘটলে একসময় পাকস্থলীর গায়ে যেমন ক্ষত তৈরি হয় তেমনি নিঃসরণ হওয়া অ্যাসিডও অপ্রয়োজনীয় হয়ে নানাবিধ উপসর্গ তৈরি করে।
খ. অতিরিক্ত মানসিক চাপ পরিহার করা ও পরিমিত এবং স্বাস্থ্যকর জীবনপ্রমোদে নিজেকে প্রফুল্ল রাখা।
গ. সময়মত নিদ্রাগমন ও সময়মত নিদ্রা ত্যাগ
ঘ. ধূমপান ও অ্যালকোহল পানে আসক্তি বর্জন
ঙ. অতিরিক্ত তেল-মশলা-ঝাল জাতীয় খাবার পরিহার
চ. পরিমিত ও প্রয়োজনীয় পুষ্টিমানসম্পন্ন খাবার গ্রহণ।
ছ. ভরপেট না খেয়ে কিছুটা অপূর্ণ আহার গ্রহণ।
জ. কৃত্রিম রাসায়নিক পদার্থে নয়নকাড়া খাবার বর্জন। ফাস্টফুড ও জাঙ্কফুড এড়িয়ে চলা।
ঝ. সুপাচ্য খাবার বা লঘুপাক খাবার গ্রহণে প্রবণতা বাড়ানো।
ঞ. কোন দাওয়াতে আমন্ত্রণকারীর অনুরোধে ঢেঁকি না গেলা। নিজের রুচিতে নিজের স্বাস্থ্য উপযোগী আহারে মনোনিবেশ করা।
জ. রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোন ব্যথার ঔষধ সেবন না করা।
ঞ. দৈনিক নিয়ম করে সকালে ও বিকালে শারিরীক ব্যায়াম করা বা হাঁটার অভ্যেস করা।
২. চিকিৎসা :
ক. খাদ্য গ্রহণের আগে প্রোটন পাম্প বাধাদানকারী কিছু ঔষধ সেবন করা যার ফলে পাকস্থলীতে অ্যাসিড নিঃসরণ কমে আসে।
খ. খাদ্য গ্রহণের পর যাতে নিঃসৃত অতিরিক্ত অ্যাসিড প্রশমিত করা যায় সেজন্যে এন্টাসিড জাতীয় ঔষধ সেবন করা।
গ. খাদ্য গ্রহণের আগে বুক জ্বালাপোড়া উপশমে ডমপেরিডন জাতীয় ঔষধ সেবন করা যাতে গৃহীত খাবার পাকস্থলী হতে উল্টোপথে না যায়।
ঘ. ডিওডেনাল আলসারে সুক্রালফেট সেবন
ঙ. মানসিক চাপ নিরসনে মন প্রফুল্লকারক ঔষধ সেবন।
চ. জীবাণুজনিত আলসারে ত্রিপল থেরাপি সেবন।
ছ. প্রোবায়োটিক জাতীয় ঔষধ সেবনের মাধ্যমে খাদ্য হজমকারী অণুজীব বৃদ্ধি করা।
গ্যাস্ট্রিক অ্যাসিডিটির জটিলতা
১. পার্ফোরেশন বা অন্ত্র ফুটো হয়ে যাওয়া।
২. পাকস্থলীর ক্ষতস্থান হতে চুয়ে চুয়ে রক্তক্ষরণ হওয়া ও কালো মল উৎপন্ন হওয়া বা ম্যালেনায় ভোগা। পরিণামে রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়।
৩. খাদ্য গ্রহণে অরুচি ও পেট ফেঁপে থাকা
৪. খাবার হজম না হওয়া
৫. পাকস্থলীর ক্যান্সারের উদ্দীপনা তৈরি হওয়া।