প্রকাশ : ২৯ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:২১
এই জেলার ইতিহাসের অংশ হয়ে গেলো ১৫ সেপ্টেম্বর-২০২৪
চাঁদপুর মেডিকেল কলেজের প্রথম ব্যাচের ইন্টার্ন ডাক্তাররা চব্বিশ ঘণ্টা সেবা দিচ্ছেন হাসপাতালে
আমি ৩৮ জন ডাক্তার পেলাম : তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ একেএম মাহাবুবুর রহমান
আড়াইশ’ শয্যাবিশিষ্ট চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালটি এখন চাঁদপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল নামেই পরিচিতি পাচ্ছে। হাসপাতালটিকে বলতে গেলে এখন মেডিকেল কলেজের অবয়বেই দেখা যাচ্ছে। নেই কোনো ডাক্তার সংকট। কোনো রোগী ভর্তি হলেই তার কাছে ছুটে যাচ্ছেন ডাক্তার। এমনকি রোগী ভর্তি হয়ে ওয়ার্ডে যখন যায় তখন কোনো না কোনো ডাক্তার তাকে রিসিভ করছেন। হাসপাতালটি ঘুরলে এখন একঝাঁক তরুণ চিকিৎসককে চোখে পড়ে সারাক্ষণ। তারা রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন। এই তরুণ চিকিৎসকরাই হচ্ছেন চাঁদপুর মেডিকেল কলেজ থেকে সদ্য এমবিবিএস পাস করা ইন্টার্ন ডাক্তার। মোট ৩৮জন মেডিকেল শিক্ষার্থী একযোগে পাস করলেন চাঁদপুর মেডিকেল কলেজ থেকে। ২৫ আগস্ট-২০২৪ তারিখে তাদের রেজাল্ট হয়। এরাই হচ্ছেন চাঁদপুর মেডিকেল কলেজের প্রথম ব্যাচ। প্রথম ব্যাচের ৫০জন পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন ৩৮জন। বাকি ১২জন ২০২৫ সালের পরীক্ষায় অংশ নেবে। সদ্য এমবিবিএস পাস করা এই ৩৮জনই চাঁদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইন্টার্ন চিকিৎসক হিসেবে যোগদান করেছেন গত ১৫ সেপ্টেম্বর। সে জন্যে ১৫ সেপ্টেম্বর-২০২৪ তারিখটি চাঁদপুর জেলার ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে। এইদিনে চাঁদপুর মেডিকেল কলেজের প্রথম ব্যাচের পাস করা ডাক্তাররা এই হাসপাতালে ইন্টার্ন চিকিৎসক হিসেবে যোগদান করেছেন। এক মাসের সরকারি ভাতাও এই ইন্টার্ন চিকিৎসকরা পেয়েছেন। এসব তথ্য জানা গেলো হাসপাতাল এবং মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে।
|আরো খবর
গত দুদিন চাঁদপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেলো ভিন্ন রকমের চিত্র। দেখা গেলো একঝাঁক তরুণ চিকিৎসক রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন। হাসপাতালের ডাক্তার, সিনিয়র ডাক্তাররা যখন ওয়ার্ডে যান তখন তাঁদের সাথে এই তরুণ চিকিৎসকরা থাকছেন। এরাই হচ্ছেন চাঁদপুর মেডিকেল কলেজের ইন্টার্ন চিকিৎসক।
২০১৮ সালে চাঁদপুর মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা হয়। ২০১৭ সালে চাঁদপুর মেডিকেল কলেজ বিল জাতীয় সংসদে পাস হয়। এর আগে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চাঁদপুর স্টেডিয়ামে জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় চাঁদপুরে একটি মেডিকেল কলেজ করার কথা ঘোষণা দেন। স্থানীয় সংসদ সদস্য ডা. দীপু মনির দাবির প্রেক্ষিতে সে জনসভায় চাঁদপুরে মেডিকেল কলেজ করার ঘোষণা দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর দীপু মনির নিরলস প্রচেষ্টায় ২০১৮ সালে চাঁদপুর মেডিকেল কলেজের যাত্রা শুরু হয়। আড়াইশ’ শয্যাবিশিষ্ট চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালের চতুর্থ তলায় মেডিকেল কলেজের অস্থায়ী ক্যাম্পাসের কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১৮ সালের ১০ জানুয়ারি চাঁদপুর মেডিকেল কলেজের প্রথম ব্যাচের ওরিয়েন্টেশন অনুষ্ঠিত হয়। এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন মাত্র ক'দিন আগে শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে শপথ নেয়া ডা. দীপু মনি। ২০১৮ সালে ভর্তি হওয়া প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থীরাই এখন চাঁদপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ইন্টার্ন চিকিৎসক হিসেবে যোগদান করলেন।
মেডিকেল কলেজের স্থায়ী ক্যাম্পাসের বিষয়ে কথা হয় কলেজের উপাধ্যক্ষ ডা. মোঃ হারুন-অর-রশীদের সাথে। তিনি জানান, গত সপ্তাহেও ঢাকা গিয়ে এ বিষয়ে মিটিং করে আসলাম। অফিসিয়াল কাজ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। আশা করি এক বছরের মধ্যে আলোর মুখ দেখতে পাবেন। গাছতলা ব্রিজের ওপারেই হবে মেডিকেল কলেজের স্থায়ী ক্যাম্পাস। ডা. হারুন-অর-রশীদ হচ্ছেন সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। তিনি চাঁদপুর মেডিকেল কলেজ শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদকও। তাঁকে কাজের এক ফাঁকে দেখা গেলো সার্জারি বিভাগের নারী ওয়ার্ডে গিয়ে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের সাথে নিয়ে রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিতে। তিনি জানালেন, তাঁর ৩৮জন ইন্টার্ন চিকিৎসক হাসপাতালে শিফটওয়ারী ২৪ ঘণ্টা ডিউটি করছেন। এর দ্বারা রোগীরা নিয়মিত চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন। হাসপাতালের সকল বিভাগেই তারা ডিউটি করছেন।
কথা হয় হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. একেএম মাহাবুবুর রহমানের সাথে। তিনি বেশ উৎফুল্ল। তিনি আনন্দের সাথে জানালেন, আমি ৩৮জন ডাক্তার পেয়েছি। আমার হাসপাতালে এখন আর বলতে গেলে ডাক্তার সংকট নেই। চাঁদপুর মেডিকেল কলেজ থেকে এবার পাস করা ৩৮জন ডাক্তার আমার হাসপাতালে ইন্টার্নি করছে। গত ১৫ সেপ্টেম্বর তারা এখানে যোগদান করেছে। এমনকি তারা প্রথম মাসের সরকারি ভাতাও পেয়েছেন। হাসপাতালের সকল বিভাগে প্রতিদিন তিন শিফটে ৩৮জন ইন্টার্ন ডাক্তার ডিউটি করছেন। সে জন্যে রোগীদের এখন চিকিৎসা সেবা দিতে আমার বেগ পেতে হয় না। নিরবচ্ছিন্ন সেবা পাচ্ছেন রোগীরা। ইন্টার্ন ডাক্তাররা তো পেশায় নতুন। সে জন্যে তারা বেশ উদ্দীপনা নিয়ে কাজ করছেন। এমনকি অনেক সময় দেখা যাচ্ছে যে, আমার ডাক্তারদের চেয়েও তারা বেশ সক্রিয় থাকেন ওয়ার্ডে রোগী নিয়ে। তিনি আরো জানান, কিছুদিন আগে নার্সদের ধর্মঘট গেছে। তখন রোগীদের নার্সিং সেবা দিতে আমার সমস্যা হয় নি। এই ইন্টার্ন ডাক্তাররাই নার্সিং সেবা দিয়েছেন।
কথা হয় এসব ইন্টার্ন চিকিৎসকের কো-অর্ডিনেটরের দায়িত্বে হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডাঃ মীর মোঃ মুনতাকিম হায়দারের সাথে। তিনিও বেশ আনন্দের সাথে জানালেন ইন্টার্ন ডাক্তারদের উদ্দীপনার কথা। তিনি বললেন, এখন হাসপাতালে আসলে বোঝা যায় যে এটা একটা মেডিকেল কলেজ। হাসপাতালের চিত্রটা এখন অনেকটা এমনই। এখন রোগীদেরকে ডাক্তার খুঁজতে হয় না, ডাক্তাররাই রোগীর পেছনে দৌড়ায়। হাসপাতালটি আড়াই শ' বেডের। কিন্তু এখানে প্রতিদিন রোগী ভর্তি থাকে ৫শ' থেকে সাড়ে ৫শ'র মতো। এতো সংখ্যক রোগীকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা দেয়া হাসপাতালের জনবল দিয়ে কোনোভাবেই সম্ভব ছিলো না। হাসপাতালে ডাক্তার সংকট তো সবসময়ই থাকে। যেমন আমার কার্ডিওলজি বিভাগে একজন মেডিকেল অফিসারও ছিলেন না। রোগীদের দেখভাল আমাদেরই করতে হতো। ইন্টার্ন ডাক্তাররা যোগদান করার পর আলহামদুলিল্লাহ এখন আর এই সমস্যা নেই। তাদের থেকে কমপক্ষে দুজন করে ডাক্তার থাকেন। তিনি বলেন, আমরা হাসপাতালের সকল বিভাগে এসব ডাক্তারের ডিউটি রোস্টার করে দিয়েছি। সে অনুযায়ী তারা কাজ করছে। শিফটওয়ারী ২৪ ঘণ্টাই তারা ডিউটি করছে। পেশায় সবেমাত্র তারা আসলেন। তাই তাদের মধ্যে কাজের উদ্দীপনা, উৎসাহটা এখন অন্য রকম।
২০১৮ থেকে ২০২৪-এর আগস্ট। প্রায় সাড়ে ছয় বছর পড়াশোনার পর তাদের কর্মজীবন শুরু হলো। বিষয়টা ভাবতেই তাদের অন্য রকম অনুভূতি। আমি মনে করি, এটা চাঁদপুর জেলাবাসীর জন্যে অনেক বড়ো প্রাপ্তি।
গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডাঃ মীর মোঃ মুনতাকিম হায়দার এবং আরেকজন সিনিয়র কনসালটেন্ট ডাঃ মোঃ নাজমুল হক কার্ডিওলজি বিভাগে রোগী দেখছেন। সাথে রয়েছেন দুজন ইন্টার্ন চিকিৎসক। সিনিয়র ডাক্তারদের দিকনির্দেশনায় তারা রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন।
কথা হয় হাসপাতালে ভর্তি হওয়া বেশ ক'জন রোগীর সাথে। তারা বললেন, এখন আমরা হাসপাতালে সবসময়ই ডাক্তার পাই। নার্সদের থেকে ডাক্তারদেরই তৎপরতা বেশি দেখা যায়। আলহামদুলিল্লাহ আমরা ভালো সেবা পাচ্ছি।
হাসপাতালে দায়িত্বরত কয়েকজন ইন্টার্ন চিকিৎসকের সাথে কথা হয়। তাদের অনুভূতি জানতে চাওয়া হয়। তারা বললেন, অনুভূতিটা কেমন হতে পারে তা তো বুঝতেই পারছেন। রোগীদের কাছে যাচ্ছি, তাদেরকে সেবা দিচ্ছি। এর আনন্দটা অন্য রকম। মহান স্রষ্টার শোকরিয়া আদায় করছি। আমাদের পেশাগত জীবন শুরু বলা হলেও এটাও আমাদের শেখার একটা অংশ। এই এক বছর আমাদের ডাক্তারি পেশার একটা টার্নিং পয়েন্ট। সে জন্যে এ সময়টা আমাদের সর্বোচ্চটুকু দিতে হবে।