মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪  |   ২৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   মিশরে ঈদে মিলাদুন্নবীর ঐতিহ্য ‘আরুসাত-আল-মোলিদ’ : জন্মদিনের পুতুল
  •   'বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের চেতনার রাজনৈতিক শক্তির বিকাশ অপরিহার্য'
  •   চাঁদপুরের ২৪তম পুলিশ সুপার মুহম্মদ আব্দুর রকিব
  •   ফরিদগঞ্জে ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে শোভাযাত্রা
  •   ওয়াইফাই সংযোগ দিতে গিয়ে প্রাণ গেল যুবকের

প্রকাশ : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

বন্যানিয়ন্ত্রণে জরুরি প্রযুক্তিগত উন্নয়ন

ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার
বন্যানিয়ন্ত্রণে জরুরি প্রযুক্তিগত উন্নয়ন

ভারতের ত্রিপুরার গোমতী নদীর ওপর ডুম্বুর ড্যাম ৩১ বছর পর ভারি বর্ষণের কারণে খুলে দেওয়া হয়েছে। এ কারণে বর্তমানে বন্যা হচ্ছে বাংলাদেশে। দায়ী অত্যধিক ভারি বৃষ্টিপাতও। ভারতীয় আবহাওয়া দপ্তর (আইএমডি) দিল্লিতে ভারি বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকার সতর্কতা এবং ত্রিপুরায় রেড অ্যালার্ট জারি করেছিল। এসব তথ্য বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরও নিশ্চয়ই পেয়েছিল এবং রাডারের মাধ্যমে বৃষ্টির বিষয়টিও জেনেছিল।

কিন্তু ড্যামগুলো খুলে দেওয়ার আগে ভারত বাংলাদেশকে আগাম জানালে স্থানীয় জনগণ বন্যার ক্ষয়ক্ষতি থেকে অনেকটা রক্ষা পেত। যাই হোক, বন্যার একমাত্র কারণ কিন্তু এটিই নয়। প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- আমাদের বন্যানিয়ন্ত্রণ করার কারিগরি সক্ষমতার অভাব, প্রাথমিক প্রতিরোধ ও প্রস্তুতিমূলক দুর্বলতা, বন্যা পূর্বাভাসমূলক অত্যাধুনিক ডিজিটাল প্রযুক্তির অভাব এবং বাংলাদেশের অবস্থান গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ এলাকায় হওয়ায় এবং বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে প্রবাহিত বিভিন্ন উপনদীর কারণে দেশে প্রতিবছরই বর্ষাকালে ছোট, মাঝারি এবং ভয়ানক আকারের বন্যা হয়ে থাকে। দেশের সীমান্তবর্তী এলাকা এবং ভেতরে ভারি বৃষ্টিপাতের ফলে অভ্যন্তরীণ নদীগুলোর পানি ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত পানি বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপ করার ক্ষমতাও অত্যন্ত কম। ফলে, পানি উপচে এটি পরিণত হয় বন্যায়। এসব দুর্ভোগ মোকাবিলায় কিছু কাঠামোগত ব্যবস্থা যেমন- বন্যা বাঁধ, চ্যানেলের উন্নতি, নদী প্রশিক্ষণ, উপকূলীয় বাঁধ ইত্যাদি প্রাচীন রীতিগুলো বহুকাল যাবৎ চলে আসছে। কিন্তু ১৯৮৮ সাল এবং এ বছরের বন্যা ইতিহাসের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে ফেলেছে। এ বছরের বন্যার ভয়াবহতা হচ্ছে, পানির অতি উচ্চতা ও তীব্রতা। ফলে কোনোরকম প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগই পায়নি প্লাবিত এলাকার মানুষ।

সীমিত আকারের কিছু ডিজিটাল পদ্ধতি বন্যার পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণে অনেক সহায়তা করছে। ২০২০ সালে থেকে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বাপাউবো) এটুআই এবং গুগল স্যাটেলাইট ভিত্তিক উন্নত ভূ-উচ্চতা তথ্য, মেশিন লার্নিং প্রযুক্তির সহায়তায় পরীক্ষামূলক ভাবে ব্রহ্মপুত্র ও পদ্মা নদীর অববাহিকার ১৪টি জেলায় এই কার্যক্রমের সূচনা হয়। বর্তমানে ৫৫টি জেলায় এ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

এই উন্নততর বন্যার পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ ব্যবস্থায় আগাম পাঁচ দিনের বন্যার পূর্বাভাস উপাত্তকে প্রক্রিয়াকরণ করে উন্নত ভূ-উচ্চতা তথ্য ও মেশিন লার্নিং প্রযুক্তির মাধ্যমে মানচিত্র তৈরি করা হয়। ফলে, বন্যা শুরু হওয়ার তিন দিন থেকে তিন ঘণ্টা আগে পর্যন্ত স্থানীয় জনগোষ্ঠী ইন্টারনেট প্রযুক্তির মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে বিভিন্ন ধরনের পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ বার্তা পাচ্ছে। পূর্বাভাসের এই আগাম সময় আরও বর্ধিতকরণের জন্য গুগলের সঙ্গে কারিগরি কার্যক্রম চলমান রয়েছে। আধুনিক এই প্রযুক্তিটিতে গুগল ‘পুশ নোটিফিকেশন’-এর মাধ্যমে অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোন ব্যবহারকারী এই পূর্বাভাস পাচ্ছে। বর্তমানে এই প্রযুক্তির মাধ্যমে সারাদেশে ১০৯টি স্টেশনে বন্যা মনিটরিং এবং ৫৫টি স্টেশনে পাঁচ দিনের আগাম বন্যার পূর্বাভাস চালু আছে। পূর্বাভাসে পানির স্তরের উত্থান-পতন, বন্যার গভীরতা, তীব্রতাসহ বন্যার অঞ্চল সম্পর্কিত তথ্য প্রদান করছে। গুগল অনুসন্ধানে বন্যা সম্পর্কিত নানাবিধ তথ্য ও পরামর্শ, যেমন- সুরক্ষা সম্পর্কিত পরামর্শ, ফসল তোলার পরামর্শ, বন্যার অ্যাপ্লিকেশন সম্পর্কিত তথ্য, জরুরি সরবরাহের তথ্য ইত্যাদি প্রেরণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি, গুগল ম্যাপ এবং আর্থ-এর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট স্থানের বন্যা সতর্কতার ভিত্তিতে প্লাবনের ছবি নিয়মিত হালনাগাদ করা হচ্ছে।

কিন্তু ভারত যখন ইচ্ছামতো তাদের সীমান্তবর্তী বাঁধগুলো খুলে দেয়, তখন অ্যাপসভিত্তিক পূর্বাভাস দিয়ে বাংলাদেশের বন্যানিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। তাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় কিভাবে বন্যা, জলোচ্ছ্বাস ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগকে পরাভূত করেছে, তাদের সহযোগিতা খুবই দরকার। বন্যানিয়ন্ত্রণে নেদারল্যান্ডসের বাঁধের ইতিহাস বিশ্বে পরিচিত। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম কৃষিপণ্য উৎপাদন এবং রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে পরিচিত। দেশটি খুবই ঘনবসতিপূর্ণ এবং অর্ধেকের বেশি মানুষ কৃষিকাজে জড়িত। কিন্তু দেশটির অধিকাংশ কৃষি জমি সমুদ্রপৃষ্ঠের অনেক নিচে। অথচ পানি ব্যবস্থাপনা, বন্যা মোকাবিলা এবং সমুদ্র জলোচ্ছ্বাস নিয়ন্ত্রণে দেশটি বিশ্বে শীর্ষে। প্রাকৃতিক বালির টিলা এবং ডাইক, বাঁধ এবং ফ্লাডগেট সমুদ্র থেকে, ঝড়ের ঢেউ থেকে রক্ষা করে। ডাইকগুলো প্রধান নদী রাইন এবং মিউসের দ্বারা দেশে প্রবাহিত পানি থেকে বন্যা প্রতিরোধ করে এবং নিষ্কাশন, খনন এবং পাম্পিং স্টেশনগুলোর নিচু অংশগুলোকে বাসস্থান এবং কৃষির জন্য শুকনো রাখে।

ডাইক, বাঁধ, ফ্লাডব্যাংক বা স্টপ ব্যাংক হলো একটি কাঠামো, যা নদীর গতিপথ পরিবর্তন থেকে রক্ষা করতে এবং নদী বা উপকূল সংলগ্ন এলাকার বন্যা থেকে রক্ষা করতে ব্যবহৃত হয়। এটি সাধারণত মাটির হয় এবং প্রায়ই এটির প্লাবনভূমিতে বা নিচু উপকূলরেখা বরাবর নদীর গতিপথের সমান্তরালে চলে। আধুনিক সময়ে বন্যা বিপর্যয় এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে সমুদ্রের প্রভাব কমাতে এবং ভবিষ্যতের বন্যা প্রতিরোধে বড় ধরনের নির্মাণকাজ অব্যাহত আছে। এগুলো ভৌগোলিক, সামরিক এবং পরিবেশগতভাবে খুবই টেকসই, যা ক্ষতিগ্রস্ত শহরগুলোতে বসবাসকারী মানুষের জীবনকে ব্যাপকভাবে উপকৃত করে আসছে।

সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সরকার সুন্দরবনের নদীভাঙন ও বন্যা সমস্যা নিরসনে নেদারল্যান্ডস সরকারের সহযোগিতায় পাঁচ বছর মেয়াদি একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এতে সুন্দরবনের ৫৪টি দ্বীপের মধ্যে ৩৩টি দ্বীপকে বিপজ্জনক হিসাবে চিহ্নিত করে প্রত্যেকটি দ্বীপের জন্য বাঁধ রক্ষা ও বন্যা নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে পৃথক মাইক্রো প্ল্যান তৈরি করেছে। এ ছাড়া নদী, খালের সংস্কার, পানির লবণ নিয়ন্ত্রণ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, মৎস্য চাষ ও কৃষির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা দূর করা এবং বায়োডাইভারসিটি রক্ষায় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ক্ষয়ক্ষতি পুনরুদ্ধারে নতুন প্রযুক্তির সরবরাহ করবে নেদারল্যান্ডস সরকার।

উপকূলবর্তী দুই জেলা দক্ষিণ ২৪ পরগনা ও পূর্ব মেদিনীপুরকে ঘূর্ণিঝড় ও নদীভাঙনের সমস্যা দূরীকরণেও অনুরূপ উদ্যোগ নিয়েছে । ইতোমধ্যেই পাইলট প্রকল্পের আওতায় মৌসুনি দ্বীপের কাছে পাটিবুনিয়া এবং পাথরপ্রতিমার কাছে গোপীবল্লভপুরে ডাচ প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাঁধ তৈরি করা হয়েছে। পরবর্তী ধাপে অন্যান্য এলাকাতে এই প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণের কাজ এগিয়ে নিতে সম্প্রতি দিল্লিতে এক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ পর্যায়ে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে এবং পানি সংরক্ষণের জন্য মুম্বাই, চেন্নাই এবং ব্যাঙ্গালুরুসহ সাতটি শহরে হ্রদের মতো জলাশয় সম্প্রসারণ এবং ড্রেন নির্মাণের মেগা প্রকল্পের আওতায় আগামী দুই বছরে আড়াই হাজার কোটি রুপি (প্রায় ৩০ কোটি ডলার) বরাদ্দ দিয়েছে।

ভারত তার সুবিধামতো বাঁধ খুলে এবং বন্ধ করে- এ ধরনের বিতর্ক আছে বহু বছর ধরে। তাদের ভাষ্যমতে, উজান থেকে আসা অতিরিক্ত পানির চাপে সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো প্লাবিত হয় এবং একপর্যায়ে পানির চাপ ধরে রাখতে না পারায় বাঁধ খুলে দেওয়া হয়।

ফলে, বাংলাদেশে তীব্র গতিতে পানি ঢুকে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি এবং ফসল, ঘরবাড়ি ও জানমালের ব্যাপক ক্ষতি করে। অর্থাৎ সমস্যাটা প্রাকৃতিকভাবেই ঘটে, রাজনৈতিক নয়। এমতাবস্থায় দুই দেশের মধ্যে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান দরকার। নেদারল্যান্ডসের আদলে পরিবেশবান্ধব স্থায়ী বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ কিভাবে আমাদের এই অঞ্চলে স্থাপন করা যায়, তা নিয়ে ভাবতে হবে এখনই। এই বাঁধ নির্মাণের ফলে দুই দেশই যেন উপকৃত হয় কিংবা কোনো দেশই যাতে কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা শান্তিতে নোবেলবিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের গ্রহণযোগ্যতা বিশ্বব্যাপী। সারাবিশ্ব তিনি চষে বেড়িয়েছেন বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর কল্যাণের জন্য। আন্তর্জাতিক সভা, সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামে তাঁর কথা শোনার জন্য মানুষ হা করে বসে থাকে। একজন নোবেলবিজয়ী হিসেবে ভারতেও প্রফেসর ইউনূস অত্যন্ত মর্যাদাবান ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত।

ভারতবাসী তাঁকে বেশ সম্মান করে এবং শ্রদ্ধার চোখে দেখে। অধিকন্তু ভারত আমাদের বন্ধুপ্রতিম দেশ। স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের অবদান দেশবাসী কখনোই ভুলবে না। তাই ড. ইউনূসের অনুরোধে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ভারত সরকারও বাংলাদেশের এই দুর্দশা লাঘবে আন্তরিক হবে- এটাই এই অঞ্চলের মানুষের প্রত্যাশা।

লেখক : অধ্যাপক এবং তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়