বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১, ১৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬  |   ২৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   চাঁদপুর শহরের পাঁচ রাস্তার মোড়ে 'আল্লাহু চত্বর'
  •   চাঁদপুর কণ্ঠৈর কলামিস্ট এএসএম শফিকুর রহমানের ইন্তেকাল
  •   নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পেল সেনাবাহিনী
  •   জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনে’ প্রধান উপদেষ্টার ১০০ কোটি টাকার অনুদান
  •   মেঘনায় নিখোঁজ দুই ভাইয়ের মরদেহ উদ্ধার

প্রকাশ : ২১ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০

ক্ষুদ্রঋণ ও সামাজিক ব্যবসার মূল্যায়ন

ড. এম. মেসবাহউদ্দিন সরকার
ক্ষুদ্রঋণ ও সামাজিক ব্যবসার মূল্যায়ন

গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা এবং ক্ষুদ্রঋণ পরিচালনা করে দারিদ্র্য নিরসনে ব্যাপক অবদান রাখায় শান্তিতে নোবেলবিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্বব্যাপী পরিচিত হলেও তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন আরও অনেক অলাভজনক সামাজিক প্রতিষ্ঠান। এগুলো হলো- ১. গ্রামীণ টেলিকম, ২. গ্রামীণ কল্যাণ, ৩. গ্রামীণ ফান্ড, ৪. গ্রামীণ সামগ্রী ও উদ্যোগ, ৫. গ্রামীণ শক্তি, ৬. গ্রামীণ মৎস্য ফাউন্ডেশন, ৭. থ্রি-জিরো-ক্লাব ইত্যাদি।

এসব অলাভজনক প্রতিষ্ঠান দারিদ্র্য বিমোচনে দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে। ১. গ্রামীণ টেলিকম- ১৯৯৬ সালের ১৬ অক্টোবর একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এটি যাত্রা শুরু করে। দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় দরিদ্র মানুষের কাছে টেলিযোগাযোগ সেবা পৌঁছে দিয়ে তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ শুরু করে এটি। মূলত নব্বই দশকের শেষের দিকে এর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে ওঠে এবং দেশের বিভিন্ন এলাকার হাট-বাজারে কথা বলার জন্য ছোট ছোট দোকান গড়ে উঠতে থাকে।

সেগুলো ‘পল্লী ফোন’ হিসেবেই বেশি পরিচিত ছিল। নরওয়ে টেলিকমের সঙ্গে ৩৪.২০ শতাংশ মালিকানায় বর্তমানে এর তহবিলে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা রয়েছে, যা দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য সেবামূলক কাজে ব্যবহৃত হয়। অক্টোবর/২২ পর্যন্ত ৩ লাখ ৩৩ হাজার ৬৬৭ জনকে ৬৫ কোটি ৩৯ লাখ টাকা শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হয়েছে এবং ৫৪ হাজার ৮০৫ জন ছাত্র/ছাত্রীকে ৩৯৮.৫১ কোটি টাকা উচ্চশিক্ষা ঋণ দেওয়া হয়েছে। ২. গ্রামীণ কল্যাণ- একটি অলাভজনক সামাজিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯৬ সালে।

প্রতিষ্ঠানটি মূলত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের মাধ্যমে দারিদ্র্য নিরসনের লক্ষ্যে কাজ করছে। বর্তমানে সারাদেশে প্রতিষ্ঠানটির ১৪৪টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে, যেগুলো দিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার গ্রামে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। এক্ষেত্রে দুই থেকে তিনশ’ টাকার একটি স্বাস্থ্যকার্ড নিয়ে একটি পরিবার সারাবছর সেবা নিতে পারে।

৩. গ্রামীণ ফান্ড- গ্রামীণ ব্যাংকের যেসব সদস্য মাঝারি বা বড় আকারের ঋণ নিয়ে অভিনব এবং প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবসা করতে চান, তাদের সহায়তা করার জন্যই গ্রামীণ ফান্ড প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৯৯৪ সালে। শুরুতে দাতাদের অর্থেই এই ফান্ড গঠিত হয়। পরবর্তীতে এই ফান্ডের তহবিল দাঁড়ায় প্রায় ৪৯ কোটি টাকা। তবে ২০১০ সাল পর্যন্ত এই ফান্ডের ঋণ কার্যক্রম নিয়মিত ছিল বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। এরপর নানা কারণে ধীরে ধীরে ঋণ কার্যক্রমের পরিধি কমিয়ে আনা হয়। ৪. গ্রামীণ সামগ্রী ও উদ্যোগ- গ্রামীণ সামগ্রী প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯৬ সালের ১৫ জানুয়ারি।

দেশের তাঁত শিল্পকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে দেশের দুই শতাধিক তাঁতি এক ছাতার তলায় নিয়ে আসে গ্রামীণ সামগ্রী। এটি করার মাধ্যমে একদিকে যেমন বাংলাদেশের তাঁতবস্ত্র বিশ্ববাজারে ঢুকতে পেরেছে, তেমনি দরিদ্র তাঁতিরাও আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছে। দেশে-বিদেশে এসব কাপড় ‘গ্রামীণ চেক’ নামে পরিচিতি লাভ করে। এ পর্যন্ত ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৫ মিলিয়ন ইয়ার্ডের বেশি গ্রামীণ চেকের কাপড় রপ্তানি করা হয়েছে। গ্রামীণ সামগ্রীর লাভের টাকায় সংশ্লিষ্ট তাঁতি পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হয়। পাশাপাশি ওইসব পরিবারের ছেলেমেয়েদের জন্য শিক্ষা বৃত্তি প্রদান করা হয়। তবে পরবর্তীতে গ্রামীণ সামগ্রীর কার্যক্রম বাড়তে থাকায় ধীরে ধীরে গ্রামীণ উদ্যোগ বন্ধ হয়ে যায়।

৫. গ্রামীণ শক্তি- ১৯৯৬ সালে গ্রামীণ শক্তির যাত্রা শুরু হয়। স্বল্প সুদের কিস্তিতে সারাদেশে প্রায় ১০ লাখ সোলার প্যানেল বসানো হয়। গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে বাংলাদেশের ৪০ শতাংশের বেশি মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ ছিল না। এমন পরিস্থিতিতে প্রত্যন্ত এলাকায় সোলার প্যানেল বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়।

৬. গ্রামীণ মৎস্য ফাউন্ডেশন- ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এই ফাউন্ডেশনের প্রধান লক্ষ্য ছিল মাছ চাষের মাধ্যমে অভাবী মানুষকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করে তোলা।

এ লক্ষ্যে বড় বড় পুকুর ও দীঘির ইজারা নিয়ে স্থানীয় দরিদ্র মানুষের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে মাছ চাষ করা হয়। এক্ষেত্রে মাছ চাষের পুরো খরচ বহন করে গ্রামীণ শক্তি ফাউন্ডেশন। মাছ বড় হলে সেটি দুই ভাগ করে একভাগ চাষিদের দেওয়া হয়। এরপর হঠাৎ ফাউন্ডেশনের কাছে জলাভূমি ইজারা দেওয়া বন্ধ করে দেয় সরকার। মূলত সে কারণেই এখন গ্রামীণ মৎস্য ফাউন্ডেশনের কার্যক্রমে স্থবিরতা নেমে এসেছে।

৭. থ্রি-জিরো-ক্লাব- এটি ১২ থেকে ৩৫ বছর বয়সের মধ্যে সমমনা, সমবয়সী পাঁচজনের একটি স্বগঠিত ক্লাব, যেখানে সদস্যরা তাদের সৃষ্টিশীলতা ব্যবহার করে এ সময়ের বিভিন্ন সামাজিক ও পরিবেশগত সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে একটি ‘তিন শূন্য’র পৃথিবী গড়তে সচেষ্ট। বর্তমানে কমপক্ষে ৩৫০০ থ্রি-জিরো ক্লাব আছে ৫৪টি দেশে। এর সঙ্গে যুক্ত আছে প্রায় ১৬ হাজার তরুণ ও যুবক। শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব এবং শূন্য কার্বন নির্গমনের সমন্বয়ে একটি ‘তিন শূন্য’র পৃথিবী গড়ে তোলাই তাদের মূল লক্ষ্য।

বিশ্বের অন্যান্য দেশেও কিভাবে এই থ্রি-জিরো-ক্লাবগুলোর একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা যায়, কিভাবে কম বয়সী ছেলেমেয়েদের এই ক্লাবের লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে পরিচিত করা যায় এবং তাদের সৃষ্টিশীলতাকে কিভাবে ক্লাবের লক্ষ্য অর্জনে চালিত করা যায়, তা নিয়ে প্রতিনিয়তই চলছে আলোচনা, সভা ও সেমিনার। গত ২৯ জুন ২০২৪, ম্যানিলার এশিয়া প্যাসিফিক কলেজে ইউনূস সেন্টার এবং থ্রি জিরো গ্লোবাল সেন্টারের আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় এক একাডেমিয়া কনভেনশন।

যেখানে ৫৬টি দেশের ৪ হাজারের বেশি ক্লাবের অন্তর্ভুক্তিতে থ্রি-জিরো-ক্লাবের কার্যক্রম নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা হয়। এর আগেও ২০২১ সালের জুলাই মাসে ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে ১১তম সামাজিক ব্যবসা দিবস অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে পৃথিবীর ১১০টি দেশের ২,০৩০ জন ব্যক্তি এই অনুষ্ঠানে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। এছাড়াও বিভিন্ন অঙ্গন ও শিল্প থেকে আসা ১৬২ জন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব এবং পৃথিবীর ৩৪টি দেশের ৯২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক বিশেষজ্ঞগণ সামাজিক ব্যবসা অ্যাকাডেমিক কারিকুলাম ও কোর্স পরিকল্পনা এবং সামাজিক ব্যবসা গবেষণা নিয়ে আলোচনা করেন।

গত কয়েক দশকে ড. ইউনূস অলাভজনক ৫০টির বেশি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। আফ্রিকার অনেক দেশ এবং আলবেনিয়া, নেপাল, ভিয়েতনাম, চীন, জার্মানি, জাপান, স্পেন, হাইতি, যুক্তরাষ্ট্র, উগান্ডাসহ অনেক দেশে তাঁর এই সামাজিক ব্যবসার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। স্বীকৃতিস্বরূপ বিশ্বের ২৪টি দেশের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ৬০টির মতো সম্মানসূচক ডিগ্রি পেয়েছেন।

দারিদ্র্যদূরীকরণে তাঁর ক্ষুদ্রঋণ ও সামাজিক ব্যবসার মডেল বিশ্বের ৪০টির বেশি দেশে ১৩০টির বেশি প্রতিষ্ঠান ধারণ করে চলেছে। বিভিন্ন দেশে ৮০টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে তাঁর নামে ‘ইউনূস সোস্যাল বিজনেস সেন্টার’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেখানে তাঁর চিন্তা, কাজ, ভবিষ্যৎ লক্ষ্য ও তাঁর জীবনাদর্শ নিয়ে গবেষণা হয়। কানাডা ও জাপানের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে তাঁর জীবনী অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ড. ইউনূসের এই সামাজিক ব্যবসার সাফল্য ও প্রক্রিয়া জানার জন্য উচ্চসম্মানীতে তাঁর কথা শোনার অপেক্ষায় থাকেন।

তিনি হচ্ছেন পৃথিবীর ওয়ান অব দ্য হায়েস্ট পেইড স্পিকার। তাঁর বক্তব্য শোনার জন্য খরচ করতে হয় ৭৫ হাজার থেকে ১ লাখ ডলারের মতো। কখনো আরও বেশি। তাঁকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনার জন্যও ডাকা হয়। ২০২৪ সালের ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত প্যারিস অলিম্পিকের আয়োজক কমিটির ৩ জনের একজন হচ্ছেন ড. ইউনূস। ২০২৬ সালে ইতালি অলিম্পিকের জন্য ইতালিয়ানরা তাঁকে পাওয়ার জন্য এখন থেকেই তদবির করছে।

লেখক : অধ্যাপক এবং তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়