প্রকাশ : ২৫ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
চলো হারাই হাওরে
সন্ধ্যায় নৌকা ভেড়ে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের টেকেরঘাট। এর আগে সকালে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ থেকে নৌকায় উঠি। এরপর সারা দিন হাওরের পানি ভেঙে আসি এ ঘাটে। রাত যখন বাড়ল তখন দেখি ভরা পূর্ণিমা। আর সে পূর্ণিমায় নৌকার ছইয়ের ওপর চলে আড্ডা। আর সারা দিনের হাওরের ফিরিস্তিও অপূর্ব।
শুরুটা করি মোহনগঞ্জ বাজার থেকে। এখানকার শাহজালাল হোটেলে নাশতা সেরে উঠি নৌকায়। বাজারের ঘাটেই নৌকা ছিল। ইঞ্জিনচালিত ছইওয়ালা নৌকা। হাওরের মানুষ বর্ষা মৌসুমে এ নৌকায় যাতায়াত করেন। নৌকাগুলো কিছুটা লম্বাটে। হাওরের নৌকা নামেই বেশি পরিচিত।
কংশ নদী হয়ে নৌকা চলতে শুরু করে। ভ্রমণসঙ্গী ৩৮ জন। নৌকা চলার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টিও শুরু হয়। বৃষ্টির মধ্যে কেউ কেউ ছইয়ের ওপর ছাতা মাথায় বসি। বাকিরা ছইয়ের তলে। খুব বেশি চওড়া নয় কংশ নদী। নদীর দুই পাশে কোথায়ও বাড়ি, কোথায়ও মাঠ। আছে গাছগাছালি। টানা জালে মাছ ধরাও দেখি। এসব দেখি আর টিপটিপ বৃষ্টির ছন্দে চলছি। কিছুদূর আসার পর দেখি নদীর পাড়ে রঙিন কাগজে সাজানো একটি নৌকা। আমাদের মাঝি জানালেন এটা বরযাত্রীর নৌকা। হাওরে বর্ষা মৌসুমে বিয়ে হলে নৌকায় বরযাত্রী আসেন।
ঘণ্টা দু-এক চলার পর নৌকা ভেড়ে বাদশাগঞ্জ বাজারে। বাজারের পাশের মাঠে আমাদের কেউ কেউ ফুটবল খেলেন। এ বল তারা সঙ্গে করেই এনেছেন। আরেক দল পানিতে ভাসিয়েছে প্লাস্টিকের নৌকা। এ নৌকা ভাঁজ করে রাখা যায়। এটাও তারা সঙ্গে করে এনেছেন। কিছুক্ষণ এখানে তাদের খেলাধুলার পর নৌকা আবার চলতে শুরু করে। নদী ছেড়ে নৌকা এবার প্রবেশ করে মূল হাওরে।
বৃষ্টি আর বাতাস হওয়ায় হাওরে বেশ ঢেউ আছে। সেই ঢেউয়ের তালেই নৌকা চলছে। বিশাল হাওরের কোথাও কোথাও বাড়িঘর আছে। আর বহুদূরে দেখি ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়। এসব দেখি আর পানি কেটে চলি।
নৌকা চলছে। সেই চলার মধেই হাতে এসে পৌঁছে গরম ভাতের প্লেট, সঙ্গে হাওরের মাছ ভাজা, সবজি আর ডাল। আহা কী স্বাদ! বাড়ির খাবারের সঙ্গে সত্যি এর তুলনা হয় না। খাবার শেষ করতেই নৌকা ভেড়ে তাহিরপুরের জয়পুর গ্রামে। হাওর পাড়ের এ গ্রাম দেখে সত্যি বিস্মিত। ছোট ছোট কাঁচা ঘরগুলো একটার সঙ্গে আরেকটা যেন লাগানো। এখানে কেউ অসুস্থ হলে তাকে নৌকায় নিয়ে যেতে হয় তাহিরপুর উপজেলা সদরে। এ গ্রামে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ও আছে।
কিছুক্ষণ জয়পুর থেকে নৌকা আবার চলতে শুরু করে। এবার নৌকা চলে টাঙ্গুয়ার হাওর হয়ে। শীত মৌসুমে এ হাওরজুড়ে থাকে নানা প্রজাতির পরিযায়ী পাখির বসবাস। আর এখন কেবলই পানি।
বিকেল হয়ে এসেছে। নৌকার ছইয়ের ওপর সবাই বসেছি। শীতল একটা বাতাস বইছে, যেন একেবারে বুকের ভেতর গিয়ে ঠেকছে তার পরশ। এর মধ্যে সবার সামনে হাজির ঝালমুড়ির বোল। শীতল পরশে একটু ঝালের আবির্ভাব আরকি। ঠিক সন্ধ্যার দিকে নৌকা ভেড়ে টেকেরঘাট। অনেকেই ঘাটে নামেন।
রাত যাপনের জন্য কারও ঠিকানা হয়েছে তাহিরপুরের গেস্ট হাউসে। বাকিরা নৌকাতেই। রাতে খাবার খেয়ে গেস্ট হাউসের যারা তারা চলে গেছেন। আর নৌকার যারা তাদের কেউ কেউ ঘুমিয়ে পড়েছেন। কেবল আমরা কয়েকজন ছইয়ের ওপর বসে আড্ডায় মাতি। এমন আড্ডা ভরা পূর্ণিমায় আরও পূর্ণতা পায়। আর এ পূর্ণতা জীবনের অনেক অপূর্ণতাকেও ভুলিয়ে দেয়।
খুব সকালে ঘাটে নেমে আশপাশটা ঘুরে দেখি। টেকেরঘাটে বিসিআইসির চুনা পাথর খনি প্রকল্প আছে। অবশ্য এখন এর কার্যক্রম নেই। অনেকটা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি হিসেবে এখানে একটি ভাস্কর্যও আছে। দিনের অনেকটা সময় এখানে থেকে আবার ফিরতে শুরু করি।